<p style="text-align:justify">অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের মতো কোরআন তিলাওয়াতেও নবীজি (সা.) ছিলেন অনন্য। তাঁর তিলাওয়াত ছিল আদর্শ তিলাওয়াতের পরিমাপক। মহানবী (সা.)-এর তিলাওয়াতের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় এটাই তিলাওয়াতকারীর জন্য সর্বোত্তম নমুনা। নিচে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো। যেমন ছিল মহানবী (সা.)-এর তিলাওয়াত হাদিসের বর্ণনায় নবীজি (সা.)-এর তিলাওয়াতের নানা বৈশিষ্ট্য উঠে এসেছে। যেমন—</p> <p style="text-align:justify"><strong>১. তিলাওয়াত করতেন নিচু ও উঁচু কণ্ঠে: </strong>আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়, নবীজি (সা.) কিভাবে কোরআন তিলাওয়াত করতেন, জোরে না আস্তে? তিনি উত্তরে বলেন, তিনি (নবী) সবভাবেই তিলাওয়াত করতেন। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ১৪৩৭)</p> <p style="text-align:justify"><strong>২. সুমিষ্ট কণ্ঠে তিলাওয়াত:</strong> রাসুলুল্লাহ (সা.) অত্যন্ত সুমিষ্ট কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। তিনি মিষ্টি কণ্ঠে তিলাওয়াত করতেন। বারা বিন আজিব (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)কে এশার নামাজে সুরা তিন তিলাওয়াত করতে শুনেছি। আমি তাঁর চেয়ে সুন্দর কণ্ঠ বা তিলাওয়াতের অধিকারী কাউকে দেখিনি। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৬৯)</p> <p style="text-align:justify"><strong>৩. কখনো উচ্চৈঃস্বরে তিলাওয়াত করতেন:</strong> একাকী তিলাওয়াত করার সময়ও মহানবী (সা.) কখনো কখনো উচ্চৈঃস্বরে তিলাওয়াত করতেন। উম্মে হানি (রা.) বলেন, আমি নবীজি (সা.)-এর তিলাওয়াত শুনছিলাম আমার ছাদে অবস্থান করা অবস্থায়। (নাসায়ি, হাদিস : ১০১৩)</p> <p style="text-align:justify"><strong>৪. তিলাওয়াতের সময় দোয়া করা: </strong>কোরআন তিলাওয়াত করার সময় কোনো সুসংবাদ এলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তা প্রার্থনা করতেন এবং কোনো শাস্তির আলোচনা এলে তা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতেন। আউফ বিন মালিক (রা.) বলেন, আমি নবী (সা.)-এর সঙ্গে উঠলাম। তিনি মিসওয়াক করতে শুরু করলেন। তারপর অজু করে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করলেন। তিনি শুরুতেই সুরা বাকারা শুরু করলেন। তিনি কোনো রহমতের আয়াতে পৌঁছলে তাতে দোয়া না করে ছাড়তেন না। আর কোনো শাস্তির আয়াতে পৌঁছলে সেখানে থেমে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করতেন। (সুনানে নাসায়ি, আয়াত : ১১৩২)</p> <p style="text-align:justify"><strong>৫. চলার পথে তিলাওয়াত: </strong>রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো কখনো বাহনের পিঠে অবস্থানের সময়ও তিলাওয়াত করতেন। আবদুল্লাহ বিন মুগাফফাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) উটের পিঠে অথবা উটের পিঠে আরোহিত অবস্থায় যখন উঠটি চলছিল, তখন আমি তিলাওয়াত করতে দেখেছি। তিনি সুরা ফাতা‌হ বা এর অংশবিশেষ অত্যন্ত নরম ও মধুর ছন্দোময় সুরে পাঠ করছিলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫০৪৭)</p> <p style="text-align:justify"><strong>৬. তিলাওয়াতে কান্না করা: </strong>কোরআন তিলাওয়াতের সময় মহানবী (সা.) আল্লাহর ভয়ে কান্না করতেন। বিশেষত নামাজে তিলাওয়াতের সময়। মুতাররিফ (রহ.) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, ‘আমি দেখেছি রাসুলুুল্লাহ (সা.) সালাত আদায় করছিলেন এবং সে সময় তাঁর বুক থেকে জাঁতা পেষার আওয়াজের মতো কান্নার আওয়াজ হচ্ছিল।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৯০৪)</p> <p style="text-align:justify"><strong>৭. তিন দিনের কমে খতম নয়:</strong> রাসুলুল্লাহ (সা.) তিন দিনের কম সময়ে কোরআন খতম করতেন না এবং এর চেয়ে অল্প সময়ে কোরআন খতম করতেও তিনি নিষেধ করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) তিন দিনের কমে কোরআন খতম করতেন না। (তাবাকাতুল কুবরা, হাদিস : ৮৮১)</p> <p style="text-align:justify">আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে তিন দিনের কম সময়ে কোরআন খতম করে সে যথাযথভাবে বুঝতে পারেনি। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩৪৭)</p> <p style="text-align:justify"><strong>৮. এক আয়াতে সারা রাত: </strong>আল্লাহর রাসুল (সা.) কখনো কখনো একটি আয়াত তিলাওয়াত করতে করতে পুরো রাত পার করে দিতেন। আবু জর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) কোনো এক রাতে নামাজে দাঁড়ান। তিনি পুরো রাত একটি আয়াত তিলাওয়াত করেন। এমনকি সকাল হয়ে গেল। এই আয়াতটিই তিনি দাঁড়ানো অবস্থায়, রুকু অবস্থায় ও সিজদায় পাঠ করেন। লোকেরা জানতে চাইল সেটা কোন আয়াত। তিনি বললেন, ‘আপনি যদি তাদের শাস্তি দেন তবে তারা আপনারই বান্দা। আর আপনি যদি তাদের ক্ষমা করে দেন তবে আপনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ১১৮; জামালুল কুররা : ১/৯৬)</p> <p style="text-align:justify"><strong>৯. সর্বাবস্থায় তিলাওয়াত: </strong>গোসল ফরজ হওয়া অবস্থায়ই শুধু রাসুলুল্লাহ (সা.) কোরআন তিলাওয়াত থেকে দূরে থাকতেন। অন্য সব অবস্থায় তিলাওয়াত করতেন। আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) বলেন, জানাবাত (যখন ব্যক্তির ওপর গোসল ফরজ থাকে) ছাড়া কোনো কিছু নবীজি (সা.)কে কোরআন থেকে আড়াল করতে পারেনি। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ২৬৫)</p> <p style="text-align:justify"><strong>১০. নামাজে দীর্ঘ তিলাওয়াত: </strong>নামাজে নবীজি (সা.) দীর্ঘ তিলাওয়াত করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে নামাজ আদায় করি। তিনি কিরাত এত দীর্ঘ করেন যে আমি বসে পড়া বা নামাজ ছেড়ে দেওয়ার উপক্রম হয়েছিলাম। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১১৩৫)</p> <p style="text-align:justify"><strong>১১. থেমে থেমে তিলাওয়াত করতেন: </strong>রাসুলুল্লাহ (সা.) থেমে থেমে আয়াত পড়তেন এবং আয়াতের শেষে থামতেন। তিনি প্রতিটি অক্ষর সুস্পষ্টভাবে তিলাওয়াত করতেন। তিনি খুব দ্রুত বা খুব ধীরে তিলাওয়াত করতেন না। যেমন—তিনি আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন পড়ে চুপ হতেন। অতঃপর পড়তেন আর রাহমানির রাহিম। (জাদুল মাআদ, পৃষ্ঠা : ২০৪)</p> <p style="text-align:justify"><strong>১২. তাড়াহুড়া করতেন না: </strong>ইমাম জুহরি (রহ.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রত্যেক আয়াতের শেষে থেমে থেমে কিরাত পড়তেন।’ নবী (সা.) যথাযথভাবে সুরা পাঠ করতেন, তা যত বড়ই হোক। (জাদুল মাআদ, পৃষ্ঠা : ২০৫)</p> <p style="text-align:justify"><strong>১৩. সুর দিয়ে তিলাওয়াত : </strong>কাতাদা (রহ.) বলেন, আমি আনাস (রা.)-এর কাছে নবীজি (সা.)-এর তিলাওয়াত সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাসুল (সা.) টেনে টেনে তিলাওয়াত করতেন। মহানবী (সা.) রাতের নামাজে কখনো আস্তে এবং কখনো জোরে সুরা পড়তেন। (জাদুল মাআদ, পৃষ্ঠা : ২০৫)</p> <p style="text-align:justify"><strong>১৪. তিলাওয়াত শুনে কান্না করা: </strong>আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে বললেন, তুমি আমাকে সুরা নিসা পড়ে শোনাও। আমি বললাম, আমি আপনাকে পড়ে শোনাব, অথচ তা আপনার ওপরই অবতীর্ণ হয়েছে! তিনি বললেন, আমি অন্যকে দিয়ে তা পড়িয়ে শুনতে চাই। আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, আমি সুরা নিসা পড়তে পড়তে (৪১ নম্বর আয়াত) ‘আমি যখন প্রত্যেক উম্মতের মধ্য থেকে একজন করে সাক্ষী উপস্থিত করব এবং আপনাকে সাক্ষী হিসেবে পেশ করব তখন কী অবস্থা হবে!’ এ পর্যন্ত পৌঁছে মাথা তুলে দেখলাম, তাঁর দুই চোখ বেয়ে পানি ঝরছে। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩৬৬৮)</p> <p style="text-align:justify">আল্লাহ সবাইকে যথাযথভাবে কোরআন তিলাওয়াতের তাওফিক দিন। আমিন।</p>