<p style="text-align: justify;">১৫ শতাংশ আয়কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রেখেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ ক্ষেত্রে যিনি নির্ধারিত কর প্রদান করে কালো টাকা সাদা করবেন, তিনি এনবিআর থেকে ‘রিলিজ’ পাবেন বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, দুদক এই কালো টাকার বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে কিনা?</p> <p style="text-align: justify;">আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেছেন, ‘১৫ শতাংশ আয়কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার বিধান এনবিআরের দেওয়া একটা সুযোগ। এই সুযোগ যদি কেউ নেয় তাহলে এনবিআরের কাছ থেকে রিলিজ পাবে। কিন্তু এটা যদি মানিলন্ডারিং কিংবা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ হয়ে থাকে, সেটা অবশ্যই দুদক দেখতে পারবে। দুদক তো তাদের বিরুদ্ধেই মামলা করে।’</p> <p style="text-align: justify;">তিনি আরো বলেন, বলেন, ‘কালো টাকা সাদা করার বিধান সাধারণত প্রতিটি বাজেটেই থাকে। এতে কিন্তু দুদকের কাজ থেমে থাকেনি। মামলাও থেমে থাকেনি। দুদক তার নিজস্ব গতিতে তার এখতিয়ার অনুযায়ী কাজ করবে।’</p> <p style="text-align: justify;">এদিকে একই মত পোষণ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজিব উল আলম। তিনি বলেন, ‘অপরাধলব্ধ টাকা আয়কর দিয়ে হালাল করা যাবে এ কথা বলা হয়নি। ঘুষ খাওয়া টাকা কর দিয়ে সাদা করলে তার ঘুষ খাওয়া হালাল হবে না। সরকারি কর্মকর্তা ঘুষ খেয়ে যে সম্পদ করেছে সেই সম্পদ বৈধ হয়ে যাবে না। কিংবা ১৫ শতাংশ আয়কর দেওয়ার কারণে তার ঘুষের অপরাধও মাফ হয়ে যাবে না। এ ক্ষেত্রে দুদকের তদন্ত করতে কোনো বাধা নেই।’  </p> <p style="text-align: justify;">২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫ শতাংশ আয়কর দিয়ে কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোনো ব্যক্তি বা কম্পানি তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সাদা করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে পরিসম্পদ অর্জনের উৎসর বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ থাকবে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ সুযোগ দেওয়ায় এই টাকার বিপরীতে আর কোনো কর দিতে হবে না। তবে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনে কোনো দুর্নীতি, অনিয়মের অনুসন্ধান করতে বাধা নেই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)।</p> <p style="text-align: justify;">প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী, আয়কর আইন ২০২৩ বা অন্য কোনো আইনে যা কিছু থাকুক না কেন, আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যক্তির কোনো পরিসম্পদ অর্জনের উৎসর বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারবে না। যদি সেই ব্যক্তি ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ২০২৪-২৫ করবর্ষের রিটার্ন বা সংশোধিত রিটার্ন দাখিল করেন। অবশ্য এ ক্ষেত্রে রিটার্ন জমার আগে ডেপুটি কমিশনার অব ট্যাক্সকে (ডিসিটি) অবগত করতে হবে।</p> <p style="text-align: justify;">এ ক্ষেত্রে প্লট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য বিভিন্ন এলাকার মৌজাভেদে স্থাপনা, বাড়ি, প্লট, অ্যাপার্টমেন্ট অথবা ফ্লোর স্পেসের করহার সর্বনিম্ন প্রতি বর্গমিটারে ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে ভূমির করহার বিভিন্ন এলাকার মৌজাভেদে প্রতি বর্গমিটারে সর্বনিম্ন ৩০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সিকিউরিটিজ, নগদ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, আর্থিক স্কিম ও ইনস্ট্রুমেন্ট এবং সব ধরনের ডিপোজিট বা সেভিং ডিপোজিটের জন্য মোট পরিসম্পদের ১৫ শতাংশ কর দিতে হবে।</p> <p style="text-align: justify;">তবে কর ফাঁকির কার্যধারা চলমান থাকলে কিংবা যেকোনো আইনের অধীন ফৌজদারি মামলার কার্যধারা চলমান থাকলে এই নিয়মে কর পরিশোধ করা যাবে না।</p> <p style="text-align: justify;">মূলত জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ বা অর্থ সাদা করার পরও দুদকের অনুসন্ধানে কোনো বাধা না থাকার প্রভাব পড়েছে কালো টাকা সাদা করায়। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেউ কালো টাকা সাদা করেনি। তবে এর আগের বছর ২০২১-২২ অর্থবছরে কালো টাকা সাদা করেন দুই হাজার ৩১১ জন। অর্থের পরিমাণে তা এক হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা। অন্যদিকে অর্থবছর শেষ না হওয়ায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের হিসাব এখনো চূড়ান্ত করেনি এনবিআর।</p> <p style="text-align: justify;">তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৮৫৯ জন ব্যক্তি কালো টাকা সাদা করেন। অর্থের পরিমাণে তা ছিল ২০ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। মূলত করোনার কারণে দেশের বাইরে পাচার করতে না পারায় বিপুল অর্থ সাদা করা হয়েছিল। আলোচ্য প্রতিটি অর্থবছরে ১০ শতাংশ আয়কর দিয়ে অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ নিয়েছিলেন তাঁরা।</p> <p style="text-align: justify;">চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সময় শেষ না হওয়ায় এখনো কোনো পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়নি। </p> <p style="text-align: justify;">তবে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত একজন ব্যক্তিও এ সুযোগ নেয়নি। এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরেও কেউ কালো টাকা সাদা করেনি। ফলে এবার এই সুযোগ দিয়ে সরকার কতটা ফলপ্রসূ হবে তা বলা যাচ্ছে না।</p> <p style="text-align: justify;">প্রস্তাবিত বাজেটে এর যৌক্তিকতা তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘অর্থনীতিতে কার্যকর চাহিদা সৃষ্টি এবং সরকারি ব্যয় নির্বাহের জন্য রাজস্ব আদায় বাড়ানোর পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল রাখতে হবে। ডাটা ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস) চালুর পর বিভিন্ন কম্পানির অপ্রদর্শিত আয় ও পরিসম্পদ প্রদর্শনে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। রিটার্ন দাখিলে করদাতার অজ্ঞতাসহ অনিবার্য কিছু কারণে অর্জিত সম্পদ প্রদর্শনে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। এ অবস্থায় করদাতাদের আয়কর রিটার্নে এই ত্রুটি সংশোধনের সুযোগ দিয়ে অর্থনীতির মূল স্রোতে অর্থপ্রবাহ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।’</p> <p style="text-align: justify;">তবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পরও এই সুযোগ নেওয়ার কেউ নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর আইনজীবী কালের কণ্ঠকে জানান, অনেকেই কালো টাকা সাদা করা এবং পরবর্তী সময়ে কোনো সমস্যা হবে কি না জানতে আসেন। কিন্তু আইনি বিষয়গুলো শুনে তাঁরা নিরুৎসাহ হয়ে চলে যান। কারণ কালো টাকা কারা সাদা করছেন তার একটি তালিকা সরকারের কাছে থাকে। ভবিষ্যতে এ নিয়ে সরকার চাইলে ভিন্ন পদক্ষেপও নিতে পারে।</p> <p style="text-align: justify;">এ ক্ষেত্রে করদাতার সুরক্ষা কতটা জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আয়কর আইন শুধু আয়ের উৎস নিয়ে কাজ করছে। অন্য কোনো বিষয়ে নয়। তাকে পরবর্তী সময়ে আর কর দিতে হবে না। যদি কোনো করদাতা কাউকে খুন করার বিনিময়ে টাকা নিয়ে থাকে, এনবিআর অথবা অন্য কোনো সরকারি সংস্থা সেটা জানতে চাইবে না। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি আদালতে মামলা হলে তার দায় কিংবা সুরক্ষা এনবিআর দেবে না।’</p> <p style="text-align: justify;">একজন বৈধ করদাতাকে যেখানে ৩০ শতাংশ কর দিতে হয়, সেখানে মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়াটা অনৈতিক, অগ্রহণযোগ্য, অসাংবিধানিক ও সৎ করদাতাদের প্রতি অবিচার হিসেবে উল্লেখ করেছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। তবে বিশ্বে শুধু বাংলাদেশেই এই সুযোগ দেওয়া হয় না।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>বিশ্বের ৫০ দেশে আছে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ</strong></p> <p style="text-align: justify;">বিশ্বের মোট ৫০টি দেশে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে। তবে বাংলাদেশের মতো এমন ব্যবস্থা করেনি কোনো দেশ। ওই সব দেশে সীমিত সময়ের জন্য সুযোগ দেওয়া হয়েছিল এবং সুযোগ না নিলে শাস্তির হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এতে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশে বারবার সুযোগ দেওয়ায় কালো টাকার মালিকরা মনে করেন ভবিষ্যতেও এ সুযোগ পাওয়া যাবে।</p>