<p>মানবজীবনে বর্তমানে ব্যাংকিং একটি আবশ্যিক অনুষঙ্গ। বিভিন্ন জরুরি প্রয়োজনে এখন ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করতেই হচ্ছে। কিন্তু দেশ-বিদেশের ব্যাংকিংব্যবস্থা সুদের শক্ত ভিতের ওপর চলমান। অথচ আল্লাহ সুদকে হারাম করেছেন। এমন অবস্থা থেকে উত্তরণে মুসলিম স্কলাররা ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে সুদমুক্ত ইসলামিক ব্যাংকিং সেবার ধারণা দিয়েছেন এবং দেশে দেশে তা বাস্তবায়ন করেছেন। তবে সুদ ও ইসলামিক ব্যাংকিং সম্পর্কে এখনো আমাদের অনেকের পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই কিংবা অনেকের আংশিক জানাশোনা আছে।</p> <p>সুদের অনেক ধরনের সংজ্ঞা ও বর্ণনা আছে। আক্ষরিক অর্থে—সুদ হলো ধার করা টাকার মূল্য। ব্যাংকিং অনুশীলনে সুদ হলো ফিন্যানশিয়াল ট্রানজেকশন বা আর্থিক লেনদেন থেকে অর্জিত লাভ। যখন একটি লেনদেনের উভয় পাশের বিনিময়মূল্য একই ধরনের অর্থ অথবা নগদে হয়, তখন আমরা এটিকে ফিন্যানশিয়াল ট্রানজেকশন বা আর্থিক লেনদেন বলতে পারি। যেমন টাকার পরিবর্তে টাকা। একইভাবে টাকার পরিবর্তে লেনদেনের উভয় পাশে একই পণ্য থাকলে, এটিকেও ফিন্যানশিয়াল ট্রানজেকশন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমন—খেজুরের পরিবর্তে খেজুর, লবণের পরিবর্তে লবণ।</p> <p>সুদভিত্তিক ব্যাংকিংয়ে আমানতকারীর কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা এবং পরে তা ফেরত দেওয়ার অনুশীলন হলো ফিন্যানশিয়াল ট্রানজেকশনের একটি রূপ। একইভাবে গ্রাহককে ঋণ দেওয়া এবং তা আদায় করাও ফিন্যানশিয়াল ট্রানজেকশনের একটি পদ্ধতি। এই উভয় ধরনের ফিন্যানশিয়াল ট্রানজেকশন প্রচলিত ব্যাংকগুলো সুদের ভিত্তিতে সম্পাদন করে থাকে। সংজ্ঞা অনুসারে, ফিন্যানশিয়াল ট্রানজেকশনের শর্তযুক্ত বৃদ্ধি হলো সুদ। ইংরেজিতে সুদকে ইন্টারেস্ট বা ইউজারি বলা হয়। কোরআন সুদকে রিবা হিসেবে অভিহিত করেছে এবং এর আদান-প্রদান কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে।</p> <p>উল্লেখ্য, ফিন্যানশিয়াল ট্রানজেকশনের সব দিক ইসলামে নাজায়েজ নয়, বরং ‘করজে হাসানা’ বা কল্যাণমূলক ঋণ আকারে ফিন্যানশিয়াল ট্রানজেকশনকে ইসলাম উৎসাহিত করে, যেখানে ফেরতের সময় কোনো অতিরিক্ত আদান-প্রদানের অনুমতি নেই। অর্থাৎ লেনদেনের উভয় পাশই হবে সমান-সমান। তবে মুনাফা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসলামিক ব্যাংক অর্থায়ন ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ফিন্যানশিয়াল ট্রানজেকশন করলে তা ফলপ্রসূ হয় না। তাই ইসলামিক ব্যাংক মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে ফিন্যানশিয়াল ট্রানজেকশনের পরিবর্তে প্রকৃত বা বাস্তবিক লেনদেন করে থাকে।</p> <p>প্রকৃত বা বাস্তবভিত্তিক লেনদেনকে আমরা বলব রিয়াল ট্রানজেকশন, যার অর্থ হলো, যে লেনদেনের উভয় দিকের বিনিময়মূল্য ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির হবে বা বিপরীত প্রকারের হবে, অর্থাৎ উভয় পাশে একই পণ্য হবে না বা টাকার বিপরীতে টাকা হবে না। এক পাশে টাকা হলে অন্য পাশে পণ্য বা সেবা থাকবে। রিয়াল ট্রানজেকশন থেকে প্রাপ্ত লাভকে বৈধ মুনাফা হিসেবে গণ্য করা হয়, যা ইসলামে হালাল করা হয়েছে।</p> <p>ডিপোজিট গ্রহণের দিক থেকে, ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের চলতি হিসাব ফিন্যানশিয়াল ট্রানজেকশনের মতো কাজ করে, যেখানে কোনো অতিরিক্ত প্রদান করা হয় না। তবে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে মুদারাবাভিত্তিক সঞ্চয়ী, ডিপিএস এবং মেয়াদি হিসাব পরিচালনা করা ফিন্যানশিয়াল ট্রানজেকশনের সমতুল্য হিসেবে বিবেচিত হয় না। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকরা বিভিন্ন ধরনের হিসাবে টাকা জমা করার মাধ্যমে তা ব্যাংকের ব্যবসায় বিনিয়োগ করে। ব্যাংক রিয়াল ট্রানজেকশনের মাধ্যমে সে টাকা পুনরর্থায়ন ও পুনর্বিনিয়োগ করে এবং অর্জিত মুনাফা একটি পূর্বসম্মত অনুপাত বা ইনকাম শেয়ারিং রেশিও অনুযায়ী ভাগ করে নেয়। যেমন ৭৫:২৫। এই সূত্র অনুযায়ী, গ্রাহক উৎপন্ন মুনাফার ৭৫ শতাংশ এবং ব্যাংক বাকি ২৫ শতাংশ পায়।</p> <p>ইসলামী শরিয়া মেনে চলার কারণে ব্যাংক মুদারাবা গ্রাহককে নির্দিষ্ট রিটার্নের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। যদিও গ্রাহকদের জন্য বর্তমান বাজার হারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মুনাফা অর্জন করতে ইসলামিক ব্যাংকগুলো সচেষ্ট থাকে। প্রচলিত ব্যাংকগুলোর আমানত হিসাবের সুদ তাদের উপার্জনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। ব্যাংকের আয় কম বা বেশি হোক—নির্দিষ্ট হারে সুদ দিতেই হয়। ইসলামিক ব্যাংকের প্রকৃত উপার্জন প্রত্যেক মেয়াদ বা প্রতি মাসে একেক রকম হয়। ফলে মুদারাবাভিত্তিক হিসাবের রিটার্ন সব সময় একই পরিমাণে না-ও হতে পারে।</p> <p>পক্ষান্তরে, ইসলামিক ব্যাংক সংগৃহীত টাকা প্রচলিতভাবে ধার দেয় না, বরং গ্রাহকের জন্য প্রকৃত পণ্য বা সম্পদ ক্রয়ে অর্থায়ন করে এবং বৈধ ব্যবসায় বিনিয়োগ করে, যা পূর্বে রিয়াল ট্রানজেকশন বা প্রকৃত লেনদেন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এখানে ব্যাংক ক্রেতা-বিক্রেতা, ইজারাদাতা, অংশীদার এবং পরিষেবা প্রদানকারী হিসেবে কাজ করে।</p> <p>ক্রেতা-বিক্রেতা হিসেবে ব্যাংক গ্রাহকের কাঙ্ক্ষিত পণ্য বা সম্পদ ক্রয় করে এবং একটি সুনির্দিষ্ট লাভ ধার্য করে আবার তা বিক্রি করে। উপার্জিত এই লাভ সুদ নয়, বরং মুনাফা, যা কোরআন হালাল করেছে। গ্রাহক পরবর্তী সময়ে একসঙ্গে বা কিস্তিতে মুনাফাসহ মোট মূল্য পরিশোধ করে।</p> <p>ইজারাদাতা হিসাবে ব্যাংক প্রাথমিকভাবে কোনো ভাড়াযোগ্য সম্পত্তির যৌথ মালিকানা অর্জন করে এবং ভাড়ার বিপরীতে তা গ্রাহকের কাছে হস্তান্তর করে। একই সময়ে ব্যাংক সম্পদে তার নিজের অংশ কেনার জন্য গ্রাহককে প্রস্তাব দেয়। গ্রাহক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কিস্তিতে সম্পদের মোট মূল্য এবং নির্ধারিত ভাড়া পরিশোধ করে। এর মাধ্যমে ব্যাংকের আয় হয় ভাড়া, যা সুদ নয়।</p> <p>অংশীদার হিসাবে, ব্যাংক গ্রাহকের ব্যবসায় ইকুইটি প্রদান করে এবং উৎপন্ন লাভ ভাগাভাগি করে নেয়। এ ছাড়া ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের সুবিধা ও সেবা প্রদানের বিপরীতে ফি এবং কমিশন উপার্জন করে। এভাবে একটি ইসলামিক ব্যাংক সব শ্রেণির গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করতে পারে।</p> <p>সংক্ষিপ্ত সংলাপে বর্ণনা করা হয়েছে যে ব্যাংকিং অনুশীলনে প্রধানত দুই ধরনের লেনদেন হয়—ফিন্যানশিয়াল ট্রানজেকশন ও রিয়াল ট্রানজেকশন। রিয়াল ট্রানজেকশন মুনাফা উৎপাদন করে, যা অনুমোদিত ও হালাল। আর ফিন্যানশিয়াল ট্রানজেকশন সুদ উৎপন্ন করে, যা নিষিদ্ধ বা হারাম। সুদ পরিহার করে বৈধ মুনাফা অর্জনের জন্য ইসলামিক ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের রিয়াল ট্রানজেকশন করে থাকে।</p> <p>এ ধারণা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাংকিং ছাড়াও অন্য লেনদেনে সুদ পরিহার করে চলতে পারি।</p>