<article> <p align="left">দেশে চিকিৎসাসেবায় সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী। এর প্রধান কারণগুলো হচ্ছে চিকিৎসাব্যবস্থা রাজধানীকেন্দ্রিক, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক ও লোকবলের অভাব, যন্ত্রপাতির সংকট এবং চিকিৎসা ব্যয় তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা করাতে হয় বলে অবস্থাপন্ন ব্যক্তি যেভাবে ব্যয় মেটাতে পারে, অন্যরা সেভাবে পারে না।</p> <p align="left"><img alt="ক্যান্সার চিকিৎসায় বৈষম্য বাড়ছে" height="360" src="https://www.kalerkantho.com/_next/image?url=https%3A%2F%2Fcdn.kalerkantho.com%2Fpublic%2Fnews_images%2F2024%2F02%2F04%2F1706989484-426aa667348309bfa9ed5ef745d7ee76.jpg&w=1920&q=100" width="600" /></p> <p align="left">এই বৈষম্য দূর করতে জাতীয় ক্যান্সার তহবিল গঠনে গুরুত্বারোপ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, প্রান্তিক পর্যায়ে ক্যান্সারের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত, হাসপাতালগুলোতে ক্যান্সার চিকিৎসার উপযোগী দক্ষ লোকবল তৈরি বা নিয়োগ এবং হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যবস্থা করলে চিকিৎসাসেবা উন্নত ও বৈষম্য কমে আসবে।</p> </article> <article> <p align="left">বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ চিকিৎসা ব্যয় নাগরিকদের নিজ পকেট থেকে দিতে হয়। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ছে দরিদ্র পরিবারগুলো। তাদের আয়ের বড় একটি অংশ এই স্বাস্থ্যসেবায় চলে যায়। এই সেবা নিতে সামর্থ্য না থাকায় স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে এবং দরিদ্র মানুষের উপার্জনক্ষমতা কমে যায়।</p> <p align="left">এমন পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশের মতো আজ ৪ ফেব্রুয়ারি দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ক্যান্সার দিবস-২০২৪। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘বৈষম্য দূর করি, ক্যান্সার চিকিৎসা নিশ্চিত করি’।</p> </article> <article> <p align="left">বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্যান্সারবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইএআরসি) তথ্য মতে, ২০২২ সালে বিশ্বে নতুন করে দুই কোটি মানুষের ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছে। মৃত্যু ৯৭ লাখ মানুষের।</p> </article> <article> <p>সংস্থাটির সর্বশেষ তথ্য মতে, একই বছর বাংলাদেশে এক লাখ ১৬ হাজার ৫৯৮ জন মারা গেছে। দেশে ক্যান্সার রোগীদের নিবন্ধন না থাকলেও বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময় বলেছেন, দেশে ১৫ থেকে ২০ লাখ ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী রয়েছে। প্রতিবছর এই তালিকায় দুই লাখ রোগী যোগ হয়।</p> <p align="left"><b>মূল সমস্যা চিকিৎসা ব্যয়</b></p> <p align="left">জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গতকাল দুপুরে চিকিৎসা নিতে আসা ক্যান্সার রোগী রহিমা বেগমের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি এসেছেন নোয়াখালী থেকে। হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের নিচতলায় পাটি বিছিয়ে রহিমার সঙ্গে বসে ছিলেন আরো পাঁচ নারী।</p> <p align="left">জানতে চাইলে রহিমা বলেন, ‘বাসাভাড়া দিতে দিতে ফকির হয়ে গেছি। এখন আর পারছি না। হাসপাতালে ভর্তির জন্য তিন দিন ধরে অপেক্ষা করেও সিট পাচ্ছি না। কবে পাব জানি না।’</p> </article> <article> <p align="left">তিনি বলেন, ‘রোগ শনাক্ত হতেই তিন লাখ শেষ। এখন তো সারা বছরই টাকা লাগে। জমিজমা বিক্রি শেষ। কেউ দিলে চিকিৎসার জন্য আসি, না হলে আসতে পারি না।’</p> <p align="left">রহিমার পাশে বসে থাকা অন্য রোগীদেরও একই অবস্থা। শয্যা কবে পাবেন, কেউ জানেন না।</p> <p align="left">নাম প্রকাশ না করে হাসপাতালটির একজন চিকিৎসা কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, বেশির ভাগ রোগী আসে রোগের তৃতীয় বা চতুর্থ পর্যায়ে, তখন তার চিকিৎসা খরচ কয়েক গুণ বেড়ে যায় এবং সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। প্যালিয়েটিভ কেয়ার দিতে হয়। ৩০ শতাংশ রোগীর সুস্থতার সম্ভাবনা থাকলেও অর্থসংকটের কারণে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারে না।</p> <p align="left"><b>ক্যান্সার চিকিৎসায় যত ব্যয়</b></p> <p align="left">বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত একজন রোগীর চিকিৎসায় গড়ে পাঁচ লাখ ৪৭ হাজার ৮৪০ টাকা পকেট থেকে খরচ করতে হয়। এই খরচ জনপ্রতি সর্বনিম্ন ৮১ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় ওষুধপত্র কিনতে। ক্যান্সারের প্রাথমিক স্তরে গড়ে চিকিৎসা খরচ তিন লাখ ৩১ হাজার ২৪৩ টাকা। দ্বিতীয় স্তরে গড় খরচ ছয় লাখ ৯৯ হাজার ৮৬৫ টাকা।</p> <p align="left">বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. নাজিম উদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘আমাদের ক্যান্সার চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র হচ্ছে রেডিওথেরাপি মেশিন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী, প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি মেশিন দরকার। সে হিসাবে আমাদের ১৭ কোটি মানুষের জন্য ১৭০টি মেশিন থাকা দরকার। আর চিকিৎসাসেবা সহজ করতে প্রয়োজন ২০০টি মেশিন। তবে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশে আছে মাত্র ২০টি মেশিন। এর অর্ধেকের বেশি আবার নষ্ট। বিএসএমএমইউতে একটি মেশিন আছে। সব সময় সচল থাকে না, মাঝেমধ্যে নষ্টও থাকছে। আরেকটি মেশিন আনার প্রক্রিয়া চলছে, তবে কখন আসে, ঠিক নেই।’</p> <p align="left">নাজিম উদ্দিন মোল্লা বলেন, ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের অভাবও আরেকটি বড় উদ্বেগের কারণ। দেশে মোট ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ তিন শর বেশি হবে না। তাঁদের পক্ষে এত বেশি রোগীর চিকিৎসা করা সম্ভব নয়।</p> <p align="left">এই ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ বলেন, ওষুধের খরচ অনেক বেশি। তবে আগের চেয়ে কিছু কমেছে। আগে যেখানে ৩০ হাজার লাগত, সেখানে এখন ১০ হাজার লাগছে। তবে কাঁচামাল দেশে তৈরি করা গেলে আরো খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব। রোগীর খরচ না কমানো গেলে চিকিৎসাসেবায় বৈষম্য হবে, এটা স্বাভাবিক।</p> <p align="left"><b>ক্যান্সারে মৃত্যুহার দ্বিগুণ হওয়ার শঙ্কা</b></p> <p align="left">তামাক ব্যবহার, অ্যালকোহল সেবন, স্থূলতা ও বার্ধক্যজনিত কারণে উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে ২০৫০ সালের মধ্যে নতুন করে ৪.৮ মিলিয়ন মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবে কম আয়ের দেশে। দরিদ্র দেশগুলোতে ক্যান্সারে মৃত্যুর হার বেড়ে দ্বিগুণ হতে পারে বলে এক পূর্বাভাসে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্যান্সারবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইএআরসি)।</p> <p align="left">সংস্থাটির পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ৩৫ মিলিয়নে দাঁড়াতে পারে, যা ২০২২ সালের চেয়ে অন্তত ৭৭ শতাংশ বেশি।</p> <p align="left"><b>প্যালিয়েটিভ কেয়ার পায় ০.০১% রোগী</b></p> <p align="left">জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ২০১৪ সালের একটি গবেষণায় এবং ২০২৩ সালে প্যালিয়েটিভ কেয়ার সোসাইটি অব বাংলাদেশের ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার জার্নালে’ দেখা গেছে, দেশে বছরে ক্যান্সারের মতো নিরাময় অযোগ্য রোগে আক্রান্ত সাত লাখ মানুষের প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা প্রশমন সেবার প্রয়োজন। এই হিসাবের মধ্যে শিশু-কিশোর রয়েছে ৪০ হাজার।</p> <p align="left">পরিসংখ্যান মতে, বিশাল চাহিদার বিপরীতে প্রশমন সেবা পাচ্ছে মাত্র ০.০১ শতাংশেরও কম মানুষ। অর্থাৎ রোগীদের বড় একটি অংশ ক্যান্সারের যন্ত্রণা নিয়ে মারা যাচ্ছে।</p> <p align="left">বাংলাদেশে ঢাকার কিছু সীমিত হাসপাতালে দক্ষ চিকিৎসক ও কর্মীদের মাধ্যমে এই সেবা দেওয়া হয়। বিএসএমএমইউয়ের প্যালিয়েটিভ মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ শিশু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে সরকারিভাবে এই সেবা দেওয়া হয়।</p> <p align="left"><b>বৈষম্য কমাতে জাতীয় ক্যান্সার তহবিল প্রয়োজন</b></p> <p align="left">ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমাদের ক্যান্সার চিকিৎসায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে শনাক্ত করতে ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। পর্যাপ্ত লোকবল নেই, যন্ত্রপাতি নেই, যে কারণে এখানে-ওখানে ঘুরতে ঘুরতে রোগী টাকা শেষ করে। শেষে যখন শনাক্ত হয়, পর্যাপ্ত চিকিৎসাব্যবস্থা থাকে না।’</p> <p align="left">অধ্যাপক আবদুল হামিদ বলেন, ক্যান্সার চিকিৎসায় যে ব্যয়, এটা ধনী মানুষ ছাড়া কারো পক্ষে বহন সম্ভব নয়। এ জন্য সরকারের একটি ক্যান্সার তহবিল করা দরকার, যেটির নাম হতে পারে জাতীয় ক্যান্সার তহবিল। সে তহবিলের জন্য প্রয়োজনে মোবাইল ফোন গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রতি মাসে ১০ টাকা করে নেওয়া যেতে পারে। এতে ১৮ কোটি গ্রাহক থেকে বছরে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি আসে। এভাবে একজন ক্যান্সার রোগী সাত লাখ টাকা করে চিকিৎসার জন্য পেলে তিনি সহজে চিকিৎসা করাতে পারবেন।</p> </article>