<p>শায়খুল হাদিস জাকারিয়া (রহ.) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর ক্ষণজন্মা আলেমদের অন্যতম। ভারতবর্ষে হাদিস ও ফিকহ চর্চায় উজ্জ্বল তারকা ছিলেন তিনি। তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) ছিলেন তাঁর আপন চাচা। মাওলানা জাকারিয়া (রহ.) মুসলিম বিশ্বে বহুল পঠিত ‘ফাজায়েলে আমাল’সহ হাদিসের বেশ কয়েকটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছেন। ফাজায়েলে আমালের মতো গ্রন্থ রচনা করায় তাঁকে তাবলিগের নেসাবপ্রণেতা বা পাঠক্রম রচয়িতা বলা হয়।</p> <p><strong>জন্ম ও পড়াশোনা</strong> : মুহাম্মদ জাকারিয়া ১৮৯৮ সালে ভারতের উত্তরপ্রদেশের কান্দলায় সম্ভ্রান্ত দ্বিনি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা বিখ্যাত মুহাদ্দিস মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া (রহ.)। বাবার নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও কঠোর বিধি-নিষেধের মধ্যে বেড়ে ওঠেন তিনি। দ্বিনদারি, ইলমচর্চাসহ ইবাদত-বন্দেগিতে নিমগ্নতা ছিল সম্ভ্রান্ত এই বংশের প্রধান বৈশিষ্ট্য। শৈশবেই পবিত্র কোরআন হিফজ করা ছিল তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য। শৈশবে বাবার অনুশাসন ও পড়াশোনা নিয়ে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আপবিতি’-কে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন। গাঙ্গুহে পিতার মাদরাসায় ১০ বছর প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করে ১৯১০ সালে তিনি মাজাহিরুল উলুম সাহারানপুর মাদরাসায় ভর্তি হন। এখানে পাঁচ বছর থাকা অবস্থায় দরসে নিজামির সব কিতাব তিনি পড়ে ফেলেন। এ সময় পিতার তত্ত্বাবধানে হাদিসের প্রসিদ্ধ ছয়টি গ্রন্থ পড়েন। পাশাপাশি জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিস মাওলানা খলিল আহমেদ সাহারানপুরি (রহ.), মাওলানা ইলিয়াস (রহ), মাওলানা জাফর আহমদ উসমানি (রহ.)-এর কাছেও হাদিসের গ্রন্থগুলোর পাঠ গ্রহণ করেন।</p> <p><strong>কর্মজীবন </strong>: ১৩৩৫ হিজরি মোতাবেক ১৯১৫ সালে সাহারানপুর মাদরাসায় পড়শোনা শেষ করে সেখানেই শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। শিক্ষকদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে কম বয়সী। ১৩৮৮ হিজরি মোতাবেক ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৫৩ বছর তিনি শিক্ষকতা করেন। এই সময় তিনি কোনো পারিশ্রমিক গ্রহণ করেননি।</p> <p><strong>জ্ঞান সাধনার উপমা</strong> : মাওলানা জাকারিয়া (রহ.) ছিলেন ইলম অর্জনের উপমাতুল্য ব্যক্তিত্ব। মাত্র এক-দুই ঘণ্টা ঘুমিয়ে রাত-দিন ইলমচর্চায় ব্যস্ত থাকতেন তিনি। তা ছাড়া সময়ের যথাযথ ব্যবহারে তিনি খুবই যত্নশীল ছিলেন। তিনি খেলাধুলা, আনন্দ-বিনোদন বা এই ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতেন। তবে তিনি কাব্য প্রতিযোগিতায় ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী।</p> <p><strong>রচনাবলি</strong> : মাওলানা জাকারিয়া (রহ.) হাদিস ও ফিকহ চর্চার পাশাপাশি কিছু অনবদ্য গ্রন্থ রচনা করেন। ছাত্র অবস্থায় তিনি তিন খণ্ডের ‘আলফিয়াতুল হাদিস’-সহ ৩০টির বেশি গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো, তাবলিগ জামাতের বহুল পঠিত ফাজায়েলে আমাল, মুয়াত্তা মালিকের ব্যাখ্যাগ্রন্থ আওজাজুল মাসালিক (আরবি), শামায়েলে তিরমিজি-এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ খাসায়েলে নবুওয়াহ (উর্দু), লামিউদ দারারি আলা জামিউল বুখারি, হাজ্জাতুল উইদা ওয়া ওমরাতিন নবি ইত্যাদি।</p> <p><strong>পারিবারিক জীবন </strong>: পিতার মৃত্যুর পর অসুস্থ মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ করে মাওলানা রউফুল হাসানের মেয়ের সঙ্গে মাওলানা জাকারিয়া (রহ.)-এর বিয়ে হয়। বিয়ের পর ১৩৩৫ হিজরিতে তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। এরপর ১৩৫৫ হিজরিতে দীর্ঘদিন সংসারিক জীবনযাপনের পর তাঁর স্ত্রী মারা যান। এরপর ১৩৫৬ হিজরিতে চাচা মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর মেয়ে ইউসুফ (রহ.)-এর বোন আতিয়্যাহর সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ে হয়। </p> <p><strong>মদিনায় গমন</strong> : ১৩৩৮ হিজরিতে মাওলানা খলিল আহমদ সাহারানপুরি (রহ.)-এর সফরসঙ্গী হয়ে প্রথমবার হজ পালন করেন। এরপর আরো অনেকবার তিনি পবিত্র হজ পালন করেন। সর্বশেষ তিনি ১৪০২ হিজরি মোতাবেক ১৯৮২ সালে মদিনায় এসে মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করেন। </p> <p>ইন্তেকাল : ১৯৮২ সালের ২৮ মে সৌদি আরবের মদিনা নগরীতে ইন্তেকাল করেন। সেখানের জান্নাতুল বাকিতে নিজ শিক্ষক ও পীর আল্লামা খলিল আহমদ সাহরানপুরি (রহ.)-এর পাশে দাফন করা হয়। তাঁর জানাজা পড়ান মসজিদ-ই-নববীর ইমাম আবদুল্লাহ জাহিম।</p> <p>সূত্র : সাইয়েদ আবুল হাসান নদবি (রহ.) লিখিত ‘মুহাম্মদ জাকারিয়া আল-কান্দলবি ওয়া মাআসিরুহু আল-ইলমিয়্যাহ’</p>