<p>বাপুরাম সাপুড়েরা আগে সাপ খেলা দেখিয়ে বেড়াত। তা নিয়েই কত কিংবদন্তি, কত গল্পগাথা, কত সিনেমা, মিথ, অলৌকিক গল্প ফাঁদা হয়েছে। গয়া বাইদা, বেদের মেয়ে জোছনা- এরা এখন আর বিন বাজিয়ে গ্রামগঞ্জে সাপ খেলা দেখায় না। কিন্তু দুই দশক আগেও পেশাটা ছিল। সাপ খেলা দেখিয়ে, বিনের তালে গান গেয়ে, ঝাড়ফুঁক করে সাপের বিষ কাটানোর নাম করে দু-পয়সা রোজগার করে নিত। ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়ার মতো সাপুড়ে বা বেদেদেরও ছিল নিজস্ব সুরের গান, যে গানের সঙ্গে মিশে আছে বিন নামের বাঁশিটির তাল ও লয়। বেদে বা সাপুড়ে পেশাটা একেবারে হারিয়ে না গেলেও বিলুপ্তির প্রায় দ্বারপ্রান্তে। সাপ খেলা দেখানোর পাশাপাশি এরা অন্য কাজও করত, সে কথা পাওয়া যায় জসীমউদ্‌দীনের গয়া বাইদার ওই বিখ্যাত গানটিতে—<br /> মোরা পঙ্খি মারি পঙ্খি ধরি/ মোরা পঙ্খিবেইচা খাই/ মোদের সুখের সীমা নাই,/সাপের মাথার মণি লয়ে মোরা/করি যে কারবার…’<br /> সাপুড়ে বা বেদেদের ঘরবাড়ি নেই, এরা যাযাবর শ্রেণির। তাদের জীবন কাটে নৌকায়। গয়া বাইদা আর চম্পাবতী গানে গানে সে কথাই বলেছিল বাবুকে, ‘মোরা এক ঘাটেতে রান্ধি-বাড়ি/ মোরা আরেক ঘাটে খাই/মোদের ঘর-বাড়ি নাই…’</p> <p>সাপুড়েরা নিজেদের সাপের ওঝা দাবি করত। সাপে কাটা রোগীদের বাঁচিয়ে তুলত তারা তন্ত্রমন্ত্র, মাদুলি আর গাছের শিকড়-বাকড়ের সাহায্যে। তাদের ওপর ছিল মানুষের অগাধ বিশ্বাস। মানুষ ভাবত, আসলেই বুঝি এদের অলৌকিক ক্ষমতা আছে। শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত উপন্যাস ‘শ্রীকান্ত’তেও দেখা যায়, শ্রীকান্তের বন্ধু ইন্দ্রজিৎ সেই অলৌকিক ক্ষমতা শেখার জন্য দিনের পর দিন একটা বেদে পরিবারকে আর্থিক সাহায্য করছে। বিখ্যাত শিকারি জিম করবেটের লেখা মাই ইন্ডিয়া বইয়ে রোগ সারানোর ক্ষমতাটির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তিনি জানিয়েছেন, ভারতবর্ষে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষকে সাপে কাটে, এদের বেশির ভাগই বেঁচে যায় ওঝা বা সাপুড়েদের ঝাড়ফুঁকে। আসলে এসব সাপে কাটা রোগীর বেশির ভাগই নির্বিষ সাপের দ্বারা আক্রান্ত হয়। সময়মতো ওঝার কাছে নিতে না পারলে বেশির ভাগ রোগীই মারা যায় ভয়ে হার্টফেল করে। যারা পৌঁছতে পারে ওঝার কাছে, তারা ধীরে ধীরে সাহস ফিরে পায়। ভয় কাটিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে। সেটাকেই তখন ওঝার কেরামতি মনে করে সাধারণ মানুষ। ওঝার কাছে নেয়ার পর যেসব রোগী মারা যায়, তারাই আসলে সত্যিকারের বিষাক্ত সাপেকাটা রোগী। এদের বাাঁচানো এই সাপুড়েদের কর্ম নয়।</p> <p>এরা যে সাপের খেলা দেখাত, সেখানেও ছিল চালাকি। বিনের তালে তালে সাপ নাচার ব্যাপারটা ধাপ্পাবাজি। সাপ কানে ভালো শোনে না, তাই বিনের তালে তালে নাচার কোনো কারণ নেই। বরং সাপুড়ে বিনের তালে তালে গান গায়, আর সাপের সামনে নিজের হাতটা ঘোরায় নানা ভঙ্গিতে। সাপ চোখের সামনে হাতের এই নড়নচড়ন দেখে বিভ্রান্ত হয়, হাতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেও নড়তে শুরু করে কী ঘটছে বোঝার জন্য। সাপুড়েরা যেসব সাপ নিয়ে খেলা দেখায়, এদের বিষদাঁত ভাঙা থাকে। তাই এদের দ্বারা সাপুড়ে বা মানুষের ক্ষতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা ছিল না। </p> <p>দিন বদলেছে, এখন বিষাক্ত সাপ আর নির্বিষ সাপের পার্থক্য মানুষ বোঝে। সাপে কাটা রোগীদের এখন হাসপাতালেই চিকিৎসা দেয়া হয়। সময়মতো চিকিৎসা দিলে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। তা ছাড়া ঝোপঝাড় উজাড় হওয়ার কারণে প্রকৃতি থেকে বিষাক্ত সাপও কমে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে। তাই সাপুড়ের দলও বদলাতে শুরু করেছে পেশা।</p>