<article> <p style="text-align: justify;">রাজনীতিতে কোনো শর্টকাট রাস্তা নেই। একটি দীর্ঘ সংগ্রাম প্রক্রিয়া ও পথপরিক্রমার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা সরকার গঠনের বিষয়টিও একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এমন নয় যে রাজনীতি একটি গাছ আর ক্ষমতা সেই গাছের এমন কোনো ফল, যেটি টুপ করে পড়ল আর কুড়িয়ে নিয়ে খেয়ে ফেললেই মসনদে বসে পড়া যায়।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">যেকোনো দেশে একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম হয় জনগণের মধ্য থেকে। জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়। গড়ে তোলে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এর জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হয়।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">কিন্তু বাংলাদেশের পঁচাত্তর-পরবর্তী বাস্তবতা হচ্ছে, এখানে রাজনৈতিক দলের নামে কিছু সংগঠন হঠাৎ করেই গজিয়ে ওঠে। ‘স্ফুলিঙ্গ তার পাখায় পেল ক্ষণকালের ছন্দ’, অনেকটা সে রকম করেই জন্ম নিয়ে ক্ষমতার মসনদে আসীন তারা। দেশের সুধীসমাজের সুবিধাবাদী অংশটিও ‘উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে’ যাওয়া দলকে সমর্থন জোগায়। আবার এসব দলে নাম লেখাতে উচ্ছিষ্টভোগী গোষ্ঠীরও আকাল পড়ে না।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের মাটির সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে রাজনীতিতে সাফল্য পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকা অন্তত দুটি রাজনৈতিক দলের জন্ম উর্দির পকেট থেকে। তারা কেনাবেচার রাজনীতিতে বিশ্বাসী। জন্মের পর এসব দল অন্যান্য দল থেকে রাজনীতিবিদ ‘পারচেজ’ করেছে। দেশের মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত নিজস্ব কোনো নীতি-আদর্শ নেই।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">১৯৭৫ সালের পর দুটি উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। দুজন সামরিক শাসক বেসামরিক লেবাসে নিজের হাতে শাসনক্ষমতা ধরে রাখার জন্য রাজনৈতিক দল গঠনের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তাঁদের অধীন কর্মকর্তারা রাজনীতির বাজার থেকে ‘বিভ্রান্ত এবং নীতিভ্রষ্ট’ কিছু রাজনীতিককে নগদ প্রাপ্তিযোগের বিনিময়ে দলে ভেড়ালেন। ২১ বছর জাতিকে বিভ্রান্তির বেড়াজালে আটকে রেখে শাসনের নামে শোষণ করতে গিয়ে ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ ও ‘...মেক পলিটিকস ডিফিকাল্ট’ তত্ত্বের জন্ম হয়। ক্ষমতায় থাকার কৌশল হিসেবে রাজনীতিকে ‘ডিফিকাল্ট’ করার খেলায় শুরুতে টাকা তাদের কাছে ‘প্রবলেম’ মনে না হলেও একসময় এসব দলের দম ফুরায়। তখন তাদের তাকিয়ে থাকতে হয় বাইরের শক্তির দিকে। কারণ জন্ম ও বেড়ে ওঠার কোনো ক্ষেত্রেই এসব দল জনগণের শক্তির ওপর নির্ভর করেনি।</p> <p style="text-align: justify;">রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তোলার তাত্ত্বিকদের জন্যও যে রাজনীতি কঠিন হয়ে যেতে পারে, তার উদাহরণ শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই আছে। ঘরে বসে রাজা-উজির মারা যায়, রাজনীতি করা যায় না। রাজনীতি করতে হলে জনগণের কাছে যেতে হয়। জনগণের রায় নিতে গেলেই তাদের ‘সংশয়ে সংকল্প সদা টলে’। ‌‘পাছে লোকে কিছু বলে’ নয়, তাদের ভয় জনগণ যদি তাদের ‘লাল কার্ড’ দেখিয়ে দেয়!</p> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সে রকমই একটি দল, যারা বছরের পর বছর ধরে আন্দোলনের কথা বলেছে, আরেকটু ‘ধাক্কা দিলে’, ‘টোকা দিলে’, ‘ফুঁ দিলে’ সরকার পড়ে যাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে, কিন্তু তারা জনগণের ম্যান্ডেট নিতে যায়নি। ২০০৮ সালে গিয়েছিল। জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করে। ২০১৪ সালে জনগণের কাছে যাওয়ার সৎসাহস হয়নি তাদের। নির্বাচন কমিশনে দলের নিবন্ধন রক্ষার তাগিদে নেতা হায়ার করে ২০১৮ সালে নির্বাচনে গিয়ে কী ফল হয়েছিল, সেটিও তো সবার জানা। অনিবার্যভাবেই ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে আসেনি তারা। নির্বাচনে না আসার পেছনে তাদের অজুহাতের অন্ত নেই। কিন্তু কী লাভ হলো তাতে?</p> <p style="text-align: justify;">দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পরে দলের কর্মকৌশল নিয়ে বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা প্রশ্ন তুলেছে। ২০১৪ সালে দশম এবং ২০২৪ সালে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির ঘোষণা ছিল নির্বাচন হতে না দেওয়ার। আন্দোলনের কথা বলেছিল দলটি। কিন্তু তথাকথিত সেই আন্দোলনে কতটা সফল হতে পেরেছে তারা? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপির আন্দোলনে কোনো পরিকল্পনা ছিল না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর হচ্ছে, আন্দোলনের শেষ কোথায়—এই প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন দলটির মাঠ পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মী। বিএনপি কি আন্দোলনের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ‘দুর্বলতাগুলো’ চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে? </p> <p style="text-align: justify;">এর পরও বিএনপি মনে করে, তাদের কর্মসূচিতে সাফল্য আসবেই। সরকার পিছু হটতে বাধ্য হবে, কিন্তু কিভাবে? দলের নেতারাও বোধ হয় জানেন না, কোন কৌশলে সাফল্য ধরা দেবে তাঁদের হাতে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি, বিএনপি বিদেশিদের দিকে তাকিয়ে থেকেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বিএনপির তৃণমূলের কর্মীদের হয়তো কিছুটা আশাবাদী করেছিল। তবে কোনো দেশ বিএনপির দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কথা বলেনি। আর নির্বাচনের পর বিএনপি ও তার সমমনাদের হতাশ করে পশ্চিমারা এখন সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাওয়া, এমনকি সম্পর্কোন্নয়নের ঘোষণাও দিচ্ছে। বাংলাদেশের নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু না বললেও নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহের কথা আগেই জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। উদ্বেগ থাকলেও বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কাজ না করার ভাবনা আবারও নাকচ করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। গত ১ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে ওয়াশিংটন ডিসিতে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেছেন, ‘উদ্বেগ থাকার অর্থ এই নয় যে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কাজ করার দায়িত্ব নেই।’</p> <p style="text-align: justify;">দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে গেছে। সরকারের মাসপূর্তি হতে চলেছে। ‘নরম কর্মসূচি’তে চলে গেছে বিএনপি। এ অবস্থায় রাজনীতিতে ফিরে আসার পথ খুঁজতে কোন পন্থা অবলম্বন করতে যাচ্ছে বিএনপি? কোন কৌশলে জনসম্পৃক্ত রাজনীতিতে ফিরবে তারা? বিশেষ করে জামায়াত সংশ্লিষ্টতা নিয়ে দলটির গ্রহণযোগ্যতা তো প্রশ্নের মুখে। সংগত কারণেই বিএনপিকে রাজনীতির মাঠে অনেক প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। প্রথম প্রশ্ন, বাঙালি জাতিসত্তা সম্পর্কে বিএনপির বক্তব্য কী? দলটি কি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক ও জাতির পিতা হিসেবে মানে? তারা কি বাংলাদেশের সংবিধানে বিশ্বাসী? এসব প্রশ্নের জবাব দিতে কৌঁসুলি হওয়ার দরকার পড়ে না। কোনো কৌশল অবলম্বনেরও সুযোগ নেই। জবাব দেওয়ার জন্য ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ যেকোনো একটি শব্দ বেছে নিতে হবে। উত্তর ‘না’ হলে বাংলাদেশের রাজনীততে বিএনপির টিকে থাকার সম্ভাবনা যে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হবে—সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে বিএনপিকে নতুন করে ঘর সাজাতে হবে। সে ক্ষেত্রে কতটা রাজনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দিতে পারবে বিএনপি? আর যদি মাঝপথ দিয়ে যেতে চায়, তাহলেই বা কোন কৌশল অবলম্বন করবে তারা?</p> <p style="text-align: justify;">বিএনপি মূলত একটি ক্ষমতালোভী দল। কোনো এক ক্ষমতাধর ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা হোক; দলটি ক্ষমতায় থাক। রাজনৈতিক দল গঠিত হলো, কিছুদিন ক্ষমতায়ও থাকল। ফলটি দাঁড়াল এই যে জনগণের কাছে না গিয়েও বিএনপি সব সময় ক্ষমতামুখী থেকেছে, গণমুখী হতে পারেনি। নেতা-কর্মী-সমর্থকদের হতাশা ও বিভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে ক্ষমতামুখী দলটি কি কখনো গণমুখী হতে পারবে? এ প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের হাতে।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক :</strong> সাংবাদিক</p> <p style="text-align: justify;"><a href="mailto:habib.alihabib@gmail.com">habib.alihabib@gmail.com</a></p> </article>