<p>মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে সর্বনিম্ন বয়স ১৩ বছর ও সাড়ে ১২ বছর নির্ধারণ করে সরকারের জারি করা বিভিন্ন সময়ের গেজেট ও পরিপত্র অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার সর্বনিম্ন বয়স নির্ধারণ সংক্রান্ত ২০১৮ সালের ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন’-এর ২(১১) ধারার অংশবিশেষ অসাংবিধানিক আখ্যায়িত করে বাতিল করা হয়েছে।</p> <p>বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের বেঞ্চ গতকাল রবিবার এ রায় দেন। ওই সব গেজেট ও পরিপত্রের মাধ্যমে যেসব মুক্তিযোদ্ধার ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করা হয়েছে, তাঁদের সব সুবিধা এই রায়ের কপি পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে চালু করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সব বকেয়া পরিশোধ করতেও বলা হয়েছে।</p> <p>বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের পরিচালক মাহমুদ হাসানসহ দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার করা পৃথক ১৫টি রিট আবেদনে জারি করা রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে গতকাল এ রায় দেন আদালত। রিট আবেদনকারীপক্ষে আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার ওমর সাদাত, ব্যারিস্টার এ বি এম আলতাফ হোসেন ও ড. ইউনুছ আলী আকন্দ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর রহমান।</p> <p>রায়ে মুক্তিযোদ্ধার সর্বনিম্ন বয়স ১৩ বছর নির্ধারণ করে ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর জারি করা গেজেট এবং সাড়ে ১২ বছর নির্ধারণ করে ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি জারি করা গেজেট অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে ২০১৫ সালের ২ নভেম্বর জারি করা সার্কুলার অবৈধ ঘোষণা করা হয়।</p> <p>আদালত রায়ে বলেছেন, ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশের (পিও-৯৪) ২(এইচ)(এ) দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটাই সঠিক। এটা শুধু জাতীয় সংসদই পরিবর্তন করতে পারে। সরকারি কোনো গেজেট, পরিপত্র বা সার্কুলার দিয়ে এই সংজ্ঞা পরিবর্তন করা যাবে না। সুতরাং এসব গেজেট ও পরিপত্র অসাংবিধানিক ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত।</p> <p>আদালত বলেছেন, বয়সের ফ্রেম দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দেওয়া যাবে না। ঐতিহাসিক দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতেই মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেখানে ১০ বছরের শহিদুল ইসলাম লালুকে বীরপ্রতীক খেতাব দিয়েছেন, সেখানে কিভাবে সরকার রিট আবেদনকারীদের অমুক্তিযোদ্ধা বলে, তা বোধগম্য নয়।</p> <p>আদালত বলেন, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন ২০০২ অনুযায়ী জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলকে (জামুকা) শুধু কার সনদ জাল, তা চিহ্নিত করে সঠিক মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়নে সরকারের কাছে সুপারিশ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা মুক্তিযোদ্ধার সর্বনিম্ন বয়স নির্ধারণে সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে, যা ক্ষমতাবহির্ভূত ও অবৈধ।</p> <p>রায়ে বলা হয়, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন ২০১৮-এর ২(১১) ধারায় মুক্তিযোদ্ধার ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করার ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণে যার যা আছে তা নিয়েই দেশের সব নাগরিককে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। এরপর ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ভোরে বঙ্গবন্ধু টেলিগ্রামের মাধ্যমে যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, সেখানেও যার যা কিছু আছে তা নিয়েই হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেছেন। ওই ভাষণ (৭ই মার্চের) ও স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের জারি করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে; যা আমাদের সংবিধানের পঞ্চম তফসিলে সন্নিবেশিত হয়েছে; যা সংবিধানের ১৫২ নম্বর অনুচ্ছেদ দ্বারা সংরক্ষিত। সুতরাং এমন কোনো আইন করা যাবে না, যা সংবিধান পরিপন্থী হয়।</p> <p>রায়ে বলা হয়, যেহেতু বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, স্বাধীনতার ঘোষণা ও ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্তিযোদ্ধার বয়সের সীমারেখা দেওয়া হয়নি; বরং সব বয়সের, সব ধর্মের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলা হয়েছে। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর সংবিধান সংশোধন না করে মুক্তিযোদ্ধার ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করতে পারে না সরকার বা অন্য কেউ। সুতরাং ২০১৮ সালের ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন ২০১৮’-এর ২(১১) ধারায় বর্ণিত ‘উক্ত সময়ে যাহাদের বয়স সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বয়সসীমার মধ্যে’—এই অংশটুকু সংবিধান পরিপন্থী, যা শুরু থেকেই বাতিল বলে গণ্য হবে। এই বয়স নির্ধারণ করে যাঁর সম্মানী বন্ধ করা হয়েছে, তা অবৈধ।</p> <p>আদালত রায়ে বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও সাত-আট বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা ছিল। বাংলাদেশে তো শিশু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বইও আছে। ৪৫ বছর ধরে তাঁরা (রিটকারীরা) সব সুবিধা পেয়ে আসছেন। হঠাৎ করে তাঁরা জানলেন, তাঁরা আর মুক্তিযোদ্ধা নন। আদালত বলেন, যে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ভিত্তি করে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের যদি অস্বীকার করি, তাহলে আমরা আর সামনে এগোতে পারবো না। মনে রাখতে হবে যে মূলত আবেগের তাড়না থেকেই মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে। দেশের প্রতি ভালোবাসার কারণে করেছে। আর এই ভালোবাসা বয়স দিয়ে কখনো বাঁধা যায় না।</p> <p>বীরপ্রতীক শহিদুল ইসলাম লালুর উদাহরণ তুলে ধরে এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে লালুর ছবি দেখিয়ে ব্যারিস্টার ওমর সাদাত তাঁর শুনানিতে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল ১০ বছর। বঙ্গবন্ধু তাঁকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন এবং বীরপ্রতীক খেতাব দিয়েছিলেন। অথচ সরকারের এসব গেজেট ও পরিপত্রের কারণে বীরপ্রতীক তো ননই, তিনি আজ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও বিবেচিত হবেন না।</p> <p>কাঁদলেন বিচারপতি</p> <p>রায়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ভোরে টেলিগ্রামের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করার সময় বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি কেঁদে ফেলেন। তিনি চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘আমি আবেগপ্রবণ হয়ে যাচ্ছি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ভোরবেলার দেওয়া স্বাধীনতার ঘোষণাটি পড়লে যে কেউই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়বে।’ এ সময় রিটকারীপক্ষের আইনজীবীরা দাঁড়িয়ে যান।</p> <p> </p>