<p>বিজয়ের সমার্থক শব্দ হলো জয়, সাফল্য, সাহায্য, মুক্তি, সমর্থন ও কর্তৃত্ব লাভ। এর আরবি প্রতিশব্দ হলো ‘ফাতহুন’, ‘নাসরুন’। ইংরেজিতে বলা হয় Victory. এর বিপরীত শব্দ হলো পরাজয়, অধীনতা, পরাধীনতা। যেকোনো জরাব্যাধি, দুঃখ-কষ্ট, শোষণ, বঞ্চনা, ক্ষতি থেকে মুক্তি পাওয়া অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ইসলামে বিজয়ের দুটি রূপ খুব স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।</p> <p>এক. স্বার্থ ও সাম্রাজ্যবাদী বিজয়ের রূপ।</p> <p>দুই. কল্যাণকামী ও আদর্শবাদী বিজয়ের রূপ।</p> <p>স্বার্থ ও সাম্রাজ্যবাদী বিজয় যত দেশে হয়েছে, সেখানে কত জনপদ তছনছ হয়েছে, কত মানুষের রক্ত প্রবাহিত হয়েছে, কত নারীর সম্ভ্রম ভূলুণ্ঠিত হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ইতিহাস সাক্ষী, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যখন কোনো বিপ্লব সাধিত হয়েছে, তখন সেখানে রক্তের বন্যা বয়ে গেছে। লাখ লাখ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। রাশিয়ায় ১৯১৭ সালের অক্টোবরে বলশেভিক বিপ্লবের সময় জার সরকারের কুকুরটিকেও হত্যা করেছিল বলশেভিকরা। এ ছাড়া স্বার্থান্বেষী ও সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা পৃথিবীতে যখনই কোনো বিপ্লব সাধিত হয়েছে, তখন বন্যার স্রোতের মতোই অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে বিজয় উৎসব পালন করা হয়েছে।</p> <p>শুধু বিপ্লবের নায়ককেই নয়, তার স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি এবং নিকটাত্মীয়দেরও প্রচার মাধ্যমে প্রদর্শন করে  তাদের গুণকীর্তন করা হয়েছে। স্বার্থ ও সাম্রাজ্যবাদীদের বিজয়ের মাধ্যমে ব্যক্তিবিশেষের পূজা-অর্চনার পথ প্রশস্ত হয়। ফলে সমাজের জ্ঞানী, গুণী ও সম্মানিত ব্যক্তিরা প্রকৃতপক্ষে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়। বিজয়ের এ রূপ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রাজা-বাদশাহ যখন কোনো জনপদে প্রবেশ করে তখন তা বিপর্যস্ত করে এবং সেখানকার মর্যাদাবান লোকদের অপদস্ত করে।’ (সুরা : নামল, আয়াত : ৩৪)</p> <p>বিজয়ের দ্বিতীয় রূপ তথা কল্যাণকামী ও আদর্শবাদী বিজয়। এ ধরনের বিজয় হচ্ছে সত্য ও আদর্শের বিজয়। মানবজাতি, মানবতা ও সভ্যতার বিজয়। বিজয়ের সর্বজনীন ও কল্যাণকর রূপটিই মুসলিম জাতির আদর্শ ও মননে। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সহচরদের বিজয় উদযাপনের ক্ষেত্রে বিশ্ববাসী বিজয়ের এ রূপটিই প্রত্যক্ষ করেছে। মহানবী (সা.)-এর মক্কা বিজয় ছিল দুনিয়া কাঁপানো বিপ্লবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিপ্লব, শ্রেষ্ঠ বিজয়।</p> <p>ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম মহানবী (সা.)-এর মক্কা বিজয় সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এ ছিল সে মহা বিজয়, যার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর দ্বিন, তাঁর রাসুল (সা.)-কে তাঁর সৈন্য সম্পদকে এবং তাঁর আমানত রক্ষাকারী দলকে ইজ্জত দান করেছেন এবং স্বীয় শহর ও স্বীয় ঘরকে বিশ্ববাসীর জন্য হিদায়াতের কেন্দ্রের মর্যাদায় ভূষিত করেছেন, কাফির ও মুশরিকদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করেছেন। এ বিজয়ে আসমানবাসীদের অন্তরেও খুশির ঢল নেমেছিল এবং তাদের মান-ইজ্জতের রশ্মিগুলো আকাশের চূড়ার কাঁধের ওপর বিস্তৃতি লাভ করেছিল, যার ফলে মানুষ দলে দলে আল্লার দ্বিনে প্রবেশ করতে লাগল এবং পৃথিবীর মুখমণ্ডল আলোর ঝলকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠল। (আর-রাহীকুল মুখতুম, পৃষ্ঠা ৪৫২)</p> <p>কিন্তু মহানবী (সা.)-এর  বিজয় উদযাপনে আত্মপ্রচার, বিজয়ের গৌরব ও অহংকারের চিহ্ন কোথাও ছিল না। ছিল শুধু নম্রতা ও আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। মক্কা বিজয়ের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) ৯ জন দাগী অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেও শেষ পর্যন্ত পাঁচজনকে মাফ করে দিয়েছিলেন। বিজয়ের এ রূপ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর এদের পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠান দান করলে এরা সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, জাকাত আদায় করবে, সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে, আর কর্মের পরিণাম আল্লাহর ইচ্ছাধীন।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৪১)</p> <p>ইসলাম ধর্মে বিজয় উদযাপনের  যে সুনির্দিষ্ট ও শাশ্বত নীতিমালা আছে, তা বাস্তবসম্মত ও কল্যাণকর। মহানবী (সা.)-এর নেতৃত্বে মক্কা বিজয় ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল বিজয়। এ বিজয় উদযাপন পদ্ধতি মানবজাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ পাথেয় ও নিদর্শক হতে পারে। মক্কা বিজয়ের দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) কোনো ধরনের প্রতিশোধ নেননি। বরং কৃতজ্ঞতায় তার শির নুইয়ে পড়ল মহান রবের দরবারে। তিনি বিজয়োত্তর আট রাকাত শোকরানা সালাত আদায় করলেন। প্রাণের শত্রুদের হাতের মুঠোয় পেয়েও তিনি ক্ষমা করে দিলেন। ঘোষণা করলেন শাশ্বত বিজয়বাণী : ‘আজ তোমাদের প্রতি কোনো প্রতিশোধ নেই। যাও, তোমরা সবাই মুক্ত।’</p> <p>বিজয় উদযাপনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা পবিত্র কোরআনুল কারিমের সুরা আন নাসরে এসেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে এবং দলে দলে মানুষকে আল্লাহর দ্বিনে (ইসলামে) প্রবেশ করতে দেখবেন, তখন আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করবেন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। নিশ্চয়ই তিনি তাওবা কবুলকারী।’ (সুরা : নাসর, আয়াত : ১-৩)  </p> <p>উপরোক্ত আয়াতগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে বিজয় উদযাপনের শাশ্বত যে বিধান পাওয়া যায়, তা হলো :</p> <p><strong>১. বিজয়কে আল্লাহর দিকে সম্পর্কিত করা : </strong>বিজয় মহান স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। এ নিয়ামত সব  জাতি ও গোষ্ঠীর ভাগ্যে জোটে না। শুধু শক্তিমত্তা, জনবল, বাহুবল কিংবা অস্ত্রবলে বিজয় অর্জিত হয় না। এর জন্য প্রয়োজন স্রষ্টার ইচ্ছা ও  সাহায্য।</p> <p><strong>২. বিজয়ের সুফল সমভাবে ভোগ করা : </strong>সুরা নাসরের দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে, ‘এবং আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বিন ইসলামে প্রবেশ করতে দেখবেন।’ অর্থাৎ বিজয়ের পর ইসলামের বিজয়ী শক্তির কাছে মাথানত করে অথবা ইসলামের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য মানুষরা দলে দলে ছুটে আসবে। তখন তাদের বিমুখ করা যাবে না। কিংবা তিরস্কার করা যাবে না। স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুখ সবাই সমভাবে ভোগ করবে।</p> <p>৩. আল্লাহর পবিত্রতা ও প্রশংসা তথা কৃতজ্ঞতা বর্ণনা করা।</p> <p>৪. যুদ্ধ বা সংগ্রামকালীন সংঘটিত বিচ্যুতি বা সীমা লঙ্ঘনের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা : যুদ্ধ মানেই ধ্বংস বা ক্ষতি। যদিও ইসলামের বিজয় অভিযানগুলো এজাতীয় কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত ছিল। তবু আল্লাহ তাআলা অনিচ্ছাকৃত ভুল-ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনার নির্দেশ দিয়ে সুরা নাসরের তৃতীয় আয়াতের শেষাংশে বলেছেন : ‘এবং তাঁর (আল্লাহর) কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। নিশ্চয়ই তিনি তাওবা কবুলকারী।’</p> <p>সুতরাং বিজয়ী যোদ্ধা বা বিজয়ীপক্ষের উচিত যুদ্ধ বা অভিযানকালীন সংঘটিত ত্রুটি-বিচ্যুতি বা সীমা লঙ্ঘনের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। মহান আল্লাহ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখুন।</p> <p><em>লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট<br /> hasimrda@gmail.com</em></p>