<p>অধস্তন আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও ছুটি) এবং শৃঙ্খলার দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ চ্যালেঞ্জ হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়েছে। বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশনাও চাওয়া হয়েছে এই রিটে।</p> <p>১০ আইনজীবীর পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির রবিবার এই রিট করেন। ১০ আবেদনকারী হলেন- মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন, মো. আসাদ উদ্দিন, মো. মুজাহিদুল ইসলাম, মো. জহিরুর ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান, শাইখ মাহাদী, আবদুল্লাহ সাদিক, মো. মিজানুল হক, আমিনুল ইসলাম শাকিল এবং যায়েদ বিন আমজাদ। ১১৬ অনুচ্ছেদের পাশাপাশি ২০১৭ সালে প্রণীত অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ বিধির বৈধতাও রিটে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে।  </p> <p>সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে অধস্তন আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও ছুটি) এবং শৃঙ্খলার দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করার বিধান কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, মর্মে রুল চেয়েছেন রিট আবেদনকারীরা। আইন সচিব ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিষ্ট্রারকে বিবাদী করা হয়েছে রিটে।</p> <p>আইনজীবী শিশির মনির কালের কণ্ঠকে বলেন, আগামী সপ্তাহে বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি শশাঙ্ক শেখর সরকারের হাইকোর্ট বেঞ্চে রিট আবেদনটির শুনানি হতে পারে।</p> <p><strong>ফিরে দেখা</strong></p> <p>মাসদার হোসেন মামলার চূড়ান্ত শুনানি করে ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করতে ঐতিহাসিক এক রায় দেন। ওই রায়ে সর্বোচ্চ আদালত বিসিএস (বিচার) ক্যাডারকে সংবিধান পরিপন্থি ও বাতিল ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে জুডিশিয়াল সার্ভিসকে স্বতন্ত্র সার্ভিস ঘোষণা করা হয়। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার জন্য সরকারকে ১২ দফা নির্দেশনা দেন আপিল বিভাগ।</p> <p>মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। পরে ২০১৬ সালের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালার একটি খসড়া প্রস্তুত করে সুপ্রিম কোর্টে পাঠায়। সরকারের খসড়াটি ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার অনুরূপ হওয়ায় তা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থি বলে ওই বছর ২৮ আগাস্ট শুনানিতে বলেন আপিল বিভাগ। এরপর ওই খসড়া সংশোধন করে সুপ্রিম কোর্ট আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেইসঙ্গে তা চূড়ান্ত করে প্রতিবেদন আকারে আদালতে উপস্থাপন করতে বলা হয় আইন মন্ত্রণালয়কে। এরপর দফায় দফায় সময় দেওয়া হলেও সরকারের সঙ্গে আদালতের মতপার্থক্যের কারণে ওই বিধিমালা গেজেট প্রকাশের বিষয়টি ঝুলে থাকে। আইন ও বিচার বিভাগ থেকে এর আগে শৃঙ্খলা বিধিমালার যে খসড়া সুপ্রিম কোর্টে জমা দেওয়া হয়েছিল, ২০১৭ সালের ৩০ জুলাই তা গ্রহণ না করে কয়েকটি শব্দ ও বিধি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। শৃঙ্খলাবিধির সেই খসড়া নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মুখে ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে দেশ ছাড়েন। ছুটি শেষে ১০ নভেম্বর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। এরপর ১৬ নভেম্বর দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞার সঙ্গে বৈঠক করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ওই খসড়া নিয়ে মতপার্থক্য দূর হয়েছে। পরে ১১ ডিসেম্বর গেজেট প্রকাশ করে সরকার।</p> <p><strong>রিট যা বলা হয়েছে</strong></p> <p>১৯৭২ সালের সংবিধানে অধস্তন আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধানের এই দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত ছিল। ১৯৭৪ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যাস্ত করা হয়। ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আনা হয়। এই সংশোধনীতে অধস্তন আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির কাছে রাখলেও ‘সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। ২০১০ সালে পঞ্চম সংশোধনী অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন সর্বোচ্চ আদালত। পরে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধন আইনের মাধ্যমে সংবিধানের বেশ কিছু অুনচ্ছেদে পরিবর্তন আনলেও ১১৬ অনুচ্ছেদ আগের মতই রাখা হয়। এই অনুচ্ছেদে বলা আছে- ‘বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল- নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরীসহ) ও শৃংখলাবিধান রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রীম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে।’ পঞ্চম সংশোধনীতেও তাই ছিল।</p> <p>রিটে বলা হয়েছে, সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে ‘অধস্তন আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের সরাসরি হস্তক্ষেপ দেখা যায়, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করে।</p> <p>রিটে আরও বলা হয়েছে, সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে। পঞ্চম সংশোধনী অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১১৬ অনুচ্ছেদে পঞ্চম সংশোধনীর বিধানই বহাল রাখা হয়েছে, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আইনের শাসনের পরিপন্থি।</p> <p>রিটে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। ১১৬ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে এই মৌলিক কাঠামো বিনষ্ট করা হয়েছে। একইসঙ্গে অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধির বাস্তবায়ন কার্যত আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে।</p> <p>তাছাড়া আলাদা সচিবালয় না থাকায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। অধস্তন আদালতের ওপর আইন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণের কারণে বিচার বিভাগের কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে বিচারকাজ পরিচালনা করতে পারছেন না।</p>