<p>প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষাদানের লক্ষ্যে গত এক যুগে দেশে বেসরকারি পর্যায়ে এক হাজার ৭৭২টি বিশেষায়িত স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাঁচ লাখের মতো প্রতিবন্ধী শিশু এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে। এ শিশুদের পাঠদানে সারা দেশে নিয়োজিত আছেন ৫০ হাজারের বেশি শিক্ষক ও কর্মচারী। তবে এসকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত সরকারি স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্তির বাইরে থাকায় শিক্ষক-কর্মচারীরা বিনা বেতনে কাজ করে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় পেশা বদল করছেন অনেকে। </p> <p>প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে অভিজ্ঞরা বলছেন, স্কুলগুলোর প্রতি অমনোযোগের ফলে বিশেষায়িত শিশুদের শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার যেমন বাড়ছে না, লেখাপড়ায় থাকা প্রতিবন্ধী শিশুরা সফলতার সঙ্গে শিক্ষাচক্র শেষ করতে পারছে না। এছাড়া শিক্ষক-কর্মচারীরা কাটাচ্ছেন অনিশ্চিত ও অমানবিক জীবন। সর্বোপরি পাঁচ লাখ প্রতিবন্ধী শিশুর শিক্ষা জীবন অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে। ভয়াবহ এ সঙ্কট কাটাতে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে বিশেষায়িত স্কুলকে দ্রুত স্বীকৃতি দিয়ে এমপিওভুক্তির আওতায় নেওয়ার বিকল্প নেই।</p> <p>সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান, এমপি বৃহস্পতিবার (২ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘প্রতিবন্ধী স্কুলগুলোকে এমপিওভুক্তি ও স্বীকৃতির ব্যাপারে সার্ভে চলছে। আরো সময় নেবে’। এক্ষেত্রে সময় বেশি লাগার কারণ সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘অনেক স্কুল রাতারাতি গজিয়েছে। অনেকগুলোর কাগজপত্র ঠিক নাই। স্কুলের জায়গা নিয়েও ঝামেলা আছে’।</p> <p>প্রতিবন্ধিতা বিশেষজ্ঞ ও মৃত্তিকা প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশেনের চেয়ারপারসন ম. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ‘প্রতিবন্ধী মানুষের মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষার আলো থেকে প্রতিবন্ধী শিশুদের বাইরে রেখে এদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন কখনোই সম্ভব নয়। সে কারণেই তালিকাভুক্ত প্রতিবন্ধী স্কুলগুলোর সরকারি স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্তি এখন সময়ের দাবি’।</p> <p>বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় বিশেষায়িত স্কুলগুলোর স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্তির লক্ষ্যে সার্কুলার জারি করে। এরপর ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তালিকা চেয়ে আরেকটি চিঠি দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে জমাকৃত তালিকা যাচাই-বাছাই করে মন্ত্রণালয় এক হাজার ৭৭২টি প্রতিষ্ঠানের চূড়ান্ত করে। এরপর প্রায় দুই বছর পার হয়ে গেলেও মন্ত্রণালয়ের স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়াটি গতি হারায়। </p> <p>সূত্র মতে, তারও আগে ২০০৯ সালে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা ও অন্যান্য অধিকার বিষয়ে নীতিমালা করে সরকার। এর আলোকেই সারা দেশে বেসরকারি পর্যায়ে বিশেষায়িত স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়। ২০১৩ সালে সরকার প্রতিবন্ধী সুরক্ষায় আইন প্রণয়ন করে। ২০১৯ সালে আইনটি গ্যাজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এর এক বছর পর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় বিদ্যালয়ের তালিকা চায়। সমিতির নেতারা জানান, বিশেষায়িত স্কুলের পাঠ্যক্রম তৈরি হয়নি। গাইডলাইন নেই পরীক্ষণ ও মূল্যায়ন পদ্ধতির। চূড়ান্ত হয়নি শ্রেণীর নামকরণও। এসব কারণে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষাজীবন নিয়ে ভয়াবহ অনিশ্চয়তার আশঙ্কা করছেন তাঁরা।</p> <p>বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির আহবায়ক গাইবান্ধার মো. আরিফুর রহমান অপু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার আইন করলেও মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা নিয়ে আগ্রহী ও মনোযোগী নন। দীর্ঘ সময় পার করে তাঁরা বিদ্যালয়ের তালিকা করলেও স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্তির আওতায় না নিয়ে এখন নানা কথা বলছেন। এতে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। চাকরি স্থায়ী না হওয়ায় পেশা বদল করছেন অনেকে। প্রতিবন্ধী শিশুশিক্ষার্থীও আশঙ্কাজনকভাবে ঝরে পড়ছে। মন্ত্রণালয়ে ধরনা দিয়েও কূলকিনারা পাচ্ছি না’।</p> <p>কিশোরগঞ্জ জেলায় বেসরকারি পর্যায়ে রয়েছে নয়টি বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করছে প্রায় এক হাজার ২৯২ জন প্রতিবন্ধী শিশু। শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মচারী মিলিয়ে এ স্কুলগুলোতে কর্মরত রয়েছেন প্রায় ১৬৮ জন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্কুলগুলো এখনো এমপিওভুক্ত হয়নি। পায়নি সরকারি স্বীকৃতি। ফলে এসব স্কুলের শিক্ষক ও কর্মচারীরা পাচ্ছেন না বেতন-ভাতা। ফলে ভ্যানচালক, নৈশপ্রহরীসহ কেবল সাধারণ কর্মচারীসহ শিক্ষকদের অনেকে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন।</p> <p>প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে বাজিতপুরে মৃত্তিকা প্রতিবন্ধী শিশু পাঠশালা ও পুনর্বাসনকেন্দ্র, কটিয়াদীতে আলোর দিশারী প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়, পাকুন্দিয়ায় জাহানারা হাসান প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় ও গাঙচিল প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়, নিকলী বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়, কিশোরগঞ্জ ও করিমগঞ্জে কল্যাণী ইনক্লোসিভ স্কুল, কিশোরগঞ্জে রাকুয়াইল সুইড বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় এবং তাড়াইলে নূর প্রতিবন্ধী স্কুল। </p> <p>কিশোরগঞ্জ বিশেষ শিক্ষা উন্নয়ন নেটওয়ার্ক, ক্যাসিডন সভাপতি ও কল্যাণী ইনক্লোসিভ স্কুলের প্রধান শিক্ষক সানজিদা খানম বলেন, ‘সরকারের তরফ থেকে এক টাকাও বেতন নাই। স্কুলে যাতায়াত খরচও পাচ্ছি না কেউ। যেন স্বেচ্ছাসেবা দিয়ে যাচ্ছি আমরা। সরকারের মনোযোগের অভাবে শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে নিতে না পারায় দিনে দিনে উৎসাহ কমে যাচ্ছে’। তিনি বলেন, ‘সরকার এসব স্কুলের শিক্ষকদের কোনোরকম প্রশিক্ষণও দেয় না। যেটুকু লেখাপড়া হচ্ছে, দায় থেকেই শিক্ষকরা সেটা করছেন’।</p> <p>মৃত্তিকা প্রতিবন্ধী স্কুলের প্রধান শিক্ষক নূরে হায়াত জানান, বহু মানবিক মানুষের অনুদানে ও পরিশ্রমে তাঁর স্কুলটি গড়ে উঠেছে। নিজস্ব জায়গায় রয়েছে দৃষ্টিনন্দন ভবন। অত্যন্ত স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় শিক্ষক-কর্মচারীরা নিয়োগ পেয়েছেন। অথচ তাঁর স্কুলটিকে অজানা কারণে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না। নেওয়া হচ্ছে না এমপিওভুক্তির আওতায়। তিনি বলেন, ‘যেসকল প্রতিষ্ঠান সরকারের সকল নির্দেশনা মেনেছে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত এমপিওভুক্তির আওতায় না নিলে প্রতিবন্ধী শিশুশিক্ষায় বিরাট সঙ্কট দেখা দেবে।</p>