<p>রোজা হলো ইবাদতের নিয়তে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা। সংযমের এই ইবাদত ইসলাম-পূর্ব অন্যান্য ধর্মেও ছিল। তবে তার ধরন ও পদ্ধতি ছিল ভিন্ন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যেন তোমরা আল্লাহভীরু হতে পারো।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৮৩)</p> <p>কিন্তু ইসলাম যেভাবে নামাজ ও জাকাতের ভেতর মৌলিক গুণাবলির সমাবেশ ঘটানোর সঙ্গে সঙ্গে তাকে অন্যান্য ধর্মের নামাজ ও জাকাত থেকে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য দান করেছে, ঠিক সেভাবে রোজাকেও অন্য ধর্মের উপবাস থেকে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য দান করেছে। যেমন পূর্ণ এক মাস রোজা ফরজ করা এবং তার জন্য মাস নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আর সে মাসে মুসলমানের জীবনবিধান কোরআন অবতীর্ণ করা। ইরশাদ হয়েছে, ‘রমজান মাস, এতে মানুষের দিশারি এবং সত্পথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৮৫)</p> <p><strong>রোজার মাহাত্ম্য ও শিক্ষা</strong></p> <p>কোনো সন্দেহ নেই, রোজা ফরজ করার মধ্যে বহু কল্যাণ ও প্রজ্ঞা নিহিত রয়েছে। মানুষের দুর্বল মেধা ও বুদ্ধির মাধ্যমে সেসব কল্যাণের পুরোটা জানা সম্ভব নয়। চেষ্টা করলে হয়তো তার কিছুটা জানা সম্ভব। এমন কিছু কল্যাণের কথা তুলে ধরা হলো—</p> <p><strong>১. আত্মিক শক্তি অর্জন : </strong>শুধু বাহ্যিক অবয়ব ও দৈহিক কাঠামোর নাম মানুষ নয়, বরং মনুষ্যত্ব লাভের জন্য আরো কিছুর প্রয়োজন। যার ভিত্তিতে তারা সৃষ্টিজগতে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। আর তা হলো আত্মা। আত্মাই মূলত মানুষের ভেতর বুদ্ধি, বিবেক ও চিন্তা-ভাবনার শক্তি সৃষ্টি করে। রুহ বা আত্মার অনন্য বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমেই সে সৃষ্টিজগতের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে এবং ফেরেশতাদের সিজদা লাভের উপযুক্ত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন আমি তাকে সুষম করব এবং তাতে আমার রুহ সঞ্চার করব, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হয়ো।’ (সুরা : সোয়াদ, আয়াত : ৭২)</p> <p>মানুষের আত্মিক শক্তি বৃদ্ধি পায় প্রবৃত্তি দমনের মাধ্যমে। প্রবৃত্তি পূরণের প্রধান দুটি মাধ্যম হলো পেট ও লজ্জাস্থান। মানুষ যখন পেট ও লজ্জাস্থানের ব্যাপারে সংযত হতে শেখে, তখন তার আত্মিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।</p> <p><strong>২. দৈহিক সুস্থতা : </strong>রোজা রাখলে যেমন আত্মিক শক্তি মেলে, তেমন তার দ্বারা শারীরিক সুস্থতাও মেলে। কেননা মানুষের পাকস্থলী বহু রোগের আকর। মহানবী (সা.) বলেছেন, মানুষ পেট থেকে অধিক নিকৃষ্ট কোনো পাত্র পূর্ণ করে না। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৩৮০)</p> <p>উদরপূর্তি করে খেলে যদি রোগ সৃষ্টি হয়, তবে অবশ্যই পেট খালি রাখা রোগ থেকে মুক্তি লাভের কারণ হবে।</p> <p><strong>৩. ধৈর্য ও দৃঢ়তা : </strong>রোজা রাখলে মানুষের ভেতর ধৈর্য ও দৃঢ়তা তৈরি হয়, যা মনুষ্যত্ব বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোজাদারের সামনে বাহারি রকম সুস্বাদু ও উপাদেয় খাবার উপস্থিত থাকার পরও সে সেদিকে চোখ তুলে তাকায় না। সে তা করে না কেবল আল্লাহর ভয়ে। রোজা মানুষের প্রত্যয়, দৃঢ়তা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে দেয় বলেই রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তির সামর্থ্য আছে, সে যেন বিয়ে করে নেয়। কেননা বিয়ে চোখকে অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানকে সংযত করে। আর যার সামর্থ্য নেই, সে যেন রোজা পালন করে। রোজা তার প্রবৃত্তিকে দমন করে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০৫)</p> <p>অন্য হাদিসে এসেছে, প্রতিটি জিনিসের জাকাত আছে। রোজা হলো শরীরের জাকাত। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৭৪৫)</p> <p><strong>৪. দুর্যোগ ও দুর্দিনের প্রস্তুতি :</strong> মানুষের জীবন সব সময় সমান যায় না। কখনো কখনো জীবনে যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ভিক্ষের মতো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। তখন অনাহারে দিন কাটানোর প্রয়োজন হয়। দীর্ঘ এক মাসের রোজা ব্যক্তিকে ক্ষুধা ও পিপাসায় অবিচল থেকে পরিস্থিতি মোকাবেলার সুযোগ করে দেয়।</p> <p><strong>৫. নিয়ামতের মূল্য বোঝা : </strong>মানুষ অভাবে না পড়লে সুদিনের এবং অসুস্থ না হলে সুস্থতার মূল্য বোঝে না। প্রবাদ রয়েছে, প্রত্যেক জিনিস চেনা যায় তার বিপরীত জিনিস দ্বারা। রোজাদার ব্যক্তি যখন খাদ্য-পানীয় থেকে দূরে থাকে তখন সে বুঝতে পারে খাদ্য ও পানীয় আল্লাহর কত বড় অনুগ্রহ। মহানবী (সা.) বলেন, আমার প্রতিপালক আমার কাছে মক্কার বাতহা (কংকরময়) এলাকা আমার জন্য স্বর্ণে পরিণত করার প্রস্তাব করেন। আমি বললাম, হে আমার প্রতিপালক! প্রয়োজন নেই, বরং আমি এক দিন তৃপ্তির সঙ্গে খাব আর এক দিন ক্ষুধার্ত থাকব। যখন ক্ষুধার্ত থাকব তখন বিনীতভাবে তোমার নিকটে প্রার্থনা করব, তোমাকেই মনে করব এবং যখন তৃপ্তির সঙ্গে খাব, তখন তোমার শুকরিয়া আদায় করব এবং তোমার প্রশংসা করব। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৩৪৭)</p> <p><strong>৬. ক্ষুধা ও পিপাসার যন্ত্রণা বোঝা :</strong> রোজা রাখলে ব্যক্তি তীব্র ক্ষুধা ও পিপাসার যন্ত্রণা অনুভব করতে পারে। ফলে অসহায় মানুষের প্রতি তার মনে দয়া ও সহানুভূতি তৈরি হয় এবং তার ভেতর সাহায্য-সহযোগিতার মানসিকতা তৈরি হয়। তখন ব্যক্তির কাছে জাকাত-ফিতরাকে আর্থিক জরিমানা বলে মনে হয় না। সিরাতের বইগুলোতে লেখা হয়েছে, শেষ জীবনে যুদ্ধলব্ধ সম্পদের কারণে মহানবী (সা.)-এর অভাব-অনটন কমে যায়। তখন তিনি বেশি বেশি রোজা রাখতে আরম্ভ করেন। এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, কেননা অভাবের সময় ভুলে না যাই।</p> <p><strong>৭. আল্লাহর কাছে চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ : </strong>রোজা রাখার মাধ্যমে ব্যক্তি আল্লাহর দরবারে চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ করে। কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে না, তবু ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে পানাহার ও জৈবিক চাহিদা থেকে দূরে থাকে। যেন সে ঘোষণা করে, ‘আমরা শুনেছি এবং পালন করেছি! হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা তোমার কাছে ক্ষমা চাই আর প্রত্যাবর্তন তোমারই কাছে।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৮৫)</p> <p>রমজানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে পূর্বসূরি আলেমরা সর্বাত্মক চেষ্টা-সাধনা করতেন। তাঁরা সারা দিন রোজা রাখতেন আর রাত জেগে জিকির, মুরাকাবা, নামাজ ও তিলাওয়াত করতেন। তাঁরা চেষ্টা করতেন রমজানের প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকতে। আল্লাহ আমাদেরও ইবাদতমুখর রমজান কাটানোর তাওফিক দিন। আমিন।</p> <p><strong><em>দারুল উলুম দেওবন্দের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রবন্ধের ভাষান্তর করেছেন মো. আবদুল মজিদ মোল্লা</em></strong></p> <p> </p>