<p class="ByName" style="text-align:justify"><span style="font-size:22px;"><strong><span style="line-height:18pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-family:SolaimanLipi">অনুবাদ : দুলাল আল মনসুর</span></span></span></span></strong></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">এক রবিবারের পড়ন্ত বিকেল। শহরের রাস্তার মোড়ের মূর্তিগুলোর লম্বা ছায়া পড়েছে নিচে। উপশহরের পরিত্যক্ত রাস্তার উঁচু হয়ে থাকা অ্যাসফল্ট থেকে তামাটে আভা ছড়িয়ে পড়ছে। ক্যাফের ভেতর থেকে বের হয়ে আসা শব্দ বলতে আছে শুধু ভেন্টিলেটরের গুঞ্জন আর থেকে থেকে শোনা ঝনঝন শব্দ। একজনের দৃষ্টি উঠে যায় সাদামাটা একটা গাছের ডালের দিকে, যেন নিচে কেউ দাঁড়িয়ে অসংখ্য বীজাধারের অবিরাম দোল খাওয়া দেখছে। বড় বড় লতিযুক্ত লম্বা পাতাগুলো একসঙ্গে, তবে অনিয়মিত বিরতিতে সংকেতের মতো নড়াচড়া করছে। পাতাগুলো এদিক-ওদিক নড়াচড়া করার ফলে মনে হচ্ছে, গাঢ় হলুদ সূর্যালোক পাতার মধ্যে পাখির বাসার মতো দুলছে। গাছের এবড়োখেবড়ো দাগভরা কাণ্ড যেখানে দুভাগ হয়ে গেছে, সেখানে গর্তের খোঁড়লে নিশ্চয়ই কোনো জন্তুর আবাস।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">আরেকটা দৃষ্টি চলে যায় দ্রুত বয়ে যাওয়া নদীর দিকে। পার থেকে দেখা যায়, সূর্যের আলো পানির ভেতর দিয়ে একেবারে তলদেশে পৌঁছে গেছে। একটা লম্বা মাছ দেখা যায়; মাছটার গায়ের রং নিচ দিয়ে স্রোতের সঙ্গে বয়ে চলা নুড়ির মতো হালকা ধূসর। একই সময় সূর্যের আলো পৌঁছে যায় বেইসমেন্ট রুমের দেয়াল পর্যন্ত; ছবিহীন উপরিভাগের পুরোটাই ভরে যায় আলোয় আলোয়। দেয়ালের সাদা রংটা সূর্যের আলোর ছটায় পাকা শস্যের রং ধারণ করে। রুমটা কেউ ফেলে গেছে কিংবা কেউ থাকেই না</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">তেমন নয়; বরং দৃষ্টির সমান উচ্চতা থেকে দেখা যায় উড়ে যাওয়া পাখি, মাঝে মাঝে রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া মানুষজন আর সর্বোপরি সাইকেল আরোহীদের কালো ছায়া; এরাই হলো রুমটার বাসিন্দা। একই রকমভাবে দৃষ্টিসীমার ওই রকম উচ্চতা থেকে দেখা যায়, দিগন্তের একেবারে পূর্ব প্রান্তের পর্বত রঞ্জিত হয়ে উঠছে সূর্যের শেষ আভায়। ছবিটা আরো কাছে চলে আসে : পর্বতের গোলাকার ওপরের প্রান্তে খাড়া চূড়াটাকে আরো স্পষ্ট দেখা যায়। চূড়ার খাড়া মাথা, চিমনি আর চকচকে দেয়াল দেখে অপ্রবেশ্য প্রাসাদের কথা মনে আসতে পারে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">সূর্য ডুবে গেছে। এখানে-ওখানে কোনো বাড়িতে দু-একটা আলো দেখা যাচ্ছে। বেইসমেন্ট রুমের ফাঁকা দেয়ালে হলুদ আকাশের প্রতিবিম্বের ওপরে আড়াআড়িভাবে কয়েকটা নকশা পড়েছে; নকশার রেখাগুলো এখন মুছে গেছে। দেয়ালটা এখন পুরোপুরিই ফাঁকা বলে ছোট ক্যালেন্ডারের গাঢ় লাল সংখ্যাগুলো ছবির মধ্যে ঢুকে পড়ছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">একটা পার্কের পাশে প্রাসাদের মতো উনিশ শতকীয় একটা ভবন দেখা যাচ্ছে; লম্বা উঁচু সব জানালা। জানালাগুলোর ওপরে আছে ত্রিকোণাকার টিমপানা। আর ছাঁইচগুলোর নিচেই রয়েছে কয়েক শ চিলেকোঠা জানালা; এগুলো ভবনের চারপাশে ছড়ানো। ভবনটার বিশালত্ব পার্কটাকে ছোট করে ফেলেছে। গাছপালা, পায়ে চলা পথ এবং বেঞ্চগুলোর চেহারায় উল্লেখ করার মতো কিছু নেই। শুধু বার্চগাছের হঠাৎ থেমে যাওয়া একটা এভিনিউ এবং পিলারের মতো ডালওয়ালা একটা গাছ অতীতের কোনো কিংবদন্তির নৈকট্য প্রকাশ করছে। গাছটার অবস্থান দেখে মনে হয়, এটা একটা বেঞ্চের মাঝখান থেকে ওপরে উঠে গেছে। রবিবারের বিকেল বলে প্রাসাদোপম অট্টালিকার দুই পাশের এক্সপ্রেসওয়েতে আজ ট্রাক চলছে না, চলছে সব প্রাইভেট কার। অট্টালিকার চারপাশে ছড়ানো-ছিটানো বাড়িগুলোকে বড়জোর কুঁড়ের চেয়ে একটু বড় মনে হচ্ছে; বাড়িগুলোর তুলনায় অট্টালিকার জানালাগুলোতে অনেক বেশি আলো দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, প্রতি তলায় বিরাট কোনো অনুষ্ঠান চলছে। আর খোলা ডাবল দরজাগুলো দিয়ে অনুষ্ঠানের আলো ছড়িয়ে পড়ছে এক হল থেকে আরেক হলে। তবে এই বিশাল বাড়িটা হলো বয়স্ক মানুষদের, কিংবা প্রবেশপথের লেখা থেকে যেমন বোঝা যায়, এটা হলো বয়স্কদের স্বাস্থ্যনিবাস। সারি সারি জানালার আয়তাকার অবয়ব থেকে বোঝা যাচ্ছে, রুমগুলো আলাদা। কোনো কোনো রুমে পর্দাহীন কাচের পেছনে বাসিন্দাদের কালো ছায়ার মতো উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে, তবে সব সময়ই অনড় ও চুপচাপ; এবং অবশ্যই তারা বাইরের কাউকে দেখতে পাচ্ছে না মনে হয়। অন্য জানালাগুলো খোলা। সিলিংয়ের উজ্জ্বল আলোতেও বোঝা যাচ্ছে, রুমগুলো ফাঁকা, পরিত্যক্ত; শুধু টবের গাছ আর পাখির খাঁচাগুলো চোখে পড়ছে। এমনকি টেলিভিশন সেটগুলো থেকে আলোর ছটাও শূন্য দেয়াল ভেদ করে লাফিয়ে বের হচ্ছে ঠিকই, তবে অন্য কোনো চিত্র রং বদলাচ্ছে না, নিজেদের রংই দিচ্ছে বদলে। ইলেকট্রিক আয়রন থেকে আসা শব্দ আর নীরব হয়ে যাওয়ার পরের ঝনঝন শব্দ আসছে একটা রুম থেকে। চিলেকোঠার জানালা থেকে বের করা মাথাটা একটা অল্পবয়সী যুবকের; সে এখানকার নিয়মিত বাসিন্দা নয়। তার চাহনি কোনো গোয়েন্দা কিংবা বিজ্ঞানীর সর্বদ্রষ্টা চাহনির মতো। উৎসবের আলোয় আলোকিত অট্টালিকার এই অংশের একমাত্র হাসির শব্দ হলো টেলিভিশনের পর্দার দর্শকদের। নিয়মিত সমান বিরতিতে শোনা যাচ্ছে এই শব্দ, মনে হচ্ছে কারো হুকুম মেনে হাসছে তারা। স্বাভাবিক গানের শব্দ আসছে রান্নাঘরের কাজের মেয়ের কণ্ঠ থেকে; সাদা টাইলসের বেইসমেন্টে সে একটা বিশাল টিনের পাত্রের ঢাকনা তোলার সময় গাইছে। আসলে তার এই গুনগুন শব্দ অতি সংক্ষিপ্ত একঘেয়ে সুরের একটু অংশমাত্র, নিজের কণ্ঠের গুণ পরীক্ষা করে দেখছে সে। কাঁকর বিছানো প্রবেশপথটা শেষ হয়েছে একটা নিচু ধাপে এসে, দুই পাশের রেলিংয়ের সঙ্গে জোড়া দিয়ে একটা ব্যারিয়ারের মতো তৈরি করা হয়েছে এটাকে। রেলিংয়ের পিতলের ভিত্তিগুলোই হলুদ আকাশের নিচে একমাত্র উজ্জ্বল স্থান। এ রকম আরেকটা জিনিস হলো এখনো দৃশ্যমান ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা একজনমাত্র বয়স্ক লোকের কনুই রাখার দুটি ক্রাচ।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">আপাত অনালোকিত কয়েকটা রুমের মধ্যে একটা রুমের পেছনের অংশে মোটের ওপর একটা বাতি জ্বলছে। একটা ঢালু ডেস্কের ওপর রাখা হয়েছে বাতিটা। চারপাশের আধা অন্ধকারে রাখা ডেস্কের ওপর উজ্জ্বল আলো পড়ছে এই ছোট বাতিটা থেকে। ডেস্কের ওপরে রাখা আছে একটা খোলা খাতা। খাতার শক্ত মলাট আকারে খানিক বড়, বহুবার মেরামত করা হয়েছে এমন একটা কাটাফাটা মোটা কাপড়ে র‌্যাপ করা হয়েছে খাতাটা। খাতার কাগজে ছাতা পড়া দাগ পড়ে গেছে, যেন এই অবস্থায় পতিত খাতাটার নিজের কোনো কাহিনি আছে, কিংবা মাঝেমধ্যে রোদ-বৃষ্টিতে রাখা হয়েছে এটাকে। আবার এমনও মনে হচ্ছে, যেন সমুদ্রপথে কারো ভ্রমণের সঙ্গী হয়েছে এটা। সারি সারি কলাম সংকেত চিহ্নে ভরে আছে পাতাগুলো, কোনো রহস্যজনক লিপির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। সংকেতগুলোর পাশে পরিষ্কার অফিশিয়াল চেহারার তবে বালকসুলভ হাতে লেখা আছে কিছু শব্দ, মনে হয় অর্থোদ্ধার করার চেষ্টা করা হয়েছে; কারণ কয়েকটার শেষে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেওয়া আছে, যেমন</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">—‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">মনে রাখা</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">রপ্ত করা</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">অস্থায়ী নিবাস গোটানো</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">যাত্রা করা</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">বসা?</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">খোলা নর্দমা?</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">সীমান্তের ওপারের পর্বতচূড়া?</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">জলবিভাজক বাঁধ?</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt"> ইত্যাদি। খাতাটার মাঝ-মলাটের ফাঁকা শিরদাঁড়ার ওপরে একটা ষড়ভুজাকৃতির কালো পেনসিল। লম্বা ও প্রশস্ত ফ্লোরবোর্ডের ওপরে স্পাইরাল নটহোলস আর পলিশড নেইলহেডস দিয়ে সমমুখী দাগ টানা হয়েছে; দাগগুলো কিছুটা দূরত্বে একটা বিন্দুতে মিলিত হওয়ার মতো এগিয়ে গেছে বলে প্রায় ফাঁকা রুমটাকে প্রশস্তই মনে হয়। আর বিশেষ প্রলেপ দেওয়া ডিম্বাকৃতির সিলিংয়ের সাজসজ্জার কারণে রুমটাতে একটা অভিজাত চেহারা এসেছে। ডেস্কটা দাঁড়িয়ে আছে একটা উঁচু করে বাঁধানো অংশে। দেখে মনে হচ্ছে, এটা মধ্যযুগের কোনো পণ্ডিতের পড়ার ঘরের ব্যালকনি। এখানে আর একটিমাত্র আসবাব হলো দেয়ালের কোটরে রাখা একটা ফোল্ডিং বেড; অনুমান করা যেতে পারে, হঠাৎ কোথাও বেরিয়ে পড়ার জন্য এভাবে রাখা হয়েছে। বেডটার খালি অবয়বের ওপরে কম্বলের বদলে একটা স্লিপিং ব্যাগ ছড়িয়ে রাখা হয়েছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt"> মাথার দিকের গোলাকার অবয়বের কারণে জানালায় ধনুকের আকার এসেছে। জানালার নিচে মেঝেতে দুটি ডাম্বেল। এগুলোর ওপরের রং চটা ধরে উঠে যাচ্ছে। আরেকটা জিনিস এখানে আছে</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">আকারহীন একটা ব্যাগ।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">রুমের মধ্যে এখন যাকে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে সে এ বাড়ির বাসিন্দা নয়। সে এই রুমের মালিক। সত্যি, তার হাতে একটা লাঠি ধরা আছে। তবে এটা ক্রাচ নয়, হাঁটার লাঠি। কঠিন শক্ত প্রায় ভাঙা যায় না এমন গোলাপের কাঠ দিয়ে বানানো হয়েছে লাঠিটা। বড় বড় পাখির ধারালো ঠোঁটের মতো কয়েকটা কাঁটা এখনো আছে লাঠিটার গায়ে। একটা হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগতে পারে। মালিক বৃদ্ধ লোকটার ধরার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে, লাঠিটা রাজদণ্ড। বৃদ্ধের ত্বক, ঠোঁট, চুলসহ মুখের সব কিছুই বয়স্ক মানুষের মতো, তবে চোখ দেখে ওপরের তলার চিলেকোঠার জানালার পাশের যুবকের সঙ্গে তার তুলনা হতেই পারে। তার দৃষ্টিসীমায় যা কিছু দেখা যাচ্ছে, যুবক দেখছে সন্দেহ আর কৌতূহল নিয়ে। কিন্তু বৃদ্ধ তার জানালার বাইরের সব কিছুর প্রতি পুরোপুরি উদাসীন। বাতাসে দোল খেতে থাকা ডাল, আকাশের বিমান কিংবা একপাশের প্রবেশপথ দিয়ে ভবনে ঢুকতে থাকা বিনুনি করা জ্যাকেট পরা কফিন বাহকদের শুধু অনুসরণ করছে তার দৃষ্টি; তবে বৃদ্ধ নিরাবেগ। একটা গাছের হঠাৎ বেঁকে যাওয়া ডালের চেহারা হয়েছে রেকাবের মতো। টুলশেডের ঢালু তক্তি ছাদ থেকে পুরনো ধূসর স্লেটের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। তক্তার দেয়াল বেয়ে ওঠা বয়সী ঝোপের সমারন্তাল শাখা দেখতে মইয়ের ধাপের মতো। বৃদ্ধের দৃষ্টি গোধূলির আগমন ঠেকিয়ে রাখতে চাইছে, দৃষ্টির সামনের সব কিছু যেন দিনের আলোয় স্নান করেছে। মাটির নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট সোজা নালার প্রান্তের ছায়ার বর্ধিতাংশ মনে হয় বিশাল কোনো নদীর বাঁক তৈরি করেছে। আরো দূরে দিগন্তে বনভূমির দীর্ঘ সারির গাছপালা আসলে জাহাজের মাস্তুল। আরো কাছে দেখা যাচ্ছে একফালি নো ম্যানস ল্যান্ড; তার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে একটা এক্সপ্রেসওয়ে। গাড়িগুলোর শব্দ শোনা যাচ্ছে না। গাড়িগুলো ব্যস্ত নদীপথের স্পিডবোটে রূপ নিচ্ছে। দিগন্তের সবচেয়ে দূরের জিনিসটা হলো মাস্তুলের জঙ্গলের পেছনের ন্যাড়া পাহাড়। চকের মতো সাদা গির্জাটা হয়ে যাচ্ছে বাতিঘর। পাহাড়ের চূড়া হয়ে যাচ্ছে একটা প্রবালবেষ্টিত দ্বীপ আর চূড়ার সামনের গাছপালার মাথাগুলো হয়ে যচ্ছে বাইরের শৈলশিরা। দূরের দিকে কিছুটা এগিয়ে কিংবা কিছুটা পিছিয়ে দৃষ্টি দিলে দেখা যাচ্ছে, দিগন্তের অন্যখানে অন্য দ্বীপের বন্দরের জেলেদের কুঁড়ের লম্বা সারি সোজা এসে মিশেছে বৃদ্ধ লোকটার জানালায় রাখা হাতের সঙ্গে, মানে বয়স্কদের বাড়ির জানালায়। ওপরের দিকে শূন্য নীলাকাশে একজন প্যারাশুটচারীর কালো রেখা দেখা যাচ্ছে, ধীরে ধীরে চক্রাকারে ঘুরছে, মসৃণ গতিতে এদিক-ওদিক ভেসে বেড়াচ্ছে এবং শেষে ঘুরতে ঘুরতে এসে একটা হালকা পাখার বীজাধারের মতো সত্যি সত্যি নেমে পড়ছে বৃদ্ধের হাতের খোলা তালুতে। প্যারাশুটচারী বীজাধার থেকে ঝুলছে, তার আকার ছোট একটা বলের মতো, একটা জুনিপার বেরির চেয়ে বড় হবে না।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt"><img alt="অনুপস্থিতি" height="416" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/04.April/05-04-2024/EID-2024/1/kk-m-12a.jpg" style="float:left" width="396" />এবার বৃদ্ধকে নড়াচড়া করতে দেখা যাচ্ছে। জানালা থেকে ডেস্ক পর্যন্ত বারবার যাওয়া-আসা করছে। প্রতিবার ডেস্কের কাছে এসে পেনসিলটা হাতে তুলে নিচ্ছে। আপাত নিঃশ্বাস আটকে রেখে কলামের নিচে একটা করে সংকেত যোগ করছে। তারপর বাইরে তাকানোর জন্য জানালার কাছে এসে ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ছেড়ে দিচ্ছে। তাতে মনে হচ্ছে, বাইরে ঘাসের মধ্যে, দারোয়ানের খুপরির তির্যক খাঁজের মধ্যে এবং ভাঁজ করে রাখা হুইলচেয়ারের মধ্যে সর্বশেষ রং ছড়িয়ে দিচ্ছে। অবশ্য বাইরে যা যা চলছে তার সঙ্গে খাতার ভেতরকার সংকেতগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই। বড়জোর সংকেতগুলো পালক লাগানো তীরের প্রতীক হিসেবে কাজ করছে, মানে ডালের প্রান্তের দুভাগ হয়ে যাওয়া, কিংবা বাতাসের ভেতর দিয়ে শাঁ করে ঘুরপাক খাওয়া বোঝানো হচ্ছে। বৃদ্ধ সামনে-পেছনে হাঁটছে লাঠি ছাড়াই। লাঠিটা দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে। তার হাঁটার ভঙ্গিতে পা টানাটানির ভাব নেই, আছে পায়চারির ধরন। এক পা আগে ফেলে অন্য পা দিয়ে তার সামান্য দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য থপথপ করে পা ফেলছে সে, এ রকম পা ফেলার মধ্যে তাচ্ছিল্যের ভাব আছে। হাঁটার জায়গা ছোট হওয়ার কারণে তার এ রকম হাঁটাও দীর্ঘ পদক্ষেপের মতো লাগছে। সংকেতগুলোর সঙ্গে শেষে কয়েকটা শব্দের একটা কলাম যোগ হয়েছে : </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">অংশগ্রহণ</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">উপলক্ষ</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">জমায়েত</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">আলাদা</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">। আপাতত তার দিনের কাজকর্ম শেষ হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। বৃদ্ধ ক্যাপ বেডের ওপরে গিয়ে বসে; তার পরনে একটা ঢিলা স্যুট আর সবগুলো বোতাম লাগানো শার্ট। হাত দুটি হাঁটুর ওপরে রেখে সে টান টান হয়ে বসে। জানালা খোলা। এক্সপ্রেসওয়ে থেকে রবিবার সন্ধ্যার গাড়ি-ঘোড়ার শব্দ গড়িয়ে আসছে ভেতরে। শুধু মাঝেমধ্যে ব্যাকফায়ারের শব্দে গাড়ির শব্দ ঢোকা ব্যাহত হচ্ছে। তারপর শোনা যায় উচ্চৈঃস্বরের চিৎকার; সঙ্গে সঙ্গে কিছু ভেঙে পড়ার শব্দ। সংক্ষিপ্ত নীরবতা ভেঙে যায় ব্যথা-বেদনা, ভয়-বিভীষিকার আর্তনাদ আর সাহায্য প্রার্থনার চিৎকারে। তারপর শুরু হয় শোরগোল, চেঁচামেচি; তার পেছনে শোনা যায় ভ্রুক্ষেপহীন হর্নের আওয়াজ। বাইরের ঘটনাবলির পুরো দৃশ্যই দেখা যায় বৃদ্ধের জানালা থেকে। কিন্তু চুপ করে বসেই থাকে সে, আপাতত মনে হচ্ছে, বাইরের ঘটনার সঙ্গে তার মানসিক কোনো যোগ নেই। দুর্ঘটনার কান্নাকাটি আর বিলাপের মাঝ থেকে হঠাৎ প্রাতিষ্ঠানিক দাফনের বেল বাজতে শুরু করে আপাত কোনো ভিন্ন ব্যক্তির জন্য। এবার সাইরেনের শব্দের সঙ্গে যদিও বাইরের কোলাহল চলতেই থাকে, যদিও বৃদ্ধ তার কুঠরির মধ্যে থেকেই মাথা তোলে শোনার জন্য তবু বোঝা যায়, সব কিছু থেকে তার শ্রবণেন্দ্রিয় ইচ্ছা করেই আরো বেশি বন্ধ করে দিয়েছে। হৈচৈ ছাপিয়ে ধীরে ধীরে শ্রবণের পর্যায়ে চলে আসে পাখির ডাক, সেচের নালার মধ্যে প্রবাহিত পানিধারা; পানির শব্দ মিশে একাকার হয়ে আসছে পার্কের গাছপালার পাতার মর্মর, ছোট পাখির কিচিরমিচির, গাঙচিলের চিৎকার ইত্যাদি। বৃদ্ধ ফোল্ডিং বেডের ওপরে বসে কোমরের ওপরের অংশ সামনে-পেছনে দোলাতে থাকে এবং ঊরুর ওপরে আঙুলের টোকা দিয়ে ছন্দ মেলানো শুরু করে। মাথা পেছনের দিকে হেলিয়ে দিয়ে সে মুখ খোলে। কিন্তু কোনো শব্দ বের হয় না। তার প্রশস্ত নাক ও সামনের দিকে বাড়ানো চোখ দেখে মনে হয়, সে প্রবীণ একজন গায়ক, দীর্ঘদিন হলো নীরব হয়ে গেছে এবং এখন তার গায়কি শুধু শোনা থেকে এবং দেখা থেকে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">পেনসিলটা খাতার ওপরে আলোর ছোট বৃত্তের মধ্যে তির্যকভাবে পড়ে আছে। পেনসিলটার ওপরের অংশে বড় হাতের অক্ষরে লেখা আছে : কাম্বারল্যান্ড। পেনসিলের নিচের লেখার আকার থেকে মনে হচ্ছে, তিনটা ট্রেন সমান্তরাল ট্র্যাকে অপেক্ষা করছে; শব্দগুলো একেকটা গাড়ি আর সংকেতগুলো হলো ইঞ্জিন। যেন ট্রেনগুলোর ছেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিতেই বাঁশি বাজানো হচ্ছে; আসলে অনেক দূর থেকে বাজানো হচ্ছে। এই বাঁশির শব্দ দীর্ঘায়িত হয়ে যাচ্ছে আরেক বাঁশি বাজানোর সুরে, যেটা গোটা ভবনকেই ভরিয়ে দিচ্ছে শব্দতরঙ্গে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">খুব কাছে কোথাও আবারও বাঁশি বাজানো হচ্ছে। আরেকটা জানালা। জানালার পাশ দিয়ে একটা আলোকিত ট্রেন এগিয়ে গিয়ে এখন একটা সেতু পার হয়ে যাচ্ছে। এই জানালাটা বৃদ্ধনিবাসের জানালা নয়। এই জানালাটা আয়তাকার, আরো প্রশস্ত, তবে সে তুলনায় খুব বেশি উঁচু নয়। এই জানালাটার চৌকাঠ নেই। এই রুমের দেয়ালগুলো নানা আকারের ফটোগ্রাফে ঢাকা, কয়েকটা আবার ফ্রেমে বাঁধানো। তবে শুধু ধাতব পাতে নয়, মেহগনি কাঠ কেটে ফ্রেম তৈরি করা হয়েছে। সব ছবি একই ব্যক্তির : ভালো করে শরীরের গঠন তৈরি হয়নি এমন বয়সের, হাঁটা শেখা বয়সের মজবুত গঠনের, কস্টিউম বলে অংশগ্রহণকারী কুইন সাজের এবং শেষের দিকে সৌন্দর্যের প্রতীক রূপে নানা রঙের আলোয় বিচিত্র ভঙ্গিমায়। প্রায় সব ছবিতেই একা। শিশু বয়স থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত সব ছবিতেই তার চাহনির আজ্ঞাপক ভাব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, সে জানে, সে-ই সবার মনোযোগের কেন্দ্রে আছে। দুটি ছাড়া সব ছবির ভেতরই এক অদম্য আত্মবিশ্বাসের প্রতি প্রতারণা করা হয়েছে। মাত্র কয়েকটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সে একজন পুরুষের কাঁধের ওপর মাথা রেখেছে। ওই ছবিগুলোতে তার মুখে ছড়িয়ে আছে সাদাসিধা ও কৃত্রিম ভাব। শুধু একটা ছবিতে তাকে নাজুক ও পরিত্যক্ত মনে হচ্ছে। বাচ্চা বয়সের এই ছবিটাতে তার চুল পিগটেইল করা, পায়ে সাদা মোজা, নার্সারিতে বাংকবেডের পাশে বেতের টেবিলে বসে আছে, মনে হয় কোনো মঞ্চের অংশ; দুপা আড়াআড়ি করে বসা অবস্থায় সামনের দিকে ঝুঁকে আছে শরীররটা, হাত দুটি ভাঁজ করে কোলের ওপর গোটানো, চাহনিতে মনে হচ্ছে, জীবনে এই একবারই সে বিমূঢ় বোধ করছে। একটা কাঠের পেঙ্গুইনের দিকে তাকিয়ে আছে সে। পেঙ্গুইনটা আকারে তার নিজের সমান। পেঙ্গুইনের ঠোঁটে ধরা আছে কাপড় রাখার হ্যাঙ্গার, তাতে লেখা আছে : পোশাকের পরিচারক।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">ছবি দিয়ে একটা দেয়ালকে আয়নার ফ্রেম তৈরি করা হয়েছে; পেছন থেকে বর্তমান চেহারার মহিলাকেই দেখানো হচ্ছে। তার চুলের বিভাজনে একটা বাঁকা লাইন। চুল মনে হচ্ছে ভেজা। সাদা ড্রেসিং গাউন পরে একটা ডেস্কে বসে আছে সে। একটা বড় বাঁধানো খাতার ওপর সামনের দিকে ঝুঁকে আছে; খাতাটা একটা লেজার বইয়ের সমান। সামনের দিক থেকে দেখলে বোঝা যায়, তার আসল মুখটা ছবির চাহনির একেবারে বিপরীত, গোমড়ামুখো এবং বেশ কঠিন। নতমুখ চোখ আর কুঞ্চিত ঠোঁটে সে একটা মোটা ফাউন্টেন কলম দিয়ে লিখে যাচ্ছে। জানালার বাইরের আকাশে সর্বশেষ হলুদ আভা, ডাইনিংয়ের ছোট কোনায় রাখা ফলের ঝুড়ি, আপাত আলোকিত শোবার ঘরের বিশাল বিছানার মাথার কাছে রাখা ফুলের গোছা</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">কোনো কিছুর দিকেই তার নজর নেই। ব্লক লেটারে লিখলেও তার লেখা প্রায় দুর্বোধ্য। কোনো কিছুর বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তার লেখার মিল পাওয়ার মতো হলে সেটা শুধু চীনা লিপিকলা হতে পারে। যা-ই হোক, লেখার সঙ্গে সে নিচু স্বরে কথাও বলছে। তার আঙুলগুলো কালির দাগে ঢাকা পড়ে গেছে, মাঝখানের আঙুলের ওপর একটা অস্বাভাবিক বড় পিণ্ড স্ফীত হয়ে উঠেছে। সে মোটামুটি নিজেকে এভাবে প্রকাশ করছে : </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">“</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">সে বলেছে, ভালোবাসা দেওয়ার বেলায় আমি নাকি একেবারেই অপারগ, অথচ সব সময় ভালোবাসা আদায় করার তালে থাকি। সে বলেছে, আমি নাকি কারো স্ত্রী ছিলাম না, কোনো দিন হতেও পারব না। বলেছে, অস্থিরতার মূর্ত রূপটাই হলাম আমি। আর যার সঙ্গেই থাকি না কেন, তাকে অশান্তি ছাড়া কিছুই দিতে পারব না আমি। আগে হোক পরে হোক, সবচেয়ে শান্ত ব্যক্তির মধ্যেও নাকি ধ্বংসাত্মক তাড়না জাগিয়ে তুলবই আমি। সেই তাড়নার বশবর্তী হয়ে সে মানুষটা বেপরোয়াভাবে অন্যদের হত্যা করার চেষ্টা করবে, অথবা আত্মহত্যা করতে চাইবে; আর আমি নাকি তার মাথার মধ্যে বিশ্বাস ঢুকিয়ে থাকব যে এ রকম বৈশিষ্ট্যই তার আসল পরিচয়। সে বলে, আমি এক শিশুসুলভ জীব, যার ওপর খুশি আমার জাদুমন্ত্র খাটাই এবং আমার শিকারকে শিশুর পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে আসি; আমি নিজে তখন দানবে পরিণত হই এবং আমার থাবা থেকে কেউ রেহাই পায় না। সে বলে, ডাইনি সার্সি ওডিসিউসের সব সঙ্গীকেই শুয়োর বানিয়েছিল, ওডিসিউসকেও বানিয়েছিল আমি সেই সার্সি। আমার সঙ্গে বাস করার কারণে তার মধ্যে নাকি মুক্ত বাতাস আর নৈঃসঙ্গ্য পাওয়ার জন্য গৃহকাতরতা শুরু হয়েছিল। আমার সঙ্গে থাকার কারণে নাকি সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, না প্রতিজ্ঞা করেছিল, আর কোনো নারীর ধারেকাছে যাবে না। সে আরো বলে, আমি তাকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে এসেছি যে সবচেয়ে সুন্দরী পরিও যদি তাকে চোখের ইশারায় ডাকে, তবু সে আকৃষ্ট হবে না, বরং তার একমাত্র কথা হবে : ভাগো এখান থেকে। সে জানতে চায়, এত দিন ধরেও কেন সে আমাকে ভালোবাসতে পারল না, কেন নিজেকে সে অসহায়ভাবে ভালোবাসার অযোগ্যই মনে করে, কেন সে আমাকে এবং নিজেকে এতটা ঘৃণা না করে পারে না। সে আমার মা-বাবাকে নিয়ে কটুকথা বলেছে, আমার জন্মস্থান সম্পর্কে খারাপ কথা বলেছে। আমার গোটা প্রজন্মকেই সে গালি দিয়েছে, বলেছে আমাদের সামনে নাকি কোনো উদ্দেশ্য নেই; আমরা অপরিণত বয়সেই নষ্ট হয়ে গেছি; আমরা শ্রদ্ধাভক্তিরহিত; আমাদের কোনো জোরালো আকাঙ্ক্ষা নেই। সে বলেছে, আমাদের দুজনের বাইরের আর কোনো কিছুতেই নাকি আমার আগ্রহ নেই; কাজকর্ম, প্রকৃতি, ইতিহাস কিছুতেই না। বলেছে, আমি প্রেমে বুঁদ হয়ে আছি, শুধু দুজনে ডুবে আছি এবং বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছি যে দুজন মানুষ সুখী হতে পারে তাদের বাইরের অন্য কিছু অন্য কারো সহায়তা নিয়ে। সে বলে, আমার কোনো কিছুতেই উচ্চাশা নেই, আমার জ্ঞানতৃষ্ণা নেই; জ্ঞান থাকলে আমার পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আমি নিজেকে বুঝতে পারতাম; অজানা বিষয়ের প্রতিও আমার কোনো আগ্রহ নেই। সে বলে, আমার এই অ্যাপার্টমেন্টে আমি দশ বছর আছি, অথচ এখনো সামনে দিগন্তের কাছে যে পর্বতটা আছে আমি সেটার নাম জানি না, কিংবা আমার জানালার বাইরের নদীটার নামও জানি না, কিংবা সামনের ওই সেতুর ওপর দিয়ে আসছে যে ট্রেন, সেটা কোথা থেকে আসছে, কোথায় যাবে, জানি না। সে বলে, এই নগরের শুধু একটা জায়গার নামই আমি জানি, সেটা হলো আমার বাড়ির পাশের রাস্তা। সে বলে, কম্পাসের সব কাঁটার প্রান্ত আমার কাছে একই রকম। মানে </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">দক্ষিণ</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt"> শব্দটা বলতে সমুদ্র আর সূর্যের আলো ছাড়া আর কিছু বুঝি না আমি, কেউ উত্তর কিংবা পশ্চিম কথা দুটি উল্লেখ করলেই আমার নাক কুঞ্চিত হয়ে যায়, আমি বিরক্তি প্রকাশ করি। সে বলে, জ্ঞানের যে কোনো ধরনের প্রতিই আমার প্রতিক্রিয়া হলো আতঙ্কের, যেন আমাকে বৈরী কোনো পরিবেশে ফেলে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সে বলে, আমার নিজের ছাড়া আর কোনো ব্যক্তি কিংবা বিষয়ের জন্য আমার সময় নেই। কোনো জিনিস যত সুন্দরই হোক না কেন, আমি সেটার দিকে মনোযোগ দিই না, একবার চোখ তুলে তাকাইও না। সে কারণেই নাকি সৌন্দর্য ও অসুন্দরতা সম্পর্কে আমার ধারণা ক্ষমাহীন পর্যায়ের ভাসা ভাসা। সে বলে, দেখার মতো, শোনার মতো কোনো কিছু যে আমি পাই না এটা একটা জঘন্য ব্যাপার। আর এখান থেকেই সব খারাপের শুরু : কোনো রকম স্থায়িত্ব আমার ক্ষেত্রে অসম্ভব। স্থায়িত্ব ছাড়া দৈনন্দিন জীবনও হতে পারে না। সে বলে, তার পরও সে আবিষ্কার করেছে, আমার মধ্যে কোনো কোনো অংশ ভালো এবং মহান। তবে সেই ভালো অংশ শুধু গণনা করা যেতে পারে; আমি সেদিকে কোনো রকম সময় সুযোগ গুরুত্ব দিই না। সে বলে, সুতরাং জুটি হওয়ার, দম্পতি হওয়ার যে স্বপ্ন আমার আছে, সেটা ভুলে যাওয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে সে পার্সিফাল এবং কিং লিয়র থেকে উদ্ধৃতি টানে : </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">জন্মদান করা যে ব্যক্তির লক্ষ্য, সে ভালোবাসা নিয়ে কথা বলে না;</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt"> এবং </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">ভালোবাসো, নীরব থাকো।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">একা একা কথা বলার সময় মহিলা তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দুর্বোধ্য লেখাটা শেষ করে ফেলেছে। লেখার মধ্যে কোথাও এক জোড়া, কোথাও তিনটা করে বিস্ময়সূচক চিহ্ন ব্যবহার করেছে সে। এই চিহ্নগুলো এবং আন্ডারলাইনগুলোই শুধু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এগুলো মূলত তার উত্তর। এবার সে উঠে দাঁড়াচ্ছে, হঠাৎ করে নয়, ধীরে ধীরে চমৎকার শক্তি খরচ করে। তার কলম ও কাগজটা মাটিতে পড়ে গেছে। সে বসে পড়ে, কাগজ-কলমের দিকে তাকায়, কিন্তু তোলে না। রবিবারের কিঞ্চিৎ শমিত সন্ধ্যাটাকে শোধন করে দিচ্ছে রুমের অনেক বাতি আর এলোমেলো করে ফেলে রাখা টেলিভিশন ম্যাগাজিনগুলো। বড় বড় খোলা চোখে মহিলা দাঁড়িয়ে আছে বিরাট একটা আয়নার সামনে। আশপাশের কোনো অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ঝগড়ার কোলাহল শোনা যাচ্ছে। তার অন্যমনস্ক চাহনি এবং সামনের দিকে ঝুঁকে থাকা দেহভঙ্গি আয়নার ভেতরের চেহারায় এনেছে পথ ভুলে উঁচু ভবনে ঢুকে পড়া কোনো প্রাণীর আদল। তারপর সে হঠাৎ কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনের দিকে তাকায় এবং শূন্যের মাঝে হাসি ছড়িয়ে দেয়, এমন একটা নিশ্চিন্ত হাসি হাসা যায় রাস্তার কারো উদ্দেশে। আস্তে করে সে পাশের একটা রুমে ঢুকে পড়ে পোশাক পরে নেয় এবং মুখে প্রসাধনী ব্যবহার করে মুখসজ্জা ঠিক করে। তারপর দুই রুমের মাঝে সামনে পেছনে লঘু পায়ে যাওয়া-আসা করতে থাকে। তার এ রকম হাঁটার ভঙ্গি কোনো স্বাড়ম্বর সহচরীর চরিত্র ধারণ করে। একটু পরেই সে দরজায় চলে যায়, বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত মনে হয়। হঠাৎ হাত থেকে ব্যাগ পড়ে যায়। ব্যাগের ছড়িয়ে পড়া জিনিসগুলো তোলার জন্য সে নিচু হয়। এরপর পুরোপুরি সোজা হয়ে দাঁড়ায়, বলা যায়, কারো দৃষ্টির সামনে নিজেকে মেলে ধরছে। তার এই চেহারায় ভুল জায়গায় চলে আসা প্রাণীর আদল নেই আর, আছে এক তারকার অভিব্যক্তি। শেষে থুতনির ওপরে একটা টস দিয়ে তার দর্শকদের উদ্দেশে বলা শুরু করে, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">দৈনন্দিন জীবনের কথা বলে আমাকে বিরক্ত কোরো না। তোমাদের আমি যে আনন্দ দিয়ে থাকি, সেটা আর কেউ দিতে পারবে না। তোমাদের সবারই আমাকে দরকার। আসলেই দরকার।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt"><img alt="অনুপস্থিতি" height="317" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/04.April/05-04-2024/EID-2024/1/kk-m-12b.jpg" style="float:right" width="396" />সম্পূর্ণ ভিন্ন তারকাদের পোস্টার প্রদর্শন করছে একটা প্রেক্ষাগৃহ। তার সামনে স্ট্রিট ইউনিফরম এবং কাত করা ক্যাপ পরা এক সৈনিক দাঁড়িয়ে আছে। তার দুই পাশে মধ্যবয়সী দম্পতি; তাদের পরনে ভ্রমণের পোশাক। সঙ্গে সুন্দর আবহাওয়ার ছাতা ও হ্যাট। তার মা তার বাহু ধরে আছে। তার বাবা খুব সামান্য দূরে। পাশ থেকে ছেলে আর ছেলের মাকে চোরা চোখে দেখছে বাবা। প্রেক্ষাগৃহটা রেলস্টেশনের অন্য পাশে। তারা ওখানে একমুহূর্তের জন্য থেমেছে। এখন স্কয়ার পার হয়ে যাচ্ছে। এখানে রবিবারের সন্ধ্যাজুড়ে আছে অ্যাসফল্টের ওপর দিয়ে উড়তে থাকা কিংবা ময়লার কানেস্তারা বোঝাই হয়ে থাকা পুরনো খবরের কাগজ। স্টেশন হলের অল্প কয়েকজন যাত্রীর চেয়ে ঘুমন্ত কিংবা চিৎকার করতে থাকা নেশাখোর আর কোনায় অপেক্ষমাণ বিদেশি শ্রমিকরাই সংখ্যায় বেশি। তারা তিনজন প্ল্যাটফরম পার হয়ে ওয়েটিংরুমের দিকে যায়। ওয়েটিংরুমটা একটা আলাদা কাঠামো, একটা কুঁড়ের চেয়ে খুব বেশি বড় নয়। এটার অবস্থান দুটি ট্র্যাকের মাঝখানে, এর আবার একটা মার্বেলের দরজাও আছে। রুমের ভেতরটা পার্লারের মতো : বাঁকানো কয়েকটা বেঞ্চ এবং কয়েকটা বার্নিশ করা টেবিল। ওপরের বাতির আলো পড়েছে বেঞ্চ ও টেবিলের ওপর। হালকা-পলকা একটা স্টোভ আছে এক কোনায়, উচ্চতায় যেন একেবারে ভেতরের ছাদ পর্যন্ত। আরেকটা কুলুঙ্গিতে আছে একটা ক্ষুদ্রাকৃতির ঝরনা; তার অন্য প্রান্তে আছে একটা ক্ষুদ্র তালগাছ। পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আকারে বড় করে বানানো হলেও দেয়ালগুলো সাজানো হয়েছে বিবর্ণ প্রাকৃতিক দৃশ্যের চিত্রকর্মে। টেবিলগুলোর সাজ হিসেবে রাখা হয়েছে কয়েকটা ছাইদানি। এখানে জানালার দুই সারির পাশেই ট্রেনগুলো সব সময় থামছে আবার চলে যাচ্ছে। তিনজনের দলটা বসে আছে। মা-বাবা দুজন হ্যাট পরেই আছে এবং তাদের মুখ অর্ধেকটা ছায়াবৃত। সৈনিক তার ক্যাপ খুলে ভাঁজ করে ট্রাউজারের পকেটে রাখে। ছোট চুলের খালি মাথা, ফুসকুড়ি ওঠা ললাট আর থলথলে চোয়ালে তাকে স্কুলবালকের মতো লাগছে। কিন্তু মা-বাবার মাঝখানে বসে থাকলেও মনে হচ্ছে না, সে ওদের ছেলে। তাদের মনোযোগ ও চিন্তা শুধু তাকে নিয়েই। কিন্তু তার মনোযোগ, তার সতর্কতা মনে হচ্ছে চারপাশের সব কিছুতে। ছাইদানির মধ্যে পড়ে থাকা চুরুটটা তার দৃষ্টিতে পর্বতের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া পথের মতো চেহারা ধারণ করে। তালগাছগুলোর বাঁকানো চূড়া শুঁড়ের মতো এদিক-ওদিক হাতড়ে বেড়ায়। সৈনিক এভাবেই যেন তার ডানে-বাঁয়ে বসা মা-বাবার থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন এবং স্বাধীন। যদি সে ভান করে হলেও ছেলের মতো মাথা নোয়ায় তাহলেও মা-বাবার কাছে সেটাই বড় পাওয়া। তার সঙ্গে কথা বলে আপাতত সক্রিয় আছে তার মা। বাবা নীরব হয়ে আছে, ভাবে মনে হচ্ছে এই দশ্যের সঙ্গে সে নেই, নিশ্চিতই নিরপেক্ষ নিরাবেগ। মহিলার বয়স খুব বেশি হয়নি, কণ্ঠও অল্পবয়সীদের মতোই। মহিলা বলে, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">আশা করেছিলাম, সেনাবাহিনীর নিয়ম-কানুনের জীবনে অভ্যস্ত হলে তোর খোলস থেকে বের হয়ে আসতে পারবি। কল্পনায় দেখতাম, আগে যে আত্মসত্তার গভীর গহনে ছিলি, সেখান থেকে পুরো আলাদা এক মানুষ হয়ে বের হতে দেখতাম তোকে</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">যে মানুষ সব কিছুর জন্য সঠিক সময়টা বুঝতে পারে, সঠিক সময়ে ঠিক পদক্ষেপটা নিতে পারে, কোনো কাজ থেকে বিরত থাকারও সঠিক সময়টা বুঝতে পারে, সঠিক সময়ে সঠিক কথাটা বলতে পারে। ফলে সত্যিকারের নেতা না হয়েও সে নির্ভরযোগ্য হতে পারে, অন্যদের উৎসাহের উৎস হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি, তুই আগের চেয়ে বেশি মাত্রায় সব কিছু থেকে অনুপস্থিত। তোর কিছুতেই মনে করা উচিত নয় যে এ কয়েক মাসে তুই পদমর্যাদাসূচক একটা ডোরাও না পেলে আমি চিন্তা করতে পারি; আমি হতাশ শুধু এই জন্য যে ব্যারাকে কিংবা বাইরে কোনোখানেই তোর উপস্থিতিটা অন্যের অনুভূতিতে জানান দিতে পারছিস না। তোর কমরেডদের কাছে তুই একজন কেউ না। তুই যখন কোনো রুমে ঢুকিস, কেউ তোর দিকে তাকায় না। তুই যখন রুম থেকে বের হয়ে যাস, অন্যরা শুধু দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনে। তুই কাউকে স্যালুট করলে তোর দিকে সে ভ্রুক্ষেপই করে না। আমরা যখন লোকজনের কাছে তোর নাম জিজ্ঞেস করলাম, দেখলাম, তোর নামের কোনো অর্থ কিংবা গুরুত্বই নেই তাদের কাছে। তুই তো জানিস, তোর বাবা যেকোনো বিষয় খুব ভালো করে বর্ণনা করতে পারে। তোর বাবার মুখে তোর বর্ণনা শুনে ওদের একমাত্র প্রতিক্রিয়া ছিল শুধু তাচ্ছিল্যের কাঁধ ঝাঁকি। রেস্তোরাঁয় শুধু তোর অর্ডারের কথাটাই ভুলে যায় ওয়েটার মেয়েরা। কোনো লাইনে দাঁড়ালে শুধু তোকেই লোকজন ঠেলে ফেলে দেয় একপাশে। তুই হয়তো কোনো রুমে একা, তুই হয়তো কোনো উঁচু প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে আছিস এবং স্পটলাইটের আলো তোর মাথার ওপরে পড়েছে; তবু তোর দিকে কেউ তাকায় না, তুই উপেক্ষিত। তুই সব সময়ই অনুপস্থিত। বাইরে কোথাও খুব একটা না গিয়ে জীবনের বিশটা বছর কাটিয়েছিস বাড়িতে। তোর কথা কেউ জিজ্ঞেস করেও না। তোর কথা কেউ মনে রাখেনি, তোর শিক্ষকরা, তোর সহপাঠীরা কেউই মনে রাখেনি। তোর ওই সব দিনের কাছের বন্ধুও আমাকে তোর মা হিসেবে চেনে না, চেনে ফ্র অমুক, ফ্র তমুক হিসেবে। এমনকি আমরা তোর মা-বাবা যখন দেখি তুই নিজেও এসব বিশ্বাস করছিস না, তখন তোকেও তোর আসল পরিচয়ের সঙ্গে মেলানো যায় না। এই মনে হয় তুই আছিস, আবার মনে হয় তুই নেই। তোর অনুপস্থিতিই আমাদের তোর কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেয়। যেহেতু তোর নিজের কাছে তোর অনুপস্থিতি স্বাভাবিক মনে হয় না, সেহেতু তুই অনুপস্থিতির ছদ্মবেশ ধারণ করিস আমাদের বিপক্ষে, অন্যদের বিপক্ষে, গোটা জগতের বিপক্ষে তোর একটা বর্ম হিসেবে। এটা তোর একটা অস্ত্রও। তোর অনুপস্থিতি দিয়ে আমাকে ভয় পাইয়ে দিস। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, তুই আমার সন্তানই না, তোকে আমার ওপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি তুই যখন ছোট ছিলি, তখনো তোর রুমে ঢোকার আগে আমাকে দরজায় টোকা দিতে হতো, যেন তুই অপরিচিত কেউ। তুই আসলে কে? শেষ পর্যন্ত নিজেকে মেলে ধর। অন্যদের তোকে চেনার সুযোগ দে। বাছা, তোর অন্য অস্ত্রগুলোও দেখা আমাদের! যে অস্ত্রগুলো মাঝে মাঝে অন্যদের নিরস্ত্র করতে পারে, সেগুলো। মাঝে মাঝে আমাকে, তোর বাবাকে, কিংবা তোর কোনো প্রতিপক্ষকে সঠিক সময়ে নিরস্ত্র করেছিস তোর সেই চাহনি, সেই প্রশ্ন দিয়ে। সেই অস্ত্র বের কর, বাবা!</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">যতক্ষণ তার মায়ের কথা চলে, ততক্ষণ সৈনিক শুধু তার চারপাশের সব কিছুতে মনোযোগী দৃষ্টি বোলায়, যেন এখনই লাফিয়ে উঠে পড়বে। কোথাও থেকে হঠাৎ একটা বল উড়ে এলে সে ধরে ফেলবে। মহিলার কথা বলার সময় সৈনিক নিজের কাঁধের ওপর দিয়ে এটা-ওটা দেখার চেষ্টা করেছে। তার মনে হয়েছে, দু-এক মুহূর্তের জন্য দূরের একটা বেঞ্চের ওপরের কালো মানুষ আরো কাছে এসেছে। দুর্বল ও অনিয়মিতভাবে চলা পানির ফোয়ারা বেশ জোরালো হয়েছে এবং স্টেশন এলাকায় এই ফোয়ারাই বেশি চোখে পড়ার মতো আকারে যেন বিশাল হয়েছে। কাচের দরজার লেখাগুলো ভেতরের জিনিস দেখার একটা কাঠামো তৈরি করেছে। একটা ট্রেনের জানালায় একটা মুখ, একটা ট্র্যাকের প্রান্তে আলোকিত একটা সুইচ একেবারে স্পষ্ট, যেন ধরাছোঁয়ার মধ্যে আছে, যেন দুরবিন দিয়ে দেখা যাচ্ছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">এখন ওয়েটিংরুমে অন্য লোকজন আছে। তারা তিনজন চলে গেছে। প্ল্যাটফরমগুলো ফাঁকা। অনেক ট্র্যাকও ফাঁকা। রেললাইন থেকে ঠাণ্ডা মৃদু দীপ্তি ছড়াচ্ছে। দীর্ঘ মোড়ের কাছে সর্বশেষ ট্রেনটা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তারপর থেকে গেল শুধু মরা মাঠের ওপারের উঁচু দালানকোঠা। আলোকিত জানালাগুলো বয়স্কদের ভবনের জানালার মতো খুব কাছাকাছি অবস্থানে আছে মনে হচ্ছে। এই সময়টাতেই সাধারণত বেশির ভাগ মানুষ রবিবারের বাইরে বেড়ানো থেকে ফিরে আসে। তবু কেউ কেউ অন্ধকারেই থাকতে চায়। রুমগুলোর মাঝখানে অগণিত কালো ছায়া দেখা যায়; সবাই অনড়, শুধু সিগারেট ধরা হাতগুলো ওঠানামা করে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">সৈনিক তার ক্যাপটা আবার পরেছে। এরই মধ্যে স্টেশন থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে, নদীর ধার দিয়ে হাঁটছে। সঙ্গে কেউ নেই। বড় বড় পা ফেলে হাঁটছে, যেন উড়ে চলেছে। প্রায় প্রতিটি টেলিফোন বুথে একটা অনড় ছায়া। একটা বাহু মনে হয় সারা দিন গাড়ির জানালায় ঝুলন্ত ছিল, এখন তুলে নেওয়া হচ্ছে। একটা বাড়ির সামনে তিন কিশোরী অপেক্ষা করছে; খুব ছোট একটা শিশু দরজার বাইরে পা বাড়াচ্ছে। বিদেশি শ্রমিকদের দল চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে; চোয়ালের উঁচু হয়ে থাকা হাড়ের কারণে তাদের আগের চেয়ে এখন আরো বেশি স্লাভিক মনে হচ্ছে। একজনের চোখে মনুষ্য হত্যাকারীর চাহনি দেখে প্রতিক্রিয়া হিসেবে সৈনিক তাকে স্যালুট করছে। লোকটা তার স্যালুট পেয়ে প্রাণ পেয়ে জেগে উঠছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt"><img alt="অনুপস্থিতি" height="310" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/04.April/05-04-2024/EID-2024/1/kk-m-12c.jpg" style="float:left" width="396" />দোকানের আলোকিত তবে আচ্ছাদিত জানালাগুলোতে কেউ নেই। অন্য কয়েকজনের থেকে একটু দূরে দাঁড়ায় সে। অন্যরা প্রায় সবাই সৈনিক। অন্যরা যখন আলাপে মগ্ন হয়, কিংবা ছায়া বক্সিংয়ে জড়ায় তখন সে জ্যাকেটের পকেট থেকে কুকি বের করে ধীরে ধীরে নিয়ম মানার মতো করে খায়। কাছেই একটা গির্জা আছে; বাসশেল্টারের দেয়ালে একটা পোস্টার, লেখা আছে : পবিত্র ভূমিতে তীর্থযাত্রা।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">বাসে উঠে আরেক পকেট থেকে একটা বই বের করে পড়ে সে। যাত্রার পুরো সময়টাতে সে বারবার বই থেকে চোখ তুলে তাকায় : রাস্তার কোনো পথচারীর দিকে কিংবা বাসের কোনো সুন্দরী মেয়ের দিকে। বইতে যা পড়ছে হজম করার জন্য প্রতিবারই প্রয়োজনের চেয়ে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকে। এক্সপ্রেসওয়ে থেকে আর্মি ক্যাম্প বেশ খানিকটা দূরে। সহজে চোখে পড়ে না, শুধু ছোট বার্চগাছের ভিড়ের মধ্যে চকচকে সাদা সেন্ট্রিবক্স চেনার মতো লাগে; সেন্ট্রিবক্সের দুই পাশে নিষেধের দেয়াল। সৈনিক আস্তে করে অন্যদের সঙ্গে এক সারিতে দাঁড়িয়ে যায়।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">রাত গভীর। এয়ারফিল্ডের আলোগুলো নিভে যায়। পথচারীদের একটা আলো বদলে যায়। আর কোনো পথচারী নেই। আলোর ওপরে লেগে থাকা ফিগারগুলো বেঁকে যায়। নিচতলার একটা অন্ধকার জানালা থেকে কার যেন কণ্ঠ শোনা যায়, শুরুতে পরিষ্কার এবং জোরে শোনা যায়; তবে পরে দুর্বোধ্য মনে হয়। কোনো ঘুমন্ত ব্যক্তির কণ্ঠ। শহরের কেন্দ্রে রাস্তার মোড়ে শুধু জন্তুদের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না: বিড়ালের হাঁচড়পাঁচড়, দূরে কোথায় যেন কসাইখানা থেকে ভেসে আসছে ষাঁড়ের গর্জন। চিড়িয়াখানা থেকে শোনা যাচ্ছে ময়ূরের আর্তনাদ। দোকানের জানাগুলোর প্রদর্শনীতে রাখা সব টেলিভিশন সেটই টেস্ট-প্যাটার্নস দেখাচ্ছে। রবিবারের দুর্ঘটনার একটা দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে, রক্তের ওপরে সাদা সাদা বালু ছিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তার পরও একটা জায়গায় রক্তের লাল রং বোঝা যাচ্ছে; কালো একটা জায়গায় জমাট রক্তের গোলাকার পিণ্ড; মনে হয়, দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তির হৃৎপিণ্ড থেকে একটু আগেই পড়েছে। একটা ক্যাফের মধ্যে ঢুকে পড়েছে রাস্তার বাতির আলো; বোঝা যাচ্ছে, আবছা অন্ধকারে রুমের চেয়ার বেঞ্চগুলো ঠিকমতো সারি করে সাজানো আছে। একটা কোনায় একটা ঝুড়ির মধ্যে রাখা হয়েছে উচ্ছিষ্ট রুটি; কোনোটা কোঁচকানো, কোনোটার ওপরের অংশ ভেঙেচুড়ে গুঁড়া হয়ে গেছে। রবিবারের সন্ধ্যায় বেকারিদ্রব্যের অবস্থা এ রকমই হয়। দাবা বোর্ডের সব মানুষের মাথা কাত হয়ে আছে; শুধু রাজা দাঁড়িয়ে আছে সোজা হয়ে। আকাশের একটা অংশ অর্ধেক চাঁদটাকে কবিরাজের হামানদিস্তার আকারে গ্রহণ করছে, যেন একটামাত্র বড়ি গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে; বড়িটা হলো একটা তারা। রুমের ভেতরটা ভরে যাচ্ছে সমান বিরতিতে চলা গুড়ুমগুড়ুম শব্দে, যেন নগরের যন্ত্রগুলো ঠিকমতো বন্ধ করা হয়নি, যেকোনো মুহূর্তে আবার চালু হয়ে যেতে পারে সেগুলো।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">শুধু জুয়ার আসরের লোকদের হাতে সময় আছে; এখানে বাইরের জগতের কোনো অস্তিত্ব নেই। ঝকঝকে টিউবের আলোয় দিনের মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে। পুরু পর্দার মাঝখানে কোনো ফাঁকা নেই, মাঝখান দিয়ে বাইরের কিছু দেখার উপায় নেই। আর জুয়াড়িরা তো কখনোই তাস ও ঘুঁটি থেকে চোখ তুলে অন্য কোথাও তাকাবে না। বাইরের জগৎ থেকে লোকজন চলে গেছে; কিন্তু এখানে থাম দিয়ে ভাগ করা বিরাট রুমের মধ্যে লোকজন গিজগিজ করছে, আক্ষরিক অর্থেই লোকের ভিড়ে রুমের চেহারা কালো হয়ে আছে। তার পরও অল্পবয়সী বিলিয়ার্ড খেলোয়াড়দের দল ছাড়া অন্য যারা প্রথম অভিজ্ঞতা অর্জন করতে এসেছে, আসলে তারা নিজেদের সাহস প্রমাণের জন্যও এসেছে। কোনো রকম হৈচৈ নেই। কেউ তেমন কথাবার্তাও বলছে না; তাস ফেটার শব্দ, ঘুঁটি নাড়ার শব্দ আর ভেন্টিলেটরের গুঞ্জন ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। একেকটা দেয়ালে একটা করে ভেন্টিলেটর আছে। এখানে একটা ছবিও নেই। সবখানে শুধু সবুজ রং করা, মানুষের নার্ভাস গোড়ালির চাপে বেজবোর্ডের ওপরের রং ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। এ রকম জায়গায় সচরাচর যেসব প্লান্ট দেখা যায়, এখানে তেমন একটাও দেখা যাচ্ছে না। একটা নিঃসঙ্গ কুকুরও নেই। সিগারেটের গোড়া ঘন হয়ে বেশ দ্রুতই পড়ছে টাইলসের মেঝের ওপর। খেলোয়াড়রা গোড়াগুলোর দিকে একেবারে না তাকিয়েই পায়ের নিচে পিষে দিচ্ছে। রুমের মধ্যে একমাত্র সাজসজ্জা হলো উঁচু সিলিংয়ে ডিম্বাকৃতির সিমেন্ট প্রলেপ। এই একটিমাত্র জিনিসের প্রতি খেলোয়াড়দের কেউ কেউ, বিশেষ করে কোনো হেরে যাওয়া খোলোয়াড় ক্ষণিকের জন্য চকিতে দৃষ্টি দিচ্ছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">রুমের মধ্যে একটা প্রধান টেবিল আছে। আকারের জন্য নয়, এর চারপাশে দর্শকদের সংখ্যার কারণে টেবিলটা চোখে পড়ার মতো মনে হচ্ছে। টেবিলটা রুমের মাঝখানে নয়, এক কোনায় পাতা হয়েছে। টেবিলে বসাদের মধ্যে একজন আকারে-চেহারায় বড়। সে পরাজিতদের কেউ নয়। তার চুল সাদা; ত্বক মসৃণ; মুখে দাড়ি নেই বললেই চলে। টেবিলের প্রায় অন্য সবারই মুখে না-কামানো দাড়ি। অন্যদের সঙ্গে তার মিল হলো, সেও কালো স্যুট ও সাদা শার্ট পরেছে; গলায় টাই নেই। কিন্তু তার স্যুটের ওপরে পরেছে প্রায় মেঝে পর্যন্ত লম্বা উটের পশমের কোট, যেন খুব ঠাণ্ডা লেগেছে। আরেকটা কারণে তাকে অন্যদের থেকে আলাদা মনে হচ্ছে: অন্যদের মতো চেয়ারে বসেনি সে, বসেছে টেবিলের কোনার একটা টুলে, হেলান দেওয়ার ব্যবস্থা নেই টুলে। পা তুলে ভাঁজ করে বেশ টান টান হয়ে বসেছে। কখন কে বাজি ধরে সে অপেক্ষায় থেকে টেবিলের চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষও খেলোয়াড় হয়ে যায়। টুলে বসা লোকটা ঢোল বাজানোর মতো করে ছন্দে ছন্দে ঘুঁটি ঝাঁকাতে থাকে, এই বাজনার কোনো শেষ নেই, যেন সে চাইছে, উপস্থিত সবাই তার বাজনার তালে তালে পা তুলে নাচতে থাকুক। তার কবজির একটা হালকা ঝাঁকুনিতেই কাপের ভেতর থেকে হঠাৎ করে ঘুঁটিটা বের হয়ে যায় বোর্ডের এক প্রান্তের দিকে, বাউন্স করে আবার ফিরে আসে মঝখানের দিকে, যা ঘটছে তার সঙ্গে শুধু তার হাতই ব্যস্ত আছে। এক হাত ঘুঁটি নিয়ে ব্যস্ত; ঘুঁটি চালার পরে আরেক হাত ব্যস্ত হচ্ছে সংখ্যা টুকে রাখায়। তার সোনালি পেনসিল স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এক টুকরা কাগজের ওপরে খোদাই করে রাখছে সংখ্যা। তার শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ নড়াচড়া করছে না। মুখে সিগারেট আছে, কিন্তু সে টানছে না। পাশ থেকে তার এক খয়েরখাঁ বারবার আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে সিগারেটে। তার পক্ষে প্রতিবারই বোর্ড থেকে ব্যাংকনোটগুলো আঁচড়ার মতো করে গুছিয়ে আনছে চামচা। এখানকার টেবিলে ধাতব মুদ্রার নাচন অবশ্য অকল্পনীয়। খয়েরখাঁ নোটগুলো গোছানোর পর মসৃণ করে সাজিয়ে রাখছে স্তূপাকারে। প্রায় অন্য জুয়াড়িদের মতোই বিশালদেহী লোকটা ম্যানেজারের কাছ থেকে কোনো ড্রিংক অর্ডার করে আনছে না। ম্যানেজার নিজেই কিছুক্ষণ পর পর ড্রিংক দিয়ে যাচ্ছে। তবে প্রতিবারই নিজের চেষ্টায় সে কোনো একটা স্তূপ থেকে একটা নোট টান দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে কোনো কথা বলছে না। মাঝে মাঝে অন্যদের থেকে তার চোখে বেশি ক্লান্তি আর ঘুম দেখা যাচ্ছে, তাকেই বেশি ফ্যাকাসে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, তার হাত দুটি স্বেচ্ছায় চলাচল করছে এবং সে ফোলা চোখের নিচে ঘুমিয়ে আছে। তবে খুব কাছ থেকে দেখলে বোঝা যায়, তার চোখের তারা দ্রুত এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। ঘুঁটি ঝাঁকি দেওয়ার সময় সে ঠিকই খেয়াল রাখছে কখন কোন দর্শকের আঙুলের মধ্যে দুমড়েমুচড়ে যাওয়া নোটগুলো দেখা যাচ্ছে। পাশের টেবিলের খেলায় বড় বড় ফ্যাকাসে ও প্রায় পশমহীন মুঠিতে ধরা আছে খুব ছোট ছোট তাস</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">সেদিকেও তার সমান নজর আছে। নিচ থেকে একটা নীল আলো পড়ছে পেছনের দিকের এক নিঃসঙ্গ খেলোয়াড়ের মুখে। সে চালাচ্ছে একটা একহাতওয়ালা লুটেরাকে। হৈচৈপূর্ণ বিলিয়ার্ড খেলোয়াড়দের দলের একাকী মেয়েটা চিৎকার করার মাঝখানে জুয়াড়ির চাহনিতে কী যেন অনুভব করতে পারে। ভিড়ের ভেতর থেকে বের হয়ে সে চারদিকে তার সঙ্গীদের দিকে তাকায়। তার তাকানোয় সঙ্গীদের কাছ থেকে সুরক্ষা চাওয়ার আবেদন আছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">ঘুঁটি আবার গড়ানো হয়; তবে টেবিলে পড়েই থাকে, কেউ তোলে না। ঘুঁটিচালক তার গেঞ্জির পকেট থেকে চোখ তুলে তাকিয়ে গেম শেষ হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। অন্যরাও তাদের ঘড়ি বের করে। ব্যাংকার সংখ্যার কলামগুলো যোগ করে। সামান্য কয়েকটা ব্যাংকনোট বিতরণ করা হয়। বড় অংশটা সে কোটের পকেটে ভরে এবং ক্যাপের খোঁজে পেছনে হাত বাড়ায়। ক্যাপটা তার কোটের উপাদানেই তৈরি। তবে তখনই ক্যাপটা পরা হয়ে গেলেও পেছনে দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে ওখানেই বসে থাকে। অন্যরা তার মতোই যার যার জায়গায় অনড় হয়ে বসে থাকে, মনে হয় স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করছে। টেবিলের চারপাশ থেকে কেন্দ্রের দিকে ধাবমান অসংখ্য আঙুলের ছাপ। এমনকি দাঁড়ানোর পরও জুয়াড়ি সঙ্গে সঙ্গেই চলে যায় না। পর্দা একটুখানি সরিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করে : শেষরাতের হালকা আলোয় দেখতে পায়, একটা বাস নগরের প্রান্তের দিকে অর্ধগোলাকার পথে এগিয়ে যাচ্ছে, ভোরপূর্ব লগ্নে তারাগুলো আবছা দেখা যাচ্ছে। হাউজিং ডেভেলপমেন্টের একই রকম চেহারার বাড়িগুলোর কোনোটার দরজার সামনে একটি, কোনোটার সামনে দুটি করে দুধের বোতল রাখা আছে। </span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">এক জগৎ থেকে আরেক জগতে যাওয়া জুয়াড়ির জন্য খুব কঠিন মনে হচ্ছে না। কালো ভেন্টিলেটর ফুটোর ওঠানামা করতে থাকা স্ল্যাটওয়ালা ফুটোর দিকে একনজর পেছন ফিরে তাকিয়ে সে দ্বিধাহীন চিত্তে লম্বা স্পষ্ট চেহারার বাসের দিকে এগিয়ে যায়। খালি বাসটা লুপের মধ্যে প্রবেশ করার সময় সে দেখতে পায়, সাপোর্টবারগুলো একগুচ্ছ তরবারির মতো চকচক করছে। সে বাসের বিপরীত দিকের পথ ধরে। সিটিলাইন পার হয়ে সে গ্রাম্য এলাকার দিকে যাত্রা করে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">আগের রাস্তায় যেমন কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনের দিকে তাকিয়েছে, এখানে সে তা-ই করছে। কেউ তাকে অনুসরণ করছে কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য নয়, বরং তার পেছনে কিছু ঘটছে কি না সেটা দেখার জন্যই সে পেছনে তাকাচ্ছে। মাঝে মাঝে সে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, কোনো অদৃশ্য দলকে মোকাবেলা করার জন্য। এ রকম দল বলতে আসলে ছোট ছোট বার্চগাছের ঝোপ ছাড়া আর কিছু নেই। অনাবাদি গুল্মাবৃত জমি পেরিয়ে মরচে ধরা পরিত্যক্ত রেইল ট্র্যাক বরাবর জুয়াড়ি লম্বা লম্বা পা ফেলে চলতে থাকে, এমনকি মাঝে মাঝে লাফও দেয়। এবার সে কথা বলা শুরু করে, অবশ্য শুধু বিড়বিড় করে অসংলগ্ন কিছু শব্দ বলে যায়: </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">কদাকার!...যে কোনোখানে...নিজের পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে...ধরা পড়া...জীবনের জল... যন্ত্রপাতি...প্রস্তুত হও...সময় নেই...বেষ্টিত...পর্যাপ্ত... অবহেলিত...গুচ্ছ...উপযুক্ত বিষয়...অন্তর্ভুক্ত করো... ভেঙে ফেলো...খোলো...খুঁজে বের করো...ভাসিয়ে দাও...দুচোখের মাঝে ধরছে, নিজেকে বারবার গুলি করার ভঙ্গি করছে। একবার সে পথ ফেলে একটা গাছের কাণ্ডের সঙ্গে মাথা ঠুকেছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt"><img alt="অনুপস্থিতি" height="382" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/04.April/05-04-2024/EID-2024/1/kk-m-12d.jpg" style="float:left" width="396" />রেল ট্র্যাকের শেষে লম্বা ঘাসের জমি পায়; তরবারির মতো সোজা ঘাসগুলো তার পথের বাধা হতে চায়। তারপর সে একটা খোলা মাঠ পায়, বড় বড় পাথর ছড়ানো সেই মাঠে কোথাও কোনো গাছপালা ঘাসের বিস্তার নেই বললেই চলে। চারপাশ থেকে শুধু ঝোপঝাড়ে ঘেরা। মাঠটাকে মনে হয় নগরের প্রান্তের তৃণভূমির ভেতর ঢুকিয়ে রাখা একটা গোলাকার চাকতি। একমাত্র উঁচু জায়গা বলতে এখানে আছে একটা ঢিবি, কংক্রিট, কাঁকর আর মাটির তৈরি ঢিবি। ঢিবির পাশের একটা পাথরের ওপর বসে জুয়াড়ি, পাশে রাখা ব্যাংকনোটের প্যাকেটের দিকে তাকায়। বিড়বিড় করে বলতে থাকে: </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">টাকা, তুই সব সময় বড় অবলম্বন। টাকা নেই তো জগৎ নেই। টাকা, তুই শুধু আমার প্যারাশুট না, যদিও এখন পর্যন্ত ওপরে উঠতে উঠতে কখনোই খুলে যেতে ব্যর্থ হোসনি, তুই আমার এয়ারশিপও, যেকোনো দিকে উড়ে যেতে প্রস্তুত, ভরসা করার মতো, একেবারে ক্র্যাশপ্রুফ। টাকাই আমার শেষ ভরসা, আমার পরিষ্কার ধারণা। টাকাই আমার সর্বশেষ আশার আলো।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">হঠাৎ সে থেমে যায় এবং একই রকম কণ্ঠে ছোট একগুচ্ছ ফ্যাকাসে হলুদ ঘাসকে সম্বোধন করে, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">আমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। কোথায় যাব, জানি না। তবু যেতে হবে। যেখানে গেলে আমি ভেতরের দুঃখ প্রকাশ করতে পারি, দুঃখ প্রকাশ করার হেতু খুঁজে পেতে পারি, যেখানে আনুগত্যের গুরুত্ব আছে। আমার বিপদ দরকার। বিপদ এখানেও হতে পারে। কিন্তু এখানে বিপদের গন্ধ পাচ্ছি না। যে স্বপ্নটা দেখলাম সেটা আসলে কী? আমি একটা টেবিলে বসেছিলাম; আমি ওই টেবিলে দশ বছর ধরে প্রতি সন্ধ্যায় বসেছি, অন্যদের জন্য অপেক্ষা করেছি। স্বপ্নে দেখলাম, অন্যরা এলো এবং অন্য টেবিলে বসল। আমার প্রতি হিংসাবশত নয়, আমাকে চেনে না বলে তারা অন্য টেবিলে বসল। আমার কী হয়েছে? ওরা আমাকে শিল্পী বলল। অথচ আমি তো মহাশত্রু, আমি জুয়াড়ি। আমার মধ্যে জগতের প্রতিনিধিত্ব নেই, আমি যেখানে আছি সেখানে প্রেমহীনতাই মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। আমি বর্শার অগ্রবিন্দু, আমি একগুচ্ছ চাবুকের প্রান্তভাগ। একাধিক গুণে গুণান্বিত না হয়ে, হিংস্রতা হ্রাস না করে আমি শুধু বিভাজন করি, আমি কিছু পয়দা করি না, আমি আক্রমণাত্মক। আমি মনের সতত উপস্থিতির ওপর এতটাই নির্ভরশীল যে আমি মোটেও উপস্থিত নই, অন্য কারো জন্য নই, আমার নিজের জন্যও নই। যে নারীদের আমি ভালোবেসেছি তারা সবাই বলেছে, তোমার উপস্থিতি নেই। ভালোবেসেছি? আমি কাউকে কখনো ভালোবাসিনি। তারা বলে, আমি নাকি সবচেয়ে বেশি মুক্ত মানুষ। তবে আমি আসলে উদাসীন, কারো কোনো কিছুতে নেই। আমি চলচ্চিত্ত। আমার যা বলতে ইচ্ছা করে বলি, আমার যেখানে যেতে ইচ্ছা করে যাই। কিন্তু তাতেও আমি স্বাধীনতার স্বাদ পাই না। শুধু আমার অতীত জীবনে অবিচার আর চরম দারিদ্র্যের অনুভূতি চলে আসে। অন্য কেউ জানে না, কত ঘন ঘন আমি নিজেকে বলি : চুপ থাকো, যেখানে যেমন আছ, তেমনই থাকো। তারা আমাকে রাজা বলে। কিন্তু আমি তো মিথ্যাবাদী, আমি তো ভণ্ড। আমার উদারতা আসলে দেখানো সৌজন্য। নিজে বাঁচো, অন্যকেও বাঁচতে দাও</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">এই নীতি এবং আমার প্রশ্রয় আসলে অনুগত্যহীনতা। অন্যদের থেকে দূরে থাকার বিষয়টা হলো অন্যদের প্রতি আমার ঘৃণা। অন্যরা আমাকে যতই জীবনের রাজা বলুক না কেন, আমি তো মানবজাতিরই শত্রু, জুয়া খেলার সময় আমি তো বদমাশ। জুয়া খেলার সময় আমি আত্মাহীন এক চোর।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">জুয়াড়ি চারপাশে দৃষ্টি ফেলে চাকতি-এলাকার মধ্যে একফালি জমিনে লাঠির মতো ওল্ডারগাছ, খর্বাকার বার্চগাছ আর বাতাসে নিঃশ্বাস ফেলা নিঃসঙ্গ ফারগাছ দেখে। পাশের স্তূপ থেকে দুটি ঢিল তুলে ঠোকা দেয়। শরীরটা সামনে-পেছনে দুলিয়ে বিড়বিড় করে প্যাচাল শুরু করে : </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">নতুন করে শুরু করো। আজ আমি প্রথমবার বললাম এই কথা। আর কাউকে এতটা জোর দিয়ে এই কথা বলতে শুনিনি। নতুন জীবন শুরু করো। তবে যদি শুধু আমি নিজেকে বলি, তাহলে এর কোনো মূল্য থাকে না। অন্য কেউ না শুনলে সে কথার কার্যকারিতা নেই। ভালোবাসো। আমি সময় নেব এবং ভালোবাসায় নিজেকে এগিয়ে যেতে দেব। যে দুঃখ আমাকে রক্ষা করতে পারে, সে দুঃখই চাই আমি। শেষ পর্যন্ত দুঃখ আমাকে বলে দেবে কোন দিকে যেতে হবে। আমার ওপরে দুঃখ চাপিয়ে দাও, ছুড়ে মারো। আমার পাঁজরের মাঝখানে ইস্পাতের কলম আর আটকাবে না। ক্ষতটা প্রতিদিন নতুন করে তৈরি করো, প্রিয়, আমার একমাত্র প্রিয়, তুমি নারী-পুরুষ যে-ই হও না কেন। দরকার হলে আমাকে প্রত্যাখ্যান করো, তবে শুধু প্রত্যাখ্যান করার কারণটা আমাকে বলো। আমাকে ঘৃণা করো, আমাকে পরিহাস করো, আমাকে উন্মোচিত হতে দাও, শুধু একা হওয়ার সমাপ্তি ঘটাও। আমাকে তিক্ত করে দাও, আমার ভেতরেই শাঁস তৈরি হতে দাও, আমাকে ফলবান হতে দাও। স্পষ্ট করে বলো, আমাকে লিখে দেখাও। তাহলেই হবে। আমি যা বলি তার অর্থ যেন থাকে, আমি যা বলি তা যেন শোনা যায়, তাহলেই সেটা টিকে থাকবে। আমি স্পষ্ট করে লিখে নিজেকেই দেব। গানের কথা টিকে না থাকলেও গায়কের কণ্ঠ টিকে থাকে।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">বলা কথাগুলো সত্যি বানানোর জন্য সে সোনালি পেনসিল দিয়ে প্যাডের ওপরে লেখা শুরু করে। লেখার কাজটা সে এতটাই গুরুত্বের সঙ্গে করে যে তার কাঁধ এদিক-ওদিক ঘুরতে থাকে, গোটা শরীর মৃদু ঝাঁকুনি খেতে থাকে। পাথরের ওপর থেকে সে উঠে পড়ে গুল্মভূমিতে জমে থাকা জলে হাত-মুখ ধুয়ে নেয়। এখানে এমন অনেক জল জমা আছে, যেন গুল্মঝোপের নিচের মাটি সারা বছর জমে থাকে। তার নিকটতম জমা জলের পাশেই দেখা যায় ঘাসের একটা একক গুচ্ছ, বড় বড় এবং চওড়া পাতাগুলো চুলের গোছার মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ঘাসের গুচ্ছ সূর্যের প্রথম আলোর ছটায় একপাশ থেকে আলোকিত হয়েছে এবং মৃদু বাতাসে দোল খাচ্ছে। ঘাসের ডগাগুলো স্বচ্ছ, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, বুকের ওপর দিয়ে পাঁজরের মতো শিরাগুলো বয়ে গেছে একেবারে প্রান্তে। একটা ডগার ছায়া পড়েছে আরেকটা ডগার আলোর পেছনটাতে। কাঁপতে থাকা, দুলতে থাকা, ঝাঁকুনি খেতে থাকা গুচ্ছের দিকে যত বেশি তাকিয়ে থাকা যায়, দৃষ্টির সঙ্গে শব্দ এসে যোগ হয়, একটা আরেকটার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায়</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">মাথার ওপরে কাকের চিৎকার, দিগন্তে ট্রেনের বাঁশি, হাউজিং ডেভেলপমেন্টের গালিচা ঝাড়ার শব্দ, চাঁদমারীতে রাইফেলের র‌্যাটট্যাট আওয়াজ। এসব শুনে শেষে ধারণা পাওয়া যায়, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শব্দ তৈরি হচ্ছে ঘাসের গুচ্ছের কেন্দ্রে, গুচ্ছের শিকড়ে। ঘাসের ডগার ভেতর দিয়ে চলমান তীব্র গতি শুধু বাতাসে তৈরি হচ্ছে, তা নয়।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">একই আলোয় বৃদ্ধ লোকটা বৃদ্ধনিবাসের বাগানের একটা মইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সে পেছনের দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, যেন কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে এবং সেই চাহনির প্রতি সাড়া দিতে এভাবে তাকিয়ে আছে সে। যে গাছটার গায়ে মই হেলান দিয়ে রেখেছে, সেটা মইয়ের তুলনায় অনেক ছোট। গাছটা এক দিকে বাঁকা হয়ে গেছে। হাতের কর্তনী দিয়ে সে গাছের ঝাঁকড়া মাথা ছেঁটে দিচ্ছে। তার চারপাশে তাকানোর ভঙ্গি, ত্বরিত সিদ্ধান্ত এবং তার হাতচালনা দেখে বোঝা যায়, সে এই কাজে দক্ষ। কেটে ফেলা ডালপালা তার সারা গায়ে পড়ছে, তার হ্যাটের কোনায়, তার কাঁধের ওপরে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">রংধনু রঙের মৌমাছির খোপের পাশের ছাউনির ভেতর তার অদৃশ্য হওয়ার পর আবার যখন তাকে দেখা যায়, তখন তার পরনে আর নীল অ্যাপ্রন নেই। তার টাই এবং কাঁধের ওপরকার প্রাবার দেখে বোঝা যায়, সে কোথাও বের হচ্ছে। বাগানের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া স্রোতস্বিনীর ওপর ঝুঁকে এসে হাত ধুয়ে নেয়। হাতে কোনো লাঠি ছাড়াই সদর দরজার দিকে এগোয়। তাকে আসতে দেখে স্টাফের সদস্যরা তাকে স্বাগত জানায়। একজন অধস্তন ব্যক্তি পরিচালকের গাড়ির দরজা এইমাত্র খুলে দিয়েছে; পরিচালক হ্যাট খুলে বৃদ্ধকে স্বাগত জানিয়ে তার জন্য শহরে সুন্দর একটা দিন কামনা করে। গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যেভাবে কথা বলা হয় বৃদ্ধের সঙ্গেও সেভাবেই বলা হচ্ছে। তবে বয়স্ক বাতিকগ্রস্ত ব্যক্তির প্রতি যেমন মেকি সম্মান দেখানো হচ্ছে, সেটাও আছে তাদের আচরণের মধ্যে। মনে হচ্ছে, তার পেছনে এরা সবাই পরস্পর হাসি বিনিময় করবে একটু পরেই।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">রাস্তার মোড়ে এসে সে গির্জার দিকে ফিরে তাকায়; প্রায় এক ব্লকের সমান লম্বা ভবনের কেন্দ্রীয় এলাকাজুড়ে আছে গির্জাটা। গির্জার ডাবল দরজার এক পাশ খোলা। খোলা অংশটুকুতে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নেই। সে যখন প্রার্থনাপুস্তকের মতো খাতায় কিছু লিখে রাখছে, তখন এক বয়স্ক দম্পতি তার পেছন পাশ দিয়ে কিছুটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে পার হয়ে যায়। একই রকম উচ্চ শব্দে, বধির লোকদের সঙ্গে যেভাবে কথা বলা হয়, তেমন জোরে জোরে তারা দুজন একসঙ্গে বলে গেল, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">তিনি আবার লিখছেন।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">শহরের মাঝখানে এক ব্যস্ত রাস্তায় থেমে গিয়ে একটা বড় ফাটা পাথরের ওপর নিতম্ব ঠেকিয়ে বসে পড়ে সে। পাথরের ওপর থেকে ধুলা ঝেড়ে তার খাতার একটা পাতলা সাদা পৃষ্ঠা বিছিয়ে নেয়। তারপর একটা লিড পেনসিল ঘসতে থাকে পৃষ্ঠার ওপর; আস্তে আস্তে একটা অক্ষরের, তারপর আরো দুটি অক্ষরের রেখা জেগে ওঠে : এভিটি, রোমান অভিলিখনের অংশ, অর্থ অনিশ্চিত</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">—‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">অথবা?</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">কিন্তু?</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">শরৎ?</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">। তার চারপাশে লোকজনের ভিড় জমছে। সেদিকে তার খেয়াল নেই; মনে হচ্ছে, সে একজন পথশিল্পী। তাদের মাথার ওপরে হটএয়ার বেলুনের হিসহিস শব্দ কিংবা শিখা তাদের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটাতে পারছে না।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">আবার একা হয়ে বৃদ্ধ একটা গাড়িহীন মোড়ে একটা মূর্তির পাদদেশে দাঁড়িয়ে আছে। এটা একটা নারীমূর্তি। পেছনের দিকে মাথা হেলিয়ে দাঁড়ানো, যেন আর্তনাদ করছে। গলার কাছের রেখা দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো। নিচের দিক থেকে দেখলে ভালো করে বোঝা যায়, অভ্রদানা চকচক করার কারণে ওপরের দিকে তোলা তার স্তন পর্বতের মাঝখানের পথ হয়ে গেছে, ওখানে তাকালে দৃষ্টি দূরে কোথাও হারিয়ে যায়; ওখানকার আলো কঠিন পদার্থের মতো লাগে। প্রাবার পরিহিত দর্শক বৃদ্ধ তার খাতায় দ্রুত একটা রেখা এঁকে নেয় এবং তার পাশে একটা শব্দ লেখে। এই কাজটা করার সময় তার গণ্ডপাশে লাল ফুসকুড়ি ছড়িয়ে যায় এবং তার সারা মুখে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে; তার এই বয়সে পাওয়া বিস্ময় খানিক বেমানান মনে হয় : কোনো অল্পবয়সী ছেলেকে কোনো ফরমায়েশে পাঠালে তার প্রথম অভিজ্ঞতায় যেমন বোধ করে, তেমন লাগে এই উত্তেজনা। পরের মুহূর্তে সে তোতলাতে থাকবে; তোতলানোর কারণ তার নিজেরই তৈরি। তবে সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে সে নিজেকে অন্যদিকে চালনা করে। দুজন স্বাভাবিক মানুষকে অনুসরণ করে একটা বেকুব ছেলের দল দুর্বোধ্য ঘড়ঘড় শব্দ, কম্পিত আওয়াজ আর আনন্দ প্রকাশের মতো হৈ-হল্লা করতে করতে মোড় পেরিয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাঁটু ভেঙে হাঁটা দেখে প্রথমেই মনে হয়, তারা বস্তাদৌড়ে অংশ নিচ্ছে। তাদের কেউ কেউ হকি খেলোয়াড়দের মতো হেডগার্ড পরেছে। বিস্মিত হয়ে, আনন্দিত হয়ে বৃদ্ধ তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিংবা তার মুখের ওপর খানিক বোকা বোকা ভাব ছড়িয়ে পড়ে। সে ওদের দলের সঙ্গে একাত্ম বোধ করে। হঠাৎ তার মনে হয়, সে এমন একটা বিষয়ের সম্মুখীন হয়েছে, যার অস্তিত্ব সম্পর্কে একেবারেই বেখেয়াল ছিল। হাঁ করা মুখে সে এই দলের দিকে তাকিয়ে থাকে, খাতাটা সরিয়ে রাখে। ওদের দিকে তাকিয়েই সে আরো সদস্য যোগ করতে থাকে দলে। কারণ মোড়ের কোনো এক জায়গায় আরেকজন দর্শক তার দৃষ্টি অনুসরণ করছে। প্রথমে একটু বিস্মিত বোধ করে সে বুঝতে পারে, আরো একজন আছে। বৃদ্ধ তার দলের পিছে পিছে এগোচ্ছে। তার লেংচানো হাঁটাও বাচ্চাদের মতোই, তবে অতটা শক্তি খরচ করতে হচ্ছে না।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">সৈনিককে সামনে হাঁটতে উদ্বুদ্ধ করছে আরেকটা ভিন্ন মিছিল। দূরে এক শহরতলিতে যেন একেবারে সীমান্তের কাছে একটা বিপন্ন যুদ্ধ-স্মৃতিসৌধ পাহারা দিচ্ছে সে। তার সামনে একটা এক্সপ্রেসওয়ে, তার ওপারে একটা নদী, এখানে নদী পার হয়ে যাওয়া সহজ। কয়েকটা দ্রুত বয়ে চলা স্রোতোধারার সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে নদী। তবে বড় বড় পাথরের কয়েকটা বাঁধ দিয়ে আলাদা করা হয়েছে ধারাগুলোকে। বিচিত্র বর্ণের যুদ্ধপোশাক আর ইস্পাতের হেলমেট পরে সে একটা বেয়নেট-উঁচু রাইফেল বয়ে নিয়ে যাচ্ছে; পায়ের কাছে মচমচ শব্দ করছে রেডিওটেলিফোন। হেলমেটের ছায়ায় ঢাকা পড়েছে তার চোখ।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">অনেকক্ষণ হলো কোনো পথচারীর দেখা নেই। শুধু গাড়ির গর্জন, অনেক ট্রাক চলছে অন্য গাড়ির সঙ্গে। তারপর তাকে পার হয়ে কয়েকটা বাচ্চা স্কুল থেকে বাড়ির দিকে চলে যায়। একটা বাচ্চা সৈনিকের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। ছেলেটার জুতার ডগা সৈনিকের বুটের ডগার সঙ্গে লেগে থাকে। সৈনিক তার বেল্টের বকলেসের ওপর টোকা না দেওয়া পর্যন্ত ওভাবেই থাকে। একমুহূর্ত পরে সেন্ট্রি আবার একা হয়ে যায়। তারপর দুই রাস্তার সংযোগস্থলে তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে পথচারীদের একটা দল দেখা যায়; তাদের উৎসবমুখর পোশাক থেকে এই দৈনন্দিন ভূমিতে অতিপ্রাকৃত দ্যুতি ছড়ায়। এ রকম রহস্যময় মনে হওয়ার কারণ হলো তাদের পোশাকের অনুজ্জ্বল রং : পুরুষদের স্যুটের কালো রং, নারীদের পোশাকের একই রকমের বেগুনি রং। এমনকি নারীদের হ্যাট ও হ্যান্ডব্যাগগুলোও একই রকমের। এই দলটা হলো অগ্রগামী দল। এদের পিছে পিছে আসতে থাকে ছুটির দিন উপভোগকারীরা, জোড়ায় জোড়ায়, ছোট ছোট দলে এবং শেষে ঢলের মতো। তারা ফুটপাত ও রাস্তারও খানিকটাজুড়ে চলতে থাকে। স্মৃতিসৌধ পার হয়ে যাওয়া এই দল আসলে কোনো প্যারেডে অংশ নিচ্ছে না। এরা স্মৃতিসৌধ কিংবা সৈনিক কাউকেই দেখছে বলে মনে হচ্ছে না। তাদের গতি মোটেও মার্চ করার মতো নয়, বরং মৃদু বাতাস খেতে খেতে হেঁটে বেড়াচ্ছে তারা। তারা নিজেদের মধ্যে মগ্ন হয়ে আছে, হালকা কথাবার্তা বলছে। তাদের অঙ্গভঙ্গি কোনো রকম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই; তাদের চোখে তৃপ্তির আভা; এমনকি শিশুদের আচরণেও বোঝা যাচ্ছে, তাদের উৎসব শেষের দিকে এলেও তার আমেজ শেষ হয়নি। বিয়ের কিংবা ব্যাপ্টিজমের অনুষ্ঠান নয়, এটা তাদের সবার একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এইমাত্র শেষ হওয়া আচার-অনুষ্ঠানের রেশ তাদের মধ্যে রয়ে গেছে, তাদের একসঙ্গে আবিষ্ট করে রেখেছে। কেননা পূজাস্থল থেকে দূরে চলে এসেছে তাদের কথাবার্তার বিষয়াদি, পুরোপুরি ঐহলৌকিক। এই বিরাট উৎসবটা শুধু এই দলের লোকেরাই পালন করে। বিদেশিদের জাতের একটা শাখা এরা। তবে বাইরে তেমন কোনো প্রমাণ নেই। শুধু যারা পাশ দিয়ে প্রাইভেট গাড়িতে যাচ্ছে, তাদের থেকে এদের সময়জ্ঞান পুরোপুরিই আলাদা। শুধু অল্পবয়সী মেয়েদের বিষয় চোখে পড়ার মতো : এদের পায়ে উঁচু বুট, তাদের পরনে আঁটো খাটো শর্টস, হাঁটার সময় চকচক করে। এদের জন্য এ উৎসব হলো রক্তমাংসের উৎসব। বাড়ি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের দীর্ঘকায়-খর্বকায় প্রত্যেকেই নিজ নিজ সঙ্গীর কাছে নিজেদের নিবেদন করবে এবং এদের রুমে রাত নামা পর্যন্ত শুধু এই মিলিত হওয়ার ভাষা বিরাজ করবে। রাস্তা দিয়ে আস্তে আস্তে যেতে যেতে আলোর নিচে চকচকে চোখে আসলে তারা নিজেদের তৈরি করছে অন্ধকার তাঁবুতে যাকে স্বামী হিসেবে পাবে তার জন্য।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">সৈনিক স্মৃতিসৌধের পাশে আর দাঁড়িয়ে নেই। তার রাইফেলটা শুধু বেদির পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। রেডিওটেলিফোনটাও নীরব হয়ে আছে। তার ইস্পাতের হেলমেটটা বালু আর ডিম আকারের পাইনকুশির ভেতর আধাডোবা অবস্থায় নদীর ধারে পড়ে আছে। পানির কুলুকুলু ধ্বনি, ট্রেনের গর্জন আর হেলিকপ্টারের একটানা শব্দ ধারণ করছে হেলমেটটা। মৃদু ঢেউ খেলানো চুলে সৈনিক একটা আন্ডারপাসের ভেতর দিয়ে দৌড়ে চলেছে; আন্ডারপাসটা এত দীর্ঘ যে তার শেষটা চোখেই পড়ছে না। তার মতো সৈনিকরা তার বিপরীত দিক থেকে আসছে। সুপারমার্কেট থেকে ব্যারাকে ফেরার সময় সবাই একই রকম প্লাস্টিক ব্যাগ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দু-চারজন কথাবার্তা বলতে বলতে যাচ্ছে; বাকিরা চুপ করেই তাকে পার হয়ে যাচ্ছে। কেউ তাকে খেয়াল করছে না। দুটি মেয়ে হাত ধরাধরি করে যাচ্ছে, দেখে মনে হয়, নিজেদের প্রতিরক্ষা দেওয়ার জন্য এভাবে হাঁটছে। তারাও সৈনিককে খেয়াল করে না। তাকে পার হয়ে চলে যাচ্ছে। তাদের দৃষ্টি যেন শুধু সামনে কোথাও বের হয়ে যাওয়ার পথ খুঁজছে। একবার থেমে সে পশমি বুট থেকে একটা ছুরি বের করে। সুড়ঙ্গের দেয়ালের খাঁজ থেকে খুব ছোট একটা খোদাই করা লেখা ছরির ডগা দিয়ে ঘষে ঘষে তুলতে থাকে। তারপর তাড়াহুড়া না করে পেছনের পকেট থেকে তার বইটা বের করে লম্বা পদক্ষেপে সামনের দিকে এগোতে থাকে। এখন সে পুরোপুরিই ডুবে আছে বইয়ের জগতে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">আন্ডারপাস থেকে বের হয়ে সৈনিক এখন সম্পূর্ণ এক আলাদা জগতে। রাস্তার পাশের ঝোপঝাড়ের গুল্মগুলোর চিরসবুজ কাপ আকারের পাতা দক্ষিণ পাশের সূর্যালোকে বহুদূর পর্যন্ত জ্বলজ্বল করছে। নদীর শুকনো পাথুরে তলদেশ দিগন্তের মোচাকৃতির পাথর পার হয়ে চলে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে সৈনিক কালো চশমা পরে এবং জ্যাকেটের জিপার খুলে দেয়। তার পেছনে বহুদূরে মেঘেদের গায়ে মিশে আছে উত্তরের তুষারাবৃত পর্বত।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">জানালার পর্দা ফেলে দেওয়া আছে বলে সূর্যের আলো আটকে গেছে বাইরে। জানালার দিকে পেছন ফিরে একটা স্যুটকেসের ওপর বসে আছে অল্পবয়সী নারী। তার শোবার ঘরের লিনেন দেরাজের ওপর বসা ছোটবেলার ছবিতে যেমন ভাব, তার মুখে তেমন একটা ভাব ধরা আছে এখন। তেমনই নীরব হয়ে কোলের ওপর দুহাত ভাঁজ করে এক পা আরেক পায়ের ওপর তুলে শূন্যে তাকিয়ে আছে সে, চারপাশের কোনো কিছুর প্রতি খেয়াল নেই। শুধু পিগটেইল করে চুল বাঁধার বদলে চুল ছেড়ে দেওয়া আছে; আর বড় বড় বোতামওয়ালা ড্রেসের বদলে সেলাই করা স্যুট পরে আছে সে। নীরব আছে ঠিকই, তবে নীরবতা বারবার ভেঙেও যাচ্ছে। যেন আগে থেকে ঠিক করে রাখা বিরতিতে মনের ভাব জোরালোভাবে বের করে দিয়ে সে বাইরের জগতের প্রতি সম্মান দেখাচ্ছে; এটা অভিনয় হতে পারে, আবার সত্যিও হতে পারে : </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">এই যে আপনারা, আপনারা সব সময় আমাকে বদলে যেতে বলেন! কিন্তু আমি তো বদলে যেতে চাই না। আমি তো কাজ করতে চাই না। কাজ আমাকে শুধু ধ্বংস করে দেবে। কাজ মানুষকে বেকুব বানায়, অবশ্যই আপনাদেরও। আমি কোনো কিছু জানতে চাই না। আমি জাদুঘরে যেতে চাই না, আমি কোনো বিদেশি ভাষা শিখতে চাই না। আমি ছবি দেখতে চাই, তবে হঠাৎ করে দেখার মতো করে, পরিকল্পনা করে নয়। সেটা যেখানেই হোক না কেন। আমি নিজের পরিচয়ের মধ্যে থাকতে পারি, নিজের মতো কাজ করতে পারি শুধু আমার নিজের ভাষায়। বিদেশি ভাষায় আমি ভালোবাসতে পারি না। কাজ যেমন ধ্বংস করতে পারে, জ্ঞানও তেমন ধ্বংস করে দিতে পারে আমাকে। জ্ঞান আমাকে নিরাবেগ বানিয়ে দেবে, আহাম্মক বানিয়ে ফেলবে। আমার ছোটবেলায় আপনারা যখন আমার সামনে লেকচার ঝাড়তেন, আমি কান বন্ধ করে রাখতাম। আপনাদের জ্ঞানের বইপত্র আমার পড়তে না পারার একটা কারণ হলো বইয়ের ভেতরের বাক্যবিন্যাস। সেখান থেকে আমি শুধু একটানা বক্তৃতা ছাড়া আর কিছুই বের করতে পারতাম না।আপনারা বক্তারা আমার রক্ত চুষে খাচ্ছেন। আপনাদের এ রকম জ্ঞান বিতরণ আর সহ্য করা উচিত নয়। আপনাদের জ্ঞান হলো নিষিদ্ধ বস্তু। জ্ঞানের জগতে প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। আপনাদের মতো ধূর্ত লোকদের জ্ঞান নিয়ে নিজেদের ভেতরই নীরব থাকা উচিত। শুধু জরুরি মুহূর্তে জ্ঞান নিয়ে এগিয়ে আসতে পারেন, তা-ও গান কিংবা কবিতার আকারে। কিন্তু আমি বাইরে যেতে চাই না। বাইরে গিয়ে আমি কী করব? আমার উপযুক্ত পরিবেশ দরকার। আমি এখানেই সেটা পেতে পারি। হাঁটো, দৌড়াও, গাড়ি-ঘোড়ায় ওঠো, ভ্রমণ করো। হাঁটো, ঘরের বাইরে</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">এসব কথা বলে আপনারা আমাকে রুমের একদম সর্বশেষ কোনায়, ভাঁজ করে রাখা পর্দার পেছনে নিয়ে গেছেন। মা-বাবার সঙ্গে যতবার কোথাও বেড়াতে বের হয়েছি, গাড়িতে বসার সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। বেড়ানোর সময় কী কী দেখেছি, তার একটাও মনে নেই। কোথায় যেন এস্কিমো পাই দেখেছিলাম, আরেকটা গ্যাস স্টেশনে সিটহীন টয়লেট দেখেছিলাম</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">এই মনে আছে। নামে লোরলি হলেও এমনকি ট্রেন থেকেও দুর্গন্ধ ছড়ায়। আবার বিমানকে ট্রান্সওয়ার্ল্ড বলা হয় এবং বিমান আন্তর্জাতিক তারিখরেখা পেরিয়ে উড়ে যায়; তবু বিমান আমাকে শুধু কংক্রিটের রানওয়েতে নিয়ে যেতে পারে, যেখানে অভিন্ন নগরীর দিগন্তের রূপরেখা আমাকে শুধু বাড়ির কথাই মনে করিয়ে দেয়। আপনাদের ত্রিস্তান দা কুনহা কিংবা আপনাদের অ্যান্টার্কটিক কিংবা কী যেন নদীটার নাম, যেখানে প্লেটো একবার ঘুরে বেড়াতে গিয়েছিলেন মনে করা হয়</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">এসব দেখার সামান্য ইচ্ছা আমার নেই। বিদেশি বিস্ময়ে আমার বিশ্বাস নেই। আপনাদের সব পবিত্র ঝরনা, গাছ ও গুহাকে খেলার মাঠ বানানো উচিত, সেখানে থাকবে কাগজের নৌকা; দৈববাণী প্রকাশের সব স্থানে ফ্লাশলাইটের ঝলমলে আলো থাকা উচিত। প্রকৃতির মহিমার কথা বলে বলে আমার কান ঝালাপালা করবেন না। এমনকি লিন্ডেনগাছ, গোলাপ, তুলোট মেঘ</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">এসব কথাও আমার গলার ভেতর আটকে থাকে। কারণ আমাদের কবিতার অ্যালবামের আবর্জনার মধ্যে এই কথাগুলো ব্যবহার করতে করতে আমরা এদের মৃত্যু ঘটিয়ে ফেলেছি। শুধু ভালোবাসার খাতিরে আমি এই জায়গাটা ত্যাগ করতে রাজি আছি, শুধু ভালোবাসার জন্য আমি দিনরাত ভ্রমণ করতে পর্বতে উঠতে, ঘোড়ায় চড়তে, সাঁতার কাটতে পারি, আপনাদের কোনো ঘোরানো পথে না গিয়ে সব সময় একেবারে সোজা পথে।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">তার ঘোষণার শেষের অংশটা তার হাতের পেছনের একটা মাছিকে উদ্দেশ করে বলা হয়। সে লাফ দিয়ে উঠে মাছিটাকে জানালা দিয়ে বের হয়ে যেতে দেয়। এভাবে সে ভবনের বাইরে একটা ট্যাক্সি দেখতে পায়। মনে হয়, ট্যাক্সিটা কিছুক্ষণ ওখানে অপেক্ষা করছে। চালক পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। জানালার ভেতর পর্যন্ত তাকিয়ে সে তাড়া দেওয়ার জন্য হর্ন বাজায়। মহিলা দৌড়ে বসার ঘরে যায় এবং দিনের রাশিফলের ভিডিও দেখে নেয় : </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">আজ আপনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিন। সঠিক মুহূর্ত হেলায় হারাবেন না। নিজের মন ঠিক করুন। শুধু সংকটে পড়লে অন্যের সাহায্য নেবেন। সংকট কিংবা বাধার চেয়ে বেশি গুরুত্বের কারো সাহায্য ছাড়াই আপনি বাধা পেরিয়ে আসতে পারেন। আপনি জানতে পারবেন, সাধারণত শুধু সংকটের সময়ই আপনি যাকে সামনে পান তার কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার চেষ্টা করেন এবং সাহায্য পাওয়া যায় না।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt"> মহিলা আয়নার সামনে গিয়ে কপোলে হাত বোলায়। তার চোখ প্রসারিত, কাঁধ বাঁকানো। দুই হাতে আয়নার ফ্রেম শক্ত করে ধরে থাকে, যেন এই রুমের চার দেয়ালের বাইরে যেতে ভয় পাচ্ছে, অথচ তাকে জোর করে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পৃথিবীর শেষ প্রান্তের দিকে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">কিন্তু এরই মধ্যে সে ট্যাক্সির দিকে হাঁটা শুরু করে দিয়েছে। তার চেহারা এবং হাঁটার ধরন বদলে গেছে : মনে হচ্ছে, একপাশ থেকে মূল মঞ্চে প্রবেশ করছে। বলিষ্ঠ পায়ে হেঁটে যাচ্ছে সে। হাতের অ্যালুমিনিয়াম স্যুটকেসটা এদিক-ওদিক দোল খাচ্ছে, যেন ভেতরে কিছু নেই। বাতাসের কারণে তার চোখ বড় বড় দেখাচ্ছে, নাসারন্ধ্র ফুলে উঠছে, দাঁত চকচক করছে। তাকে এগিয়ে আসতে দেখে চালক আশ্বস্ত হয় এবং মহিলার কষ্ট দূর করার জন্য তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে নিজের হাতে নিয়ে নেয় স্যুটকেসটা। এবার মনে হচ্ছে, স্যুটকেসটা আগের চেয়ে বেশ ভারী। ট্যাক্সিতে উঠে মহিলা ভবনের দিকে ফিরে তাকায়</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">কালো কালো আর দাগদাগালিভরা কাঠের ব্যালকনি; বেঁটে সাইপ্রাস-বেড়ায় ঘেরা ছাদবাগানওয়ালা আলগা ভাবের চেহারা দেখানোর মতো কংক্রিটের কাঠামোটার সামনের পাশ দেখা যাচ্ছে। মহিলা শব্দ করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। একই মুহূর্তে তার হাতের মুঠি আলগা করে সে। তখনই চাবির গোছা নিচে পড়ে যায়। চাবিগুলো সাইডওয়াকের ওপর একটা একলা গিংকো পাতার পাশে ফ্যানের পাতের মতো পড়ে থাকে। দূর থেকে বাতাসে উড়ে এসেছে বড় কাণ্ডওয়ালা এই ছোট পাতাটা, বড় গাছের পাতার চেয়ে বরং ফুলের পাপড়ির সঙ্গে চেহারার মিল বেশি পাতাটার।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">ট্যাক্সি দ্রুত চলা শুরু করে। এরই মধ্যে সামনের মোড়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে। তারপর মহাসড়কে ওঠার পর আসে সিদ্ধান্তহীনতার সব দৃশ্য; বাঁ দিকে লেন পরিবর্তন, মাঝরাস্তায় আবার ফিরে আসা, দিক পরিবর্তন, চুলের কাঁটার মতো সোজা পেছনে ঘোরা, খোলা রাস্তায় উল্টো গিয়ার।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">শেষে দুই রাস্তার মিলনস্থলে এসে থেমে যায় ট্যাক্সি। রাস্তার বাতি সবুজ হলেও ক্যাব অনড় হয়ে থাকে। অন্য গাড়িগুলো দুপাশ থেকেই চলে যেতে থাকে। মাথার ওপরের তার থেকে ট্রাফিক আলো ঝুলছে, আকারে বড় হলেও আলোটা অপার্থিব ছন্দে অবিরাম দুলছে। মুহূর্তের জন্য আলোটাকে মনে হয় হাজার চোখের বিরাট এক দেবী, চারপাশে লাল-হলুদ-সবুজ রঙে চোখ পাকিয়ে তার পায়ে মনুষ্যজীবন সমর্পণ করার দাবি জানাচ্ছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">বসন্তের রোদে তৃণভূমির ঘাসের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে আছে জুয়াড়ি। জায়গাটা অনাবাদি গুল্মভূমি, সে আগে যেখানে ছিল, তার চেয়েও প্রত্যন্ত এই জায়গাটা। কোনোখানে পানি জমে থাকার মতো খানাখন্দ নেই, পাথরের টুকরার ঢিবি নেই। প্রান্তের দিকে যে দু-চারটি গাছগাছালি আছে, সেগুলোর কোনোটাই ভালো করে বাড়তে পারেনি, বেশির ভাগই শুকিয়ে গেছে। একমাত্র শব্দ বলতে আছে বাতাসের শনশন আওয়াজ, আশপাশে কোনো বসতি কিংবা আবাদ নেই বলে কোনো কিছুতে বাধা না পেয়ে বিশাল ফাঁকা পরিত্যক্ত এলাকা থেকে সরাসরি বয়ে আসছে বাতাস। লোকটা আহত হয়ে পা টানতে টানতে এখানে চলে আসতে পারত। অবশ্য এখানে কাউকে দেখতে পেত না সে। মনে হয়, একসময় মানুষের বসতি ছিল; গাছপালার পেছনে এ রকম ধ্বংসাবশেষ আছে, যা দেখলে পাহাড় কিংবা বড় টিলা মনে হতে পারে। একটা গর্ত দেখা যাচ্ছে, তার চারপাশটা সাদা; একসময় এটা হয়তো প্রবেশদ্বার ছিল, নিচের অংশটা ছিল জানালা। তবে এ জায়গাটা কোনো প্রাচীন নিদর্শন পাওয়ার মতো জায়গা নয়। শায়িত জুয়াড়ির একপাশে পাথরের তৈরি একটা ফায়ারপ্লেস আছে, ছাই অনেকটা তাজা মনে হচ্ছে, বৃষ্টি হয়ে ঝরতে পারেনি এমন কয়েক ফোঁটা পানির দাগ লেগে আছে ছাইয়ের ওপরে। অন্য পাশে বাংলা চার সংখ্যার আকারে একটা রবার ব্যান্ড পড়ে আছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">জুয়াড়ি হঠাৎ লাফিয়ে উঠে একটা বক্সগাছের কাছে যায়। গাছের নিচে একটা পাথরকে ঘিরে আছে ঘাসের থোকা; মনে হচ্ছে এটাই ছিল আগেকার এস্টেটের সীমানাচিহ্ন। পাথরের ওপর পা রেখে সে মাথার অনেক ওপরের টাওয়ারগুলো আর বক্সগাছটা সম্পর্কে ভাবতে থাকে। এই জাতের গাছ সাধারণত এত বড় হয় না, গাছটা খুব নরম, আবার বুনোও। গাছটার পাতা কাটা হয়নি অনেক দিন, পাতাগুলো চারদিকে অসমান গোছায় ছড়িয়ে পড়েছে। সবগুলো বিভিন্ন দিকে পৃথিবীর প্রান্তের রাস্তার দিকনির্দেশক তীরের মতো মাথা বের করে এগিয়ে গেছে। গাছের একেবারে মাথার ওপরে খানিকটা বাঁকা তবে তীরের মতো লম্বা নতুন একটা ডাল অবিরাম মাথা দুলিয়ে যাচ্ছে আরেকটা পাতাহীন গাছের দিকে। এই গাছটার ডালপালা নেই, মাথা থেকে গোড়া পর্যন্ত আইভিলতায় ঢাকা পড়েছে। আলাদা কোনো গাছ বলে আর এটাকে চেনার উপায় নেই। এটাকে গাছ না ভেবে বরং কোনো পাহারাদারের অগোছালো খুপরি বলা যায়। এই গাছটার মাথা ওপরের দিকে দুলতে থাকে এবং আইভিলতা কচি ডালপালার সঙ্গে জড়াতে থাকে। মাথার ওপরে মনে হয় একটা বাসা আছে। আসলেই একটা বাসা আছে। কী যেন নড়াচড়া করছে বাসার মধ্যে, বাসার প্রান্ত বেয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। একটা বাজপাখির বাচ্চা, কয়েক দিন আগে মনে হয় উত্তরের দিকে কোথাও থাকতে পালক গজিয়েছে। ইগলের আকারের মেঘের মতো ধূসর রঙের রেখা উঁকি দিচ্ছে এটার হলুদ চোখের চারপাশে। উড়ে যাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, মসৃণ পরিপাটি পালকের শরীরে চুপ করে বসে আছে। চোখ পর্যন্ত নড়াচড়া করছে না, কোনো কিছুতে সাড়া দিতেও প্রস্তুত নয় মোটেও। দীর্ঘ ভ্রমণের পর দীর্ঘ বিশ্রামের জন্য চুপটি করে বসেছে। কিন্তু নিচ থেকে বাচ্চাটাকে যে দেখছে তার মধ্যে কী একটা ঘটছে। মুখের এক কোনায় ত্বকের ওপর একটু ঢেউ খেলার মতো মনে হলো প্রথমে; তারপর মুখভঙ্গির মতো, শেষে সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল নীরব হাসি। শিশুকালের পর থেকে সে আর কখনো এমন হাসি হাসেনি। এবার সে আস্তে আস্তে দৌড়ানো শুরু করে। তবে বাসায় বসে থাকা ইগল মাথা ঘুরিয়ে তাকায় না তার দিকে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">দৌড়াতে দৌড়াতে জুয়াড়ি মাঝে মাঝে এদিক-ওদিক মুখ ঘুরিয়ে চারপাশে দেখার চেষ্টা করে। তার মনে হয়, এইতো কয়েক মুহূর্ত পার হয়েছে এবং সে মানবজীবনের প্রথম চিহ্ন দেখতে পায় : স্কাউটরা ছোট এক টুকরা কাগজ সেঁটে দিয়ে গেছে একটা কাঁটাগাছের ঝোপের সঙ্গে। কাগজের টুকরাটায় কাঁচা হাতে লেখা আছে : </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">এই চিহ্ন অনুসরণ করুন।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt"> সে অন্যদিকে ঘুরে চলা শুরু করে এবং একমুহূর্ত পরেই আরেকটা কাগজের টুকরা পায়। সেটাতেও একই কথা লেখা। এটা পড়ে আছে কয়েকটা বাড়িঘরের কাছাকাছি এলাকায়, একটা ময়লার কানেস্তারার জালির সঙ্গে আটকে আছে। সে গাছপালার ঝোপের দিকে ফিরে যেতে থাকে এবং একদল নারী-পুরুষের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তারা ট্র্যাকস্যুট পরে হাঁটু মুড়ে একটা ফিটনেস কোর্সে অংশ নিচ্ছে। জুয়াড়ি আবার চলা শুরু করে এবং পরের মুহূর্তে শহরের প্রান্তে পার্কের মতো একটা কবরস্থানে পৌঁছলে দেখতে পায়, একটা দাফনের মিছিল তার পথ পার হয়ে যাচ্ছে। বেল বাজতে থাকে এবং দাফনে অংশগ্রহণকারীরা একটা বাঁধানো কবরের চারপাশে ঘোরে। জুয়াড়িও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। অপরিচিত হলেও তাদের একজন হালকা মাথা ঝাঁকিয়ে তাকে স্বাগত জানায়। তারা যখন কবরের পাশে, সে ওই অপরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে বিদায় নেয় এবং কবরস্থানের বাইরে চলে আসে। কর্মব্যস্ত শহরে পৌঁছানোর পর সে মোটামুটি একই রকম গতিতে হাঁটতে থাকে। শুধু একবার কোনো কারণ ছাড়াই সে ছোট একটা খোলা জায়গায় থামে। থামার আকস্মিকতায় তার হাত থেকে কয়েকটা ঘুঁটি সাইডওয়াকে পড়ে যায়। সে ঘুঁটিগুলোর গড়িয়ে যাওয়া থামায় এবং কুরিয়ে তোলে, তারপর কোনার দিকে অদৃশ্য হয়ে যায়। দেখে মনে হয়, সে দ্বিগুণ পেছনে চলে এসেছে। আসলেই আকাশে বাষ্পের রেখাগুলো ভিন্ন দিকে চলে যাচ্ছে। আরেক দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে একটা সিগারেটের গোড়া। সংগীতের এক ছাত্রী আবার আরেক দিকে হাঁটছে তার বাদ্যযন্ত্রের ছোট বাক্স নিয়ে। অদৃশ্য হাতের নিয়ন্ত্রণে একটা মোটরগাড়ি অ্যাসফল্টের ওপর দিয়ে চলছে আরেক পথে। দৌড়াতে দৌড়াতে সে পেছনের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">আমাকে অনুসরণ করো।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">নগরীর মাঝখানে বিভাগীয় বিপণি থেকে দুপা দূর দিয়ে যে ট্রেনটা চলছে, সেটাও খেলনার মতো মনে হচ্ছে। ট্রেন থামার কোনো স্টেশন নেই; ট্রেনের নিচের ট্র্যাক সর্বশেষ গাড়ি পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারের সঙ্গে মিশে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য ট্রেনটাকে খেলনা খেলনা মনে হচ্ছে। কিন্তু ট্রেনটা যাত্রীর ভিড়ে ঠাসা। আরো যাত্রী দৌড়ে এসে ট্রেনে উঠে পড়ছে। তবে সড়কের গাড়িতে ওঠার জন্য যাত্রীরা যেমন ব্যাগপত্র বোঝাই করে নিয়ে আসে, এরা তেমন নয়। আন্তর্জাতিক এক্সপ্রেস ট্রেনগুলোর মতো এটাও ভিন্ন ভিন্ন অংশের সমন্বয়ে তৈরি। ইঞ্জিন প্ল্যাটফরম থেকে অনেকখানি সামনে। যাত্রীদের দেখে মনে হচ্ছে না, তারা নিয়মিত ভ্রমণ করে অভ্যস্ত। দীর্ঘ অবয়ব আর যাত্রীদের উত্তেজনা এবং বিস্ময় প্রকাশের কারণে এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছে, এটা সারা দেশের অভিবাসী এবং তীর্থযাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত একটা বিশেষ ট্রেন। </span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">এখনো পরিষ্কার দুুপুর। বসন্তের দুপুরবেলা গাড়িগুলোর গোলাকার ওপরের অংশে চকচক করে উজ্জ্বল আভা ছড়াচ্ছে। একটা সংকেত বাজে, তবে ট্রেনের বাঁশির মতো নয়, অনেকটা সমুদ্রের জাহাজের ভেঁপুর মতো। সংকেতটা দীর্ঘতর হয়েছে বলে প্ল্যাটফরমের একটা শিশু রেডিওর নাটকের মতো করে ছন্দে ছন্দে দুহাতে একবার কান চেপে ধরছে, আরেকবার ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু বিস্ময়ের কথা হলো, এত বড় ট্রেন ছাড়ার আগে যাত্রীদের বিদায় জানাতে মাত্র অল্পসংখ্যক মানুষ এসেছে। জানালার বাইরে খুব একটা তাকাচ্ছে না কেউ। ফলে বাজারের স্টলগুলোর পাশ দিয়ে এগোনোর সময় জুয়াড়িকে ভিড়ের মধ্যে পথ করে নেওয়ার মতো পরিশ্রম করতে হচ্ছে না। সোজা কম্পার্টমেন্টের দিকে এগিয়ে যেতে পারে সে। কোনো করিডর ধরে কম্পার্টমেন্টে যেতে হয় না, বরং বাইরে থেকে সরাসরি পৌঁছে যায় সে। দরজায় পৌঁছানোর আগেই দেখতে পায়, দরজাটা খোলা আছে। ধারণক্ষমতা অনুযায়ী যাত্রী উঠে পড়লে রজ্জুরেলের দরজা যেমন একাই বন্ধ হয়ে যায়, সে ভেতরে ঢোকার পর এই কম্পার্টমেন্টের দরজাও বন্ধ হয়ে যায়।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">তার সিটে বসার পরও কয়েকটা সিট খালি থেকে যায়। আরো তিনজন যাত্রী আছে। চারজনের প্রত্যেকেই যার যার মতো আলাদা এসেছে, তবে কম্পার্টমেন্টের এ রকম আসন ব্যবস্থাটা সবাই মেনে নেয়। জুয়াড়িকে নিয়ে তাদের দল পূর্ণ হয়েছে। জানালার পাশে বসা মহিলা জুয়াড়ির দিকে খুব বেশি মনোযোগের সঙ্গে তাকায় না। তার সব মনোযোগ তার অ্যালুমিনিয়াম স্যুটকেসের দিকে, যেন স্যুটকেসটা বিপন্ন অবস্থায় আছে। তার বিপরীত পাশে বসা বৃদ্ধের হাতে পেনসিল। সে ডুবে আছে তার খাতার মধ্যে। আর সৈনিক আছে পেছন ফিরে। কারণ সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে, যেন দরজা পাহারা দিচ্ছে। আসলেই বেশ কয়েকজন এই কম্পার্টমেন্টে ঢোকার চেষ্টাও করে; প্রথমে আসে বড় বড় গলায় কথা বলতে থাকা এক জুটি; ভেতরে চারজনকে দেখে তারা ফিরে চলে যায়। তারপর ভ্রমণের পোশাক পরা একজন পাদ্রি আসে; সবার দিকে শুভেচ্ছা জানানোর ভঙ্গিতে হাসিমুখে তাকায়, তার একটা পা চৌকাঠেই থাকতে আর ভেতরে ঢোকে না, যেন পাশের কম্পার্টমেন্টেও শুভেচ্ছা জানাতে হবে। শুধু একটা শিশু দরজা খোলার মতো শক্তি নিয়ে সৈনিকের পাশ দিয়ে খানিকটা এগিয়ে এসে দরজায় ঠেলা দেয়; তখনই তার মা-বাবা মাথা এগিয়ে দিয়ে শুধু শিশুটাকে বলে, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">না, এখানে নয়। অন্য কোথাও।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt"> শিশুটা শুধু একটু কাঁধ ঝাঁকি দিয়েই মেনে নেয়।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">বাইরের কোলাহল থেমে গেছে। কিন্তু ট্রেন ছাড়ছে না। অনেক সময় আছে। সৈনিক সিটে বসে। তবে উসখুস করে ওঠে, কোনো ঘটনার আশায় নয়, কোনো কথার আশায়। মহিলাই প্রথমে অন্যদের দিকে নজর দিয়ে নিরিবিলিতে বলা শুরু করে, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">শিশুকাল পার করার পরই আমি এদিক-ওদিক ঘুরতে বের হই। একবার বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে যেতে বহুদূর চলে গেলাম। কোথায় গিয়েছি আর বুঝতেই পারছি না। একসময় লোকজন আমাকে ধরে ফেলে আমার পরিচয় জানতে চায়। কিন্তু আমি নিজের নাম-ঠিকানা সব গেছি ভুলে। আমি শুধু একটার পর একটা ট্রেন ধরেছি। তবে দূরের ট্রেন নয়, শুধু লোকাল ট্রেন ধরেছি, অবশ্য ট্রেনটা কোথায় যাচ্ছে সেসব আমি জানার চেষ্টা করিনি। ফিরে আসার টিকিট কখনো কাটিনি। ওখানে আমি কী করছিলাম, প্রশ্ন করাতে লোকজন জানায়, আমি শেষ স্টেশনের ওয়েটিংরুমে এবং এর আশপাশে বসে থেকেছি, কিংবা ট্রেন বোঝাই করার সময় প্ল্যাটফরমে দেখা গেছে আমাকে, কিংবা মাঝে মাঝে কোনো মাঠের কোনায়, কাঁকরের গর্তের কাছে, কিংবা কোনো ছোট নদীর ধারে। কোন মৌসুম চলছে তা জানার ধার ধারিনি আমি। লোকজন আমাকে খেয়াল করা শুরু করে, যখন তারা দেখে আমি একই জায়গায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আছি। তার আগ পর্যন্ত আমি এমনভাবে ঘোরাঘুরি করেছি, যেন আমি জেনেশুনে কোথাও যাচ্ছি, রাস্তাঘাট চিনি। লোকজন মাঝে মাঝে গাড়ি থামিয়ে আমাকে গাড়িতে উঠতে বলেছে, তবে কখনো আমাকে কেউ ছোঁয়নি, আমার গায়ে হাত দেয়নি। কারো সঙ্গে আলাপ শুরু হওয়ার মতো বিষয়ও ছিল না। কারণ আমার কাছে সব প্রশ্নের উত্তর শুধু একটাই       ছিল : আমি জানি না। সুতরাং আমাকে পুলিশের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি ভবঘুরে হতে পারি না, সেটা প্রশ্নের অতীত। এমনকি গ্রামের কনস্টেবলরাও তাদের বেড়ার আড়াল থেকে বের হয়ে এলো আমাকে দেখে। হঠাৎ করে তারা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা ছেড়ে দিল। আমাকে সব সময় অনেক টাকা দেওয়া হয়েছে; সে জন্যই তারা ভেবেছে আমি খ্যাপাটে। বাড়িতে না পাঠিয়ে তারা আমাকে একটা ইনস্টিটিউশনে নিয়ে গেল। অ্যাম্ফিথিয়েটারের মতো একটা লেকচার হলে আমাকে ছাত্রদের সামনে প্রদর্শন করা হলো। প্রফেসর সাহেব আমাকে প্রদর্শন করলেন আমি অসুস্থ ছিলাম বলে নয়, আমার নিজের অবস্থার কারণে। যদিও আমি তাঁর প্রশ্নের উত্তরে শুধু শিখিয়ে দেওয়া হ্যাঁ অথবা না বলে গেলাম, তবু আমার কাজ শেষ হলে তিনি দুহাতে আমার হাত নাড়া দিয়ে দরজা খুলে দিলেন। ছাত্ররাও আমাকে নিয়ে পাগল ছিল। ঘুরে বেরিয়ে আমি খুব তৃপ্তি পেয়েছি, তা নয়। কারণ যখন তারা আমাকে কোথাও বসে থাকতে দেখেছে তখনই হয় আমি কাঁদছি, নয়তো সাহায্যের জন্য চিৎকার করছি। তবে আমার অবস্থা তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। যেসব বিষয় তাদের চোখের সামনে পড়েনি, সেগুলো সম্পর্কে তারা ভাবতে পেরেছে। মানসিক রোগীরা যখন পারফরম করছে, তখন আমি কিউবিকলের আড়ালে বসে থাকছি আমার পালা আসা পর্যন্ত। শ্রোতারা হাসছে কিংবা কাশছে, আমি শুনতে পেয়েছি। তবে আমি সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা নীরব হয়ে গেছে। তারা আমার জন্য দুঃখ পায়নি, আমাকে ঈর্ষা করেছে। আমার সম্পর্কে তারা যা শুনেছে তাতে তাদের আকাঙ্ক্ষা বেড়ে গেছে। তারা পরিচিত রাস্তাঘাটের ভিড়ে ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে আমার মতো করে স্বপ্নের মতো একা একা বিচরণ করতে পারত তাহলে তাদের ভালো লাগত। আমার ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়ানো দেখে তাদের মনে অন্য মহাদেশে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগেনি, বরং নিকটবর্তী কোনো শহর কিংবা গ্রামের কথা খুব মনে পড়েছে, এত দিন যার কথা তাদের মনেই আসেনি। ভাগ্যিস, আমার কারণে সে নামগুলো অনুরণন তৈরি করে এবং সে জায়গাগুলো সম্ভাব্য গন্তব্য হয়ে ওঠে। যদিও আমি একটা প্রতিষ্ঠানের গাউন পরে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তবু তাদের কাছে আমি নায়িকার মতো ছিলাম। যারা নিজেদের সচ্ছল বলে মনে করত তাদের মতো সচ্ছল ছিলাম না আমি, কিন্তু তাদের চেয়ে আমি ভালো ছিলাম। অস্থায়ী ছাত্র হিসেবে আপনাদের একজনও ছিলেন ওখানে। তিনি শুধু আমার প্রদর্শনীতে এসেছিলেন। কারণ তিনি মনে করেন, আমি তাকে নাড়া দিতে পেরেছি। তিনি এসেছিলেন। কারণ তিনি আমাকে সম্মান করতেন।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">তার কাছ থেকে কী যেন নিচে পড়ে যায়। তোলার জন্য সৈনিক নিচু হয়। মাদার-অব-পার্ল ক্যাপ লাগানো একটা ঝরনা কলম এটা। হাতের মুঠোয় ক্যাপটা ঘোরাতে থাকলে সে খেয়াল করে, বাইরে থেকে সূূর্যের আলো বাহিত হচ্ছে ক্যাপের মধ্য দিয়ে। ট্রেনের শরীর একটু ঝাঁকি দেয় এবং ট্রেন দুটি গাছের কাছাকাছি এগিয়ে যায়। একটা একেবারে ট্র্যাকের কাছাকাছি, আরেকটা সমান্তরাল রাস্তার পাশে। গাছ দুটির ডালপালা একসঙ্গে মিশে একটা খিলানের আকার তৈরি করেছে। অবশ্য খুব মসৃণ খিলানের আকার পায়নি। কারণ ট্র্যাকের কাছের গাছটার ডালপালা ছাঁটা হয়েছে থাম ও তারের জন্য জায়গা তৈরি করতে। ফলে খিলান তাপে বা রোদে ফেটে গেছে এবং ওপরে মসৃণতা নষ্ট হয়ে দাগ তৈরি হয়েছে, যেগুলোকে হাতির শুঁড়ের মতো মনে হচ্ছে। ফাটলের ওপরে মেঘের চেহারা তৈরি করেছে কালিঝুলি আর ডিজেলের ধোঁয়া। পাখিরা ধোঁয়া এড়িয়ে এদিক-ওদিক চলে যাচ্ছে। পরিত্যক্ত প্ল্যাটফরম একমুহূর্তের জন্য চকচক করে ওঠে। একটা উঁচু ভবনের মাথার ওপরে একটা লেখা দৃষ্টিসীমায় চলে আসে : হোটেল ইউরোপা।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">প্রথমে কম্পার্টমেন্টের যাত্রীদের চারজনই নিজ নিজ কাজ থামিয়ে দেয়। জুয়াড়ির দুই ঠোঁটের মাঝখানে একটা সিগারেট এবং হাতে লাইটার। সৈনিকের একটা আঙুল তার বন্ধ করে রাখা বইয়ের মধ্যে। বৃদ্ধ লোকটার পেনসিল লেখার জন্য খাতার ওপরে এমনভাবে ধরা আছে, যেন তিনি পেনসিলের গায়ে কাম্বারল্যান্ড কথাটা অন্যদের দেখাতে চাইছেন। অল্পবয়সী মহিলার হাতে ধরা আছে পকেট আয়না। তবে সে লিপস্টিক ঠিক করার কাজটা আপাতত বন্ধ রেখেছে। তাদের মধ্যে আর কোনো আলাপ যেন অনুমোদন পাচ্ছে না কারো কাছ থেকেই। নীরবতা তাদের সন্তুষ্টি আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। শুধু মহিলাই একজনের দিক থেকে আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছে। শুধু তার মুখটাই জানালার দিক থেকে ফেরানো। বাইরে একের পর এক সংক্ষিপ্ত সুড়ঙ্গ এবং রেল সেতু পার হয়ে যাচ্ছে তাদের ট্রেন। গাছপালা ও বাড়িঘরের আকারে তেমন কোনো পরিবর্তন সহজে চোখে পড়ছে না। তবে আলো আগের মতো নয়, বদলে যাচ্ছে। কারণ দৃষ্টি ও আকাশের মাঝখানে বাধা কম। ট্রেনটা কিছুক্ষণ আন্তর্মহাদেশীয় এক্সপ্রেসের মতো খুব দ্রুত চলেছে; কিন্তু এখন রাস্তার বাসের মতো ঘন ঘন থামছে। ট্রেনের ট্র্যাক এখন আর বাইরের রাস্তার সমান্তরালে চলছে না। কিছুক্ষণ মাঠ ও ছোটখাটো ঝোপঝাড়ের পাশ দিয়ে চলেছে; কিছুক্ষণ আগে সোজা বনের ভেতর দিয়ে চলেছে। স্টেশনগুলোতে যাত্রী খুব উঠছে না; তবে দলে দলে নামছে এবং সব স্টেশনে প্রায় একই রকম মিছিলের মতো একই রকম রাস্তায় মাইলখানেক দূরের একই রকম পাহাড়ের ওপরের গ্রামের গির্জার উদ্দেশে চলছে তারা। জঙ্গলের মধ্যে ছাউনির মতো একটা স্টেশন; সেখানে অফিসের ব্রিফকেস হাতে শুধু একজন যাত্রী নামে এবং ঝোপ-জঙ্গলের পথে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। মহিলাও এখন জানালার দিকে ফিরেছে। লোকটার চলে যাওয়া দেখে সে মনে করে, এই লোকটাই তাদের সঙ্গের সর্বশেষ যাত্রী। মহিলা দরজার হাতল ধরতে এগিয়ে যায়। খুব দ্রুত মাথা নেড়ে বৃদ্ধ তাকে থামায়। বিপরীত দিক থেকে আসা যাত্রীবোঝাই আরেকটা ট্রেন অন্য ট্র্যাকে থামে। হৈচৈ করতে করতে স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা মাঝখানের আইলে চলে আসে। ট্রেন চলা শুরু করলে বৃদ্ধ বিস্ময়কর রকমের উঁচু গলায় সুর করে কথা বলা শুরু করে; তার প্রতিটি কথা সব রকমের কোলাহল ছাপিয়ে স্পষ্ট বোঝা যায়, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">সকল জাতের মানুষের ছেলেবেলায় পাহাড় পর্বত সমুদ্র পেরিয়ে অজানা-অচেনা সব দেশ চলে আসত অস্তিত্বে। সেসব দেশের নামধাম ছিল ঠিকই; কিন্তু কেউ জানত না, কোথায় সেসব দেশের অবস্থান। শুধু কোন দিকে অবস্থিত তার কমবেশি ধারণা থাকত মনের মধ্যে। নীল নদের উৎস দক্ষিণে; ককেসাস পূর্ব দিকে; কিংবদন্তির আটলান্টিস পশ্চিমে, আর আল্টিমা টিউল উত্তরে। তার পরে আসে বাণিজ্যের জাহাজ, এরপর দেশজয়ের যুদ্ধ, তারপরে আসে ইতিহাস এবং ভয়ানক প্রচণ্ডতা নিয়ে লাফিয়ে আসার মতো দ্রুতগতিতে আসে সব জাতির সাবালকত্ব; এটাই ছেলেবেলার ভূগোলের কিংবন্তির বিস্ফোরণ ঘটায়। নীল নদের উৎস তালগোল পাকানো হয়েছে, ককেসাসের চূড়া স্বর্গীয় উচ্চতা থেকে নেমে এসেছে বাস্তবের সাধারণ মাত্রায়, পৃথিবীর সর্বশেষ প্রান্তের রাজ্য হিসেবে যেখানে ছিল, সেখান থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে আল্টিমা টিউলের অবস্থান। সমুদ্রের বুক থেকে আর কোনো আটলান্টিস জেগে উঠবে না। তবে নামগুলো রয়ে গেছে; মহাকাব্য এবং গানে নামগুলোর মধ্যে অতিকাল্পনিক শক্তি রয়ে গেছে বলেই এই নামগুলো লোককাহিনির জগতে প্রাণ দিতে পেরেছে। তখন থেকেই সময়ের আবর্তে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসের উৎস হিসেবে এবং মহাপ্লাবনের পরে আরারাত পর্বতে নুহর কিস্তির ঘাট হিসেবে স্বর্গ আরো বেশি বাস্তব হয়েছে। শিশু মুসা ঝুড়ির মধ্যে সব সময় ভাসতেই থাকবে ধীরে বয়ে যাওয়া নীলের জলে। নাম হলো বাস্তবতার অতিথি। বাল্যকালে আমাদের যে কয়টা প্রিয় জায়গা ছিল, আমরাও একই রকমভাবে সেগুলোর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছি অনেক দূরের নামধাম। গরু চরানোর মাঠে কোনো গাছের নিচে বৃষ্টির সময় আমরা আলু সিদ্ধ করে খেয়েছি; সেই মাঠের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া ছোট নদীটার নাম হয়ে গেছে লিথি কিংবা বিস্মৃতির নদী; কয়েকটা সরু লতা এভাবে অ্যামাজনের জঙ্গলে পরিণত হলো; এভাবে ঘরের পেছনের টিলার চূড়া সিয়েরা নেভাদার ছোট পাহাড়ে পরিণত হলো; টিলার ওপরের বুনো পদ্ম ভারতীয় পদ্মের রং লাভ করল এবং বাগানের ঝোপের নিচের গর্ত এভাবেই আমাদের নতুন বিশ্বের প্রবেশপথে পরিণত হলো। আমরাও এখন বড় হয়ে গেছি। ওই সব দিনে সব নাম ব্যতিক্রমহীনভাবে অচল হয়ে গেছে। আমাদেরও ইতিহাস আছে এবং শুধু নাম বদল করলেই আর ওই সব দিনের ঘটনাবলি ফিরে পাওয়া যাবে না। আমি বিশ্বাস করি না, ওই সব দিন আর ফিরিয়ে আনা যাবে, ওই ছোট নদীটা বড় নদীর আকার পেলেও না, সরু লতাগুলো বড় বড় শক্ত লিয়ানাগাছে পরিণত হলেও না, এমনকি পাহাড়ের পদ্মচূড়ায় সত্যিকারের আকাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও ফিরিয়ে আনা যাবে না। তবে কোনো জায়গার যে নিজস্ব শক্তি আছে, সে কথা আমি মন দিয়ে বিশ্বাস করি। আমি কোনো বড় জায়গার শক্তির কথা বলছি না। যেকোনো ছোটখাটো অচেনা কোনো জায়গার শক্তিতে আমি বিশ্বাস করি, হতে পারে আমার নিজের দেশের কিংবা অন্য দেশের ছোট একটা জায়গা। যে জায়গাগুলোর নামধাম নেই, খ্যাতি নেই, তেমন জায়গার কথা বলছি। এ রকম কোনো জায়গার বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে উল্লেখ করার মতো কিছু নেই, চারপাশে কিছু না কিছু থাকতে পারে। আমি ওই সব জায়গার শক্তিতে বিশ্বাস করি। কারণ এখন আর সেখানে কিছু ঘটে না। আর আগেও সেখানে উল্লেখ করার মতো কিছু ঘটেনি। আমি শূন্যতার মরূদ্যানে বিশ্বাস করি, সে জায়গাটা আবার সব কিছুর পরিপূর্ণতা থেকে বিচ্ছিন্ন হতেই হবে, এমন নয়; বরং পরিপূর্ণতার মাঝেও থাকতে পারে এমন জায়গা। আমি নিশ্চিত, শারীরিকভাবে ওই সব জায়গায় পা না ফেললেও যাত্রা করার ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এবং ভ্রমণের জন্য আমাদের মনের ভেতরের টানের কারণে ওই জায়গাগুলো বারবারই সুফলদায়ক হয়ে থাকে। এ রকম কোনো জায়গায় গেলে আমি নবযৌবন পাব না। আমরা সেখানে জীবনসুধা পান করব, তা-ও নয়। সেখানে গেলে আমাদের অসুখ-বিসুখ সেরে যাবে,  তা-ও নয়। আমরা শুধু গিয়ে থাকব, এটুকুই সব। পচা তক্তার খানিক রাস্তার ওপর, মরচে ধরা গালিচার আকারের প্রান্তর পেরিয়ে আমরা সেখানে গিয়ে থাকব। সেখানকার ঘাস কেঁপে উঠবে সাধারণত ঘাস যেভাবে কাঁপে, বাতাস বয়ে যাবে ঠিক যেভাবে বাতাস বয়, বালুর ভেতরে পিঁপড়ার মিছিল যাবে পিঁপড়ারা যেভাবে মিছিলে যায়, বৃষ্টির ফোঁটা ধুলার মধ্যে অতুলনীয় আকার ধারণ করে থাকবে বৃষ্টির ফোঁটা সাধারণত ধুলার ওপর যেমন আকার ধারণ করে থাকে। সে জায়গায় শূন্যতার ভিত্তির ওপর আমরা শুধু সব কিছুর নিজের চেহারার মধ্যেই রূপান্তর দেখে থাকব। এমনকি আমাদের যাত্রাপথে যেহেতু এই রূপান্তরের দিকেই তাকিয়ে আছি আমরা দেখে থাকব, ঘাসের একটা শক্ত ডগা দোল খাওয়া শুরু করেছে; আবার একটা গাছের উপস্থিতিতে আমাদের ভেতরের সত্তা মুহূর্তের জন্য ওই গাছের আকার ধারণ করেছে। ওই জায়গাগুলোর আমার প্রয়োজন এবং আমার ভেতরে ওই জায়গাগুলোর প্রতি প্রবল </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">টান</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt"> আছে; আমার মতো বয়সী কোনো মানুষ সাধারণত এই </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">টান</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt"> শব্দটা  ব্যবহার করে না। তাহলে আমার ভেতরের </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">টান</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">টা কী পেতে চায়? শুধু প্রশমিত  হতে চায়।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">তার কথাবার্তা চলার সময় আবহাওয়া বেশ কয়েকবার বদলে গেছে : পরিষ্কার রোদ এবং বৃষ্টি, জোরের বাতাস এবং প্রশান্ত নীরবতা, এপ্রিল মাসে যেমন হয়ে থাকে। দুপাশে নুড়ির কাঁকরের তীরের মাঝখানে একেবারে সরু একটা নদী পার হয়ে যায় ট্রেন; একটু পরে আরেকটা, এটা আবার খরস্রোতা, কাদা মেশানো ঘন পানি নিয়ে গর্জন করে ছুটে চলেছে। সম্ভবত আগের নদীটাই পরবর্তী বাঁকে এ রকম চেহারা ধারণ করেছে। গাছের ডালপালার সমান্তরালে স্টেশনগুলো একটা থেকে আরেকটা ক্রমেই দূরে দূরে মনে হচ্ছে। একবার ট্রেনটা একটা খোলা পল্লী এলাকায় থেমেছে। বাতাস এতটাই প্রবল যে ভারী গাড়িও কেঁপে উঠেছে। শুকনা পাতা, বাকলের টুকরা এবং ডালপালা এসে জানালার সঙ্গে বাড়ি খেয়েছে। শেষে ট্রেন চলা শুরু করলে অপেক্ষা করার সময় যে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো এসে পড়ছিল, সেগুলোকে পার হয়ে গেল সামনের ফোঁটাগুলো।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">বিস্ময়ের কথা হলো, এত দূরের প্রত্যন্ত পল্লীতে হলেও এই স্টেশনে অনেকগুলো ট্র্যাক দেখা যাচ্ছে; সবগুলো মিশেছে সামনের একটা কংক্রিটের ব্যারিয়ারে। শুধু প্ল্যাটফরমের দুই পাশের রেল পালিশ করে মসৃণ করা হয়েছে; বাকি সব কিছুই মরচে ধরে বাদামি হয়ে গেছে। কৃত্রিম একটা ফাঁপা জায়গায় অবস্থিত স্টেশনটা। স্টেশন থেকে বাইরে বের হওয়ার জন্য আছে খাড়া একটা সিঁড়ি। মহিলার স্যুটকেস নিয়েছে সৈনিক। তারা চারজনই একসঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। অন্যদের থেকে এই চারজন আরো ধীরে উঠছে। অন্য সবার এখানকার সিঁড়ি উঠে অভ্যাস আছে। তবে নবাগতরা তাদের রাস্তা সম্পর্কে নিশ্চিত। একটা সুইংগিং দরজা পার হয়ে তারা বিনা দ্বিধায় জুয়াড়ির দেখানো পথে এগিয়ে যাচ্ছে, জুয়াড়িই এখন নেতৃত্বে আছে। খাটো করে কাটা ছড়ানো-ছিটানো ঘাসের একটা ফাঁকা এলাকা; মনে হয় গবাদি পশুর পরিত্যক্ত খোঁয়াড় কিংবা সার্কাসের মাঠ। সেটা পার হয়ে তারা দেখতে পায়, তারা বিরাট এক বনের প্রান্তে এসে গেছে। বনের গভীরের গাছগুলো দেখে প্রথমে মনে হয় তুষারে ঢাকা পড়েছে। আসলে এগুলো সাদা বার্চগাছ। একটা সীমানার মতো রেখা পার হতে তারা কিছুটা দ্বিধায় পড়ে যায়। খোলা মাঠের হলদেটে কাদা আর কালো ঢেউ-খেলানো ঝরনার মতো স্থিতিস্থাপক উদ্ভিদ-পচা মাটির মাঝে রয়েছে বিভাজনরেখাটা। উদ্ভিদ-পচা ডোবা জলা আর তার ভেতরে গ্রথিত বন মাঠের চেয়ে কয়েক ফুট উঁচু। মাটি ভেদ করে কোনো দেয়াল তৈরি করা হয়নি, বরং কয়েকটা কাঠের ছোট মই দেখা যাচ্ছে। সহজ হাত ইশারায় জুয়াড়ি তার দলের সবাইকে একটা মই বেয়ে এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত করে। এভাবে সে দেখাতে চায়, সে এমন একজন মানুষ, যে সব পরিবেশেই কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই নিজের বুদ্ধি ঠিক রেখে চলতে পারে। সে সবার পরে ওঠে এবং ওপরে পৌঁছে আবার নেতৃত্ব নিয়ে নেয়। বার্চগাছগুলোর মাঝখানে নিচে কোনো ছোট ঘাস-লতার ঝোপঝাড় নেই। চারজনই গাছগুলোর ভেতর দিয়ে হাঁটাহাঁটি করে আর স্টেশনের দিকে এগোতে থাকে। বিভিন্ন দিক থেকে অন্য যাত্রীরাও সেদিকেই যাচ্ছে। মাঠের ভেতর দিয়ে হাঁটার সময় সবাই মার্চ করার মতো এক সারিতে চলে, যদিও সমান্তরালে চলার মতো যথেষ্ট জায়গা আছে। সাদা গাছের ভেতর দিয়ে দেখার কারণে মনে হচ্ছে, চালাঘরের মতো কাঠামোটার অবস্থান তৈগা অঞ্চলের কোথাও।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">বার্চের আলোয় বনাঞ্চলটা উজ্জ্বল হয়ে আছে। গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে শেওলার মাটিতে, যথারীতি কয়েকটা গাছ মিলে একেকটা গোলাকার বলয় তৈরি করেছে। সে জন্য মনে হচ্ছে, সবগুলো গাছ একটা শিকড় থেকে জন্মেছে। একজন একজন করে পার হয়ে যেতে যেতে তারা গোলাকার নাচে অংশগ্রহণ করছে এমন লাগছে, পার হতে হতে মাথা ঘোরার মতো অবস্থা তৈরি হচ্ছে। হঠাৎ সামনে এসে যায় একটা ফুটপাত, কালো জমিনে সাদা পাথর বিছানো আছে। শেষে চার যাত্রী এসে পড়ে গাছপালাহীন একটা প্রশস্ত খোলা জায়গায়। কিছুক্ষণ আগেই তারা বুঝতে পেরেছে, সামনে শেওলার বদলে আসছে বেরিগাছ এবং পথের মাঝখানে একটুকরা ঘাসের জমিনও আছে। আর এখন পথটা অনেক প্রশস্ত হয়ে এসেছে; চারজন একসঙ্গে পাশাপাশি হাঁটতে পারে। খোলা জায়গাটার প্রবেশপথে নিজ নিজ প্রবৃত্তি চালিত হয়ে প্রত্যেকেই একমুহূর্তের জন্য থামে। মহিলা বৃদ্ধের বাহু ধরেছে; বৃদ্ধ সামান্য মাথা দুলিয়ে সায় দিয়েছে তাকে। এখন তারা যার যার মতো ভিন্ন ভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ছে, যেন আর কোনো নেতার দরকার নেই তাদের।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">খোলা জায়গাটা কিছুটা পাহাড়ি, আকারে হিমবাহবাহিত কাঁকরের স্তূপের মতো, উদ্ভিদ-পচা জলাভূমির ভেতর যেন বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে জায়গাটা বেশ বড়; যদিও এই নবাগত চারজন পুরোপুরি নীরবে আসেনি, তবু অন্য প্রান্তে বিচরণরত হরিণের দল নির্বিঘ্নে ঘাস খেয়ে যাচ্ছে। শুধু পুরুষ হরিণটা সর্দারের মতো তার হালকা বাদামি মাথাটা একবার তুলেছে। একমুহূর্তের জন্য মনে হয়, সর্দারের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এই দল ইন্ডিয়ানদের দল। খোলা জায়গাটার মাঝখানে একটা হ্রদ আছে। প্রথমে মনে হয়, হ্রদটা কৃত্রিম, কিন্তু মাঝখানে নলখাগড়াজাতীয় ঘাসের দ্বীপ, কালো কাদামাটির তীর এবং সব রকমের জীবজন্তুর আনাগোনার চিহ্ন প্রমাণ করে, এটা একটা জলাডোবা। বলতে গেলে হ্রদের ভেতর শুধু কাঁকরের স্তূপের শেষ মাথায় একটা জায়গায় শুকনা পায়ে হেঁটে যাওয়া যায় উপরিভাগের শিলাস্তরের ওপরকার কাঁকরের পথ দিয়ে। আর এখানকার পানি একেবারে নিখুঁত স্বচ্ছ, আলোনিরোধক প্রতিবিম্ব নেই এখানকার পানিতে। তলানিতে পড়ে থাকা নুড়িগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কাঁকরের স্তূপের কাছ থেকে বের হয়ে আসা ঝরনার পানির ভেতর কী চমৎকার চকচকে সরু বিন্দুর রেখাগুলো! কাঁকরের পথের সঙ্গে সমান্তরালে এসে হ্রদের জলে মিশেছে ঝরনা। এই জায়গাটার বিশেষত্বের মধ্যে একটা জিনিস হলো হালকা ধূসর রঙের পাকা কাঠের তক্তার তৈরি কুঁড়েঘর; হলুদাভ কিংবা লালচে বাদামি গাছের আঠালো রসের দাগ আছে তক্তার জোড়ায়। আরেকটা জিনিস হলো পাহাড়ি নদীপথে উজান ও ভাটিতে চলা নৌযানের ঘাট। পানির ওপরে সামনের দিকে এগিয়ে থাকা ঘাটটাকে রোলার কোস্টারের মতো দেখায়।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">তারা চারজন একে একে এখানে এসে জড়ো হয়। মহিলা, বৃদ্ধ ও সৈনিক জুয়াড়ির দিকে তাকিয়ে তার কোটের পকেট থেকে বিশাল এক চাবির গোছা বের করা দেখে। সে কুঁড়েঘরের তালা খোলে, দরজা হাট করে খুলে ফেলে, ভেতরের কাচ-ধাতব কম্পার্টমেন্টটাও খুলে ফেলে। শেষে আরেকটা চাবি ঘুরিয়ে সে একটা গাড়ি চালিয়ে বের করে নিয়ে আসে; বের হওয়ার সঙ্গে গাড়িটাকে যেন আরো দীর্ঘদেহী মনে হয়। এটা একটা ক্যাম্পার। বার্চগাছের ডালগুলো গাড়ির পিঠঘেঁষে আস্তে আস্তে পার হয়ে গাড়িটাকে খানিক আড়াল করে দেয়, আবার খানিক শোভাবর্ধনও করে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">সে পেছনের দরজা ঠেলা দিয়ে খুলে দেয়, ঘাসের ওপর একটা ফোল্ডিং টেবিল পাতে এবং টেবিলের ওপর একটা সাদা টেবিলক্লথ বিছায়। সৈনিক তাড়াহুড়া করে জুয়াড়ির কাজে হাত লাগায়: গাড়ির ভেতর থেকে চারটা চেয়ার বের করে আনে। তবে এই মুহূর্তে কেউই টেবিলে বসে না। বৃদ্ধ ইচ্ছা করেই গাছপালার ভেতর দিয়ে কোথায় যেন এগিয়ে যায়; জুয়াড়ি তার ক্যাম্পারের ভেতরে ঢোকে এবং মহিলা আবারও তার রুপালি স্যুটকেস নিয়ে সৈনিককে ইশারা করে তাকে অনুসরণ করে ঘাটের দিকে যেতে। তার স্যুটকেস থেকে বের করে আনা কাঁচি আর চিরুনি নিয়ে সৈনিকের পেছনে দাঁড়িয়ে তার চুলের কেতা বদলে দেয় মহিলা। তারপর দ্রুত ইশারায় তাকে ইউনিফরম খুলে ফেলতে বলে। তাকে বেসামরিক পোশাক পরিয়ে দেয়, এটাও তার স্যুটকেস থেকেই বের করে। পোশাক পরানোর সময় বারবার কয়েক কদম করে পেছনের দিকে সরে এসে দেখতে থাকে কেমন দেখাচ্ছে সৈনিককে। আসলে সৈনিকের চেহারা যতটা নয়, তার বেশি খেয়াল করার বিষয় হলো মহিলার নিজের হাতের ওস্তাদি। পোশাক পরানোর পরও মহিলা এটা টানে, ওটা ঠিক করে, এখানে একটু সুতা টেনে ঠিক করে; এ রকম চলার সময় সৈনিক কিছু মনে করে বলে মনে হয় না। থলথলে মুখের বোকাটে চেহারা থেকে মসৃণ বয়সহীন কসমোপলিটন চেহারায় রূপান্তরের মধ্য দিয়ে তাকে গ্রীষ্মের পোশাকে সব কিছুর জন্য প্রস্তুত করার কাজটা চমৎকারভাবেই স্বাভাবিক মনে হয়। যখন সে মহিলার দিকে ফিরে তাকায়, শুধু তার চোখজোড়া আগের মতোই ভারী মনে হয়। আত্মতুষ্টি পাওয়া সদা হাসিখুশি মহিলার পেছনে তারা বৃদ্ধকে দেখতে পায়। সে বনের ভেতর থেকে খালি মাথায় এইমাত্র বের হয়েছে। তার হ্যাট খুলে বোঝাই করেছে মাশরুমে। মহিলার যা যা দরকার সব তার স্যুটকেসে আছে। এখন সে একটা বেধনিকা বের করে সৈনিকের বেল্টে একটা অতিরিক্ত ছিদ্র করে তখন বৃদ্ধ তীরে তাদের পাশে বসে বিচিত্র রঙের মাশরুম পরিষ্কার করতে থাকে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">ততক্ষণে সবার জন্য টেবিল তৈরি হয়ে গেছে। ক্যাম্পারের ভেতর বসা জুয়াড়িকেও পরিবর্তিত মনে হচ্ছে। হাতাওয়ালা শার্ট আর ফুলওয়ালা অ্যাপ্রন পরে সে স্টোভে কষ্ট করে সবার জন্য খাবার তৈরি করছে বলে নয়, বরং রান্নার কাজ করার জন্য সে অর্ধচন্দ্র আকারের চশমা পরেছে বলে তার চেহারায় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। শুধু যখন সে চশমার প্রান্ত দিয়ে তাকায় তখনই কেবল তার চাহনি অন্য সময়ের মতো ঠাণ্ডা ও বিপজ্জনক মনে হয়। জিনিসপত্র বোঝাই গাড়ির রান্নাঘরের মধ্যে তার চালচলনে একদম জাত বাবুর্চির আভিজাত্য প্রকাশ পাচ্ছে : খুব যত্নের সঙ্গে চশমা পরিষ্কার করছে, গরম করার জন্য প্লেটগুলো ওভেনে রাখছে, সিলিংয়ে ঝুলন্ত গুল্মের ডাল থেকে কিছু নেওয়ার জন্য হাত বাড়াচ্ছে এবং যখন-তখন ক্যাম্পার থেকে বের হচ্ছে এমন ভঙ্গিতে, যেন সে বহু বছর ধরে রেস্তোরাঁঁ চালাচ্ছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">এরই মধ্যে মহিলা ও সৈনিক টেবিলে বসে অপেক্ষা করছে। বৃদ্ধ শেওলাঢাকা তটে বসে আছে তার মোটা কাপড়ে বাঁধানো খাতা নিয়ে। সে খাতায় কী কী যেন আঁকার চেষ্টা করছে, যেন কিচেনের শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাচ্ছে সে। তারপর অপ্রত্যাশিতভাবেই সেও চুপ হয়ে যায়। চোখে পড়ার মতো টান হয়ে বসার পেছনে আসলে এই জায়গাটা কিংবা আলো ভূমিকা রাখছে। একটুও বাতাস নেই, তবু তার প্রাবার ফুলে উঠছে। তার পায়ের কাছের ঝরনার জলে এক বোতল মদ ঠাণ্ডা করা হচ্ছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">এখন চারজনই টেবিলে। খাওয়াদাওয়া শেষ হয়ে গেছে। গ্লাসগুলো টেবিলেই আছে। তবে শুধু বৃদ্ধ লোকটাই মদ পান করছে। জুয়াড়ি ও মহিলা ধূমপান করছে। সৈনিক খানিকটা সরে গেছে। এক পায়ের গোড়ালি আরেক হাঁটুতে তুলে একটা হার্পে টুংটাং আওয়াজ তুলছে। অবশ্য তার হাতের আড়ালে পড়ে গেছে বাদ্যযন্ত্রটা। তারগুলো বিচ্ছিন্ন, অনেকক্ষণ পর পর আওয়াজ তুলছে বলে কোনো সুর আশা করা যাচ্ছে না। আপাতত মনে হচ্ছে, তার আওয়াজের তালে তালে বৃদ্ধ মদের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে, প্রতিবার চুমুক দেওয়ার পর গ্লাসটা টেবিলের ওপর রাখছে কিংবা ঠিক মুহূর্তে আওয়াজ না পেলে মুখের কাছাকাছি ধরে রাখছে গ্লাসটা, যেন আওয়াজের অপেক্ষায় থাকছে। তার দৃষ্টির সামনে ক্যাম্পারের পেছনের খোলা দরজাটা একটা গুহায় পরিণত হয়ে যাচ্ছে, আর বাথহাউসের নুড়ির ছাদটা খিলানের আকার নিচ্ছে এবং খাবারের টুকরা ছিটিয়ে দিলে দ্রুত ওপরে চলে আসা মাছের আঁষের মতো চকচক করছে। পুরো খোলা জায়গাটা একটা বাগানের সব বৈশিষ্ট্য পেয়ে যাচ্ছে। এখানে সময় কোনো বিবেচনার বিষয় নয়। শব্দ বলতে শোনা যাচ্ছে শুধু বাগানের শব্দ, টেবিলক্লথের পতপত শব্দ, পানিতে মাছের তৈরি ছলাৎ শব্দ এবং বনের শেষ প্রান্তের ফার্নগাছগুলোর মধ্যে পাখির ডানার শব্দ আর কিচিরমিচির। অনেক দূরের আকাশে ভেসে চলেছে মেঘের দল। অনেক উঁচু আকাশটাকে মাথার ওপরে ধরাছোঁয়ার মতো খিলান মনে হচ্ছে। মেঘেদের মাঝের নীল পাক খেয়ে খেয়ে আকার বদলাচ্ছে, পানির ওপরে, ঘাসের ওপরে এমনকি জলার ভেজা মাটির ওপরে নীলের ছায়া পড়ছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">ক্যাম্পারের পেছনে গিয়ে পরনের সব কাপড় খুলে ফেলে বৃদ্ধ ও মহিলা হ্রদের দিকে দৌড়ে যায়; চেহারায় কোনো রকম বিব্রত বোধ করার চিহ্নমাত্র নেই। বৃদ্ধ বাচ্চাদের মতো লাফ দিয়ে দৌড় শুরু করে। দৌড়ানোর ভঙ্গিও বাচ্চাদের মতো। মহিলা একমুহূর্ত দেরি করে শুরু করে দৌড়, যেন বৃদ্ধকে আগে যেতে সুযোগ দেয়, তবে পানির কাছে যেতে যেতে সে বৃদ্ধকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়। পুকুরের পানিতে তাদের দুজনের সাঁতার কাটা দেখে জুয়াড়ি ও সৈনিক। এদের দুজনের মুখে একটা করে টুথপিক। পানি বেশ উষ্ণ। মহিলা বয়স্ক সাঁতারুর দিকে এগিয়ে এসে সাঁতার কাটছে। মনে হচ্ছে, তারা শুকনা পথে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে। মহিলা বলতে থাকে : </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">ইচ্ছা করছে এখানেই থেকে যাই। অন্য যেকোনো জায়গার কথা মাথায় এলে মনে হচ্ছে, সে জায়গাটা এখানকার চেয়ে বেশি গরম কিংবা বেশি ঠাণ্ডা, বেশি আলোকিত কিংবা বেশি অন্ধকার, বেশি নীরব কিংবা বেশি হৈচৈপূর্ণ, বেশি ভিড়ে ঠাসা কিংবা বেশি শূন্য হতে পারে। যেকোনো নতুন জায়গা সম্পর্কেই আমার মনের ভেতর সংকোচ কাজ করে। আর পুরনো জায়গা তো আমার পছন্দই হয় না। চেনাজানা জায়গায় ময়লা-আবর্জনা আর কুিসত সব কিছু অপেক্ষা করছে; অচেনা জায়গায় আছে একাকিত্ব আর দ্বিধাদ্বন্দ্ব। হ্যাঁ, আমি জানি, আমি পুরোপুরি স্বস্তি পাই শুধু চলমান অবস্থায়। তবে তখন হাত-পা ছড়ানোর জন্য আমার একটা জায়গার দরকার হয়। আপনি যদি আমাকে এ রকম কোনো মহিলার কথা বলতে পারেন, যার জীবনযাপন চলছে শুধু একটা স্যুটকেসের ভেতরের জিনিসপত্র নিয়ে, তাহলে তার ব্যাগের মধ্যে আপনি যেসব জিনিস অবশ্যই দেখবেন সেগুলোর নাম আমি বলে দিতে পারি : এখানে একটা বাঁধানো ফটোগ্রাফ, ওখানে একটা দাঁত মাজার ব্রাশ। আমার একটা জায়গার দরকার হয়ে থাকে এবং সে রকম কোনো জায়গা খুঁজে পেতেও সময় লাগে। আমার ইচ্ছা, আমি এখানেই চিরদিনের জন্য থেকে যাই।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">তার সাঁতারের সঙ্গী ডুব মারে। উঠে আসার পর দেখা যায়, তার মুখের ত্বক এইমাত্র ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুর মুখের ত্বকের মতো কোঁচকানো। পানির ভেতরে তার কণ্ঠ খানিকটা আলাদা শোনায়; তার উত্তর হ্রদের ওপর প্রতিধ্বনি তোলে : </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">এই ইচ্ছা পূরণ হওয়ার মতো নয়। আর পূরণ হলেও শেষ পর্যন্ত কখনোই পরিপূর্ণতা আনবে না। আমার জীবনে আমি যখনই মনে করেছি, আমি সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছেছি, কেন্দ্রে বা ঈপ্সিত জায়গায় পৌঁছেছি, তখনই আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে, আমি আর সেখানে থাকতে পারব না। আমি শুধু অল্প সময়ের জন্য থামতে পারি। তারপর আবার চলতে হয় আমাকে যতক্ষণ না মনে হয়, কিছু সময়ের জন্য থামার মতো কোনো জায়গা পেয়েছি। আমার কাছে অস্তিত্ব অল্প একটু সময়ের চেয়ে বেশি কিছু নয়। পরিপূর্ণতার মধ্যে স্থায়িত্ব থাকতে পারে না, সেটা এখানে হোক আর অন্যখানেই হোক। অন্য কোনো জায়গার চেয়ে পরিপূর্ণতার জায়গাগুলোই আমাকে বেশি দুঃখ দিয়েছে। পরিপূর্ণতার জায়গা এখন আমার কাছে ভয়ের জায়গা। এক জায়গায় থাকার অভ্যাস গড়ে তোলা ভালো কিছু নয়। যেখানেই হোক না কেন, পরিপূর্ণতার জায়গার অস্তিত্বও বেশি সময়ের হতে পারে না। ভালো করে জানার আগেই এ রকম জায়গার আকর্ষণী ক্ষমতা হারিয়ে যায়, জায়গাটাও হারিয়ে যায়। পরিপূর্ণতা এখানে পাওয়া যাবে না। যেখানে পাওয়া যাবে, আমরা সেখানেও নই। সুতরাং এখন যাওয়া যাক। এখান থেকে দূরে। সামনের দিকে চলতেই থাকি। সময় হয়ে গেছে।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">সাঁতারুর কথা বলার সময়ের মধ্যেই বাগানের চেহারায় রূপান্তর ঘটে গেছে। আলো বদলে না গেলেও হ্রদ শেষ বিকেলের চেহারা ধারণ করেছে। ঝরনা প্রায় শুকিয়ে এসেছে এবং পানির স্তর নেমে গেছে। সব কিছুর ভাঙাচোরা চেহারা বের হয়ে পড়েছে। টায়ার, ধাতব রড, আস্ত একটা সাইকেল, সাদা হয়ে যাওয়া বাকলহীন গাছের গোড়া জেগে উঠেছে। বনের প্রান্তের দিকে ঝোপঝাড়ের গায়ে লেগে আছে কোনো জীবজন্তুর কঙ্কাল। আরেক জায়গায় ধসে পড়া একটা শুটিং বেঞ্চ বের হয়ে পড়েছে। অকালে ঝরে পড়া পাতা বসন্তের হ্রদের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। কিনারার কয়েকটা ফাঁকা জায়গায় তুষার জমে ঝুল-সাদা দাগের মতো লাগছে। আকাশের মেঘগুলোর সঙ্গে যোগ দিচ্ছে একই রঙের বাষ্পের ধারা। ঝোপের ভেতর আটকে থাকা বিবর্ণ খবরের কাগজের টুকরা একটা নির্দিষ্ট তারিখ দেখাচ্ছে। আর ওই সনির্বন্ধ আওয়াজ হলো এক্সপ্রেসওয়ের অবিরাম বেজে যাওয়া হর্ন।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">খোলা জায়গাটা থেকে সবাই চলে গেছে। বোটহাউসটা বন্ধ। সাঁতারুরা বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাওয়া হ্রদে কোনো চিহ্ন রেখে যায়নি। শুধু কাদার তটে তাদের খালি পা আর ক্যাম্পারের টায়ারের চিহ্ন লেগে আছে। সে চিহ্ন আবার কাঁকরের পথে এসে বিলীন হয়ে গেছে, যখন এই পথ দিয়ে ক্যাম্পার উঠে গেছে পাথরের স্তূপের ওপরে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">অনেকক্ষণ হলো তারা চারজন রাস্তায় উঠে এসেছে। ক্যাম্পারে হাত-পা ছড়িয়ে বসা দেখে বোঝা যাচ্ছে, তারা এখন চলন্ত অবস্থায় বেশ স্বস্তিতে আছে। জুয়াড়ি চালকের আসনে; মহিলা তার পাশে বসে জুয়াড়ির গাড়ি চালানো দেখছে। বৃদ্ধ ও সৈনিক মিনিবাসে কিংবা ক্যাবে বসার মতো মুখোমুখি বসেছে পেছনের দুটি বেঞ্চে। শুধু উঁচু সিটের জন্য নয়, আরো উঁচু এলাকার পরিষ্কার ও সুপরিসর আলোর জন্যও মনে হচ্ছে, তারা ওপরের দিকে উঠছে। পাশের জানালা দিয়ে স্থলভাগের কোনো দৃশ্য দেখা যাচ্ছে না, দেখা যাচ্ছে অস্তগামী সূর্যের হলুদ হয়ে ওঠা খোলা আকাশ। আকাশের আবছা অবস্থা দেখে মনে হয় ধোঁয়া জমাট বেঁধেছে, কিন্তু না, আকাশ আবছা হয়েছে ধুলার কারণে। এখন কাঁকর বিছানো রাঙা পথটার পুরোপুরি দখলদার ক্যাম্পার। রাস্তাটার পাশে আছে ক্রমহ্রাসমান গাছপালার একটা বন। আকারে বড়জোর ঝোপঝাড়ের মতো মনে হচ্ছে। ফিকে হয়ে আসা আলোয় দেখা যাচ্ছে একটা তাঁবু</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">নগরী দূর দিগন্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। একটা ব্যারিয়ারের ওপরে ওখানে নির্মাণ করা গম্বুজ আর টাওয়ারের সেন্টার এবং রেডিও ট্রান্সমিটার অবস্থিত। মানুষের বসতিহীনতার অনেক কাঠামো দেখে তারা চারজন এখনই ওখানে যাওয়ার জন্য মনস্থির করে ফেলে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">এলাকাটা পুরোপুরি পরিত্যক্ত নয়। রাস্তার পাশে একটা মনুষ্য অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে, হাত ইশারা করে লিফট চাইছে। চালক তার পাশে থামালে সংকেত-পথিক বাসে ওঠার মতো নির্লিপ্ততায় পেছনের দিকে সৈনিক ও বৃদ্ধের পাশে উঠে বসে। মাথায় স্কার্ফজড়ানো অল্পবয়সী একটা মেয়ে, তার চোখ দেখেও বোঝা যায়। হাঁটুর ওপরে যে ঝুড়িটা সে রাখে সেটা খালি। নিকটবর্তী কোনো বাজার থেকে বোধ হয় আসছে। তার জিনিসপত্র সব বাজারে বিক্রি করে এসেছে। তবে একমাত্র অদ্ভুত বিষয়টা হলো, সে হঠাৎ ঝোপের ভেতর থেকে উদিত হয়েছে। কারণ সে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সে জায়গাটার আশপাশে কোনো পথঘাট নেই। কেবল তার উপস্থিতিতেই মনে হয়, এটা বিদেশবিভুঁই। কিন্তু আর কোনখানেই বা এ কথা বলা অসম্ভব! হতে পারে, এটা প্রত্যন্ত উত্তরাঞ্চল কিংবা গভীর দক্ষিণাঞ্চল। আবার এও হতে পারে, এটা মধ্যাঞ্চলের কোনো জায়গা। শুধু বিশেষ মুহূর্তের আলো অভিনবত্ব যোগ করতে পারে কোনো জায়গার চেহারায়। সংকেত-পথিকের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করার কোনো চেষ্টা কেউ করে না; উভয় পক্ষেই পারস্পরিক যোগাযোগ ধারণার বাইরে থেকে যায়, অনাকাঙ্ক্ষিত থেকে যায়। শুধু নারী দুজন একে অন্যের দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার যার যার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বৃদ্ধ একটা ওভারহেড ল্যাম্পে সুইচ দেয়। খাতার ওপরে পতিত আলো তার বয়স্কনিবাসের ডেস্কের ওপরে রাখা বাতির আলোর মতো দেখায়। এই আলোতেই বৃদ্ধ তার সংকেত লেখা চালিয়ে যায়। তবে গাড়ির ঝাঁকুনির কারণে তার সংকেতগুলো আরো বেশি স্পষ্ট এবং ছবির মতো হয়ে যাচ্ছে। একটা করে পেনসিলের টান দিতে একবার করে নড়ছে সে, আর একবার টান দেওয়ার পর খানিক সময় চুপ করে ডুবে থাকছে খাতার পাতায়। অন্য কোনো দিকে তাকাচ্ছে না সে। তার সামনে বসা সৈনিক শুধু মাঝেমধ্যে তার দৃষ্টি ফেরাতে পারছে। সৈনিকের হাতে আছে একটা বই, এখনো বন্ধই আছে। বইটা খোলার ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। প্রথমে বইটা সামনে বাড়িয়ে ধরে যেন সঠিক দূরত্ব নির্ধারণ করার চেষ্টা করছে। তার পরে কিন্তু সতর্কতায় খোলার কোনো চেষ্টা সে করছে না। সে বরং বইয়ের মলাটের ওপর ব্যাটারিচালিত ছোট একটা রিডিং ল্যাম্প আটকে দেয়। ডান হাত দিয়ে ব্যাটারিটা তোলে এবং বাঁ হাত দিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠার প্রথম লাইনের ওপর আধাসিলিন্ডার আকৃতির কাচের রড ধরে, এতে অক্ষরগুলো বড় দেখায় এবং মাঝের ফাঁকা জায়গা আলোকিত হয়ে ওঠে। তাঁবু আকারের ছাউনি তৈরি করে বাতিটা; তখন বইটাকে আরো স্বচ্ছ মনে হয়। একমুহূর্তের জন্য মনে হয়, পাঠকের সক্রিয় চেষ্টা ছাড়াই কিছু একটা ঘটে যাচ্ছে। কিন্তু পাঠক তো চুপচাপ বসে থাকলেও দুহাতে দুটি কাজ করে যাচ্ছে; ম্যাগনিফাইং কাচ বয়ে নিচ্ছে এক লাইন থেকে আরেক লাইনে এবং ভারী ব্যাটারিটাও ধরে আছে। মাঝে মাঝে ভারী পাথরের মতো তুলে ধরছে ব্যাটারিটা। পৃষ্ঠা উল্টানোর চেষ্টাও সে করছে না। কারণ প্রথম পৃষ্ঠায়ই তো তার অনেক সময় লাগছে। একটা করে বাক্য শেষ করতেও অনেক সময় লাগছে। আর একটা বাক্য শেষ করে তাকে গভীর নিঃশ্বাস ছাড়তে হচ্ছে পরবর্তী বাক্য শুরু করার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। পাঠক নিজেকে একজন দক্ষ কারিগর হিসেবে প্রকাশ করছে। দীর্ঘদিন ইউনিফরম পরিহিত থাকার কারণে কিছুক্ষণ আগে তাকে যে পোশাক পরানো হয়েছে, সেটায় তখন বেমানান মনে হলেও এখন মনে হচ্ছে, দারুণ মানিয়েছে। বই পড়ার সময় এ রকম পোশাক আরাম দিতে পারে। রিডিং জ্যাকেটের নিচে তার বুক ফুলে উঠছে, তার কাঁধ চওড়া হয়ে উঠছে। তার এই পাঠকের শার্টের মাদার-অব-পার্ল বোতামগুলো মৃদু আলো ছড়াচ্ছে; গলার শিরাগুলো ফুলে উঠছে। পাঠকের চোখ বাইরের প্রান্তের দিকে সরু হলেও ভেতরের প্রান্তে প্রেরিত হচ্ছে; কারণ সামান্য কয়েক ইঞ্চি দূরে হলেও অক্ষর ও শব্দগুলো যেন দূরের দিগন্ত তৈরি করছে। তার এ রকম চোখ দেখে মনে হচ্ছে, সে বইটা আত্মস্থ করছে না, বরং বইটাই তাকে হজম করছে। একটু একটু করে সে বইয়ের ভেতরে চলে যাচ্ছে, যতক্ষণ না তার কান প্রসারিত হয়ে যাচ্ছে, সে বইয়ের মধ্যে ডুবতে ডুবতে বইয়েরই অংশ হয়ে যাচ্ছে। বইয়ের মধ্যে তো দিনের আলো। একজন ঘোড়সওয়ার রিও গ্র্যান্ডে পার হতে যাচ্ছে। পাঠককে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলে বৃদ্ধের নিজের মুখ পাঠকের মুখভঙ্গি নকল করার চেষ্টা করছে। সেও প্রায় পুরোপুরি বইয়েরই অংশ হয়ে গেছে, অনেকটা স্বচ্ছ, পরিষ্কার।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">নীরব সংকেত-পথিক অনেকক্ষণ আগেই নেমে গেছে। সে যে সিটে বসেছিল, সেখানকার ভাঁজও সমান হয়ে গেছে। চলন্ত যানটির ভেতরে কালো রাত। এখন গাড়ি চালাচ্ছে মহিলা। তার দৃষ্টি সামনের রাস্তায় সজাগ, আবার দূরে কোথাও হারিয়ে গেছে মনে হচ্ছে। তার পাশে টান হয়ে বসে আছে জুয়ারি, কিন্তু থেকে থেকে ঝিমুনি আসছে তার। </span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.45pt">বৃদ্ধ সামনের দিকে ঝুঁকে এসে চালককে দিক পরিবর্তন করতে বলে। পাশের প্রায় পুরোপুরিই সোজা রাস্তাটা খাড়া হয়ে নেমে এসেছে। রাস্তার পাশের ঝোপঝাড় একেবারে রাস্তাঘেঁষা, মাঝে মাঝেই গাড়ির ওপরে এবং জানালায় বাড়ি মারছে। মাঝেমধ্যে অন্ধকারের ভেতর থেকে হেডলাইটে মুষলধারা দেখা যাচ্ছে, কোথাও কোথাও ফেনায়িত স্রোত দেখা যাচ্ছে। চলতে চলতে গাড়ি একটা মোটামুটি সমান খোলা জায়গায় চলে আসে, সেখানে প্রথমে চোখে পড়ে একটা ভাঙা স্লুইস গেট; সেটার গায়ের সঙ্গে এখনো একটা শিকল ঝুলছে, একটা পচতে থাকা কাঠের চাকার গায়ে কয়েকটা স্পোকের গোড়া লেগে আছে এখনো। শেষের দিকে দেখা যায় একটা পরিত্যক্ত কারখানা। কারখানার জানালায় এক রকমের ঝাড়গাছ গজিয়েছে। মাল তোলার ঢালু পথে এখনো স্তূপ হয়ে পড়ে আছে ছেঁড়া বস্তা আর গুঁড়া ইট। পেছনের ছাউনিতে পুরনো উল্টো কুবরসহ একটা ঠেলাগাড়ি পড়ে আছে, যেন এখনই কেউ টেনে নিয়ে যেতে পারে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">মুষলধারা যেখানে একটা নদীতে মিশেছে, সেখানে এসে তারা রাতের জন্য ক্যাম্প করে। সাদা-কালো ওয়েস্টার্ন মুভিতে উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় পানির চেহারা যেমন দেখা যায়, তেমন একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে এখানে। নদীটা খুব প্রশস্ত নয়, তবে সে তুলনায় বেশ গভীর মনে হচ্ছে। নদীর ওপর একটা কাঠের সেতু আছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">ওপারে একটা খাড়া পথ এসে মিশে গেছে সেতুর সঙ্গে। পারাপারের জন্য এই নদীই হয়তো একসময় খুব গুরুত্বের ছিল, হয়তো বিতর্কিত কোনো সীমান্তও ছিল এটা। কারণ এখনো নদীর এক প্রান্তে পড়ে আছে আগে ছিল এখন নেই এমন একটা প্রতিবন্ধক দরজার হাতল। পতাকাদণ্ডের মরচে ধরা কোটরের চারপাশের প্লাস্টারের গায়ে গুলিসৃষ্ট ছিদ্রের মাধ্যমে যেন ধাঁধা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এখন জায়গাটা প্রায় পুরোপুরি পরিত্যক্ত, বিশেষ করে এখন রাতের বেলা। এ জায়গাটা এখন আর যাত্রাপথের কোনো স্টেশনও নয়। শুধু একজন বিলম্বিত ভ্রমণকারীকে দেখা যাচ্ছে, সম্ভবত তাড়াহুড়ার কারণে সে ক্যাম্পারটার দিকে তাকানোর জন্য থামতে পারেনি।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">ক্যাম্পারটা পার্ক করে রাখা হয়েছে রাস্তা আর একটা ভাঙা ভবনের মাঝখানের জায়গার ছোট করে কাটা ঘাসের ওপর। জুয়াড়ি ও সৈনিক বেশ দ্রুততায় দুটি বাংকবেড তৈরি করে ফেলেছে; এই কাজ করার সময় এত সব অপ্রশস্ত জায়গায় একজনের সঙ্গে আরেকজনের একবার ঠোকাও লাগেনি। ভেতরের পাশটা অদৃশ্য বাতির ক্ষীণ আলোয় আলোকিত। এক কোনায় একটা রেডিও আছে, দেখে মনে হচ্ছে বন্ধ, তবে রেডিওর ভেতর থেকে একটা কণ্ঠ থেকে থেকে কথা বলছে। শব্দতরঙ্গের সঙ্গে জায়গার নামগুলো ঘড়ঘড় করে বাজছে। নামের অনেকগুলোই বিদেশি, আন্তর্জাতিক রেডিওর ইংরেজিতে। রেডিওর শব্দ বাইরে থেকেও শোনা যাচ্ছে। বৃদ্ধ ও মহিলা বাইরে আগুনের পাশে বসে আছে। মহিলা বৃদ্ধের প্রাবারের মধ্যে ঢুকে পড়েছে এবং বৃদ্ধের কাঁধে মাথা রেখেছে। কিন্তু এখানে মুষলধারা নদীতে পড়ছে বলে রেডিওর শব্দ পানি পড়ার শব্দের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। তুলনামূলকভাবে নদীই যেন শব্দহীন, যেন থেমে গেছে। </span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">এখন চারজনই ক্যাম্পারের মধ্যে। আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘাসের মধ্যকার আগুন শেষ হয়ে গেছে। তবু মহিলা ছাইয়ের পাশে বসে আছে। তবে এখন তার পাশে বৃদ্ধ নয়, বসে আছে জুয়াড়ি। অল্প একটু দূরে বসে আছে সে। ছাইয়ের মধ্যে পা গরম করছে মহিলা। এখন আর তার শীত তাড়ানোর জন্য আলখাল্লাজাতীয় পোশাক দরকার হচ্ছে না। </span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">শেষে জুয়াড়ি নীরবতা ভাঙে : </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">ওই যে নদীর পারে পড়ে আছে ভাঙা ওয়াশটাব, গোটা একটা পরিবারের জন্য যথেষ্ট বড়। এটা কিন্তু পারিবারিক কাজে লাগানো হয়নি কখনো। যুদ্ধের সময় প্রতিরোধ আন্দোলনের সদস্যরা নদী পারাপারের কাজে ব্যবহার করত। রাতের বেলা তারা এটা বেয়ে নদী পার হতো, তবে ঠিক এখানে নয়, আরো অনেকটা উজানে। মাঝেমধ্যে উল্টেও যেত। অনেকে, বিশেষ করে কিষানরা মারা গেছে। তারা অনেকে সাঁতার জানত না। এ রকম অনেক ওয়াশটাব বানানো হয়েছিল। এখানে কোনো স্মৃতিসৌধ নেই। কেউ জানেই না যে এখানকার ধ্বংসস্তূপ ছিল এই এলাকার কয়েক মাইলের মধ্যে একমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। এই এলাকার সামান্য কিছুসংখ্যক বাড়িতে এমনকি গাছপালার সারির পাশের খামারে অনিয়মিতভাবে কোথাও নিভু নিভু করে, কোথাও জ্বলজ্বল করে আলো ছড়াত এখানকার বিদ্যুৎ। এই জায়গাটার কথা লোকজন জানতে পারে শুধু একটা লোকগানের মাধ্যমে। অবশ্য গানটার মধ্যে যুদ্ধের ওই সব স্মৃতির কথা বলা হয় না। গানে শুধু এই জায়গাটার নাম উল্লেখ করা হয় এবং এখানে শুরু হওয়া প্রেমের কথা বলা হয়।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">মহিলা অনেকটা অনিচ্ছায় শোনে তার কথা, যেন বেশি বকবকানি শুনতে না হয় তাকে। শেষে প্রধান কথাটা তার কাছে স্বস্তির মনে হয়। সে কোনো জায়গার নামধাম সম্পর্কিত গল্পগুজব শুনতে আগ্রহী নয়, শুধু প্রেম সম্পর্কিত গল্প শুনতে ভালো লাগে তার। জুয়াড়ি সময় নেয় এবং পরিবর্তিত কণ্ঠে বলে, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">আমাদের সামনে আপনাকে যখন অ্যাম্ফিথিয়েটারে আনা হলো তখন আপনার জন্য আমার মনে তেমন শ্রদ্ধাবোধ জাগেনি, আপনাকে পাওয়ার বাসনা জেগেছে। আপনাকে পেতে চেয়েছি। আপনার অসহায়ত্বটা ছিল পূর্ণাঙ্গ, আপনার ভ্রু এমন একটা আভা ছড়াচ্ছিল যে আমি আপনার প্রেমে পড়ে গেলাম। আপনার হতাশা আমার ভেতর কামনা জাগিয়ে তুলল। তারপর আপনি বন্ধুত্বপূর্ণ শান্ত কণ্ঠে আপনার ঘুরে বেড়ানোর কথা বললেন। প্রফেসর বললেন আপনার অভিজ্ঞতার বর্ণনা রোগবিদ্যাবিষয়ক। আর আমার মনে হলো, আমার জীবনের যোগ্য নারীকে আমি পেয়ে গেছি, এত দিন যাকে স্বপ্নে লালন করেছি, তাকে পেয়ে গেছি। একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব ছিল, আসলে আপনি যখন এলেন তখনই সিদ্ধান্তটা নেওয়া হলো। আমার মন আপনার কাছে যখন ধরা পড়ে গেল তখন আমি আনাড়ি, বিশুদ্ধ, পবিত্র, স্বর্গীয় অবস্থায় যদিও আপনাকে পেলাম পুরোপুরি নারী হিসেবে, রক্তমাংসের নারী, শরীরী নারী যেন এক নিখুঁত তরি। একেবারে শেষ সারিতে আমার ওপরের আসন থেকে আমি আপনার ওপর পড়ে গেলাম, আমি আপনার মধ্যে ঢুকে গেলাম, এতটাই শক্তি আর গভীরতায় পড়ে গেলাম যে আমাদের পরমানন্দ একেবারে পূর্ণবিলয়ের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে গেল। যদিও আমি অনেক দূরে বসে ছিলাম, তবু আপনার মুখের আদল, চরম দুরবস্থার মুখ, অলঙ্ঘ্য নারীসুলভ স্বর্গসুখের মুখোশ এবং চরম কামুকতার মুখবিকৃতির মাঝে কোনো পার্থক্য আমি দেখতে পেলাম না। সেদিন আমরা অন্যদের সামনেই আমাদের ভালোবাসা বিনিময় করলাম, আমি আপনাকে ভালোবাসলাম আপনার পরিত্যক্ত অবস্থায়, আপনি আমাকে ভালোবাসলেন আমার বিশুদ্ধ সমবেদনায়। তখন থেকে কোনো মানুষের জন্য কিংবা কোনো জিনিসের জন্য আমার আর কোনো আবেগানুভূতি জাগেনি। সেদিন থেকে আমার সামনে এমন কোনো বিরল, সুন্দর মানুষ দেখিনি। সেদিন আপনি-আমি সবার সামনেই এক অনন্য শিশু পয়দা করলাম।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt"> তার কথা শুনে মহিলা হয়তো বলতে পারত, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">কী রকম শিশু?</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt"> জুয়াড়ি হয়তো জবাব দিতে পারত, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">এখনো পর্যন্ত অজাত এক শিশু, সম্ভবত এর মধ্যেই মৃত, সম্ভবত টিকে থাকতে অসমর্থ, একটা ক্ষীণ প্রতিমূর্তি, ক্রমান্বয়ে ক্ষীণতর হচ্ছে এমন।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.45pt">মহিলা মনোযোগ দিয়েই শুনেছে জুয়াড়ির গল্প। তবে থেকে থেকে মাথা ঝাঁকিয়ে যেন বোঝাতে চেয়েছে, গল্পটা তার মনের মতো হচ্ছে না। কিংবা বিস্মিত হয়েও মাথা ঝাঁকাতে পারে, এমন ঘটনাও ঘটা সম্ভব! হয়তো সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু ভেবে একবার সে হেসেও উঠেছে। জুয়াড়ির সর্বশেষ বাক্যের পর মহিলা ছাইয়ের মধ্যে পা দিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে একটুকরা কাঠ পায়। সেটায় এখনো আগুন আছে। সেখান থেকে একটা সিগারেট জ্বালায়। আগুনের আকস্মিক আঁচে তার চোখ সরু আর মুখ মুখোশের মতো লাগে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">পূর্ণিমার চাঁদ দিগন্তের কাছে থাকতে দেখা গেল হলুদ এবং বিরাট। এখন মাথার ওপরে ছোট সাদা মনে হচ্ছে। তবে চাঁদের আলো অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অপরিচিত, অদ্ভুত লাগছে। শুধু নদীর পূর্ণ অবয়ব ঝলমল করছে তা নয়, নদীর পারের ঝোপ-জঙ্গলের পাতা এবং ক্যাম্পারের ধাতব অংশ নয় শুধু, কাঠের অংশও ঝলমল করছে। পর্দা টেনে দেওয়া হয়েছে। নাকডাকার মৃদু আওয়াজ তাদের মধ্য থেকে ওঠানামা করছে। পরিত্যক্ত ক্যাম্পফায়ারের ছাই থেকে ধোঁয়া উঠছে। জ্বলজ্বল করা পানিতে আরো উজ্জ্বল একটা কিছু এগিয়ে আসছে, নড়াচড়া করা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। নদী পার হয়ে আসছে, প্রথমে আকারটা স্পষ্ট নয়, শুধু জিনিসটার পেছনে ইংরেজি </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">ভি</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt"> অক্ষরের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে। তীরে উঠে আসার পর জিনিসটার কালো ছায়া থেকে বোঝা যায়, এটা একটা প্রাণী। তবে সিলের চেয়ে অনেক ছোট এবং গায়ে লোম আছে; ভোঁদড়ের চেয়ে অনেক বড়, লেজও ভারী। বিবরটা গুটিসুটি মেরে অনড় হয়ে বসে। তার চোখ ও কান ছোট, কয়লার মতো কালো। পেট ও পায়ে কাদার স্তর লেগে আছে। নাক দিয়ে এদিক-ওদিক গন্ধ শুঁকে যাচ্ছে অবিরাম। এখানকার দৃশ্যে যা যা আছে সব কিছুর অভিভাবক সে এখন, নাক গন্ধ শুঁকে সব কিছুর নজরদারি করছে। এখানকার সব কিছুর মালিকও সে। সে রাতের বেলা পরিশ্রম করে, নদীতে বাঁধ তৈরি করে। ভাটিতে তার কর্মস্থল থেকে কাজকর্ম সেরে এইমাত্র বাড়ি ফিরেছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">সকালের আলোতে দেখা যাচ্ছে, এখন গ্রীষ্ম। উষ্ণ বাতাসে অন্য পারের খাড়া ঢালের পাতার দেয়াল সবুজের বলয় হয়েছে, এই ঝোপ থেকে ওই ঝোপে পার হয়ে যাচ্ছে সবগুলোকে একত্র করতে; শুধু যেখানে নিচের ছোট গাছগুলোর পাতা শুকিয়ে যাওয়ার মতো ফ্যাকাসে ধূসর হয়েছে, আবছা আলো ছড়াচ্ছে, সেখানে ছিন্ন হচ্ছে একত্র করার ঢেউ। এখনো স্বপ্নের ভেতর ডুবে থাকা কান ঝিঁঝির ডাককে ঘুগরা পোকার একটানা হট্টগোল মনে করছে। এই পারটাও চরম গ্রীষ্মের আলোয় স্নাত হয়েছে। হাঁটু পর্যন্ত লম্বা সাঁতারের ট্রাউজার পরে বৃদ্ধ ঝরনার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ঝরনা তার শাওয়ার হিসেবে কাজ করছে, পর্দা হিসেবেও কাজ করছে। মহিলা বৃদ্ধের পায়ের কাছে পানির মধ্যে চোখ বন্ধ করে বসে নিরিবিলি গোসল করছে; বাথটাবের মতো মাথা রেখেছে একটা শিলাখণ্ডের ওপর। পানির স্তর উঠে আসছে তার থুতনি পর্যন্ত।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">জুয়াড়ি ও সৈনিক ঘাসের মধ্যে বসে তাস খেলছে। আপাত মনে হচ্ছে, সৈনিক হাসছে। কিন্তু তার কান গাঢ়-লাল হয়ে উঠেছে, অনেকটা কালো হয়ে গেছে। জুয়াড়ির অবস্থাও প্রায় এ রকমই। সে বসে আছে ফুলহাতা শার্ট গায়ে। তাস শাফল করা আর ফেলার পর জড়ো করে আনার কাজ জুয়াড়ি এমন আন্তরিকতা ও উত্তেজনার সঙ্গে করছে, যেন এতক্ষণ সে দর্শকমাত্র ছিল, এখনই কেবল খেলার সুযোগ পেয়েছে। সামান্য এই বন্ধুত্বপূর্ণ খেলার জন্যই সে অতিরিক্ত শক্তি খরচ করছে, খেলাটা অবশ্যই টাকা দিয়েও হচ্ছে না। তার চুলের ভেতর থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে, ঘামে ভিজে শার্ট বুকের কাছে এবং পিঠে আটকে গেছে। তাস ফেলার আগে মাঝে মাঝে চিন্তা করতে হচ্ছে, এই সময়টুকুতে সে দাঁত দিয়ে নখ কাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। একবার-দুবার সে নামিয়ে ফেলা তাসও ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রতিপক্ষ জুয়াড়ির আঙুলের ওপর তার শক্ত হাত নামিয়ে এনে তাকে থামিয়ে দেয়। হেরে যাওয়ার পর জুয়াড়ি দুহাত মাথার ওপরে তুলে একটার সঙ্গে আরেকটা আটকে ধরে উচ্চৈঃস্বরে খিস্তি ঝাড়ে। মহিলা ড্রেসিং গাউন পরে তাদের পাশে বসে মুখে মেকআপ নেয়, তাদের খেলার হার-জিত সহজে মেনে নেয়। খেলায় একজন বিজেতা আছে, কিন্তু জয় নেই। আশপাশে ঘটতে থাকা ঘটনাকেই ধীর করে দিয়েছে এই খেলা। খেলার মধ্যে তারা সময় মাপার উপায় পেয়েছে। আবার ধীরগতির সময় তাদের বেড়ার মতো সুরক্ষা দিয়েছে। এই বেড়ার বাইরে যা কিছু আছে তার আর কোনো আকর্ষণ নেই, শুধু ভীতি তৈরি করতে পারে। শুধু অভ্যাসের ভেতরে পাওয়া সাধারণ সময় বিরাজ করে, প্রাত্যহিক ঘটনা, ইতিহাস, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">খারাপ অসীম</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">, ছোট-বড় অশেষ মহাযুদ্ধ</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">এসব ছাপিয়ে যায় সময়। দিগন্তের ওপারে প্রাণঘাতী ঐকান্তিকতা শুরু হয়ে যায়। গাছপালার মাথা একটা সীমান্তরেখা তৈরি করে। যারা সদ্য মারা গেছে তাদের জিহ্বা ওই সীমান্তের ওপারে কাঁপতে থাকে আরেকটা নিঃশ্বাস টানার প্রয়াসে। দলে দলে নারী-পুরুষ ওপরে ওপরে পছন্দের শব্দ উচ্চারণ করে যাচ্ছে, ভেতরে ভেতরে সবাই চুপ। তারা বিভিন্ন বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে, কত রকমের অন্ধ সমর্থক তারা। এ রকম সমর্থন থেকে কারো মুক্তি নেই। তারা সর্বোচ্চ পর্বতকেও নিচু ভূমির ভেতর নিয়ে যেতে পারে। তাস খেলাকেও বাস্তবতা মনে করে কেউ কেউ বেড়ার মধ্যে নিরাপদ থেকেও সময়ের সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করে। তাস খেলোয়াড়রা ঘাসের মধ্যে একে অন্যের মুখোমুখি বসে থাকে; মনে হয়, তারা নিজ নিজ বর্ম ফেলে দিয়েছে, আসল চেহারা দেখাচ্ছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">বৃদ্ধ অন্যের আনন্দ মাটি করে দেয়। সে হঠাৎ এসে তাসগুলো তুলে নিয়ে নদীর মধ্যে বহুদূরে ছুড়ে মারে। দীর্ঘ সময় যেন এখান থেকে দূরে ছিল সে, তার মুখভর্তি না-কামানো দাড়ি, রোদে পোড়া তামাটে বর্ণ মুখ। উল্টো করে পরা প্রাবার এখন উজ্জ্বল রঙের লিনেনের পালের মতো দেখা যাচ্ছে। গোড়ালিঢাকা জুতা পরে একটা পানির বোতল নিয়ে কাঁধে ঝুলিয়েছে একটা ঝোলা, লংমার্চের জন্য সব কিছু নিয়ে প্রস্তুত সে। ঝালরওয়ালা পশমের উজ্জ্বল রঙের ডোরাকাটা ক্যাপ পরেছে মাথায়। এক হাতে ভাঁজ না করা একটা মানচিত্র, আরেক হাতে সদ্য কেটে আনা একটা ঝাড়গাছের লাঠি। জোকারের মতো ঢিলা ট্রাউজার পরে একটা পা এগিয়ে দিয়ে আরেক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মারমুখী চেহারা সত্ত্বেও চনমনে ভাবে আছে সে। তার মানে, সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে এবং তাস ফেলে দিয়েছে তার সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">অন্যদের তাকে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ দেয় খানিক। তারপর সে বলা শুরু করে, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">আনন্দ ভ্রমণ শেষ। এখান থেকে আমরা হাঁটা দেব। আর গাড়িতে চড়া নয়। মানুষ যখন গাড়িতে চড়ে তখন বিদায় নেওয়া হয় না, জায়গার পরিবর্তন হয় না, কোথাও পৌঁছানোর মতো বোধও আসে না। আমি নিজে গাড়ি চালালেও আমি কখনো সত্যিকার অর্থে ভ্রমণ করিনি। আমার হৃদয় কখনো ভ্রমণের অংশ হতে পারেনি। আমি গাড়িতে চড়লে একটা ভূমিকার মধ্যে আটকে যাই; সেটা তো আমার স্বভাবের বিপরীত। গাড়ির মধ্যে একটা কাচের ভেতরে একটা অবয়বের ভূমিকায় থাকি, সাইকেলে চড়লে হ্যান্ডল ধরার এবং পেডাল করার ভূমিকা পালন করতে হয়। কিন্তু হাঁটা নিজেই একটা বিষয়। মাটির ওপরে পা ফেলা। তখন আমার হাত থাকে মুক্ত। আমার নিজের ছন্দের সঙ্গে দোল খেতে থাকে আমার হাত। শুধু সম্পূর্ণরূপে প্রয়োজনে পড়লেই গাড়ি চালানো কিংবা গাড়িতে চড়া উচিত। যেসব জায়গায় গাড়িতে চড়ে গিয়েছি সেসব জায়গায় আমি কখনো পৌঁছিনি, থাকিনি। শুধু হেঁটেই কেবল কোনো জায়গার পুনরাবৃত্তি সম্ভব। হাঁটলেই বোঝা যায়, কোনো জায়গা আমার সামনে উন্মোচিত হচ্ছে; তখন মাঝখানের স্থানটুকু গান গেয়ে ওঠে। শুধু হাঁটার সময়ই আমি গাছের আপেলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারি। শুধু পদচারীর মাথা তার কাঁধের ওপর বেড়ে ওঠে। শুধু একজন পদচারীই তার পায়ের গুলের অভিজ্ঞতা পেয়ে থাকে। শুধু একজন পদচারীই তার শরীরের ভেতর বয়ে যাওয়া স্রোত টের পায়। কেবল একজন পদচারীই তার কানের মধ্যে লম্বা গাছের উপস্থিতি বুঝতে পারে, যেটাকে নীরবতা বলা হয়। শুধু একজন পদচারীই নিজেকে ছাড়িয়ে যায় এবং নিজের কাছে পৌঁছে যেতে পারে। কেবল একজন পদচারীর চিন্তার মধ্যে নিরেট কোনো বিষয়ের অস্তিত্ব থাকে। আমরা হাঁটব। হাঁটা নিজ থেকেই সম্পাদিত হতে চায়। যারা দরকারে হাঁটে কিংবা যারা দুর্ঘটনাক্রমে হাঁটে, আপনারা কিন্তু তাদের মতো করে হাঁটবেন না। সবচেয়ে স্বাধীন ক্রীড়া হলো হাঁটা। এখনই সময় বেরিয়ে পড়ার। পদচারীদের গুণ বা বৈশিষ্ট্য পেয়ে থাকে কোনো জায়গা। আহ, আমার হাঁটার অতৃপ্ত ক্ষুধা, হেঁটে কোথাও চলে যাওয়ার তাড়না, চিরতরে হাঁটতে থাকা!</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.25pt">’</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">বৃদ্ধের আদেশ বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয় তার শ্রোতারা। জীবনে যা চেয়েছে তা-ই হাতের কাছে পেয়ে গেছে জুয়াড়ি; সেই মানুষই এখন হাঁটার সরঞ্জাম বিতরণ করছে সবার মাঝে। কাপড়চোপড় বাতাসের মতো ফিনফিনে; জুতাগুলোও হালকা। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয়টি হলো, এদের সবার পোশাক বিশেষ কেতা বা শৈলী তৈরি করেছে, এমনভাবে মানিয়েছে, যেন এদের জন্যই অর্ডার দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। সব রকম বেমানান বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও পোশাকের চমৎকারিত্ব তাদের একটা দল গঠন করতে সহায়ক হয়েছে। মহিলা তার হেডব্যান্ড পরেছে টায়রার মতো করে; সৈনিক পার্কা জ্যাকেট পরেছে ইউনিফরমের মতো; আর জুয়াড়ি তার ডাস্টকোট পরেছে অফিসের পোশাকের মতো। সৈনিক ও জুয়াড়ি পিঠে তুলে নিয়েছে ভারী ব্যাগ। ভারী ব্যাগের ওজনের কারণে তাদের শরীর বাঁকা হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ব্যাগ কাঁধে নেওয়ার কারণে তাদের আরো লম্বা মনে হচ্ছে, যেন তাদের কাঁধের জন্য ব্যাগের ভার খুবই দরকার ছিল।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.45pt">ছায়াময় ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে রেখে যাওয়া হচ্ছে ক্যাম্পার। গাড়ির পিঠের ওপরের অংশটা ভুলে ফেলে যাওয়া কাঠের স্তূপের মতো লাগছে। পরিত্যক্ত জায়গাটাতে প্রাণের উপস্থিতি যোগ করছে একটা পাখি। পাখিটা ছোট নাজুক পা দুটি স্রোতস্বিনীর মাঝখানে একটা বড় পাথরের ওপরে রেখেছে। পাখিটার শরীরের চেয়ে লম্বা লেজ একবার উঠছে আবার নামছে। বিরাট গোলাকার পাথরটার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পানির শব্দও একটানা শোনা যাচ্ছে, এই শব্দের মধ্যে একটা নেতিবাচক ছন্দোময় ভারী পতনের সুর আছে, অন্যসব শব্দকে ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে পানির এই শব্দ, বাদ্যযন্ত্রের শব্দতরঙ্গের মতো সুললিত, কিংবা বলা যায়, বিস্মৃত মহাকাব্যের প্রতিধ্বনির প্রতিধ্বনি। </span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">ধ্বংস হতে থাকা ভবনের গায়ের গুলির ক্ষতগুলো ঢেকে দিচ্ছে চুন-বালুর মিশ্রণের সঙ্গে মিশে যাওয়া মাকড়সার জাল। বরফ ও তুষার গলা বাষ্প ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে সেতুর ওখান থেকে। তক্তাগুলোতে ফাটল শুরু হচ্ছে। নিষিদ্ধ এলাকার একটা ভাব বিরাজ করছে এই জায়গাটাতে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.25pt">পদচারীরা সেতু পার হয়ে অন্য পারে না গিয়ে বরং নদীর পাশ দিয়ে খচ্চরের চলা একটা পথ ধরে হাঁটতে লাগল। আমরা ভাটির দিকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু মাঝে মাঝে এদিকে তাকিয়ে ঢেউ আসা দেখলে মনে হচ্ছিল, আমরা উল্টো দিকে যাচ্ছি, মানে উজানে যাচ্ছি। শেষে চিত্র একেবারে গোলমেলে হলো, যেমনটা প্রাচীন ওয়েস্টার্ন মুভিতে দেখা যায় : স্টেজকোচের চাকা উল্টো দিকে ঘুরছে মনে হয়।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.4pt">নদীটা যে উপত্যকা থেকে বের হয়ে এসেছে, ঠিক সেখানেই ছিল আমাদের প্রথম যাত্রাবিরতি। আমরা যে পাশে ছিলাম, নদীর সেই পারটা একটা সমতলে গিয়ে মিশেছে। আর অন্য পারটা তখনো কিছুটা খাড়া, তবে সেটা ধীরে ধীরে লম্বা একটা আধাবৃত্তের মতো হয়ে নদীর পাশে জায়গা ছেড়ে দিয়েছে একটা রাস্তা, একটা রেললাইন এবং শেষে মাঠকে, শেষে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে নদীর সমান্তরালে থেকে পাহাড়ের মালায় মিশে গেছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">এখানে পাহাড়ের মাঝখানের সরু পথের শেষে এসে একটা সরু উঁচু পায়ে চলা সেতু দিয়ে নদী পার হলাম। সেতুটা অত্যন্ত সরু হওয়ার কারণে আমরা খুব সতর্কতার সঙ্গে এক পা এক পা করে পার হলাম। সেখানে পেলাম নদীর ভিন্ন চিত্র : দক্ষিণের আলোয় ঝলমল করা অগভীর নদী। এখানকার জল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে কাঁকর বিছানো বড় পারের মাঝে তৈরি করেছে খরস্রোতা নদী। লোকবসতি খুব পাতলা পাতলা। যত দূর চোখ যায়, একজন নিঃসঙ্গ জেলের দেখা পাওয়া গেল হয়তো, কিন্তু আমরা তার দৃষ্টিসীমায় হাজির হলেও মাথা তুলে আমাদের দিকে তাকানোর মতো দৃষ্টান্ত দেখলাম না।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">আমরা অন্য পাশের রাস্তায় আসার পর দেখলাম রাস্তাটা কেন অব্যবহৃত রয়ে গেছে : অনেক দিন মেরামতহীন পড়ে আছে, সাধারণ লোকজনের চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়নি। রাস্তাটা মহাযুদ্ধের সময় তৈরি করা হয়েছিল প্রধানত রণাঙ্গনে সৈনিক ও রসদ পরিবহনের জন্য। অ্যাসফল্টের ফাটলের মধ্যে ঘাস গজিয়েছে, আস্ত ঝোপঝাড় আর ছোটখাটো গাছপালা গজিয়েছে; সেগুলোর ডালপালা একত্র হয়ে ওপরের দিকে পাতার ছাদ তৈরি করে ফেলেছে। পায়ের নিচে স্থিতিস্থাপক শেওলার ফিতা মাড়িয়ে এই সোজা জনমানবহীন রাস্তায় আমরা আরামেই হেঁটে যেতে পারতাম। কিন্তু আমাদের নেতা রাস্তাটার সমান্তরালে চলা রেললাইনের বাঁধের দিকে পথ দেখালেন আমাদের।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">রেললাইনটা অবশ্য কোনোভাবেই অব্যবহারে পতিত হয়নি। ট্রেন যাচ্ছে-আসছে দেখলাম। যেগুলো উজানে যাচ্ছে সেগুলোর গতি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে, যেগুলো ভাটির দিকে যাচ্ছে সেগুলোর গতি ধীরে ধীরে কমে আসছে। মনে হচ্ছে, এভাবেই ট্রেনগুলো কোনো শহরের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে। অবশ্য আমরা এ রকম কোনো শহরের চিহ্নমাত্র দেখলাম না। অদৃশ্য শহর ছেড়ে চলে যাওয়া ট্রেনগুলোর যাত্রীরা চুপচাপ বসে আছে; শহরের দিকে এগিয়ে আসা ট্রেনগুলোর সামনের মাথা থেকে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত আকস্মিক ঝাঁকি খেলে গেল। সিটগুলো থেকে একটা সাধারণ উত্থান জাগিয়ে তুলল যেন। ট্রেনের শেষ মাথা থেকে সামনের মাথা পর্যন্ত করিডর ধরে কন্ডাক্টরদের সেভেন লিগ বুট-দৌড়ের একই রকম দৃশ্য চলতে লাগল। বিশাল প্রবেশপথের আকারের একটা খোলা জায়গা দিয়ে বাঁধ পার হয়ে আমরা পর্বতের গা বেয়ে একটা হালকা আঁকাবাঁকা পথ ধরলাম। পথটা আমাদের সবার একসঙ্গে পাশাপাশি চলার জন্য যথেষ্ট প্রশস্ত। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল, আমাদের বয়স্ক নেতা তাড়াহুড়া করছেন, আপাত মনে হলো, একা হতে চাচ্ছেন। সে কারণে ওপরে ওঠার একেবারে শুরুতেই আমরা এক সারিতে এগোতে লাগলাম। একটু পরেই দেখা গেল, পাশ থেকে খানিক আত্মবিশ্বাসী দৃষ্টি হেনে মহিলা তাকে পার হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মনে হয়, বোঝাতে চাইছে, তার আর কোনো নেতার দরকার নেই। সামনের একটা বাঁকে সে অদৃশ্য হয়ে গেল। অনেকক্ষণ পর একটা খোলা জায়গায় সে আবার আবির্ভূত হলো, সঙ্গীদের থেকে অনেক ওপরে আকাশের গায়ে তার কালো ছায়া। সে একবারও এদিক-ওদিক তাকাল না। সমতল খোলা জায়গায় যেমন, তেমন করে পাহাড়ের খাড়া পথেও মাথা উঁচু রেখে হাত দোলাতে দোলাতে সংক্ষিপ্ত পথে এগোতে লাগল। সবার পেছনে ব্যাগ কাঁধে জুয়াড়ি ও সৈনিক আস্তে আস্তে হেঁটে আসতে লাগল। একেবারে পেছনে সৈনিক আসছে, সে জুয়াড়িকে পেছনে ফেলে আসতে চায় না। কারণ সে জানে, বেচারার এ রকম খাড়া পথে হেঁটে ওঠার অভ্যাস নেই, তার হাঁটুতে বারবার বাঁধন কষাতে হয়।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">অল্প একটু আগে তারা সমতল এলাকাটা ছেড়ে এসেছে; তবে ইংরেজি </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">এস</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt"> অক্ষরের মতো প্রথম বাঁকটা তাদের অনেক দূর নিয়ে এসেছে। সমতল এলাকাটার চেহারা ও চলমানতা তাদের মনে যথেষ্ট পরিষ্কার হয়েই আছে। পথের এক পাশে তুষারঢাকা পর্বত, অন্যদিকে স্পষ্ট কুয়াশা। কুয়াশাকে চালাচ্ছে কালো চেহারার জাহাজ; জাহাজের পাশের এই কুয়াশাকেই বলা হচ্ছে সমুদ্র। একই সময়ে এখানকার সব রকম শব্দই যেন নৈঃশব্দ্যের পেটে চলে গেছে। আবার যে শব্দগুলো শ্রবণযোগ্য,  সেগুলোরও রূপান্তর ঘটছে। ট্রেনের ঝনঝন শব্দ কাচের দেয়ালের পেছনের দরজায় টোকা দেওয়ার মতো হচ্ছে; মোরগের ডাকও শুনতে লাগছে কাচের দেয়ালের পেছনের অবিরাম কল সাইনের মতো। পরিষ্কার, বিচিত্র ও শান্ত ডিজাইনটা মধ্যযুগীয় প্যানেলের ডিজাইন। সে কারণেই প্রথমবারের মতো প্যানেলের জন্য স্থলভাগের দৃশ্য ব্যবহার করা হয়েছে। সমুদ্র, চষা মাঠ এবং উঁচু পর্বত সমগ্র পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব করে। দূরে কোথাও চকচক করা গাড়িটাও এই নীরব জগতেরই অংশ। ভিন্ন ভিন্ন রঙের হলেও পর্বতপাশের কোনো একটা আড়াল জায়গার মনুষ্যবসতির বাড়িগুলোও আকাশের দিকে পৃথিবীর মেটে রঙেরই প্রকাশ ঘটায়। নীরবতার কারণে এখানকার যেকোনো শব্দের শ্রবণের বিষয়টাও খুব তীক্ষ; পথের বালুর ওপর প্রজাপতির পাখার স্পর্শও শ্রবণে ধরা পড়ে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">এস</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt"> আকারের বাঁকটা ক্রমেই সরু হয়ে আসছে। আরো বেশি কাঁটাগাছের ঝোপ দেখা যাচ্ছে পথে। মনে হচ্ছে এই পথে আর কোথাও যাওয়া যাবে না। আর আশঙ্কা করার কারণও আছে, সামনের বাঁকেই পরিত্যক্ত একটা পাথরের কোয়ারিতে গিয়ে পথ শেষ হয়ে যাবে। শেষে প্রমাণিত হবে, এই পথটা ভুল ছিল। রাস্তার পাশের ঢালের নৌকাটা ঢালের অর্ধেকটা পর্যন্ত ওঠানো আছে, কাদার ভেতর থেকে তুলে আনা ডিঙির মতো পুরু মনে হচ্ছে নৌকাটার গঠন, যেন প্রাগৈতিহাসিক সময়ে এই জায়গাটা যখন সমুদ্রের পানির নিচে ছিল, তখন জোয়ারের ধাক্কায় এত দূর এসে ঠেকেছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">বাঁক পার হওয়ার পরে প্রথমে চোখে পড়ে একটা সামরিক কবরস্থান। আকারে দুটি কোয়ারির সমান প্রশস্ত ও গভীর। এলাকাটা কিছুটা উঁচু করা হয়েছে, একেকটা সারির জন্য বর্ণমালার একটা করে অক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে। মার্বেলের বড় বড় খণ্ড মানুষের চেয়ে বড় আকারের। নামের সারির সঙ্গে খোদাই করা একটা করে তামার ফলক যোগ করা আছে প্রতিটা মার্বেল খণ্ডের পাশে। নামগুলো খানিক দূর থেকেও পড়ার মতো স্পষ্ট; প্রতিটা সারির ওপরে একই কথা লেখা আছে</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">বর্তমান। এই কথাটার কালো অক্ষরগুলো বীরদের এই বিশাল মাঠের মতো কবরস্থানের সবখানে ঝিকমিক করছে। মনে হচ্ছে শব্দহীন কণ্ঠে চিৎকার করছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">কবরস্থানটা সৈনিকের মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং সে খোদাই করা লেখাগুলো পরীক্ষা করে দেখে। অন্যরা জায়গাটাকে একটা বিশেষ কাজের স্থান ছাড়া আর কিছু মনে করতে পারে না। যেখানে পরাজিত শক্তির শহীদরা শুয়ে আছে, সে জায়গাটাকে তারা দেখছে ভিন্ন দৃষ্টিতে। গ্রামের কোনো সাধারণ কবরের চেয়ে বেশি কিছু নয়, এখানেও ঘাস গজিয়েছে। কাঠের ক্রুশগুলোর কয়েকটাতে সংখ্যাও লেখা নেই; নামের অনেকগুলো অসম্পূর্ণ, শেষে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেওয়া আছে কিংবা যথেচ্ছভাবে লেখার কারণে মনে হতে পারে এগুলো মৃতদের ডাকনাম। আমরা এখানে থামি, একজন আরেকজনের জন্য অপেক্ষা করি, একটা কপাটক থেকে পানি পান করি এবং একসঙ্গে এগোনোর জন্য প্রস্তুত হই। তারপর আমরা একটা খাড়া গিরিকন্দরে প্রবেশ করি। মাথার ওপরে ছাদের মতো খিলানের গায়ে লেগে আছে ঝুলন্ত ঝোপঝাড়; নিচে কাদামাটির ওপর খানিকটা অন্ধকার তৈরি হয়েছে ওপরের ঝোপঝাড়ের কারণে। আমাদের ওপরে ওঠার পথটা সংক্ষিপ্ত, তবে অসংখ্য পরিবর্তন ঘটে এই সময়ের মধ্যে। কয়েক কদম এগোনোর পরই দেখা যায়, মোটামুটি ঘড়ঘড় শব্দ করে পাশ দিয়ে চলা স্রোতোধারাটা আরো সরু হয়ে আসছে এবং একই সময়ে পায়ের তলার কাদামাটি ছোট ছোট শিলায় পরিণত হচ্ছে। বিভাজনচিহ্নটা আরো স্পষ্ট করে দিচ্ছে গাছের একটা সাপের মতো শিকড়। ইটের মতো বাদামি মাটি আর মসৃণ হালকা রঙের পাথরের মাঝখানের এই সীমান্তবর্তী গাছটা আকারে বিরাট, ডালপালা চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে; আশপাশে এ রকম গাছ আর নেই। পথের ওপরে ছায়া পড়েছে এই গাছটার। মাটির নিচ থেকে সর্বশেষ পানিটুকু তুলে নিচ্ছে এই গাছটার শিকড়। এই এখন শিলার পথ শুরু হচ্ছে, এই শিলার মধ্যে এক ফোঁটা পানি নেই। এখানে একটা প্রাকৃতিক সিঁড়ির কাছে এসে মিশে গেছে গিরিকন্দর। পাশাপাশি সর্বশেষ ধাপ পর্যন্ত উঠে চারজনই গাছটার ওপরের ডালের শেষ মাথার কাছে চলে আসে; শিকড়ের মতোই এই ডালটাও দেখতে সাপের মতো, ওপরের উঁচু মাটির সঙ্গে লেগে আছে। ঘন পাতাওয়ালা ডালটা লম্বা এবং এর মাথা হীরার আকারের ময়াল সাপের মতো। মাথাটা সামনের দিকে বাড়ানো এবং লম্বভাবে পড়ে আছে মাটি থেকে একটু ওপরের দিকে। তারপর রূপকথার গাছের মতো এই গাছটার সুরক্ষা ছেড়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে তারা দেখতে পায়, বিশাল এক মালভূমির সামনে চলে এসেছে। প্রথম দর্শনে তাদের মনে হয় সামনের এলাকাটা ঊষর। তাদের মনে হয়, পেছনে মাথার কাছে ওই বিশাল গাছের ডালে ঝুলন্ত বীজশুঁটিগুলো জীবজগতের সর্বশেষ চিহ্ন হিসেবে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">তবে তারা যে পানির এলাকার দিকে চিরতরে পেছন ফিরেছে সেটা তাদের জন্য একটা সুবিধা বটে। এত দীর্ঘ সময় ধরে পানি পতনের শব্দ তাদের সঙ্গে সঙ্গে ছিল : মুষলধারার গর্জন, নদীর কুলুকুলু ধ্বনি এবং ঝরনার বুদবুদ।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">মালভূমি ধীরে ধীরে নিচের দিকে নেমে গিয়ে বিশাল ফাঁকা তৈরি করেছে। এই ফাঁকাটা আবার অনেক দূরে শেষ প্রান্তে গিয়ে ধীরে ধীরে ওপরের দিকে উঠেছে, পরিষ্কার নীল রেখায় দেখা যাচ্ছে এত দূর থেকেও। এত বড় ফাঁপা জায়গা শুধু স্বপ্নেই দেখা যেতে পারে। যত দূর চোখ যায়, নীল রেখার প্রান্তগুলো দেখা যায় ঢেউ খেলানোর মতো, বালুর স্তূপের মতো। পাশের প্রতিটা পাহাড়ের মাথা ভেতরপাশের দিকে নিচু হয়ে নেমে গেছে; আর বাইরের পাশটা উঁচু। মনে হয়, একটার পেছনে চড়ে আছে আরেকটা। সবগুলোর মাথাই সীমা এঁকেছে আকাশের দিকে। পাহাড়ের মাথাগুলোর পেছনে অন্য এলাকার আর কোনো পর্বতচূড়া এসে খাড়া হয়নি। এ কারণে দিগন্তবিস্তৃত ডিম্বাকার মালভূমিটা একটা বিচ্ছিন্ন এলাকা, পরিচিত জগৎ থেকে একেবারেই আলাদা। মালভূমিটা শুধু একটা এলাকা নয়, এটা একাই একটা দেশ, আমাদের মহাদেশের ওপরে একটা মহাদেশ।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">এই দেশের প্রধান আকার হলো ডিমের মতো; আমাদের চোখের সামনে ভেতরের সব কিছুকেই যেন বাইরের দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। দিগন্ত আর আমাদের মাঝে যেন ছোটখাটো কোনো আনাচকানাচ নেই, কোনো গুহা নেই, পাহাড়ের ভেতরের কোনো আড়াল নেই। সব কিছু পরিষ্কার দৃশ্যমান এবং চেহারায় একটুও বিকৃতি কিংবা পরিবর্তন নেই। সামগ্রিক চেহারাটার প্রতি কৃতজ্ঞতা, প্রতিটা বিষয় অন্যগুলোর থেকে আলাদা, তবে সবগুলো রুচিশীল চেহারার একাত্মতায় আবদ্ধ, সে কারণে ডিম্বাকৃতির এলাকার মধ্যে তৈরি হয়েছে সক্রিয় জীবনের মরীচিকা। উন্মত্ত প্রত্যাশায় বলা যায়, প্লবমান উৎসবমুখর মানুষ জমায়েত হয়ে তৈরি করেছে এই জীবন।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">তবু এই দেশ অবশ্যই বসবাসহীনই থেকে গেছে, সাম্প্রতিক সভ্যতার কোনো চিহ্নই নেই এখানে : লোকজনের বসতি, বৃষ্টি মাপার যন্ত্র, পাহারাদারের খুপরি কিংবা অন্য কোনো ত্রিকোণমিতিক বিন্দু। ফাঁকা জায়গার পরিচ্ছন্ন লতাগুলো হলো বুনো জুনিপার ঝোপ; আর বাতাসে দোল খেতে থাকা হলুদ শক্তকণার বিশাল মধ্যপশ্চিমের মাঠগুলো মিলে তৈরি হয়েছে গাছহীন ঘাসের প্রেইরি। চারপাশ থেকে অনেকটা মানুষের আকারে গাছপালা দৌড়ে আসছে প্রেইরির ভেতরে। শুকনো, ডালপালাহীন, বাকলহীন গাছপালা ছুটে আসছে বিবর্ণ ঘাসের ভেতর দিয়ে। এখনো খানিকটা প্রাণ আছে এমন ছোট ছোট মোচাকৃতির উদ্ভিদের দল মাঝে মাঝে ফাঁকা এলাকা থেকে উঠে আসছে এবং ডিম্বাকৃতি ওপরের দিকে অমসৃণ রেখা তৈরি করছে; এগুলো মরা কাঠের ধূসর ঝালরের সাজে সেজেছে বলে এদের সবুজ পাতার সমাহারকে দ্বীপের মতো মনে হচ্ছে। কিন্তু এই এলাকাকে পুরোপুরি মৃত বানিয়ে রেখেছে আসলে শূন্য আকাশ। কিছুক্ষণ গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায়, আকাশের নিচের গাছপালা, এমনকি স্বাস্থ্যবান গাছপালাও ধ্বংসের চেহারা ধারণ করেছে। একমুহূর্তের জন্য মনে হতে পারে, এই আকাশটা জীবনের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন। আকাশের এই বৈরিতার প্রমাণ মেলে আঙুলের ডগার চেয়েও ছোট একটা পাখির কাণ্ড দেখলে : ঝোপের ভেতর থেকে অল্প একটু বের হয়ে এসেই আতঙ্কে চিকচিক আওয়াজ তুলে সঙ্গে সঙ্গে তার আশ্রয়ের দিকে দ্রুত ফিরতি উড়াল দেয়। এ রকম আকাশ দেখে সন্দেহ করার কারণ নেই যে কোনো প্রাগৈতিহাসিক যুগে, সেই যুগের লক্ষণ অবশ্য এখনো চলছে এই এলাকায়, অসংখ্য বিদঘুটে চেহারার হাড়ের মতো রঙের বিশাল, কখনো কখনো ঘরের মতো আকারের প্রকাণ্ড প্রস্তরখণ্ড আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো পড়েছে গোটা প্রেইরি এলাকায়, নিস্ব-রিক্ত গাছপালার মধ্যে পড়েছে। এখনো যেকোনো মুহূর্তে ব্রহ্মাণ্ডের বিশাল প্রস্তরপতন ঘটতে পারে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">পদচারীরা বারবার এই অতিপ্রাকৃত দেশের দিকে তাকিয়ে একেকবার একেক চেহারা দেখেছে; ক্ষণে ক্ষণে চেহারা বদলানো এই এলাকাটা চারজন পদচারীর ওপর আলাদা আলাদা প্রভাব ফেলেছে। মহিলা জুয়াড়ির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে আটকে রইল, এতটাই নির্ভরশীল হয়ে রইল যে তাকে টানতে গিয়ে জুয়াড়ির খোঁড়ানো ছাড়া উপায় রইল না। দৃষ্টি থেকে অনেক আগেই অদৃশ্য হয়ে গেছে নদী উপত্যকা; তবু বারবার পেছনে তাকাতে লাগল মহিলা। আতঙ্কের মধ্যেই তার মুখের সৌন্দর্য বেড়েছে মনে হলো; চোখ বড় বড় দেখাচ্ছে, চোখের নিচের হাড় টান টান, ঠোঁট রক্তের মতো লাল। যেকোনো সাধারণ পরিস্থিতিতে শান্ত থাকার চেষ্টা করে জুয়াড়ি; তবে এখন তার হাত নাকের কাছে উঠে এলো; ঘুঁটি চলার সময় কিংবা তাস ফেলার সময় এমন করে থাকে সে। নাকের কাছে হাত নেওয়া দেখে মনে হতে পারে, সে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে। অবশ্য সে কখনো এ রকম দেশে জুয়া খেলেনি। এদিকে এই অজানা জায়গার নীরবতা দেখে সৈনিকের ভালোই লাগে; কোথায় এসেছে তা না জানার মধ্যে দারুণ মজা আছে। এ রকম মজা কোনো মানুষ সাধারণত পেয়ে থাকে যখন ঘুম থেকে জেগে উঠে বুঝতে পারে না সে কোথায় আছে : তার নিজের নামটা পর্যন্ত মনে না থাকলেও শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারে, সে বর্তমানের মধ্যে আছে। কারণ সকাল, আলো, দরজার বাইরের সিঁড়ির ধাপ, ধুলার ওপরে বৃৃষ্টির ফোঁটা, প্রথম দেখা ব্যক্তির চোখ, পুরনো বইয়ের শব্দগুলো</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">সবই দেখতে পায়।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">সৈনিকের আনন্দ অন্যদের স্পর্শ করে না। কারণ তাদের নেতাসহ সবাই কিছু সময়ের জন্য নিজের মধ্যে আটকে থাকে। বৃদ্ধ মালভূমিতে পৌঁছানোর জন্য তাড়াহুড়ার মধ্যে ছিল, অথচ এখন সামনে এসে থেমে গেছে। তার রাজ্যের দিকে ইঙ্গিত করা অঙ্গভঙ্গিও বদলে গেছে : নিচে নামানো তার চোখের পাতায় ভয় লেগে আছে; তার কণ্ঠেও এ রকম ভীতি প্রকাশ পাচ্ছে : স্বাভাবিক হচ্ছে না তার ধ্বনির মাত্রা, হয় বেশি নিচু হচ্ছে, নয়তো বেশি উঁচু হচ্ছে, হয় বেশি জোরে বলা হয়ে যাচ্ছে, নয়তো বেশি আস্তে বলা হচ্ছে, যেন নিজেই অবিরাম শুনে যাচ্ছে, যেন এই এলাকায় এসে নিজের কণ্ঠ সে আগে কখনো শোনেনি, বা অন্য কারো সামনে কথা বলেনি। অবশ্যই এত বছর ধরে সে বহুবার এসেছে এখানে, এই জায়গার সঙ্গে সে পুরোপুরিই পরিচিত।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">বৃদ্ধ বলা শুরু করল, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">আমরা এই এলাকায় চলে এসেছি। আমাদের এখন সময় আছে। আজকের দিনটা আমরা যেমন পাচ্ছি, আগামীকাল তেমনই পাব। এই মুহূর্তে হয়তো আপনারা সবাই কিছুটা শঙ্কিত, তেমনটাই স্বাভাবিক। গ্রীষ্মের সময় এখানে শীত। এই এলাকার স্বচ্ছতা আসলে দৃষ্টির ভ্রম। অন্য কোনো জায়গায় এই তেপান্তরের চেহারা ধারণ করা যাবে না, এভাবে সাজানো যাবে না এবং কোনো হোটেলের জানালার বাইরে ইচ্ছামতো দেখা যাবে না এ রকম দৃশ্য। কোথাও পানির প্রবাহ নেই। চারপাশে শুধু নীরবতা। আপনাদের দিকে তাকানোর মতো অন্য কোনো জীব নেই। আপনাদের সঙ্গে কথা বলার মতো কোনো মানুষ নেই। আপনাদের নিশ্চয়তা দেওয়ার মতো আয়নার প্রতিবিম্ব পাবেন না। প্রতিটা পাথরের নিচে হয়তো জাতসাপ আছে, কিন্তু এখানে আপনাদের কোনো প্রতিপক্ষ নেই, যার জন্য আপনাদের প্রতি পদক্ষেপ মেপে ফেলতে হবে। কোনো শত্রু নেই, যার চোখের দিকে তাকাতে পারেন। এই এলাকায় অন্য জায়গার মতো কোনো কিছুর জন্যই সঠিক মুহূর্তটি পাবেন না</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">না অস্ত্র বের করার, না বই খোলার। শুধু </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">এখন</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt"> কিংবা </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">কখনো নয়</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt"> বলে কিছু পাবেন না এখানে, পাবেন </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">সর্বকাল</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">সর্বসময়</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">; অথবা পাবেন </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">কখনো নয়</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt"> এবং </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">কখনো নয়</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">। এই এলাকায় আপনাদের ছুরি কারো তাজা রক্তমাংস কাটতে পারবে না। এখানে শুধু বইপত্রে কিংবা মানুষের ভাষ্য থেকে শুনে প্রকৃতিকে জানতে পারবেন। আমি আপনাদের ভয় পাইয়ে দিলেও আমিই আপনাদের কাছে প্রতিজ্ঞাও করছি। আমি আপনাদের কাছে প্রতিজ্ঞা করছি, এখানে শুধু ক্ষুধা-তৃষ্ণা পাবেন না, তা নয়, মাথার ওপরে ছাদ পাবেন, ঘুমানোর জায়গা পাবেন, এখান থেকে বাড়িতে ফিরেও যেতে পারবেন। আমি আরো প্রতিজ্ঞা করছি, আপনারা এখানে সৌন্দর্যও পাবেন। আমরা সব কিছুই দেখব অন্য আলোয়। যতক্ষণ এখানকার বাতাস আমাদের নিঃশ্বাসে নেব, ততক্ষণ আমরা পারস্পরিক সম্পর্ক এবং জীবনের চিহ্ন দেখতে পাব নির্জীব ও বিমূঢ় বস্তুর মধ্যেও। যত দিন সকালে আমরা এই এলাকার আলোয় হাঁটব প্রথম কয়েক কদম ফেলার পরই আমাদের ভেতরের প্রতিমা আমাদের সামনের খোলা জায়গায় চলে আসবে, একটা শব্দ, একটা ছন্দ, গানের আকারে কিংবা কোনো গল্পের আকারে। আপনারা এখানে নতুন, কিন্তু অপরিচিত নন। আপনারা প্রত্যেকেই আগে এখানে এসেছেন। যে সময়টাতে আপনারা এখানে-ওখানে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়িয়েছেন তখন এখানেই ফিরে আসতে চেয়েছেন। এই এলাকার দিকে এসেছে এমন পথের চিহ্নই আপনারা খুঁজেছেন আপনাদের ব্যাংকনোটের জলছাপের ওপর। দিনের বেলা কোনো বই এই এলাকা সম্পর্কে আপনাদের কিছু বলতে পারেনি; কিন্তু রাতের বেলা আপনাদের স্বপ্নরা এসে ঠিকই কথা বলেছে এই এলাকা সম্পর্কে। এই জনশূন্য এলাকাটা হাজার হাজার বছর ধরে জাতিগুলোর ট্রানজিটের একটা জায়গা হিসেবে, কিংবা যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে কাজ করেছে। কখনো কখনো বিধ্বস্ত হয়েছে, ধ্বংস হয়েছে। যে কবিরা এখান দিয়ে গেছেন তাঁরা এই জায়গাটাকে </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">তাৎপর্যহীন</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt"> বলে অবমূল্যায়ন করেছেন। তাঁদের কেউ হয়তো শুধু একপলক তাকিয়েই </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">পাথরের সমুদ্র</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt"> বলেছেন; আরেকজন হয়তো বলেছেন, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">মানুষের পতনের পর ঈশ্বর যেন এখানে এসে থেমেছিলেন অভিশাপ দেওয়ার জন্য</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">। তোমার কোনো সম্পদের পাতালকুঠরি নেই, ডালিমগাছ নেই, চিরকাল শুধু শূন্যতাই বেড়েছে; তবু আমাদের মতো মানুষের কাছে তুমি গৌরবের ভূমি। আজীবন আমি অননুগত থেকেছি শুধু আমার এই খাতাটার জন্য; এখানে এই আমার যন্ত্রণাদাতা। হে নিঃসঙ্গ, ঊষর, বিধ্বস্ত, পথের পরে পথ বাড়ানো অফুরন্ত বিশাল দেশ, আমি শুধু তোমার প্রতিই বিশ্বস্ত থেকেছি।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">’</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">সামনের এলাকাটার দিকে ভালো করে দেখলে নিঃসন্দেহে বোঝা যেত, বৃদ্ধের কথাগুলো প্রাণহীনকেও প্রাণ দান করতে পারে, তার কথায় সব কিছুর চেহারা চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, সব কিছুর দেহরেখা স্পষ্ট দেখা যায়; গভীর নিচু অবস্থা থেকে প্রাণহীন ফাঁকা জায়গাটাকে সে ওপরে তুলে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু সামনের এলাকাটা নিয়ে তার কণ্ঠ ধর্মীয় গান গাওয়ার মতো কাঁপা কাঁপা স্বরে পৌঁছলেও আমাদের দলের কেউ বৃদ্ধের বার্তা গ্রহণ করেনি। সৈনিক তার কথা শোনে অন্যমনস্ক হয়ে, যেন সে আসলে অন্য কিছু শুনছে; জুয়াড়ি তার হাতের মুষ্টিতে ধরা চাবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। চাবিগুলোর ইস্পাতের মাথা নাকল-ডাস্টারের মতো মাথা বের করে থাকে। মহিলা একটা পকেট আয়নায় নিজের চেহারা দেখায় ব্যস্ত; আয়নাটা সে এত কাছে ধরেছে যে ভেতরে শুধু তার চোখের প্রতিবিম্বই দেখতে পাচ্ছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">ভাবলেশহীন পরোক্ষ চেহারায় দলনেতা আয়নাটা নিয়ে ঝোপের মধ্যে ফেলে দিল। প্রায় একই সময়ে সে জুয়াড়ির চাবির গোছা এবং তার নিজের হাতের নতুন লাঠিটাও ফেলে দিল, যেন এসব জিনিস আরো একটা করে বাড়িতে আছে। মহিলা ও জুয়াড়ি কিছু মনে করেছে বলে মনে হলো না। তারপর বৃদ্ধ মাটির ওপরে জোরে ধপাস করে পা ফেলে; হঠাৎ মাটি কেঁপে ওঠে এবং সৈনিকসহ অন্যরা চমকে ওঠে। মাটির ভেতর অর্ধেকখানি ডুবে থাকা বিরাট একটা পাথরের দিকে বৃদ্ধ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কত বছরের পুরনো জানার উপায় নেই, তবে এটা একটা প্রবেশদ্বারের ভাঙা অংশ, তা বোঝা যাচ্ছে। আঁচড়ে আঁচড়ে পাথরের ওপর থেকে ছত্রাক তুলে ফেলে। একমুঠো চমৎকার জুনিপারের মোচা ছিটিয়ে দেয় পাথরখণ্ডের ওপর এবং সতর্কতার সঙ্গে ফুঁ দিয়ে লেখাবার্তার ওপর ফেলে। এভাবে সে মোচাগুলো খাঁজগুলোর ওপর ছড়িয়ে দেয়। জাদু করার মতো এভাবে সে পাথরের ওপর থেকে একটা ছবি তোলে এবং জাদুকরের আলখাল্লার মতো তার প্রাবারের একটা ঘূর্ণি ছুটিয়ে তার দর্শকদের  দেখায় : দশ রশ্মিওয়ালা রেখাহীন একটা সূর্যঘড়ি পাথরের ভেতর আঁচড়ে আঁচড়ে তৈরি করা হয়েছে এবং চকচকে বাদামি জুনিপারের মোচাগুলোর জন্য স্পষ্ট দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে সেটা। একই রকম ভাবভঙ্গিতে সে খাতা থেকে একটা সাদা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলে। টুকরা টুকরা করে মুখের ভেতর পুরে একবার ডানে একবার বাঁয়ে চিবাতে থাকে। চিবানো কাগজের মণ্ড মুখ থেকে বের করে এনে আঙুলের ওপর ফেলে এবং পাথরের দ্বিতীয় ব্লকের ওপর সারি করে রাখে, মনে হয় পাথরটা মাটির ভেতর থেকে উঠেছে। কিছুক্ষণ শুকাতে দিয়ে মণ্ড পাথরের ওপর থেকে তুলে ফেলে আমাদের প্রত্যেককে অক্ষরগুলোর ছাপ দেখায় : ডিআইএম, সংক্ষিপ্ত রূপটাকে সে বিশদ করে বুঝিয়ে বলে, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">ডিও ইনভিকটো মিট্রে</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">, মানে বের করেও দেয়, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">অজেয় সূর্য দেবতার প্রতি</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">। তারপর সে আমাদের সামনের জনমানবহীন এলাকার দিকে ইঙ্গিত করে এবং তার স্বভাবমতো বলে ওঠে, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">তাহলে এবার আমাদের যাত্রা শুরু করা যাক।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">’</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">এ রকম পাণ্ডুলিপি উন্মোচনই চেয়েছিলাম আমরা; এর মাধ্যমে এই তেপান্তরে জীবনের আর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় কি না। ঘাসের মধ্যে পাথর পুঁতে রাখার চিহ্ন, প্রাকৃতিক পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে থাকা যুদ্ধপূর্ব মাইলপোস্ট, রোপণ করা একটা চেরিগাছ ইত্যাদি। চেরিগাছটার পাতার মধ্যে প্রথমে খানিক আমরা কিছুই দেখলাম না, এরপর দেখলাম চকচক করা লাল ফল; শেষে দেখলাম চোখ-ধাঁধানো দীপ্তি আর ঝলক, যা পাতার সবুজ রংকে ম্লান করে দেয়। ঘাসের মধ্যে পুঁতে রাখা পাথর আর দেখা গেল না। বরং পানির মধ্যে উঁচু করে বানানো পথের মতো দেখা গেল যত দূর চোখ যায় একেবারে দিগন্ত পর্যন্ত।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">মাথা নিচু করে কাঁধ বাঁকিয়ে বৃদ্ধ বেশ দ্রুত যেতে লাগল। পেছন থেকে দেখার কারণে একবার তাকে মৃত্যুপথযাত্রীর মতো, আরেকবার স্কুলবালকের মতো লাগল। আমরা বাকিরা এই অদ্ভুত দেশের সীমানায় পা রাখার মুহূর্তে সীমাহীন আনন্দ পেলাম। মহিলা হাত নামিয়ে গাড়ির চাকার মতো করে চার হাত-পায়ে হাঁটা শুরু করল। জুয়াড়ির ব্যাগের মধ্যে সব সময় একটা বাস্কেটবল থাকে; সেটা বের করে সৈনিক এবং সে সামনে-পেছনে ছুড়ে দিতে থাকল। থামার একটা জায়গায় তারা একটা কংক্রিটের কোর্ট দেখতে পেল, পরিত্যক্ত কোনো সেনা ক্যাম্পের অধীনে ছিল হয়তো, লতাপাতায় ঢেকে আছে, এখনো একটা দণ্ড আছে, সার্ভিসের একটা বাস্কেটও আছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">উষ্ণ সূর্যালোক আমাদের মুখের ওপর পড়ছে। পর্বতের ওপরের ঘাসের মধ্য দিয়ে চলার মতো করে আমরা এগিয়ে চলছি। এতক্ষণ যেগুলো প্রেইরি ঘাসের মতো দেখছি, সেগুলো একটু ভিন্ন, এখানে-ওখানে ছড়ানো-ছিটানো থোকা থোকা সরু ঘাস, আমাদের পা তোলার সময় যে অল্প একটু বাতাস ছড়ায় তাতেই ঘাসগুলো মাথা নুইয়ে ফেলছে। এগুলোর নিচে আছে ঘন মোটা ঘাস। আমাদের এখনো মনে হচ্ছে, আমরা রাস্তায়ই আছি। এখানকার বিন্যস্ত গাছপালার জন্য ভালো লাগছে। এ ঝোপ থেকে ও ঝোপে আমাদের সঙ্গ দিতে দিতে উড়ে যাচ্ছে একদল চড়ুই। প্রতিবার তাকানোর পরই দেখতে পাচ্ছি, চড়ুইগুলোর সংখ্যা বাড়ছে। শূন্য থেকে বের হচ্ছে বলে তারা টেলিগ্রাফের তারের দখল নিয়ে নিচ্ছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">এবার কাঁধ ঘোরাতে ঘোরাতে দৃষ্টি জুতার ডগায় স্থির করে আমাদের নেতা পুরোপুরি হাঁটায় আত্মনিবেদন করেছে। হাঁটার তালে তালে মাথার ওপরের টুপির কাঁটার মতো ভঙ্গুর বলয় থেকে শুরু করে তার সারা শরীর ঝাঁকি খাচ্ছে। কোনো অন্ধ ব্যক্তি পরিচিত জায়গার খানাখন্দ বাঁক</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">এই সব কিছু মনে রেখে যেভাবে সতর্কতার সঙ্গে হাঁটে, তার পুরোপুরি মগ্ন হয়ে হাঁটার ভঙ্গিটাও সে রকম মনে হয়। এবার সে হাঁটার গতি কমিয়ে আনে এবং তার কাঁধ প্রসারিত হয়ে যায়। আমরা তাকে পার হয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় দেখি, সে একেবারেই নিজের মধ্যে মগ্ন হয়ে আছে, তবে আবার সতর্কও আছে। পাখিদের সৃষ্ট সামান্য শব্দ কিংবা মৃদু বাতাসের শব্দ শোনার জন্য তার কান খাড়া হয়ে আছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">এরপর শুরু হয় তার জ্ঞানদান। বারবার সে আমাদের থামিয়ে, সবাইকে জড়ো করে সাধারণ একটা ইশারায় একের পর এক যুদ্ধ, শান্তি কিংবা একসঙ্গে দুটি বিষয়েই আমাদের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যখন সে একটা কাঠের স্তূপের ওপর আঙুলের টোকা মারে তখন সে বোঝায়, এটাও ছিল যুদ্ধকালীন আশ্রয়স্থল। কোনো পরিখার ফাঁকা জায়গার ওপরে আঁকাবাঁকা হয়ে পড়ে থাকা ঝোপের ডালপালার সারি সরানোর সময়, প্রেইরি ঘাসের মধ্যে পড়ে থাকা একমুঠো রাজবেরি তোলার জন্য নিচু হওয়ার সময়, একটা কোয়েলের ডিম তোলার সময়, একবারে গুল্মের আস্ত ঝোপ তুলে আনার সময় যখন আমাদের নাকে সুগন্ধের ঝাপটা লাগায়, আমাদের মাথার ভেতর ঢুকে যায় সুগন্ধ; ঝোপের পর্দা সরিয়ে আমাদের বাঁ পাশে পাথরের ভাণ্ডার বের করে ফেলার পর বোঝা যায়, ছুটির দিনের জন্য মনে হয় এগুলো এভাবে ফেলে গেছে মানুষ। বৃদ্ধ আমাদের ডান দিকে দেখায় পাকা শস্যের মাঠ, পর্বতের ওপর থেকে বয়ে চলা ছোট স্রোতস্বিনীর মতো সবুজ; ঝোপের বড় বড় পাতা বাতাসে দোল খায়; হাতের ইশারায় সে দেখিয়ে দেয়, গাছের মাথা বজ্রপাতে কিভাবে কাটা পড়েছে। একটা সোনালি ইগল শূন্য আকাশ থেকে বের হয়ে পড়ে যেন তার হাতের ইশারায়, তার ইশারায় যেন শূন্য নীল আকাশে জন্ম নেয় রেখার মতো মেঘ, তারপর আবার নিরুদ্দেশ হয়ে যায় সে মেঘ; পাথরের ওপরে যখন সে খোদাই করা লেখা বের করে ফেলে তখন থেকেই এ কাজগুলো করে যাচ্ছে সে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">বৃদ্ধ হঠাৎ সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তার চারপাশের সবার কথা ভুলে যায়। তার খাতাটা এবার তুলে নেয়। খাতার লেখা অংশটুকু কালো ও ফোলা মনে হয়। খাতাটা একটা বিশাল ভলিউমের মতো। কাম্বারল্যান্ড পেনসিলের শব্দ প্রায় শোনা যায় না এবং নীরবতাকে আরো ভারী করে ফেলা অন্যান্য একটানা শব্দের ভেতর ডুবে যায় পেনসিলের শব্দ। পেনসিলের ছন্দ মোর্স ট্রান্সমিটারের শব্দের মতো। পেনসিলটা কথা বলে, অন্যের কথার মধ্যে হস্তক্ষেপ করে, যুক্তি দেখায় এবং প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। এভাবেই কোনো বিষয় স্পষ্ট করে দাঁড় করাতে চায়। আমরা দেখতে পারি না কী লেখা হচ্ছে, কারণ খাতাটা লেখকের কনুইয়ের আড়ালে; তবু কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে ওপরে তাকিয়ে আমরা বুঝতে পারি, স্থলভাগের ওপরে ক্রিয়াশীল আছে ক্রিয়াপদ। এই এলাকাটার প্রতিটা অংশের ভেতর দিয়েই চলছে নিঃশব্দ শোঁ শোঁ আওয়াজ। পর্বতের চূড়ার উঁচু হয়ে থাকা এবং ঘাসের জমিনের শুয়ে থাকার মধ্যে ক্রিয়াপদ ততটাই সক্রিয় আছে, যতটা আছে ঝোপের মধ্যে পাখির বসে থাকার মধ্যে। আমাদের পায়ের তলার ঘাসের মধ্যে আছে চিরন্তন সবুজ বর্ণধারণ, মাথার ওপরের আকাশে আছে প্রাণবন্ত নীলবর্ণ ধারণ। আর এ দুয়ের মাঝে, দৃষ্টির সমান উচ্চতায় আছে বনভূমির অবিরাম নতুন হয়ে ওঠা, সমতলভূমির ওপর দিয়ে চলে যাওয়া এবং পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠা। এখানকার গাছপালা, এমনকি মরাগুলোও যেন দীর্ঘ খবরের মধ্যে এগিয়ে চলা রাস্তার বাতিগুলোর মতো দায়িত্বরত আছে। গাছের ডালগুলো জোরে জোরে দোল খাচ্ছে। আগে থেকেই যা কিছু ছিল সব আবার পেনসিলের ছন্দে বারবার অস্তিত্বে চলে আসছে নিজ নিজ চেহারায়।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">আমাদেরও পেয়ে বসল দিকনির্দেশনাহীন শক্তি। আমরাও যার যার মতো আলাদা করে এদিক-ওদিক ঊষর জমিনের ওপর এবং চষা মাঠের ভেতর ছড়িয়ে পড়লাম। আসলে আমরা আর কোনো কাজই করলাম না, শুধু হাঁটতে লাগলাম। একজন থেকে আরেকজনের খানিক দূরত্ব বজায় রেখে আমরা একা একা দ্রুত হাঁটতে লাগলাম; তবে দূরে হলেও ছিন্ন হইনি আমরা। একজন আরেকজনের দিকে খুব একটা তাকাইনি। তবে জানতাম তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে অন্য পক্ষ থেকে হাতের ইশারায় সাড়া দেওয়া হবে, কমপক্ষে দৃষ্টিসীমার মধ্যে থাকলে তো অবশ্যই। সাড়া দেওয়ার জন্য চিৎকার করারও প্রয়োজন নেই।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">ফসল তোলার মতো কাজ করতে পারে এমন একজনই ছিল আমাদের মধ্যে, সে হলো বৃদ্ধ। সে আমাদের দিকে ফিরে এসেছে, যেন আমাদের আর বর্তমান মুহূর্তে তার নেতৃত্ব দরকার নেই। সামনে ঝুঁকে পড়া, মাটিতে লাঙলের দাগ অনুসরণ করার মতো করে সামনে-পেছনে এগোনো-পেছানো, পড়ে থাকা শস্য কুড়ানোর মতো নিজের পদচিহ্ন অনুসরণ করে ফিরে আসা, একটা জায়গায় গোলাকারে ঘোরা কিংবা কয়েক কদম পেছনে চলে এসে কিছুই ফেলে যাওয়া হচ্ছে না এমন নিশ্চয়তা পাওয়া, কিংবা সময়ে সময়ে এক হাত কোমরে রেখে আরেক হাত চোখের ওপর রেখে সূর্যের আলো ঠেকানোর ভঙ্গিতে খানিক দাঁড়িয়ে থাকা</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">এসব করতে লাগল সে। তার খাতায় কোনো কিছু লিখে রাখার সময় সে বাঁকা হয়ে এমন ভঙ্গি করল, যেন সে একটা বাঁকে এসে লাঙল ঘোরাচ্ছে। তার দিকে তাকানোর পর দেখলাম, আরেকটা মানুষকে দেখা যাচ্ছে মাঠের ভেতর দিয়ে আসতে। আগে যাকে দেখা গেল তার বদলে নয়, বরং তার পেছনে দেখা গেল পরেরজনকে। আগেরজন তখনো ওখানেই হাঁটছে। শেষে দেখা গেল, ওই একটা লোকই এক মাইল লম্বা এক মিছিল হয়ে গেছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">দিগন্তে মেঘ দেখা গেলে আমরা আবার একত্র হলাম। ততক্ষণে আমরা ওই এলাকার একেবারে ভেতরে চলে এসেছি। ফাঁকা জায়গাটার একেবারে নিচের অংশে আমরা অনেকক্ষণ হেঁটেছি। তবু আমরা সরু একচিলতে প্রেইরির ওপরই আছি। পুরো উপত্যকা পূর্ণ করার আগ পর্যন্ত প্রেইরি বহুদূর ছড়িয়েছে। বাতাস ও আলোর স্বচ্ছতা এবং কোনো কোনো মুহূর্তের বাতাসের বেগ থেকে আমরা বলতে পারতাম, আমরা তখনো উঁচু মালভূমিতেই আছি।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">এত দ্রুত দিগন্ত পার হতে পারে শুধু সমুদ্র থেকে উঠে আসা মেঘ। একমুহূর্তের মধ্যে সারা আকাশ ঢেকে ফেলল মেঘ। অভ্যন্তরের এলাকায় যেমন খানিকটা আগাম বার্তা জানায় ঝড়, এখানে তেমন কোনো ইঙ্গিতই দিল না। প্রথমে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি শুধু পাথরগুলোকে ভিজিয়ে দিল। ঘাসের ভেতর থেকে ভিজে ওঠা পাথরের গায়ের নানা রকম রং দেখা যেতে লাগল। ঘাসের মধ্যে ঝিঁঝি পোকার ডাকের মতো শব্দ, তারপর বিরতি, যেন ঝড় শক্তি গুছিয়ে নিচ্ছে। এবার কিছু বুঝে ওঠার আগেই বৃষ্টি আমাদের ওপর একেবারে ভেঙে পড়ল। আমাদের হাতের পেছনের পাশে বয়ে নামতে লাগল, আমাদের হাঁটুর পেছনের ভাঁজে জোরে ধাক্কা মারতে লাগল, আমাদের মাথা যেন উড়িয়ে নিতে চায়। আমাদের জুতার মাথার ওপরে ভেঙে পড়ছে। ততক্ষণে হাঁটু পর্যন্ত জল জমা হয়ে গেছে। সে পানির মধ্য দিয়েই আমরা হেঁটে এগোনোর চেষ্টা করলাম। পানি ভারী আর ক্রমান্বয়ে ভয়ানক রকমের ঠাণ্ডা হচ্ছে মনে হলো। অবশ্য জুয়াড়ির ব্যাগের মধ্যে একটা রেইনকোট আছে, আমাদের চারজনকে ঢেকে ফেলার মতো যথেষ্ট বড়। কিন্তু বাতাস আরো প্রচণ্ড হয়েছে। বৃষ্টি ওপর থেকে যতটা চাপে ফেলেছে তার চেয়ে বেশি জোরে পড়ছে সামনে থেকে। ঝড়বৃষ্টি অল্পক্ষণের মধ্যেই আমাদের আধা অন্ধ বানিয়ে ফেলল, নিঃশ্বাস নেওয়া-ফেলাও অসম্ভব হয়ে গেল।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">আশ্রয়ের সন্ধানে প্রেইরির প্রান্তের দিকের ঝোপঝাড়ের দিকে এগোনোর চেষ্টা করলাম; কিন্তু আমাদের গতি একেবারেই হতাশাজনক এবং ধীর, দুঃস্বপ্নের মধ্যে যেমন হয়। কাদার ভেতর ডুবে যেতে লাগলাম, বারবার হোঁচট খেতে লাগলাম, পরনের কাপড়ের ভারে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতেও কষ্ট হচ্ছিল, হাঁটুর কাছে আটকে যাচ্ছিল কাপড়, পড়ে যাচ্ছিলাম, নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য বারবার থামছিলাম। আমাদের অনুসরণকারীকে পেছনে নয়, চারপাশেই দেখতে লাগলাম। শেষে একটা অস্থায়ী আশ্রয় পাওয়া গেল। শক্ত এবং ঘন পাতার স্তরবিশিষ্ট ঘন ঝোপের মধ্যে আশ্রয় নিলাম আমরা। ছড়িয়ে পড়া পানির আক্রমণ কিছুটা কমাতে পারল আমাদের আশ্রয়স্থল। আমরা চারজনই ওখানে অনেকক্ষণ থাকলাম, তবে প্রত্যেকে নিজ নিজ কুঠরির মতো অন্যদের থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলাম। ওখানে আশ্রয়ে থেকে আমরা চোখের সামনে দেখলাম, মহাপ্লাবনে উঁচু মালভূমি কিভাবে কুয়াশাঢাকা সমতলের মতো জলাভূমিতে পরিণত হচ্ছে; আমাদের আশ্রয়স্থল ঝোপঝাড়গুলো দ্বীপে পরিণত হচ্ছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">একটু একটু করে কমে আসে বৃষ্টি। কিছুটা থামার পর আবার আসে। ক্রমান্বয়ে আগের চেয়ে কম সময় স্থায়ী হয়। তারপর বাতাসের সর্বশেষ ঝাপটায় শুধু একটা গাছ থেকে খানিক পানি পড়ে। এভাবে শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি থেমে গেল; বাতাসও থেমে গেল। বৃষ্টি পড়ার সময় গভীর পানি জমা হওয়ার ফলে প্রেইরিকে মনে হয় উদ্ভিদ প্রাচুর্যে ভরা। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই পানি আবার শুষে নেয় মাটি। বাকি থাকে শুধু গড়গড়া করার মতো শব্দতোলা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। বোতলের ছিপি খোলার সময় যেমন শব্দ হয়, মাটির নিচে পানি চলে যাওয়ার সময় তেমন শব্দ হতে লাগল চারপাশে। আর ঝোপের ভেতরকার পানি নানা রকম ফোঁটায় কমতে থাকল, এক পাতার ফোঁটার সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্য লেগে রইল অন্য পাতার ফোঁটা।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">বৃষ্টির পানি জমে খানাখন্দ কিংবা গর্ত তৈরি হয়নি; কোনো পাখিও তেমন পানিতে গোসল করার সুযোগ পায়নি। ঝড়ের পরেই বিরাজ করছে কান বন্ধ করা নীরবতা : বৃদ্ধের কথা অনুযায়ী এটা হলো </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">ননস্টিলনেস</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">। সে আবার লেখা শুরু করেছে; এখন আর কাগজের খসখস শব্দ হচ্ছে না, কারণ কাগজ তো আর্দ্র হয়ে গেছে। আমাদের চারপাশে যে ধূসর রং দেখা যাচ্ছে এটা কিন্তু কুয়াশা নয়, এক রকমের আবছা অবস্থা, ঘন, একই রকম, ধোঁয়ার মতো কিংবা ফিতার মতো কোনো কুণ্ডলী নেই, যেমন দেখা যায় তুষার গলে যাওয়ার সময়। আমাদের একমাত্র দিগন্ত আমরা নিজেরা আর কতিপয় পাতা; পাতাগুলো আবার মলিন আলোর কারণে ইন্ডিয়া ইনকে আঁকা প্রতীকের মতো দেখাচ্ছে। আমাদের দর্শনের সর্বোচ্চ সীমা তখনো আয়ত্তের মধ্যে পাওয়ার মতো দূরত্বে, পাখির ঠোঁটের মতো বাঁকানো কাঁটা যার ইঙ্গিত অজানার দিকে। </span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">আমাদের কোটর থেকে বের হওয়ার সময় দেখা গেল, ঝোপের কাঁটার সঙ্গে আমাদের কাপড় আটকে আছে, আশ্রয় খোঁজার সময় বেখেয়ালে আমরা কাঁটার সঙ্গে আটকে গেছি। আমাদের ভ্রমণের পরবর্তী পদক্ষেপে দেখা গেল, আমরা সাধারণত যা করতাম তেমন করে কোনো কিছুর দিকে বারবার তাকিয়ে লাভ নেই; মায়ার মতো প্রশান্তিতে যত ছোটই হোক না কেন, যেকোনো কিছুর নড়াচড়া চোখে পড়ার মতো। কিন্তু তেমন নড়াচড়া দেখা গেল না, এমনকি ঘাসের ডগার ওপর পালকের মতো নরম কিছু দেখেও মনে হলো, যেন একসঙ্গে লেগে আছে, এমনকি আমাদের কেউ ঘাসের ডগায় ফুঁ দিলেও মনে হলো নড়ছে না।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">বাতাসের প্রবাহ শুরু হতে হতে অনেকটা সময় পার হয়ে গেল। তবে বিপরীত দিক থেকে শুরু হলো, যেন আমাদের পেছনের দিক থেকে বাতাস ফিরে এসেছে। শুরু থেকেই আমরা বাতাসের ধরন অনুভব করার চেষ্টা করলাম বলে বুঝতে পারলাম, এবারের বাতাস পুরোই আলাদা ধরনের। আগের বাতাসের বেগ শোনা গিয়েছিল একেবারে আলাদা কিছু বিষয়ের কারণে, বিশেষ করে কচি মোচা ও পাতার কারণে। আর পরের বাতাসটা এলো একেবারেই আলাদা করা যায় না এমন অবস্থায়, শিস বাজানোর মতো করে এবং ঠকঠক করতে করতে, মানে এই বাতাস কোনো মরুর ওপর দিয়ে বইবে না, বরং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে গেলেও মানায়; অবশ্য নিশ্চিত করে বলা যায়, কয়েকটিমাত্র পাখি কয়েদিদের মতো বিলাপ করতে করতে এরই মধ্যে পাখা ভাসিয়ে উড়ে চলে গেছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">জমা হতে এবং উড়ে যেতে মেঘ যতটুকু সময় নিল, তার চেয়ে খুব বেশি সময় লাগল না আমাদের কাপড় শুকাতে। আমাদের একমাত্র জুতার ফিতা খোলাটা খুব কঠিন কাজ, যেটা বর্ষণের সাক্ষী। জোর বাতাসকে ধন্যবাদ দিতেই হয়, এখনকার বাতাসটা বেদনাদায়কভাবে পরিষ্কার। যে জিনিসের দিকেই তাকাই আমরা, সেটাকে খুব বেশি নিকটে মনে হয়, খুব বেশি তীক্ষ চেহারার মনে হয়। বেশি নিকটে মনে হওয়ার কারণে আমাদের জুতার সামনে অনেক কিছুই ভুল দেখা হয়, কাছে মনে করে পা ফেললেও কাছে নয়। গাছপালার পাশাপাশি অবিরাম বিদ্যুচ্চমকে গাছপালার নেতিবাচক চেহারাও দেখতে পাই। আমাদের পাশ দিয়ে কৃষ্ণসার মৃগদের একটা দল খুরের উচ্চ শব্দ তুলে দৌড়ে চলে যায়, অথচ আসল চিত্র হলো দল নয়, ওটি একটিমাত্র হরিণ। আমাদের সামনের প্রেইরি ঘাস পুরোপুরিই চিরুনির টানে যেন ভাগ ভাগ হয়ে গেছে বলে কাছে-দূরে নগ্ন পাথরের মরু ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছে না। এখনকার জোরের বাতাসটা গর্জন করতে করতে আমাদের মাথার খুলি ভেদ করে বয়ে যাচ্ছে, সামনে-পেছনে যত দূর শূন্য আছে, সবটাই দখলে নিয়েছে এই বাতাস। বাতাসের দ্রুতগতির কারণে মনে হচ্ছে চাঁদটা তাড়াতাড়ি ক্ষয়ে যাচ্ছে। আর নিচের এই এলাকাটা অবনত সমতলে আটকা পড়ে ভয়ে কাঁপছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">একমাত্র শান্ত জায়গা পাওয়া গেল টিলার ওপরের বাঁকের পেছনে। বাতাস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমরা ওখানে আশ্রয় নিলাম। মনে হলো, পরিষ্কার, উষ্ণ চৈত্রদিনের বিকেল পেয়ে গেছি আমরা। মরূদ্যানের মতো এ রকম একটা আশ্রয়ে মাটিতে নিতম্ব ঠেকিয়ে সৈনিক কপালে মুঠি চেপে ধরল। অন্যরা তার চারপাশে দাঁড়াল। শেষে সৈনিক মুখ তুলে তাকাল। দেখা গেল, তার মুখটা হয়ে গেছে কোনো বুড়ো মানুষের মুখ। হাসার চেষ্টা করতে গিয়ে সে নিজের সব দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলল। একমুহূর্ত পর কোনো রকম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করেই নিজের দুর্বলতা নিয়ে হাসা শুরু করল। নিজের দুর্দশা প্রকাশ করার ফলে নবশক্তি পেয়েছে বলে কারো সাহায্য ছাড়াই উঠে দাঁড়াল। হাঁটা শুরু করে সে বিড়বিড় করে ঠোঁট নাড়ানো শুরু করল, যেন কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আসলে সে নিজের হাঁটার পদক্ষেপ গুনছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">আসন্ন সন্ধ্যার সূর্যের আলোয় আপাত কাঁপা কাঁপা দীর্ঘ ছায়ার সময় আমাদের নেতা হঠাৎ পায়চারি করতে করতে দ্রুত হাঁটা শুরু করল এবং আমাদের জানাল, আমরা ইচ্ছা করলে আরো পরে যাত্রা শুরু করতে পারি। আমাদের থেকে অনেকখানি এগিয়ে সে আস্তে করে ওপরের দিকে উঠে যাওয়া একটা বনের ভেতর প্রবেশ করল; এখানে নানা জাতের গাছপালা। মাঝখানে দেখলাম সাইপ্রাসের সারি, মনে হলো, কবরের ভেতরের পায়ে চলা পথের ওপর আছে গাছগুলো। খুব জোরে বয়ে যাওয়া বাতাসের কারণে কালো পাতায় ঢাকা অনেকগুলো কাণ্ডও যেন নিজেদের নগ্নতায় বিশাল আকারে হাঁ করে উঠছে। এটা আর আমাদের চোখের ভ্রম নয়। পথের শেষে গিয়ে বৃদ্ধ আলোর ধনুকের ভেতর দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। একমুহূর্ত পরে আমরা দেখলাম, বনের ভেতর থেকে ধোঁয়া উঠছে; আমরা মনে করলাম, এটা ধোঁয়ার সংকেত। পরে পরিষ্কার বোঝা গেল, আজকের জন্য ওটাই আমাদের গন্তব্য।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">একটা প্রাকৃতিক গুহা আর মানুষের তৈরি একটা কাঠামোর মাঝখানে প্রবেশপথে বৃদ্ধ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। প্রথমে আমরা মনে করলাম, এটা আলোকলতাঢাকা জানালাহীন ঘর, দক্ষতার সঙ্গে তৈরি একটা দরজাও হয়তো ছিল একসময়, চৌকাঠের ওপরে বিন্দু বিন্দু জমাটজলের ফেস্টুন, কাদার মেঝেতে একই রকম চৌকাঠ; আর এগুলোর মাঝে ঝুলন্ত অবস্থায় আছে হরেক রকম লতা, দক্ষিণের এলাকায় দড়ির পর্দা এভাবে ঝুলতে দেখা যায়। মাথার ওপরে ছাদ তৈরি হয়েছে ঘন গুল্মের সবুজে। বৃদ্ধ যখন আতিথেয়তার অঙ্গভঙ্গিতে রজ্জু সরিয়ে আমাদের ভেতরে ঢোকার পথ দেখাল, তখন আমাদের একজন স্বতঃস্ফূর্ত হয়েই জুতা খুলে ফেলল এবং অন্যরাও তার দেখাদেখি জুতা খুলল। একটা কালো-হলুদ আগ্নেয়গোধা চুপ করে থেকেই আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকাল; এটা তাহলে গুহার অতিথিশালার কুলতাত্ত্বিক প্রতীক।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">এই গুহাটা একসময় বাংকার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং এর ভেতরের দেয়ালগুলোতে কংক্রিট লাগানো হয়েছে। ছাদ থেকে ঝুলন্ত জমাটজল স্মোকহাউসের মাংসের মতোই কালিঝুলিময়; তবে এ অবস্থা শুধু প্রবেশের মুখে; বাঁক ঘুরে আমরা আরেকটা গুহায় ঢুকলাম। ভেতরটা আগের গুহার চেয়ে বেশি গভীর, তবে অন্ধকার আগের চেয়ে কম। পাতলা ছাদে গোলাকার আপাত কৃত্রিম বেশ কয়েকটা জানালা। একসময় এখানে গাছের শিকড় গজিয়েছিল, এখন বাইরের জগৎ দেখা যায় এবং জানালার কারণে এখানকার রংগুলো আরো তীব্র হয়েছে। ছাদের ওপরকার ঝোপঝাড়ের গ্রীষ্ম-সবুজ রঙে রাঙা হয়েছে পুরো গুহাটা; মেঝেতে জমে থাকা গোলাকার জলের ওপর পড়েছে ঝোপগুলোর প্রতিবিম্ব। জলের অংশ পার হয়ে সামনে পটভূমির দিকে এগিয়ে গেছে একটা তক্তা। একনজরেই  চেনা যায় একটা শুকনো </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">চিমনি কর্নার</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">, কাটা লোহার তৈরি একটা স্টোভে গর্জনরত আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। এত জোরের শব্দের কারণেই বাইরের বাতাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে না। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, বাইরের পথের শেষ দিকে বৃদ্ধ এ জন্যই টুকরা কাঠ কুড়াচ্ছিল। কাত হয়ে থাকা দুটি পাইপ দিয়ে দেয়ালের একটা ফুটোর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে স্টোভটাকে। মোটা পাইপটা ধোঁয়া বের করার জন্য, আর সরু পাইপটা স্টোভের জলাধারে বৃষ্টির পানি নিয়ে আসার জন্য। কোনো হোস্টেলের চিত্রের সঙ্গে মিল কল্পনা করা যেতে পারে এখানকার স্টোভের পাশে কাঠের বেঞ্চ এবং গুহার দেয়ালের পাশের লম্বা বেঞ্চের চিত্রের। বিন্দু বিন্দু জমাটজলের প্রবাহ থেকে তৈরি চুনের দণ্ড গুহার দেয়ালের পাশে হেলান দেওয়ার জন্য বেঞ্চের পেছনে লাগানো তক্তার মতো; পাশের ঘুমানোর জায়গাটা একটা চোরকুঠরির মতো এবং এর মেঝেতে শস্যের খোসা আর খড়ের সঙ্গে কয়েক স্তরের লতাপাতা বিছানো হয়েছে। মেঝের ওপর যত্নে ভাঁজ করা ধূসর রঙের সেনা-কম্বল বিছানো না থাকলে যে কেউই এটাকে পশুদের থাকার জায়গা মনে করতে পারত। জানালা না থাকায় ওপরের দিকে ঝুলন্ত একটা শিলাখণ্ডের কারণে চোরকুঠরিটাকে কিছুটা একটা রুমের মতো মনে হচ্ছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">এবার বাবুর্চি হয়েছে বৃদ্ধ। জুয়াড়ির ব্যাগের মধ্যে পাওয়া জিনিসপত্র দিয়ে বেশ দক্ষতার সঙ্গেই সে সন্ধ্যার খাবার তৈরি করে ফেলে। গুল্ম আর শস্যের শাঁস মিশিয়ে স্বাদু ও সতেজ বানিয়ে নিল ব্যাগের ভেতরের জিনিসগুলো। এখানে আসার সময় সে শস্যের শাঁস, পাহাড়ি ডুমুর ও জুনিপার বেরি কুড়িয়ে এনেছে। এগুলোর জন্য টিনজাত খাবারের স্বাদ আরো বেড়ে গেছে। আমরা বাকিরা প্রচণ্ড ক্লান্ত বোধ করার ফলে আর বাইরে যেতে চাইলাম না। প্রথমে তো আমরা বেঞ্চ থেকেই উঠতে চাইছিলাম না। আমাদের বাবুর্চি যখন সব কিছু ধোয়ামোছার কাজ করছিল আমরা তখন গুহার প্রবেশমুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, বাংকারের দিকে আসার পথের বাঁকে আরো অনেক পাতা উড়ে আসছে, যেন এখানে কিংবা ওপরের জানালার গর্তের মতো ফাঁকায় এসে নিরিবিলিতে বিশ্রাম নেবে পাতাগুলো। জানালার গর্তের ফাঁকা জায়গাটা অনেক দিন আগে থেকেই রাতের মতো কালো হয়ে আছে। সন্ধ্যার ওই মুহূর্তটা আমাদের কাছে বাবুর্চির চেহারায় একজন বুড়ো মানুষের একটা অনন্য চিত্রকল্প হাজির করল; সেটা চিরকাল টিকে থাকার মতো। গুহার দেয়ালে একটা তেলের কুপি জ্বালিয়ে আমাদের আতিথ্যকর্তা আমাদের সঙ্গে বসল। আলোর বৃত্ত প্রথমে কিছুটা টলতে থাকল, তারপর বড়জোর টেবিলের ওপর অনড় পড়ে থাকা আমাদের বড় বড় হাত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। আমাদের হাত তখনো ফোলা ফোলা লাগছে। তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলির মাঝে তখনো যেন বেভুলে ধরা আছে ব্রেডের শেষ টুকরা, একটা বইয়ন কিউব, একটা মটরদানা, একটা সিগারেট ইত্যাদি। কয়েক ঘণ্টা বৃষ্টির মধ্যে কাটানোর ফলে আমাদের আঙুল তখনো কুঁচকে আছে, আঙুলের আসল রং ফিরে আসেনি, যেন আমাদের হাত গোটা সময় ধরেই পানির নিচে ছিল। কুপির সলিতা তোলার পরে রুমের সবখানে সমানভাবে আলো পড়া শুরু করে। ছাদ থেকে নিচের দিকে দেয়ালের ওপর প্রলম্বিত চুনের দণ্ডগুলোর মাঝের জায়গা সবটুকু আবছা আবছা অন্ধকার হয়ে পড়ে এবং তাতে এগুলোর চেহারা আরো গুরুত্ব পায়, আরো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। উপরিভাগটা চুনাপাথরের। তার ফলে রাতের জন্য ফেলে রাখা জানালার পর্দার নিয়মিত ঢাকনার চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মেঝে থেকে ওপরের দিকে ওঠা নানা রকমের চুনের দণ্ড বাড়িতে ব্যবহৃত এক সারি মজবুত এবং অভিজাত চেহারার জিনিসপত্রের চেহারা তৈরি করে : জগ, বোতল, কাপ, রুটির ছত্রাক ইত্যাদি।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">জুয়াড়ি একটা ট্রানজিস্টার রেডিওতে সুইচ টিপে চালু করে দেয়। রেডিওটা এত ছোট যে তার হাতের মধ্যে প্রায় অদৃশ্যই রয়ে যায়। আমরা খবরের অংশবিশেষ শুনি। খবর পাঠকের কণ্ঠ খুব কোমল ও পরিষ্কার; অতিরিক্ত যথার্থতায় উচ্চারণ করার ফলে তার কথাগুলো শুনে মনে হয়, বাচ্চাদের কিংবা বিদেশিদের উদ্দেশে বলা হচ্ছে। আসলেই খবরের বার্তাগুলো বিশেষ কিছু লোকের জন্যই পাঠানো হচ্ছে। খবরের অংশটা এ রকম : </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">...যত দূর জানা যায়, কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। কারো সম্পত্তি বিনষ্টের কোনো খবরও শোনা যায়নি। ট্রেন, বিমান, জাহাজ</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt"> সব ঠিকমতোই চলছে। সব পাহাড়ি পথ খোলা আছে। অনুসন্ধানী দল নিরাপদেই ফিরে এসেছে। সর্বশেষে নিখোঁজ হিসেবে যাদের কথা বলা হয়েছিল, তারাও নিরাপদে আছে, ভালো আছে। প্রধান প্রধান নগরীর পরিবেশ শান্ত আছে এবং দেশের কোনো এলাকা থেকেই বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের কোনো সমস্যার খবর পাওয়া যায়নি। খাবারের কোনো ঘাটতি নেই, কোনো রকম মহামারির হুমকি কিংবা আশঙ্কা নেই। যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সবই ফলপ্রসূ প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে তেমন কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা নেই বলে বিশেষ কোনো পদক্ষেপের কথাও বিবেচনা করা হচ্ছে না। আবহাওয়ার অবস্থায়ও লক্ষণীয় উন্নতি দেখা যাচ্ছে...।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">’</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">তখন থেকে গুহার পাশ দিয়ে বহমান রয়ে যায় বাতাস; এবং চুনাপাথরের ছাদ থেকে চুইয়ে পড়া পানির ফোঁটাগুলোও নীরবতার অংশ হয়ে যায়। এই নীরবতার ভেতর থেকেই আমাদের আতিথ্যকর্তার কণ্ঠ জেগে ওঠে। তার কণ্ঠে বিস্ময়বোধ ক্রমেই বাড়তে থাকে : </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">আজ আমরা কত দূর চলে এসেছি! আমরা পৃথিবীর অর্ধেক পথ ভ্রমণ করে ফেলেছি। আজ সকালে জলপ্রপাতের নিচে হাড় জমিয়ে ফেলা ঠাণ্ডা-স্নানের অভিজ্ঞতা হয়েছে; দুপুরের প্রচণ্ড তাপে পটপট আওয়াজ তোলা তামার লিপিফলক দেখলাম যুদ্ধে নিহতদের কবরস্থানে; আজ বিকেলে মরুবৃষ্টির সঙ্গে লড়াই হলো আমাদের, বৃষ্টির মধ্যে বইতে থাকা তিব্বতীয় উত্তুরে ঝাপটা বাতাসের তোড়ে দম ফেলার সুযোগ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছিল না। আমাদের পেছনপাশ থেকে আক্রমণ করছিল বাতাস। শেষে সন্ধ্যার দিকে একটা গুহার পেছনে এই গুহায় পৌঁছে গেলাম, বাংকারের এই কিচেন-বেডরুম কাম বসার রুমটা পেয়ে গেলাম। আমার কাছে এই একটা দিনের ভেতর দিয়ে কত কত দিন পেরিয়ে গেল! গোটা একটা দিন পেরিয়ে গেল আপনাদের তাস খেলা দেখতে, দ্বিতীয় দিনটা গেল নদীতে গিয়ে; তৃতীয় দিনটা গেল উঁচু মালভূমিতে উঠতে; চতুর্থ দিনটা গেল সেখানে আমার হাঁটাচলার ধরন ঠিক করে নিতে, তারপর একটা সপ্তাহ গেল রাস্তার দিকচিহ্ন খুঁজে নিতে, আপনাদের ঝড় বাতাসের মধ্যে পথ দেখিয়ে আমার এই চুনদণ্ডওয়ালা গুহা পর্যন্ত নিয়ে আসতে এবং এটাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে, যাতে এটাকে আপনাদের কাছে পাহাড়ি ভিলার মতো ঝকঝকে এবং অতিথিপরায়ণ মনে হয়।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">’</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">দীর্ঘ বিরতির পর জুয়াড়ি কথা বলা শুরু করে : </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">আমার মা-বাবা অনেক দিন আগেই মারা গেছেন। তবে দুজনই আলাদা আলাদা স্পষ্ট ছাপ ফেলে গেছেন আমার স্মৃতির ওপর। যদিও পরে তাঁদের আরো বহুবার দেখেছি, তবু আমার মনে হয়, ওই সব চিত্রকল্পই যেন তাদের শেষ স্মৃতি হয়ে আছে এখনো। আমি এখনো মনের চোখে দেখি, বাজারের ব্যাগের ভারে মাথা নুইয়ে পড়া আমার মা পাহাড়ি খাড়া পথে বাড়ির দিকে হেঁটে আসছেন। মা একা একা নিজেকে টেনে নিয়ে ওপরের দিকে উঠে আসছেন; আশপাশে বহুদূর পর্যন্ত অন্য কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু যে তাঁর ভারী ব্যাগের জন্য এমন দেখাচ্ছে তা নয়। প্রথমে মা আমাকে খেয়াল করেন না। তার মুখটা খানিক অচেনা-অদ্ভুত লাগছে, পুরুষ মানুষের মুখের মতো লাগছে। প্রথমবারের মতো মায়ের আসল চেহারা দেখছি। আসল চেহারা? পরিত্যক্ত, মনুষ্য সম্প্রদায় থেকে নিপতিত, একাকিত্বের যন্ত্রণাক্লিষ্ট, সূর্যের আলো সত্ত্বেও তার সামনে পলকহীন দৃষ্টির মৃত্যু। মা আমাকে যখন দেখেন, তাঁর মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না; মা বিস্মিত হন না, আনন্দিতও হন না। এখন তাঁর আসল চেহারা আড়াল করতে চান না, এটাই তাঁর শক্তি। হতাশার এই শক্তি নিয়েই তিনি কিছুটা অবজ্ঞার চোখে তাকান একজন ব্যক্তির দিকে, যে ব্যক্তি মায়ের সকল চিন্তা সত্ত্বেও সময়ের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর কাছেই আসতে পারে, তবু সে আর তাঁর সন্তান হবে না। তার দিকে একবারও না তাকিয়ে মা এরই মধ্যে তাকে পার হয়ে যান। বনের গভীরে একটা ফাঁকা জায়গায় বসে থাকতে দেখি আমার বাবাকে। আগে আমরা দুজন ওখানে ব্লুবেরি কুড়াতে গিয়েছি। কয়েকটা পথের সংযোগস্থলে ঘাসের মধ্যে পা ছড়িয়ে একটা কাঠের ক্রুশে হেলান দিয়ে বসে আছেন বাবা। যদিও পদচারী হিসেবে বাবার অভিজ্ঞতা আছে এবং বয়স এখনো তুলনামূলকভাবে কম, তবু তিনি অত্যন্ত ক্লান্ত বোধ করার কারণে আর এগোতে পারছেন না। বাবা চান না আমি তাঁর সঙ্গে ওখানে বসে থাকি, বরং তিনি বলেন, আমি যেন একা একাই বেরি কুড়াতে এগিয়ে যাই। বাবা পেটের ওপর হাত রেখে শুয়ে থাকেন। তাঁকে ওই অবস্থায় দেখে মনে হয়, সত্যিই তিনি অনুনয় করছেন এবং বলছেন, প্লিজ, এগিয়ে যাও! তাঁর চাহনিতে শুধু বেদনা নয়, বরং আমাকে মুক্তি দেওয়ার মানসিকতাও প্রকাশ পাচ্ছে। তিনি বলেন, আমি মনে হচ্ছে একেবারে অচল পর্যায়ের ক্লান্ত বোধ করছি, বাছা; মন খারাপ কোরো না, আমাকে এখানে রেখে তুমি এগিয়ে যাও। আমি তোমার বাবা; আমি তোমার জন্য এখানে অপেক্ষা করব কিছুক্ষণ, আমি এখানে থাকব। এই দুটি ছবিতে আমার মা-বাবা দুজনই আমার জন্য জীবিত আছেন। বাস্তবে কিংবা কল্পনায় যখন আমি ওই খাড়া পাহাড়ি পথে আসি, আমি দেখতে পাই, আমার মা তাঁর সন্ন্যাসীর মতো হতাশা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে যান। যখনই আমি বনের মাঝখানের ওই ফাঁকা জায়গাটার পাশ দিয়ে যাই, আমি দেখি, আমার ক্লান্ত বাবা পেছনের দিকে তাকিয়ে আমার চলে যাওয়া দেখছেন। তবে আজকে ওই খাড়া পাহাড়ি পথ কিংবা বনের মাঝখানের ওই ফাঁকা জায়গা</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">কোনোটারই দরকার নেই। আমি যেখানে যাই, সেখানেই আমর মা-বাবাও আসেন। তাঁরা ওই বিশেষ দুটি দৃশ্য থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে শূন্যতায় মিশে, আলোর কল্পিত ক্ষুদ্রাংশে মিশে শুধু তাদের চাহনির অবয়ব নিয়েই চলে আসেন আমার কাছে। শেষে তাঁদের সবার দৃষ্টি আমার দৃষ্টির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে এবং ভিন্ন কিছুতে মিশে গেছে। একটা কণ্ঠ, যেটা আমার মা-বাবাকে নিয়ে আমাকে শোক করার ক্ষমতা দিয়েছে; আমার পঞ্চাশ বছরের জীবনে প্রথমবারের মতো পৃথিবীতে আমাকে স্বাগত জানিয়েছে, একই সময়ে আমাকে ডাক দিয়ে আরেকজনের কথা ভাবতে বলেছে, তার যত্ন নিতে বলেছে, তার জন্য কিছু করতে বলেছে, সব কিছু করতে বলেছে, এই মুহূর্তে। এখন! এখনকার মতো আমি চলতেই থাকব যত দিন বেঁচে থাকি।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">’</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">জুয়াড়ির কথা বলার সময় সৈনিক একমুঠো শুভ্রসাদা পাথর তুলে নিয়েছে। পাথরগুলো খুব ছোট, বড়জোর মটরদানার মতো। এককালে নদীর তলদেশে নুড়ি আকারে পড়ে ছিল; তারও আগে কোনো এককালে হয়তো শূন্যের কোনো গাছের শিকড় থেকে নিচে পড়েছে। সে পাথরগুলো সবার হাতে হাতে বিতরণ করে। তাদের হাতে পাথরগুলোর শব্দ শোনা যায় কখনো মার্বেলের মতো, কখনো দূরের শিলাবৃষ্টির মতো, কখনো গুলির মতো, আবার কখনো পুরনো মুদ্রার মতো। যদিও সে সারা দিন একটা কথাও বলেনি, তবু তার কথা শুরু করার জন্য গলা পরিষ্কারের দরকার হয় না, সরাসরি শুরু করে : </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">ছেলেবেলায় আমার জানালা দিয়ে একটা সমতল এলাকা দেখতে পেতাম। বিরাট সেই সমতলভূমির পুরোটাই মাঠ আর ঘাসের জমি। আমার ইচ্ছা হতো, পুরো এলাকাটা একেবারে দিগন্ত পর্যন্ত বাড়িঘরে পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক। সাদা সমতল ছাদওয়ালা আধুনিক বাড়ি তৈরি হয়ে যাক। আমি চাইতাম, আমাদের গ্রামটা বড় একটা নগর হয়ে যাক। দিনের পর দিন আমি অধৈর্য হয়ে তাকিয়ে থাকতাম এবং দেখার চেষ্টা করতাম, সত্যিই কোথাও বাড়ি তৈরি করা শুরু হয়েছে কি না। খামারের কাঠের তৈরি দু-চারটা চালাঘর গণনায় আনার মতো নয়। শেষে কখন সারা পৃথিবীতে আমাদের গ্রামের নাম বুয়েনস এইরেস কিংবা হোক্কাইডো কিংবা ভ্লাদিভস্তক কিংবা সান্তা ফের মতো পরিচিত হবে? আমার ইচ্ছা অনেকটা সত্যি হয়েছে : আমাদের গ্রামটা কোনো বড় নগরে পরিণত হয়নি; তবে সমতলভূমির অনেকটা ঢাকা পড়েছে এই এলাকার সাবেক মালিকদের নামে গড়ে ওঠা আবাসিক উন্নয়নের কাজকর্মে। সবগুলোই সমানভাবে উপশহরের চেহারা পেয়েছে। গ্রামের নামের সঙ্গে উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম যোগ করে দেওয়ার ফলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অংশগুলোর নাম বড় শহরের বিভিন্ন সেকশনের মতো শোনায়। এলাকার প্রান্ত দিয়ে একটা মহাসড়ক চলে গেছে এবং এক্সপ্রেসওয়ের দিকে চলে গেছে একটা ফিডার রোড। এক্সপ্রেসওয়ের ওখানে তো সব সময় গাড়ি-ঘোড়ার গর্জন শোনা যায়, যেমনটা আমার ছেলেবেলার কল্পনায় দেখতাম। আমার ছেলেবেলার ফাঁকা সমতলভূমি দেখা যায় শুধু আমার বাবার আঁকা ছবিগুলোতে। তিনি বলেন, তিনি কাজ করেন প্রকৃতি থেকে উপাদান নিয়ে। প্রতিদিন সকালে তাঁর ইজেল সেট করেন কোনো একটা নতুন ভবনের পাশে; তবে তাঁর ক্যানভাসে ফুটে ওঠে শুধু পুরনো দিনের ফাঁকা প্রাকৃতিক ভূদৃশ্য। বাবা বলেন, তাঁর দরকার শুধু ওই সব বাড়ির মাঝখানে এখানে-ওখানে একটু করে ফাঁকা জায়গা। ওই সব ছোট ফাঁকা জায়গায় পুরনো খোলা জায়গাগুলো বাড়তে থাকে। তাঁর কাজ শুধু ওই জায়গাগুলোকে তাঁর ক্যানভাসে স্থানান্তর করে নেওয়া। বাবা বলেন, তিনি বাসিলাসের মতো পেইন্ট ব্যবহার করেন এবং এটা এমনিতে ধ্বংস হয় না তেমন জিনিসকে বাতাসে পরিণত করতে পারে। বাবার এই কথা শুনে আমার ছেলেবেলার আরেকটা ভিন্ন চিন্তা মনে পড়ে যায় : ওই সব দিনে গ্রাম্য এলাকায় হেঁটে বেড়ানোর সময় আমি বিশ্বাস করতাম, ঘাস ও শস্যের মতো মাঠের ভেতরের পাথরও বড় হয়, একসময় পাথরগুলোও বাড়িঘরের মতো বড় হয়ে উঠবে। এই এলাকার পাহাড়চূড়াগুলো আমার কল্পনার নগরের বড় বড় বাড়িঘরের জায়গা নিয়েছে। শুধু আমার বাবার শূন্যতা টের পাচ্ছি। এখানে এসে বাবাকে যতটা মিস করছি, ততটা আর কোথাও করিনি। বাবা, তোমার কথা খুব মনে পড়ছে। আমি তোমাকে সব সময়ই মিস করেছি। আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমাকে মিস করব। তোমাকে মিস করার কারণ হলো তুমি আমার দুঃখকষ্ট পছন্দ করোনি। আমার কর্তৃত্বধারণকারী হিসেবে, আমার গল্প বলিয়ে হিসেবে, আমাকে ঠেকিয়ে রাখা ব্যক্তি হিসেবেও মিস করি তোমাকে। বাড়ির মতো আশ্রয় হিসেবে, আমার স্বপ্নের ভেতর আমার মাথার ওপর একটা হাত হিসেবে, একটা সুগন্ধ হিসেবে, আমার আত্মা হিসেবে তোমাকে মিস করি। আমি তোমাকে মিস করি অন্ধত্বের পর্যায় পর্যন্ত, তোমাকে মিস করে একটা ছুরি বের করে আর্তনাদ করে ওঠার মতো পর্যায়ে চলে যাই আমি। বাবা, সামনে এসো, দেখা দাও!</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">’</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">শেষের কথাটা চিৎকার হয়ে বের হয়। হাতে ছুরি নিয়ে সৈনিক বেঞ্চ থেকে লাফিয়ে ওঠে। তবে ছুরি ছুড়ে মারার বদলে সে ছুড়ে মারে নুড়ি। নুড়িগুলো শিলাখণ্ডের ওপর বৃষ্টির মতো পড়ে। বাইরে পাহাড়ি আকাশে তারাগুলো মিটমিট করে জ্বলে, যেন জোর বাতাসের তোড়ে বিকৃত হয়ে গেছে। ঝোপঝাড়ের মধ্যে পিঠ উঁচু করে চুপচাপ শুয়ে আছে একটা বন্য শূকর। পাশে আরো কয়েকটা ছোট উঁচু পিঠ দেখা যাচ্ছে। হ্রদের চলমান উপরিভাগের চেহারা যেন নকল করছে চকচকে ঢেউ-খেলানো পাতার একটা শস্যক্ষেত। পাশের ঠেলাগাড়িটা একটা নৌকার কাজ করছে। শস্যের অর্ধবৃত্তাকার চকচকে ঢেউগুলোর ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে, মালভূমির পাদদেশের বিরাট সমুদ্রবন্দর থেকে উঠেছে দূরের দিগন্ত। মনে হয়, সৈনিকের চিৎকার দিগন্ত ছুঁয়েছে এবং শস্যের মাঠের ঢেউ-খেলানো চাকচিক্যটা হলো তার প্রতিধ্বনি। </span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">অনেক পরে আমরা যখন পাতার বিছানায় শুয়ে থাকি, মহিলা কথা বলা শুরু করে। তেলের বাতিটার আলো কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। রুমটা অর্ধেক অন্ধকারে। আমরা উপুড় হয়ে শুয়ে আছি বলে আমাদের মাথা এক দিকে ঘোরানো এবং আমাদের হাত চোখের ওপর ফেলা। কে ঘুমিয়ে আছে আর কে জেগে আছে বলা মুশকিল। শুধু মহিলাকে দেখা যাচ্ছে, তার চোখ বন্ধ, মুখের অবয়বও কিছুটা বোঝা যাচ্ছে, মুখ ডুবিয়ে আছে পাতার বালিশে, বাচ্চারা মাঝে মাঝে যেমন করে থাকে অটাম গেম খেলার সময়। বাচ্চাদের মতোই পরিষ্কার কণ্ঠে কথা বলে যাচ্ছে; তবে বোঝা যাচ্ছে না সে ঘুমের মধ্যে কথা বলছে, নাকি ঘুমের ভান করে আছে। তার পাতার বিছানাটা অন্যদের বিছানার চেয়ে একটু উঁচু। সেখানে তার শোয়ার ভঙ্গি দেখে মনে হয়, সে কোনো রাজকীয় বিছানায় শুয়ে আছে। নিচের সেনা-কম্বলটার চেহারায়ও আর সামরিক আদল নেই। মহিলা বলা শুরু করে : </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">তুমি মিথ্যাবাদী। তুমি শুরু থেকেই আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছ। মুখে যা বলেছ, কখনো সেটা তোমার আসল কথা ছিল না। তুমি প্রতারক। তুমি বিশ্বাসঘাতক, তুমি চোখে ধুলা দিয়ে বেড়াও। তুমি আমাকে লোভ দেখিয়ে ফাঁদে ফেলেছ। আমার জীবন গোল্লায় গেলে তার জন্য তুমি দায়ী, এর জন্য তোমারই শাস্তি হওয়া উচিত। ডিআইএম কোনো অজেয় সূর্যদেবতা নয়, এটা প্যান্টিহসের একটা ব্র্যান্ড। তুমি এক রুচিহীন পাঠক। তুমি বলে থাকো, আমি বিরক্ত হতে পছন্দ করি; আসল সত্য হলো, তুমি একা থাকতে পছন্দ করো; একা হলেও সঙ্গে তোমার বই, তোমার স্বর্ণের পেনসিল আর পাথর রাখা চাই। তোমার তথাকথিক সানডায়াল শিলার গা আঁচড়ে শত বছর আগে কোনো মহান ব্যক্তি আবিষ্কার করেননি, বরং এই যে গতকাল খেলার ছলে বাচ্চারা বের করে ফেলেছে। আর এটা সানডায়াল নয়, এটা সামান্য হিজিবিজি লেখা। তুমি এক ফানুসে পণ্ডিত। তোমার পড়ার মধ্যে, কোনো কিছু বের করে ফেলার মধ্যে, ব্যাখ্যা দেওয়ার মধ্যে কোনো রকম উৎসাহের কিছু নেই। তোমার এসব কাজকর্ম তোমার অদ্ভুত অভ্যাসেরই অংশমাত্র। তুমি এক কণ্ঠ আবিষ্কার করেছ, সে কণ্ঠ তোমাকে বলেছে, এটা নাও এবং পড়ো; তার পর থেকে তুমি দেখতে পেয়েছ, বুঁদ হয়ে আছ তোমার লেখা শব্দে, তোমার চিঠিতে এবং সংকেতে। তোমার রোমান মাইলপোস্ট আসলে কোনো চলচ্চিত্রকারের ফেলে যাওয়া একটা সরঞ্জাম। তোমার প্রাচীনতম পাথরে খোদিত লেখার বিষয়ও একই রকম।  তোমার কথাগুলো তোমার মেকি ও সত্যি পাথরগুলোর ওপর থেকে যেতে পারে। শুধু যুদ্ধযন্ত্রের গর্জনের নিচে নয়, বরং প্রথম সাম্রাজ্যের পতনের শব্দের নিচেও ডুবে গেছে তোমার কথাগুলো। তোমার টাইগ্রিস, তোমার ইউফ্রেটিস আর কখনো স্বর্গ থেকে প্রবাহিত হবে না। যারা অল্প বয়সে মারা গেছে, তাদের সান্ত্বনার প্রতীক হিসেবে তোমার শিশুকে আর কখনোই ডলফিন সমুদ্র পার করে দেবে না। তোমার আর কোনো বইতেই আরেকজন ওডিসিউস, আরেকজন সেবার রানি, আরেকজন মার্সেলাস থাকবে না। হেঁটে পার হয়ে যাওয়ার মতো নদীর তলদেশ তুমি আমাকে দেখিয়েছ, তবে তুমি নিজেই আর এ রকম শুকনা তলদেশের কথায় বিশ্বাস করো না। তোমার বসন্তের অর্থ তোমার কাছেই নেই, আমার কাছে থাকবে কী করে!  এখানকার এই শূন্যতা এখন আর তোমাকে কিছু দেওয়ার সম্ভাবনা দেখায় না। এই নীরবতাও কিছুই বলে না তোমাকে। এখানে তোমার হাঁটায়ও আর কোনো কার্যকারিতা নেই। এখানকার বর্তমানটা তোমার পদক্ষেপের মাঝখানে অন্য যেকোনোখানের মতোই অন্ধকারে মিশে যায়, যদিও একসময় এই তোমার কাছেই মনে হতো বর্তমানটা কত পবিত্র, কত অনন্য রকমের উজ্জ্বল। এখানেও শূন্যতা মানে শূন্যতাই, মৃত মানে মৃত; অতীত আর কিছুতেই ফিরে পাওয়ার মতো নয়। উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে যাওয়ার মতো কিছুই নেই। নিজের রুমে তোমার একা থাকারই কথা। সূর্যের আলো থেকে দূরে, জানালার পর্দা টানা থাকবে, নকল আলোয় ইজিচেয়ার থাকবে, একটা টেলিভিশন সামনে থাকবে, আর কোনো অভিযানে যাওয়া থাকবে না, মনোযোগ বিচ্ছিন্ন না করে দৃষ্টি সামনের দিকে রাখা থাকবে; চোখের কোনায় আর কোনো খোদাই লেখা খোঁজাখুঁজি থাকবে না, অন্ধকার কুঠরির দিকে আর ফিরে তাকানো থাকবে না, অন্যদিকে ঘোরা থাকবে না, আর প্রার্থনা করা থাকবে না, মোটের ওপর তোমার উপস্থিতি থাকবে না</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">থাকবে শুধু নীরবতা। তোমাকে ছাড়া তোমার প্রেইরি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রেইরির অবস্থা এত চমৎকার হতো! </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">ভ্যানিটি ফেয়ার</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">! </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">অ্যামিকা</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">! </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">হার্পারস বাজার</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">!</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">”</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">তার কথা বলার সময় বাতাস কিছুটা হালকা হয়ে এসেছে। তার যখন শেষ হয়, ততক্ষণে বাতাস একেবারেই পড়ে গেছে। ওপরের দিকে জানালার খোলা পথে দেখা যায়, আকাশটা আগের চেয়ে নিচে নেমে এসেছে। গাছের একটা ডাল থেকে যেটাকে ঝুলন্ত ঘোমটা মনে হয়, সেটা আসলে ছায়াপথ। চারজন ঘুমন্ত ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন দিকে মুখ করে শুয়ে আছে, যেন ওপর থেকে তাদের যখন-তখন যেমন-তেমন করে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কম্বলের ওপরে জুয়াড়ির হাত; তার হাতটা কম্বলের নিচে রাখা মহিলার হাত ধরে আছে। এভাবে তাদের হাত চুপচাপ পড়ে আছে। ঘুমন্ত মহিলা হঠাৎ বেদনার্ত কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে। তার দম বন্ধ হয়ে আসে। তারপর শরীর দুলিয়ে কান্না। তার বন্ধ চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। সে স্বপ্নে একটা লোককে মরে যেতে দেখেছে; লোকটার মৃত্যুর পর পৃথিবীতে সে একমাত্র মানুষ হিসেবে বেঁচে আছে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকে সে। বাচ্চাদের মতো কাতর স্বরে কাঁদতে থাকে, একবার থামে, আবার শুরু করে। প্রতিবার আগের চেয়ে আরো জোরে শুরু করে। তার কান্না রুমটার বাতাস ভারী করে ফেলে, কিন্তু আর কেউ শোনে না।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">পল্লী এলাকাটা পুরোপুরি নীরব। ভোরের ফুটে ওঠা আলোয় গুহাবাসটা ইস্পাতের প্রান্তের মতো তীক্ষ হয়ে উঠেছে। বাংকারের মেঝেতে বাদুড়ের বিষ্ঠার স্তূপ স্লিপিং ব্যাগের আকার ধারণ করেছে। চিমনির গর্তের ওপরে আর ধোঁয়া নেই। ঘাসের মধ্যে আর শিশির নেই। কয়েকটা পাথরের গায়ে জীবজন্তুর মাথার খুলির মতো গর্ত আছে। পাথরের গর্তের ভেতরের আকাশ আরো বেশি ধূসর, পাথরও আরো প্রাচীন মনে হয়। ক্যানভাসে ঢাকা বইটা নিয়ে বৃদ্ধ পায়ে পায়ে বাইরে খোলা জায়গাটায় চলে এসেছে। তার চুল ভেজা, মনে হয় এইমাত্র গোসল করেছে। ভেজা চুল বেশ লম্বা মনে হচ্ছে। সামনে কোনো আয়না নেই; তবু আয়নার ভেতরে তাকানোর মতো করে চুল আঁচড়ায় সে। পরনে এখন আর প্রাবার নেই, পরেছে বেল পর্যন্ত ঝুলে থাকা একটা ঢিলা শার্ট। শার্টের বোতাম লাগানো হয়েছে তির্যকভাবে। তার ক্লাউনের ট্রাউজারের সঙ্গে মানিয়েছে শার্টটা। তবে ভাঁজগুলো স্পষ্ট, যেন এই প্রথম পরেছে শার্টটা।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">প্রথমে খাতাটা চাকতির মতো দোলাতে দোলাতে সে তাড়াতাড়ি হাঁটে, তারপর ট্রাউজারের মধ্যে গুটিয়ে নিয়ে পা ফেলার তালে তালে বাজাতে থাকে খাতাটা। বাজানোটা ফাঁকা আওয়াজ তোলে এবং প্রান্তরের ফাঁকা জায়গাটা ভরিয়ে দেয় শব্দে। আবছা অবস্থা থেকে একটু একটু করে প্রাকৃতিক ভূদৃশ্যের চেহারাটা দৃষ্টির সামনে স্পষ্ট হতে থাকে। চারপাশে স্পষ্ট রেখায় ফুটে ওঠে এলাকার অবয়ব।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">পরে পেছনের দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পায়, গুহার আবাসটা আসলে আর দশটা বড় শিলাখণ্ডের মতোই একটা শিলাখণ্ডমাত্র, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। বৃদ্ধ গান গাওয়া শুরু করে। অনেকক্ষণ আগে দিক পরিবর্তন করেছে সে। প্রথমে যেটাকে খোলা মালভূমি দেখেছিল, এখন তার চারপাশে খাড়া খাড়া সব দেয়াল। এখন সে একটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে; এখানকার প্রায় সব গাছই মরা। ঘোরাঘুরি করতে তার ভালো লাগছে, একেকবার হোঁচট খেয়ে পড়লে তার মনে হচ্ছে, এটাও একটা বিজয় অর্জন হলো। সে এতক্ষণ লেখা চালিয়ে এসেছে; তবে এখন হাঁটতে হাঁটতে লেখা চালিয়ে যাচ্ছে। এখন সে খাতায় লিখছে না, লিখছে বাতাসে, বড় বড় অক্ষর এঁকে যাচ্ছে শূন্যে। ভাঙা গলায় চড়া সুরে সে গান শুরু করে : </span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">নীরবতার ভেতরে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">নীরবতার ভেতরে একা একা।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">নীরবতা একা একা।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">নীরবতা, তুমি কোথায় আছ?</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"> </p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">নীরবতা, আমার প্রতি তুমি সদাই সদয় ছিলে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">নীরবতা, আমি তোমার ভেতর সব সময়ই সুখী ছিলাম।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">নীরবতা, আমি তোমার সাথে বারবার প্রতিবার শিশুই ছিলাম;</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">নীরবতা, তোমার ভেতর দিয়েই আমি জগতে এসেছি;</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">নীরবতা, তোমার ভেতর দিয়েই আমি শুনতে শিখেছি;</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">নীরবতা, তোমার কাছ থেকে আমি আত্মা অর্জন করেছি;</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">নীরবতা, শুধু তোমাকেই আমার গুরু মেনেছি;</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">নীরবতা, অনেক মানুষের মাঝে মানুষ হয়ে বের হয়েছি     শুধু তোমার কাছ থেকে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"> </p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">আমার কাছে যেমন ছিলে তেমন হয়ে এসো, নীরবতা।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">আমাকে বুকে নাও, নীরবতা।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">তোমার বাহুর আড়ালে আমাকে নিয়ে নাও, নীরবতা। </span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">আমাকে নীরব করে রাখো, নীরবতা;</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">আমার গ্রহণ করার ক্ষমতা দাও, নীরবতা;</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">আমাকে শুধু গ্রহণক্ষম করে দাও, নীরবতা;</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">শুধু গ্রহণক্ষম করে দাও, নীরবতা।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.5pt">আমি তোমার কাছে চিৎকার করে আবেদন জানাচ্ছি, নীরবতা।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">সবার ওপরে তুমি, নীরবতা।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"> </p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">নীরবতা, সব প্রতিমার উৎস।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">নীরবতা, বিশাল এক প্রতিমা।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">নীরবতা, কল্পনার মা।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"> </p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">তার ঘুরে বেড়ানোর প্রথম পর্যায়ে মনে হয়েছে, ইচ্ছা করে তার পদরেখা ফেলে যাচ্ছে : পথের ডান পাশে, বাঁ পাশে ডালপালা বাঁকিয়ে ধরেছে, গাছের কাঁটাগুলোকে তার শার্ট থেকে সুতা টেনে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে, তার ট্রাউজার থেকে তুলা টেনে নিতে দিয়েছে এবং তার ইস্পাতের চিরুনি দিয়ে প্রতিটা বড় পাথরের ওপর তেরসা টান মেরেছে সে। কিন্তু তারপর নীরব হয়ে সে শুধু পদরেখা ফুটে ওঠা থামিয়েই দেয়নি, বরং কোনো কোনো জায়গায় সে নিজের পায়ের ছাপ মুছে দিয়েছে এবং পাথরের ওপরের সর্বশেষ দাগও মুছে ফেলেছে। তখন পাথরের গায়ে মনে হয়েছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাকৃতিক দাগ বা ফাটল রয়ে গেছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">প্রথমে সে প্রেইরি ঘাসের মধ্যে প্রাণীদের পায়ে চলা পথ অনুসরণ করেছে; এখন সে সেসব পথ পরিহার করে চলছে। দ্বিধা ছাড়াই সে ঝোপ-জঙ্গলের ঘন গুল্মের ভেতরের ক্রমশ সরু হয়ে আসা পথের ভেতর দিয়ে নিজের পথ তৈরি করে যাচ্ছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">তার জুতার ফিতা ঢিলা না হওয়া পর্যন্ত সে হাঁটতে থাকে। ফিতা বাঁধার জন্য নিচু হয় এবং শেষে বসেই পড়ে, যেন এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিল। সে এখন যেখানে এসেছে, সেখানে ঘন জঙ্গল মিশে গেছে একটা প্রায় গোলাকার ফাঁকা জায়গায়। এটা আসলে উঁচু মালভূমির মাঝখানে বালুময় একখণ্ড জায়গা। গোড়ালি সমান বালু উড়ে এসে শক্ত উঁচু রেখা তৈরি করেছে; তবে উপরিভাগের একটু নিচেই নরম, আগের দিনের সূর্যের তাপে এখনো উষ্ণ হয়ে আছে। জুতা খুলে বৃদ্ধ বালুর মধ্যে খালি পা ডুবিয়ে দেয়।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">মরুভূমিটা বাচ্চাদের খেলার মাঠের চেয়ে বড় নয়; জায়গাটা অনেক পুরনোও নয়। মাঝখানে বড় হচ্ছে একটিমাত্র লম্বা, রুক্ষ গাছ; এটাকে অর্ধেক গাছ অর্ধেক ঝোপ বলা যায়। গায়ে লেগে আছে নানা রকম মরা লতাপাতা। তার ফলে গাছটাকেই চেনা কঠিন হয়ে গেছে। গাছটার চারপাশে কাঁটা ঝোপের মধ্যে ফুল-ফলের চিহ্নও আছে: ব্ল্যাকবেরি এবং তৃষ্ণা নিবারক মৌরিগাছের গোড়ালি আছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">এগুলোসহ পকেট থেকে বের করা ব্রেডের টুকরা দিয়ে বৃদ্ধ সকালের নাশতা করে। সকালের সূর্যের আলোয় তার মাথার ওপরের শুকিয়ে যাওয়া গাছটার ডগা যেন নতুন করে সবুজ রং পাচ্ছে। ডালগুলোর একটার সঙ্গে আরেকটা পেঁচিয়ে খাঁচার মতো যে নেটওয়ার্ট তৈরি করেছে, তার গভীরে চুপচাপ বসে থাকা একটা পাখির কালো ছায়া দেখা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে না, পাখিটা কোন জাতের, তবে মাথা আর লেজ উঁচু হয়ে আছে। মাথার ওপরের আকাশটাও একেবারে ফাঁকা নয়। অনেক উঁচু দিয়ে নীরবে খুব ধীরে একটা বিমান আকাশটা পার হয়ে যাচ্ছে; খুব বেশি সাদা বিমানটাকে আক্ষরিক অর্থেই একটা হাওয়াই জাহাজ হিসেবে দেখা যেতে পারে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">বৃদ্ধ তার খাতাটার জন্য হাত বাড়ায়। খাতা তার পাশেই বালুর ওপর পড়ে আছে। তার ঘুরে বেড়ানোর ফলে সর্বশেষ যে ভরসা তৈরি হয়েছিল, সেটা তার কণ্ঠে আর নেই; দ্বিধান্বিত কণ্ঠে সে বলে, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="letter-spacing:-.3pt">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">হৃদয় আমার, এখন শুধু তুমি আছ আমার সঙ্গে। কমপক্ষে এত দিন আমি যেমন চেয়েছি, আমার জীবনে তেমনটাই ঘটছে এই বিদেশবিভুঁইয়ে। কত দিন আমার কাঁধে হাত রেখে কেউ বলেনি : সারা বছর তুমি লিখে যেতে পারো না। কত দিন আমাকে কেউ আমার সম্পর্কে বলেনি : সব সময় শুধু পড়েই যাচ্ছে। প্রকৃতিতে যে মৌলিক নিয়ম আমি দেখতে পাই, সেটা শুরু থেকেই আমার জীবনে প্রয়োগ করতে অক্ষম ছিলাম আমি, আমার সমকক্ষ অন্য মানুষদের কাছেও পাঠাতে পারিনি সে নিয়মের বার্তা। শুধু আমার লেখায় সে নিয়মের বাস্তবায়ন ঘটাতে পেরেছি, তা-ও যখন একা থেকেছি, শুধু তখন। আমি যখন একা থেকেছি, শুধু তখন সব কিছুর অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে ধরা দিয়েছে। আমার একাকিত্বের মুহূর্তে যে সংকেতগুলো আবিষ্কার করতে পেরেছি, সেগুলোই কেবল অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে পেরেছি। আর এখন আমার লেখার সময়টা শেষ হয়ে গেছে। লেখার বাসনাটা মরে গেছে। আমি এই বাসনাটাকে চিনি; আমি জানি এটার জায়গা আমার হৃদয়ে, তবে এটা এখন মৃত। সুতরাং এখন আমি কোথায় যেতে পারি? আমি এখন আছি কোথায়? আর কোনো জায়গার অস্তিত্ব কি নেই? আমার ভেতরের সব আলো কি আমি পুড়িয়ে নিঃশেষ করে ফেলেছি? আমি কি আর সৌন্দর্যের আশা করতে পারি না? তাহলে আমি কি শেষ হয়ে গেছি, হেরে গেছি? সেটাও কি পুরোপুরি আমার অস্তিত্বের সঙ্গে আছে? নাকি আমার পরাজয়ের মধ্যেই আমার লক্ষ্যে চলে এসেছি?</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">বালুর ভেতর থেকে উঠে সে বালুময় জায়গাটার ওপর এদিক-ওদিক হাঁটা শুরু করে। হঠাৎ তার পা দুটি ছোট হয়ে আসে; তার কাঁধ অনেক চওড়া হয়ে ওঠে। প্রায় অদৃশ্য পাখিওয়ালা সেই গাছটাকে চারপাশ থেকে সে আরো সুপরিসর বর্ণনার সুতায় বাঁধে। গাছটা থেকে মাঝে মাঝে খসখস আওয়াজ আসছে। এ ছাড়া আশপাশে জীবনের কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না, এমনকি পিঁপড়াদের চলাচলের পথও ফাঁকা এবং বালুর ভেতরের গর্তও শূন্য।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">খাতাটা নিয়ে আবার বসে সে। ললাট রাখে খাতার ওপরে। খুঁড়ে তোলা দুটি ডিঙির আকারে তার চোখের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ করে আনে। পাখিটার কালো ছায়ার অবয়ব দেখতে পাচ্ছে এখনো, চুপচাপ বসে আছে, মাথা আর লেজ উঁচু করে তোলার কারণে রূপকথার পাখির মতো দেখাচ্ছে। হঠাৎ যেন নিজের ইচ্ছায় পেনসিলের পরিচিত শব্দ শোনা যায় না আর। তার বদলে চলে আসে একটানা খসখস শব্দ। বার্ধক্যের বাদামি দাগওয়ালা হাত তার হাঁটুর ওপরে রাখা খাতায় লিখে যাচ্ছে। কাগজের দিকে না তাকিয়ে দৃষ্টি সোজা সামনের দিকে রেখে লিখে যাচ্ছে সে। তারপর তার হাতের নড়াচড়া আরো কমে আসে, যেন পাখিটা ভয় পেয়ে উড়ে না যায়। শেষে দেখা যায়, সে আসলে লিখছে না, ছবি আঁকছে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">ঝোপের ভেতর থেকে পাখিটার কালো ছায়া অদৃশ্য হয়ে গেছে। শুকনা বন-জঙ্গলে পটপট শব্দ তুলে সেখানে এখন বয়ে নামছে বালুর মেঘ। তার পেছনপাশের ছাপ ছাড়া আর কোনো চিহ্ন নেই বৃদ্ধের। ছোট মরুভূমির প্রান্তে তার অনুপস্থিতিতে ব্ল্যাকবেরি চকচক করছে এবং সাদা-হলুদ আম্বল ফুটছে। এই গাছগুলো শিকড় গেঁথেছে যে শুকনো ফাটা মাটিতে, সেখানে আঙুল সমান ফাটলের নানা রকমের প্যাটার্ন তৈরি হয়েছে। গ্রীষ্মের আকাশে উড়ে যাচ্ছে একটা বিমান; মনে হচ্ছে, বিমানটার নড়নচড়ন নেই।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">অন্যরা জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাদের দৃষ্টি চলে যায় গুহার সাদা দেয়ালের একটা জায়গায়, যেখানে সূর্যের আলো পড়েছে। অন্য সময় চাপা সাদা দেখায় তেমন একটা দগ্ধ মিশ্রণ গুহার মধ্যে বোতলের মতো সবুজ দেখাচ্ছে, যেন ফোঁটায় ফোঁটায় চুইয়ে পড়া পানিতে ভিজেছে। যদিও এই বিশেষ স্পটটার নির্দিষ্ট কোনো আকার নেই, তবু আমরা যখন সবাই চোখ মেলে তাকাই দেখতে পাই, এটা একটা সংকেতের মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে কথা বলে উঠছে : উঠে পড়ো! সকাল হয়ে গেছে, সব কিছুই এখানে আছে তোমাদের সঙ্গে, বাইরে খোলা জায়গাটায়ও আছে। উঠে পড়ো সবাই। চালু হয়ে যাও।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">আমাদের কারো মধ্যে আর নিদ্রাহীনতার ক্লান্তিবোধ নেই; আমরা দ্রুতই সব রকম চেতনা ফিরে পাই। কোথায় আছি, আমরা জানি; আমাদের দুঃস্বপ্ন থেকে সবাই হালকা মন নিয়ে জেগে উঠি। বিরল আনন্দ নিয়ে আমরা সবাই আশা করি, সকালটা ভালোই পাব। দেয়ালের সূর্যের আলো পড়া অংশটা আমাদের নতুনত্ব খোঁজায় উৎসাহী করে তোলে। মেঝেতে অনেক খানাখন্দের মাঝে একটা বড় খাল দেখতে পাই। সেখান থেকে হাত-মুখ ধোয়ার এবং কফি বানানোর পানি সংগ্রহ করি।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">আমাদের ধারণা, বৃদ্ধ আমাদের আগে এই দিকে চলে গেছে, তাকে অনুসরণ করার জন্য আমাদের জন্য তার মানচিত্রটা রেখে গেছে, সামনেই কোথাও আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, কমপক্ষে সন্ধ্যায় সামনের শহরে অপেক্ষা করছে। শুরু থেকে আমাদের চোখেমুখে কোমল ছোঁয়া দিয়ে হালকা বাতাস অবিরাম বয়ে যাচ্ছে। এই বাতাসের প্রবাহ কি তার পদক্ষেপের কারণেই শুরু হয়নি? নিশ্চয় তাই, কারণ বৃদ্ধ অবশ্যই তার ট্রাউজারের পকেটে লতাগুল্ম নিয়ে যাচ্ছে। বাতাস কী সুন্দর সুগন্ধে ভরা! বাতাসে মিশে সুগন্ধ বাতাসকে উষ্ণ করে তুলেছে। দুশ্চিন্তা থেকে না হলেও হালকা আনন্দ প্রকাশ করতে তাকে আমরা ডাক দিলেও পারতাম। অবশ্যই পারতাম। কিন্তু কী নামে?</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">জেগে ওঠার পর থেকে যে জ্ঞানতৃষ্ণা আমাদের পেয়ে বসেছে, সেই তৃষ্ণা নিয়ে আমরা সারা দিন হাঁটি। যদিও মনে হয় খতিয়ে দেখার মতো কিংবা আবিষ্কার করার মতো মাটির পৃথিবীতে আর কিছু নেই, তবু নতুন যেকোনো স্থলভাগের প্রতিই আমাদের আগ্রহ অনুসন্ধানীদের মতো। যেকোনো নতুন জিনিস দেখলেই আমরা সবাই সেটার চারপাশে আবিষ্কারের আনন্দ নিয়ে ঘুরতে থাকি। আমাদের বোধগম্যতা কখনোই অকৃত্রিম বাহ্যিক নয়, এটা সব সময় এক রকমের আত্তীকরণ, যেটা অমোচনীয়ভাবে আমাদের মনের ওপর বর্ণ, আকার ও সম্পর্কের গভীর ছাপ ফেলেছে এবং আমাদের শক্তি দিয়েছে। কোনো কিছুর প্রতি এ রকম দৃষ্টি নিয়ে এগোনোর কথা আমরা আগে ভাবিনি; তবে সব কিছুর মধ্যে নিজস্ব মূল্যবোধ দেখেছি। ওই সব জিনিসের শুধু উপস্থিতি দেখেই আমরা অনুভব করেছি, আমরা কিছু একটা ফিরে পেয়েছি। আমরা সেগুলোকে বুকে নিতে চেয়েছি, অনুভব করতে চেয়েছি, পরিমাপ করে দেখতে চেয়েছি এবং সঞ্চারিত করতে চেয়েছি। সামান্য একটা ঘাসের ডগা কি চায়নি আমরা এটাকে ভালো করে দেখি, এটার সঙ্গে এক ধরনের যোগাযোগ স্থাপন করি? কমপক্ষে একটা ক্ষীণ আর্তি তো প্রকাশ করেছে, তাই না? আমাদের সারা দিনের আবিষ্কারের চেষ্টার ফলে যেসব খবর পাই তাতে আমাদের জন্য কল্পনাসাধ্য একটা খবরের কাগজ জরুরি হয়ে পড়ে।</span></span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="letter-spacing:-.3pt">সেদিন আর আমাদের কোনো ঘটনা ঘটতে পারে না। পাথরের নিচে পলায়নপর সাপের লেজের শুধু কালো ডগাটুকু দেখতে</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> পাই। অভ্যাস কিংবা অনুশীলন না থাকলেও জুয়াড়ি অপ্রত্যাশিত চাঞ্চল্যে এ পাথর থেকে ও পাথরে লাফিয়ে বেড়াতে থাকে। বৃদ্ধের প্রাবার কাঁধের ওপর নিয়ে মহিলা নদীর চোখ-ধাঁধানো সাদা তলদেশে ঘন হয়ে পড়ে থাকা শিলাখণ্ড আর গাছের মুড়ার ওপর দিয়ে স্বপ্নে যেমন হয়ে থাকে তেমন নিশ্চিত পদক্ষেপে নাচতে থাকে। আর সৈনিক যখন তার স্কুলবালকদের মতো ব্যাগটা পিঠের ওপর নিয়ে আমাদের সবার সামনে পাহাড়ের ন্যাড়া চূড়ার দিকে ওঠানামা করতে থাকে, তখন সে খানিকটা খোঁড়ায় এবং যেন গুলি খেয়েছে এমন ভঙ্গিতে পড়েও যায়। সে আসলে তার অতীতের কোনো দৃশ্য অভিনয় করে দেখায়।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">পাহাড়ের চূড়ায় না থেমে আমরা সরাসরি হ্রদের দিকে নেমে আসি। হাঁটা, লাফানো ও পাহাড় বেয়ে ওঠা ছাড়াও সেদিন আমরা পৌঁছতে থাকি। প্রথমে আমরা দেখি, হ্রদটা আসলে নলখাগড়ার হলুদ ফ্যাকাসে জঙ্গল। হ্রদের কিনারে গাছের সঙ্গে বাঁধা একটা নৌকা পেয়ে যাই। পাহাড়ের ওপর থেকে দেখে আমাদের মনে হয়েছে, খুব সহজে হেঁটেই এই হ্রদের অন্য পারে চলে যাওয়া যাবে। তবে স্কাউটের নির্দেশনা মেনে আমরা নৌকাটা নিই। অবশ্য প্রথমে নৌকাটার জল সেচে নিতে হয়, তারপর হাত দিয়ে বইঠা বাওয়ার কাজ করতে হয়। এই হ্রদের বিরল ব্যাপার হলো হ্রদের মধ্যে অর্ধেক ডোবা গাছপালা আর পাথুরে তলদেশ থেকে দৃশ্যমানভাবে উঠে আসা স্বচ্ছ পানি। একটু পরেই মহিলা বইঠা বাওয়ার কাজ অন্যদের জন্য রেখে গায়ে ভালো করে প্রাবার পেঁচিয়ে নৌকার সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। বাতাসের প্রবাহ খুব বোঝা না গেলেও হ্রদের চারপাশের অলডারগাছের ডালপাতার মধ্যে অবিরাম মর্মর শব্দ শোনা যায়; ক্রমান্বয়ে আরো জোরে হতে থাকে শব্দ, শেষে ঝড়ের মতো শব্দ অন্য সব শব্দকে ছাপিয়ে যায়। অবশ্য পানিতে বাস করা কোনো পাখি চিৎকার করে ওঠে না; পানি থেকে কোনো মাছও লাফিয়ে ওঠে না। অন্য পারে আপাত জঙ্গলের মতো দেখা যায়, সেখানে একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়ে; দীর্ঘ সময় পর মনুষ্য উপস্থিতির চিহ্ন দেখছি। আমরা কি সত্যিই স্বস্তি পাই? আমরা কি একই রকম হতাশও হই না?</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">অন্য পারে পৌঁছানোর পর আমরা দেখতে পাই, সাইনবোর্ডে মরচে ধরেছে, লেখা বোঝা যাচ্ছে না প্রায়। শেষে শুধু এটুকুই বোঝা যায়, সাবধান</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ভিমরুল। অক্ষরগুলোর চেহারা দেখে বোঝা যায়, সাইনবোর্ড যুদ্ধের আগে লেখা হয়েছে। এখানকার ঘাটটাও পচে গেছে; কাঠের স্তূপগুলো দুমড়েমুচড়ে গেছে, কয়েকটা আবার অন্যগুলোর চেয়ে ভেতরে ঢোকানো আছে, গাছে শেওলা ধরেছে। তা ছাড়া ঘাটটা এখন পানি থেকে অনেকটা দূরে; কারণ অনেক বছরের ব্যবধানে হ্রদ শুকিয়ে গেছে। মরা উইলোগাছগুলোর গায়ে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। গাছগুলোর কাণ্ডে শেওলার দাগ থেকে বোঝা যাচ্ছে, আগে পানি কত দূর পর্যন্ত উঠেছিল।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আমাদের বর্তমান সময়ের প্রথম চিহ্ন হলো কাঠের কুঁড়েঘর। এটা একটা ক্যাফে ছিল, নিকটেই নিজস্ব জেনারেটর। তবে কাজ করছে না; কারণ লেখা আছে, আজকের জন্য বন্ধ। আবছা আলোয় বিরাট কাচের জানালার পেছনে দেখা যায় একটা পানশালা; তার পেছনে একটা ফায়ারপ্লেস, পাশেই প্রস্তুত রাখা হয়েছে কাঠের গুঁড়ি, যখন-তখন জ্বালানো যাবে। বাইরে বাগানের ছড়ানো-ছিটানো বেঞ্চগুলোর মধ্যে টেবিল-সকার গেমের ব্যবস্থা আছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা নব ঘুরাই এবং আমাদের বের হওয়ার মুহূর্তে কাঠের তৈরি মানুষগুলোর পা ওপরের দিকে দেখতে পাই।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">যদিও মানচিত্রে দেখানো পথটা ঘাসে ছাওয়া প্রশস্ত একটা পথ এবং আমাদের ছড়িয়ে পড়ার মতো যথেষ্ট জায়গা আছে, পথটাতে তবু আমরা নৌকায় যেমন কাছাকাছি ছিলাম সে রকম ঘনিষ্ঠ হয়ে চলতে থাকি। কিছুটা উঁচু করা সবুজ পথটা খানিক স্থিতিস্থাপক। মহিলা মাঝে মাঝে সৈনিকের কবজি ধরে ফেলছে এবং দুজনে একসঙ্গে বুনো সর্পিল নাচ নেচে যাচ্ছে। আর জুয়াড়ি মুচকি হেসে তাদের পেছনে চলছে। কিছুক্ষণের জন্য এ রকম ভাবা সম্ভব হলো যে এই এলাকাটা ইতিহাস থেকে পালানোর সুযোগ করে দিচ্ছে। আবার একই সময়ে এটা একটা নতুন দেশ, যেখানে কোনো কিছু শুরু করা যেতে পারে।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আমাদের নতুন পথ পুরনো পথে মিশছে। মালভূমিটা পাথুরে ধূসর রঙে পুরনো পথে মিশছে। যদিও সুরকির উপরিভাগটা মনে হয় যত্নে রাখা হয়েছে এবং এখনো নতুন আছে, তবু আমরা এই পথে কোনো যানবাহনের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি না, আশপাশের ঝোপঝাড়ের ওপর ধুলাও জমা হয়নি। সবুজ পথ থেকে মরুর পথে রূপান্তর যেমন আকস্মিক, তেমন হঠাৎ করেই সামুদ্রিক বাতাস সামান্যতম মৃদু বাতাস ছাড়াই তাপে পরিণত হয়ে যায়। বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে আমরা চিরস্থায়ী এক দুপুরে সরাসরি সূর্যের নিচে আছি। দৃষ্টি বেশিদূর যাচ্ছে না; ম্যাপে রাস্তা সোজা দেখানো হলেও এখানে খানিক পর পরই এই ওপরের দিকে উঠছে, এই নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে, আবার দূরের দিগন্ত অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। উজ্জ্বল প্রান্তওয়ালা অল্পসংখ্যক গম্ভীর মেজাজের মেঘ একেবারে অনড় থেকে আরো কয়েক টুকরার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। সমুদ্রের মতো নীল আকাশে মাথার ওপরের আকাশের মহাশূন্য ক্যাপসুল থেকে স্পোরাডিস দ্বীপপুঞ্জকে যেমন দেখা যায়, মেঘগুলোকে তেমন দেখাচ্ছে। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা ব্ল্যাকবেরি থেকে শক্তি পাওয়া যায় না; প্রায় পুরো একমুঠো গিলে খাওয়ার পরে বড়জোর আমাদের তৃষ্ণা খানিকটা কমে। যে নীরবতার মধ্যে এতক্ষণ আমরা অভ্যস্ত থাকার মতো ছিলাম, সেটা এখন শব্দহীনতায় পরিণত হচ্ছে; এমনকি ঝিঁঝি পোকাদের গুঞ্জনও থেমে গেছে। আমাদের আগমন দেখেই ঝিঁঝিদের মাথা গর্তের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। আমাদের চলার শব্দ ছাড়া একমাত্র শব্দ হলো আমাদের পায়ের আঙুলের সামনে থেকে ফড়িংদের দ্রুত উড়ে যাওয়া।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এই উঁচু ভূমিতে সব কিছু যেভাবে ঘটে, তেমনই আকস্মিকভাবে বৃষ্টির শোঁ শোঁ আর ওপর থেকে ভেঙে পড়ার শব্দ শুনতে পাই, যদিও আকাশ তখনো উজ্জ্বল। আমাদের পথ সরু হতে হতে মাথা সমান উঁচু ঝোপঝাড়ের মধ্যে পায়ে চলা পথে পরিণত হয়েছে। তার একপাশে মনে হয়, পরিকল্পিতভাবেই গুল্ম-ঝোপ লাগানো হয়েছে। এখানে পুরনো রাস্তাটা নতুন রাস্তার খুব কাছে চলে এসেছে; তবে নতুনটার সঙ্গে মিশে যায়নি। দুটি রাস্তা কিছুদূর পর্যন্ত সমান্তরালে চলেছে। পুরনো রাস্তাটা এখন আর চোরাকারবারিদের চলা পথের চেয়ে বেশি কিছু নয়; এটা এখানে এসে প্রেইরি ঘাসের সঙ্গে মিশে গেছে। একটা খরগোশ আমাদের সামনে চলে আসে, বাতাস শুঁকে দেখে এবং সঙ্গে সঙ্গে দূরে কোথাও মিলিয়ে যায়। একটা বিদ্যুতের লাইন থেকে আসছে বৃষ্টির শব্দ; আমরা বাঁধে উঠতে না উঠতে নতুন রাস্তার ওপারে শূন্য জায়গা থেকে আমাদের খুব কাছে চলে আসে। আমাদের কয়েক কদম চলার সময় তারের পটপট শব্দ বৃষ্টির শব্দ হয়ে যায়।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সরু ও আঁকাবাঁকা রাস্তাটা আসলে একটা দুর্গম পথের মতো। তবে শত শত বছর ধরে তৈরি হওয়ার ফলে বেশ মজবুত। মনে হয়, এই এলাকায় এটাই একমাত্র সড়ক এবং সিল্ক রুট কিংবা প্যান-আমেরিকান মহাসড়কের বিশেষ কোনো অংশের সঙ্গে তুলনা করা যায় এটাকে। উপরিভাগে সুরকি কিংবা অ্যাসফল্ট ব্যবহার করা হয়নি। এটা ছিল একটা পাথরের পথ; নির্মাতারা শিলার ভিত্তি থেকে উদ্ভিজ্জ মাটির স্তর কেটে কেটে এটাকে রাস্তা বানিয়েছে, পাশের এক ফুট চওড়া কাঁধ তেমনটাই ইঙ্গিত করে। এই প্রাকৃতিক রাস্তাটার বিন্যাস খুব ঘন, কোনো ফাটল নেই, শুরু থেকেই এত মসৃণ হওয়ার ফলে রোল করার দরকার হয়নি। দু-চারটা উঁচু-নিচু জায়গা ক্ষয় হয়ে সমান হয়ে গেছে। কিন্তু শুধু আমরা ছাড়া আর কারা এই পথে ভ্রমণ করেছে? অতি নগণ্যসংখ্যক যানবাহন, ভারী বস্তা বোঝাই, ব্যারেল কিংবা অভিবাসীদের নিয়ে কোনো যানবাহন এখান দিয়ে যাতায়াত করে থাকতেও পারে। আমরা ছাড়া এদিকে কাউকে দেখছি না; তবু বারবার পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করছি, দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার মতো অন্য কেউ আছে   কি না।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">একটানা ওপরের দিকে উঠতে উঠতে আমরা আরো উৎসাহ পাই এবং গভীর করে শ্বাস নিতে থাকি। অনেক বাঁক থাকার কারণে বেশিদূর পর্যন্ত দেখার সুযোগ নেই। আমরা আশাবাদী, যেকোনো মুহূর্তে খোলা পল্লী এলাকার দেখা পাব। কোনো রোডমার্কার নেই; দূরত্বের কোনো ইঙ্গিতও নেই। শুধু রাস্তার এখানে-ওখানে মরে পড়ে থাকা প্রজাপতি আর তেলের চিহ্ন দেখে বোঝা যাচ্ছে, এ রাস্তায় মোটরগাড়ি চলে। আমরা এই পথে একাকী, এ সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েই আমরা পাশাপািশ চলতে থাকি। একটা মোড় পার হওয়ার পর দেখি, শিলার কোটরে একটা ঠেলাগাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। আমরা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই একটু ছড়িয়ে যাই, যেন গাড়িটা আমাদের দিকে আসছে। নো ম্যানস ল্যান্ডে এই গাড়িটার উপস্থিতিতে আমাদের মধ্যে যে ধারণাটা তৈরি হয়েছিল অদ্ভুতভাবে হলেও তার বিপরীতে দেখা গেল, সময়ের পরিচিত ছন্দ আমাদের খুব বেশি আগে আগে পেয়ে বসেছে, এই অনিশ্চয়তার দেশে এই পরিচিত ছন্দটাকে আরো কিছুটা সময় দূরে রাখা উচিত ছিল এবং এটাকে অনুসন্ধান করে বের করা উচিত ছিল। অন্যদিকে পুরোপুরি এই তেপান্তরের জগতে ওই দুটি চাকা বিস্ময়কর আবিষ্কার হিসেবে আমাদের খানিক চমকে দেয়। আমরা নিজেদেরই ধন্যবাদ জানাই।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তারপর হঠাৎ করেই সামনের ভূভাগ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। রাস্তার দুপাশেই ট্যাংক চলে আসে; সবার অস্ত্রের মুখ আমাদের দিকে তাক করা। সামনের প্রতিটা মোড় থেকে গুলি আর গোলার বজ্র আমাদের দিকে ধেয়ে আসে। ঝোপঝাড় মাড়িয়ে ধাতব অস্ত্রে আওয়াজ তুলে সেনারা আমাদের দিকে আসতে থাকে। একটা অবজারভেশন টাওয়ার বাইনোকুলারের ভিড়ে চকচক করছে। আর কোনো পাখির আওয়াজ শোনা যায় না। </span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">পরের মোড় পার হতে হঠাৎ করেই আমাদের দৃষ্টি গিয়ে পড়ে প্রাকৃতিক গুহার লম্বা সারির মধ্যে, আরেকটু উন্নত গুহাবাসের ওপর। এটা চেনার কারণ হলো, এখানে প্রবেশের মুখে দেখা যাচ্ছে কাঠের ঠেস এবং গেটের শিক। কাদামাটির মেঝেতে এখানে পাথর নয়, গোল আলুর বিরাট স্তূপ। আমাদের সামনে প্রত্যাশিত মাঠের বদলে দেখতে পাই ফারগাছের সারি, সদ্য লাগানো চারাগাছ, গাছগুলোর ঘন সবুজ পাতার ডগা সমান নৈকট্যের সারি তৈরি করেছে। গাছগুলোর ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটা সোজা এবং অপ্রত্যাশিতভাবে প্রশস্ত; তবে দেখে মনে হয় কোনো খামার কিংবা বনের ভেতরকার পথ। এসবের মধ্যে আমরা যে আনন্দ পাই তার বিপরীতে চলে আসে আমাদের দুর্দশা : এত তাড়াতাড়ি পরিচিত মধ্য ইউরোপের আবহে চলে এলাম! হঠাৎ পুনরায় গাছপালা বন-জঙ্গলের দেখা পেয়ে আমরা আবার আনন্দ পাই; আমাদের চারপাশে দেখি প্রেইরি ঘাস। চোখের কোণে তাকিয়ে দেখতে পাই গমক্ষেতের মরীচিকা। এই পর্যায়ে এ রকম দৃষ্টির ভ্রম খুব ঘন ঘন হচ্ছে, শেষে আর কিছু দেখতে পাই না। এর কারণ আমাদের ক্লান্তির চেয়েও বেশি হলো তৃষ্ণা। তৃষ্ণা আমাদের সব ইন্দ্রিয়কে অবশ করে দিয়েছে, আমাদের মুখ আর গলা শুকিয়ে একেবারে কাঠ বানিয়ে দিয়েছে। আমরা বৃথাই জুয়াড়ির জন্য অপেক্ষা করতে থাকি; জাদুমন্ত্রে কোনো তরল বস্তু পেয়েও যেতে পারে সে। সে প্রতিটা সংকটের মুহূর্তেই চমৎকার কিছু হাজির করেছে। তবে এতক্ষণে আমাদের গলা থেকে দিগন্ত পর্যন্ত পৌঁছে গেছে আমাদের তৃষ্ণার বিশাল মরুভূমি।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আমরা কি ভুল রাস্তায় চলে এলাম? আমরা কি আধা অন্ধের মতো কোনো মোড় ফেলে এলাম? তবে সর্বশেষ মোড়ে এসে দেখতে পাই, রাস্তাটা একটা সমতলে মিশেছে। সমতলটা মালভূমির ছাদও হতে পারে। যা-ই হোক, অনেক দূর সামনে একটা মানুষের অবয়ব দেখে আমরা স্বস্তি ফিরে পাই। আমরা হাঁটা থেকে দৌড়ানো শুরু করি। আমাদের ছায়া শিলার ফাটলের ওপর টর্চের মতো কেঁপে ওঠে। সামনের ওই মনুষ্য অবয়বটা উজ্জ্বল রঙের কাপড়ে পেঁচানো। মানুষটার শুধু গোলগাল মাথা আর কাঁধই দোল খেতে খেতে চলেছে তা নয়, তার সারা শরীরই দোল খেতে খেতে যাচ্ছে। লোকটা আমাদের বৃদ্ধ নেতাও হতে পারে। তৃষ্ণায় আমাদের কণ্ঠ একেবারে কাহিল হয়ে না পড়লে আমরা তাকে ডাকও দিতে পারতাম। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম, সে আমাদের দিকেই আসছে; কিন্তু সে যে আমাদের দিকে আসছে না, সেটা বুঝতেও তার অনেকটা নিকটবর্তী হতে হলো আমাদের। সে বরং আমরা যেদিকে যাচ্ছি সেদিকেই যাচ্ছে। আরো অনেক নিকটবর্তী হয়ে বুঝতে পারি, যাকে আমাদের বৃদ্ধ ভেবেছি সে তো আসলে পিঠে স্কুলব্যাগ নিয়ে চলা এক বালক। কিন্তু আমরা বালকের কাছে পৌঁছানোর আগেই পাশের একটা রাস্তা থেকে একটা বড় চকচকে নতুন বাস তাকে তুলে নিয়ে চলে যায়। আমরা আগে থেকে টের পাইনি, বাসটা আসছে। মহাসড়ক ধরে আরো কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে বাসটা আরেকটা পার্শ্বরাস্তায় মোড় নেয় এবং জোরে জোরে হর্ন বাজাতে থাকে, যেন এই বুনো পল্লীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাচ্চাদের জড়ো করে নিয়ে যাওয়ার জন্য হর্ন বাজাচ্ছে। পরে আমরা আরেকজন লোককে দেখি; সে আসলেই একজন বৃদ্ধ মানুষ। খুব কাছে থেকে দেখেও তাকে আমরা আমাদের নেতা বলে ভুল করি। রাস্তা থেকে অল্প একটু দূরে খাড়া শস্যের গাছের প্রায় আড়ালে সে একটা নিঃসঙ্গ গাছের শিকড়ের ওপর শুয়ে ঘুমাচ্ছে।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সেদিন প্রথমবারের মতো আমরা ওখানে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়াই। দূর থেকে তাকে দেখে তাৎক্ষণিকভাবে বৃদ্ধের চেহারা আমাদের মনে আসার কারণ হলো, তার কানের ওপরে হাত, পরম প্রশান্তিময় বোকাটে স্বাপ্নিকের মুখ আর বিশেষ করে পাশের গাছের কাণ্ডের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখা হাঁটার একটা লাঠি। তবে আমাদের একজন তাকে ধাক্কা দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করার আগেই আমরা দেখি, তার চেহারাটা অ্যাপ্রন পরিহিত এবং মাথার পেছনের দিকে ঠেলে রাখা খড়ের হ্যাট পরা একজন মাঠের কৃষকের চেহারা হয়ে যায়। তার ফাটা থাবার মতো গেঁটেবাত আক্রান্ত আঙুলে একটা কাস্তে চালানোই কঠিন, পেনসিল তো দূরের কথা।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ঘুমন্ত ব্যক্তির কাজ করার জায়গা একটা বাগান। প্রেইরি থেকে বেড়া দিয়ে আলাদা করা। আশপাশে বাড়িঘর নেই; বাগানটা নিঃসঙ্গ। তবে কোথাও পানির কপাটক আছে নিশ্চয়; কারণ একটা হোস বড় বড় ঘাসের ভেতর দিয়ে সর্পিল গতিতে এসে বাগানের বেডগুলো পর্যন্ত পৌঁছেছে। টমেটো ও কিশমিশের মতো ফসল বাগান থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। অন্য যেগুলো আছে সেগুলো শুধু দেখেই আমাদের তৃষ্ণা আরো বেড়ে যায়। পেঁয়াজ, রসুন দেখে আমাদের প্রায় ভুলই হয়ে যায় গোক্ষুর মনে করে। হোসটা অনুসরণ করে আমরা একটা পাথরের দীর্ঘ দেয়াল পর্যন্ত চলে আসি। দেয়ালের পেছনে বর্ণহীন প্রেইরি কোনো রকম রূপান্তর ছাড়াই একটা হালকা সবুজ ছোট ঘাসের মাঠে পরিণত হয়। মাঠের মাঝখানের শিলাখণ্ড দেখে মনে হয়, এটা মানুষের হাতের কাজ, অন্য কথায়, এটা একটা বাড়ি। রাস্তা বরাবর একটা বড় বাঁক, অমসৃণ পাথর এবং ঘুলঘুলির মতো জানালার কারণে এটাকে একটা ছোটখাটো দুর্গের মতো দেখাচ্ছে; অন্য যা-ই হোক, এটার চেহারায় একটা সামরিক স্থাপনার ধরন আছে। ঘাসের মধ্যে কয়েকটা জায়গায় আগুন জ্বলছে; কারা যেন এভাবে ফেলে গেছে। আগুন থেকে আকাশের দিকে ধোঁয়া উঠছে ঘন হয়ে সোজা হয়ে। এ রকম স্পষ্ট আকারের কারণে ধোঁয়ার অবয়বগুলোকে আমরা সত্যিই পিলার মনে করছিলাম। ভেতর থেকে যেসব কণ্ঠ শুনতে পাই সেগুলোও আমাদের ধারণার সঙ্গেই মিলে যায়, মানে এটা একটা সামরিক স্থাপনা; রুমগুলো বড় বড় এবং ফাঁকা। তবে আমরা দীর্ঘ দেয়ালটার দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পাই, মানচিত্রে দেখানো সেই গ্রামের সামনের পাশ এটা। এটা আসলে প্রশস্ত একটা পাশ মাত্র। এখানকার ঘরগুলোর মধ্যে কোনো বিভাজনচিহ্ন নেই। এ রকম ডজনখানেকের বেশি ঘর দেখতে পাই। তবে এই পাশটা আমরা দেখতে পাই একটার পর একটা জানালা দিয়ে। প্রতিটা জানালার পেছনে অ্যাপার্টমেন্ট আছে; প্রতিটা অ্যাপার্টমেন্টের আলাদা প্রবেশপথ। একেবারে শেষ প্রান্তের জানালা দিয়ে দেখতে পাই নিকুঞ্জ, ফুলের বাগান এবং সরাইখানার সারিবদ্ধ পেছনের উঠান। এখানে আমরা একেকজন একেক জানালায় দাঁড়ালে আমাদের বিভিন্ন ধরনের জগ কিংবা কলসিতে করে পানি দেওয়া হয়। শুধু আমাদের যে লেবু দেওয়া হয় সেই লেবুগুলো এক রকমের। আমরা অনেকক্ষণ ধরে পানি পান করতেই থাকি। বিদায় নেওয়ার মুহূর্তের আগ পর্যন্ত আমাদের কথা বলার শক্তি পাই না। আমাদের কেউই আগে কখনো এ রকম স্বাভাবিক শুভেচ্ছা পাইনি। সামান্য কয়েকটা কথা বলার মাধ্যমে বিদায় নেওয়ার সময় আমরা বুঝতে পারি, মানুষের ভাষার উৎপত্তি হয়েছে এ রকম শুভেচ্ছা জানানোর প্রয়োজনে এবং শুভেচ্ছা থেকে পাওয়া আনন্দের জন্য।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তৃষ্ণা মেটানোর পর আমাদের দূরত্ব বোঝার দৃষ্টি বদলে যায়। যেতে যেতে আমরা মালভূমির ছাদের উচ্চ ভূমিরেখা দেখতে পাই; মাথার ওপরে ঘনক্ষেত্র আকারের বড় বড় পাথরখণ্ডের চাপে এটা ভারী হয়ে আছে। সন্ধ্যার দিকে পাথরগুলোর একটা থেকে স্বচ্ছ আলো ছড়িয়ে পড়তে দেখি এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা একটা করে সবগুলো থেকে আলো জ্বলে ওঠে; শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, দিগন্তের চূড়া আসলে একটা নগর। আমরা রাস্তায় থামার পর আমাদের পাশ দিয়ে এগিয়ে যায় ধীরে চলা একটা টহলগাড়ি। গাড়িটা এত ছোট যে বড়জোর একজন পুলিশের জায়গা হয়। জানালা নামিয়ে পুলিশ আমাদের দিকে একনজর তাকায়। আমাদের সৈনিকের কাছ থেকে পাওয়া একটা বিশেষ ইঙ্গিতের কারণেই গাড়ির পুলিশ তার গাড়ির গতি বাড়িয়ে চলে গেল নাকি? এই দৃষ্টির অনাক্রম্য অবস্থা তৈরির পেছনে কারণ হিসেবে আছে দুটি বিষয় : একটা হলো এই ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টি এবং জগতের মাঝে শান্তিপূর্ণ প্রতিমা স্থাপন, আরেকটা হলো বিরক্তিকর কুিসত অবস্থার মধ্যে আলো ফেলা।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আরেকবার সৈনিকের চাহনির ইঙ্গিতে সাড়া দিয়েই যেন খোলা রাস্তায় বাস থেমে যায় এবং আমাদের ভেতরে তুলে নেয়। এটা কি ওই বাস, যেটা পল্লী এলাকার পুরো যাত্রাপথটা ঘুরে এসেছে এখানে? যদি তা-ই হয় তাহলে বাসটা ওই বাচ্চাটাকে কোথাও নামিয়ে দিয়ে এসেছে এবং অন্য কোনো যাত্রী তোলেনি। তবে আমরাও কি বাসের যাত্রী? বাসের মধ্যে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। বাসের সিটগুলো রাস্তা থেকে অনেক উঁচু। আমাদের পেছনে ছোট গাড়ি আছে; কিন্তু একটাও আগে চলে যাচ্ছে না। ধীরে ধীরে আমরা একটা বহরের অংশ হয়ে যাই। আপাত মনে হচ্ছে, একটা পুলিশের গাড়ি সামনে আমাদের পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নগরের দিকে। হাঁটুর ওপরে হাত রেখে সোজা হয়ে বসে সামনের দিকে তাকিয়ে আমাদের মনে হচ্ছে, যা হচ্ছে সব স্বাভাবিক।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এই শহরের কোনো উপশহর নেই। একমুহূর্ত আগে ফিকে আলোয় পল্লী এলাকার একটা দেয়াল পার হওয়ার সময় সেটা থেকে আমাদের ধারণা হয়েছে, সেটা শুধু ভগ্নদশায় পড়ে গেছে তাই নয়, বরং কোনো গুহার মধ্যে পড়ে গেছে। এরই মধ্যে রাস্তা শেষ হয়ে আসছে এবং আমরা রেলস্টেশনেরও বাইরে। গোটা শহর কি স্টেশনেরই একটা বর্ধিতাংশ? রেল প্রশাসনের অফিস ছাড়া বাকি ভবনগুলো কিসের? যা-ই হোক, ভবনগুলোর শুধু সামনের পাশ আলোকিত; তা ছাড়া রাস্তার কোনো বাতিও নেই। গোধূলির সময় ভবনগুলোর ছাদে ঘূর্ণায়মান সংকেত চলমান ট্রেনে রূপান্তরিত হয়। হেঁটে এগিয়ে গিয়ে আমরা শহরের আরো কিছু লক্ষণীয় চিহ্ন দেখতে পাই, যেমন</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">একটা পার্ক এবং একটা প্রেক্ষাগৃহ। পার্কে কোনো জলের ঝরনা নেই; একটা সিডারগাছের চারপাশে আছে তালগাছের বৃত্ত। প্রেক্ষাগৃহও পল্লী এলাকার দেয়ালের মতো ধ্বংসের মধ্যে পতিত হয়েছে, সেটাও হয়েছে সাংঘাতিক আকস্মিকতায়; সময়ের আবর্তন স্পষ্ট ফাটল তৈরি করে না। টিকিটের অফিস ধসে পড়েছে, এটার ওপরের ঘড়ি</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ডায়াল, কাচ এবং সব রকমের কৌশল একেবারে পরিপূর্ণ ধ্বংসের মুখে পড়েছে। অনেক দিন আগে নিশ্চয় ভূমিকম্প হয়েছিল। একসময়ের রঙিন পোস্টারের মুখগুলো আর চেনা যাচ্ছে না। পরের বাড়িঘরগুলো ঘন খোলা কংক্রিটে তৈরি করা হয়েছে। হঠাৎ করেই শহরটা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরে ওঠে। কারণ পথচারীরা নানা জাতের মানুষ; আর এই অবিরত চলমান মানুষদের চেনার কোনো উপায়ও নেই। বিদেশিরা আমাদের মতোই; কেউই অন্যদের দেখছে বলে মনে হয় না, কেউ পালিয়ে এসেছে কি না, কিংবা যার যার মতো কোনো না কোনো উৎসবে যাচ্ছে কি না বলার উপায় নেই।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সাইডওয়াকহীন রাস্তার একেবারে মাঝখানে দাঁড়িয়ে একজন দারোয়ান খুব জোরালো ইশারায় আমাদের তার হোটেলে নিয়ে যায়। বাসচালকের মতো এই লোকটাকেও আমাদের বৃদ্ধের প্রতিনিধি মনে করি আমরা। হোটেলের লবি একেবারে ঝকঝকে উজ্জ্বল, যেন ব্র্যান্ড নিউ। আমরা ছাড়া আর কোনো মেহমান নেই। একমাত্র পরিচারক আমাদের পছন্দমতো রুম বেছে নিতে দেয়। সব রুম অবশ্য সব দিক থেকে একই রকম। সবই শহরের বিপর্যয়ের দিনের এবং তার পরের দিনের ছবি দিয়ে সাজানো।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">গোসল করে পোশাক বদলে আমরা ডাইনিংরুমে সমবেত হই। ডাইনিংরুমটাও হোটেলের আর সব এলাকার মতোই ফাঁকা এবং উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত। লাউডস্পিকার থেকে ভেসে আসে পিয়ানোর সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ভাবিত গান গাওয়া কার যেন ভাঙা কণ্ঠের আওয়াজ। দরজার পাশ থেকে শুনে আমরা মনে করি, কণ্ঠটা আমাদের বৃদ্ধের এবং টেবিলে বসার পরে আমরা ওয়েটারের ছদ্মবেশের মধ্যে বৃদ্ধকেই খুঁজি। হোটেলে প্রবেশের সময় এই লোকটাকেই তো দেখেছি রিসেপশনিস্ট হিসেবে। তার চুল রং করা ছিল না? তার হাতের পেছনের অংশের বার্ধক্যের দাগ নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে না? তার চশমার লেন্সের কাচ জানালার কাচ নয়। শেষে তার পেনসিল এবং হাতের লেখা দেখার জন্য আমরা তার কাছ থেকে কিছু তথ্য জানতে চাই। ছদ্মবেশ ধারণ করতেই পারো তুমি, তবে প্রবেশপথে রাখা সিগারেটদানির বালুতে তোমার মনোগ্রামের ছাপই আমাদের জন্য যথেষ্ট। </span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">যদিও রুমের মধ্যে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই, তবু উৎসবমুখর আলোকসজ্জা, দেয়ালঘেঁষা চারাগাছ, টেবিলের পাশে তেজপাতাগাছ</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এগুলো দেখে মনে হয়, আমাদের চারপাশে অদৃশ্য মানুষজন আছে। ওয়েটার প্রতিবার তার পিতলের গম্বুজাকৃতির ঠেলা নিয়ে সুইংগিং দরজা পার হয়ে আসার সময় একটুক্ষণের জন্য কিচেনের চেহারা দেখতে পাই আমরা : চোখ-ধাঁধানো সাদা যেন কেউ ওখানে থাকলে তার চেহারাই মুছে ফেলবে; ওয়েটারের পেছনে শুনতে পাই লোকজনের চিৎকার আর ব্যস্ত কণ্ঠের আওয়াজ। মনে হয়, তাদের অস্থির ব্যস্ততার মুহূর্ত চলছে। আমরা নিশ্চিত, আমাদের খাওয়াদাওয়া শেষ হলে শেফের হ্যাট পরা অবস্থায় বৃদ্ধ দরজায় এসে দাঁড়াবে, মাস্টার শেফের স্বভাবসুলভ বিনয়ী ও লাজুক ভঙ্গিতে হালকা হেসে আমাদের প্রশংসা গ্রহণ করবে।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">হঠাৎ দেখতে পাই হোটেলে খেতে আসা লোকজনের ভিড়; সব দিক থেকে আরো ওয়েটার ঢুকছে। দেখে তো মনে হচ্ছে, এই শহরে লোকজন দেরিতে ডিনার করে। রাস্তায় যদিও আমরা শুধু বিদেশি লোক দেখেছি, এখানে খেতে আসা লোকদের সবাইকে স্থানীয়ই মনে হচ্ছে।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ব্যর্থ চেষ্টায় প্রতিবার মুখ তুলে তাকানোর পরই আমাদের আশা খানিকটা বিলীন হয়ে যায়। প্রতিবার ভুল করে অন্য লোকের মধ্যে তাকে খুঁজতে চেষ্টা করে বুঝতে পারি, আমাদের কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির স্মৃতি আরো বেশি ফিকে হয়ে যাচ্ছে। তার অস্তিত্ব কি আসলেই ছিল? সে, তার পেনসিল, তার খাতা আসলে ভ্রম নয় তো? আর আমরা কারা? এই যে কুঞ্চিত ঠোঁটওয়ালা মহিলা, নখের মধ্যে ময়লাওয়ালা অল্পবয়সী বেচারা ছোকরা, দালালের ব্রেসলেট পরা ব্যাংকনোট নিয়ে ঘুরে বেড়ানো অচেনা লোকটা</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এরা কারা?</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আমাদের সবার কাছে এই ভাবনাটা কখন এলো যে হারানো লোকটা চিরতরে নাই হয়ে গেছে? যখন ডাইনিংরুমটা আবার ফাঁকা হয়ে গেল, তখন এসেছে এই ভাবনাটা। ততক্ষণে ওয়েটাররা অনেক আগেই রুম থেকে চলে গেছে। তবে উৎসবের মতো আলোকসজ্জা আর পিয়ানোর সংগীত অপরিবর্তিত আছে, অবশ্য সেই কণ্ঠটা নেই। চিত্রকল্পহীন একটা ভাবনা। সঙ্গে আমাদের নির্বাক করে দেওয়ার মতো বিবমিষা; কোনো কথা বলাই আমাদের কাছে যেন ভয়ার্ত চিৎকার। একটা কথাও না বলে আমরা প্রত্যেকে ভিন্ন গমনপথের এলিভেটর, সিঁড়ি, সার্ভিস, এন্ট্রান্স ধরে যার যার রুমে চলে যাই। পেছনে পড়ে থাকে শুধু করিডরে প্রতিধ্বনি তোলা সংগীত। এ রকম সংগীত সম্পর্কে কবি বলেছেন, যারা জানে আর কোনো দিন বাড়ি ফিরে যেতে পারবে না, তারা দূর থেকে এই সংগীত শুনলে তাদের মন আতঙ্কে ভরে যায়।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সারা রাত শহরটাকে মনে হয় একটা বিশাল রেলস্টেশন। সব রুম থেকে রেলের বগি এক লাইন থেকে আরেক লাইনে নেওয়ার শব্দ শোনা যায়। তার মাঝে লাউডস্পিকারের পর্যায়ক্রমিক সম্পর্কযুক্ত শহরের নাম শোনা যায়: </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ভেনিস-মিলান-ভেন্টিমিগলিয়া-লিয়ন-প্যারিস</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> কিংবা </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ইস্তানবুুল-সালোনিকা-বেলগ্রেড-জাগরেব-মিউনিখ-অসটেন্ড</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">। আমাদের মনে হয়, এই একটানা নামের আওয়াজ সংগীতের প্রভাবকে আরো জোরালো করে দেয়। অদ্ভুত কারণে অন্য সব শব্দ বলতে শোনা যায় ক্ষীণ বেলের শব্দ এবং মাঝে মাঝে আশপাশে কোথাও থেকে আসা আর্তনাদ আর কাতর কান্না। কান্নার শব্দ অত্যধিক বুনো মনে হয় বলে আমাদের একজন মনে করে, পাশে কোথাও গালাগারদ আছে। আরেকজন মনে করে জেলখানা আছে; আরেকজন মনে করে চিড়িয়াখানা আছে। কিন্তু কোথাও থেকে একবারও কুকুরের ঘেউঘেউ শোনা যায় না, অনেক দূর থেকেও শোনা যায় না। মনে হয়, ভূমিকম্পের পর থেকে শহরে একটা কুকুরও নেই।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তবে এই অভাবটা পূরণ করে মোরগের ডাক, অন্ধকার থাকতেই মোরগের ডাক শোনা যায়। ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে বিপুলসংখ্যক মোরগ ডাকতে থাকে বলে আমাদের মনে হয়, আমরা এখন বাইরে আছি এবং এই হোটেল, এই শহর</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এগুলো সত্যি নয়, মায়া। আমাদের একমাত্র নিশ্চয়তা হলো, বৃদ্ধের কী জানি কিছু ঘটেছে। এই নিশ্চয়তা আমাদের শান্ত করার বদলে ভূত দেখায়। জীবনে খুব প্রিয় ছিল এমন ব্যক্তি সাম্প্রতিক সময়ে মারা গেলে ঠিকমতো বিদায় নিতে না পারলে প্রেতাত্মা হয়ে বারবার ফিরে আসে, তাই না?</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সুতরাং বৃদ্ধ অশুভ অনুপস্থিতির ভেতর চলে গেল। এই অবস্থাটাই চলতে লাগল। রুমের অন্ধকারতম জায়গাগুলোতে লুকিয়ে থাকতে লাগল সে, নিদ্রাহীন রাতে যখনই আমরা সামান্য স্বপ্নের ভেতর আশ্রয় পাওয়ার সুযোগ পাচ্ছি, তখনই সে এসে আক্রমণ করছে, সকালের রোদেও আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। একই সময়ে আমাদের একজন কাপড়ের হ্যাঙ্গারে তার প্রাবার ঝুলতে দেখে ভয়ে চিৎকার করছে; আরেকজন ব্যালকনির রেলিংয়ে তার হাতমোজা দেখে ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে; আরেকজন চাকু হাতে চক্রাকারে ঘুরছে, কারণ সে নিজের চুল মুখের সামনে ঝুলতে দেখে মনে করেছে, তাকে কেউ আক্রমণ করার জন্য আশপাশে ঘুরছে। </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">মৃতব্যক্তি</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> একই সঙ্গে অনেক মৃতব্যক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। সবগুলো মৃতব্যক্তি দলবদ্ধ হয়ে আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে; আমরা জীবিতরা হয়ে গেছি নিঃসহায়।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আমাদের সকালের নাশতা দেওয়া হয় বাইরে চত্বরে। ওখান থেকে হোটেলের পার্ক দেখা যায়। একই টেবিলে বসলেও আমরা আর কোনো অর্থেই </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">একসঙ্গে</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> নই। আমরা একে অন্যের কাছে অপরিচিত, এমনকি আগের রাতের চেয়ে সকালবেলা বেশি অচেনা। কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে বসেছি, অথচ আমাদের মাঝে যেন বেড়া আছে। আমাদের একে অন্যের সঙ্গে আগে কোনো কিছুতে কি মিল ছিল আদৌ? শালার বেকুব এক দৈবক্রমে বিশেষ এই মানুষগুলোর সঙ্গে দেখা হয়েছে! জ্ঞাতিত্বের বেকুব মরীচিকা এই মানুষগুলোকে আর আমাকে এই অদ্ভুত জায়গায় এনে ফেলেছে।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">অপরিচয়ের চেয়েও খারাপ বিষয় শুরু হয়ে গেছে : আমরা একজন আরেকজনের প্রতি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছি। আমাদের কারুরই আর নিজের মতো অন্য পথে যাওয়ার শক্তি নেই, আবার নিজের চারপাশে দেখে নিজের চিন্তা নিয়ে চর্চা করে এখানেও সন্তুষ্ট হতে পারছি না। এই জায়গাটার সঙ্গে আমরা আটকে আছি, কোনো কিছুতেই আগ্রহ নেই। আমরা এখন একে অন্যের শত্রু, যেকোনো সময় একে অন্যকে আঘাত করে বসতে পারি। মহিলা সব সময় কাগজের টুকরা কুটি কুটি করে ছিঁড়ে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে, এভাবে যেন সে আমাদের কুশপুতুল পোড়াচ্ছে। জুয়াড়ি এত সুন্দর আরামদায়ক বাতাসেও কাঁপছে, মাঝে মাঝেই আত্মহনন করার মতো পাগলের হাসি হাসছে, যেন এখনই প্রচণ্ড ক্রোধে ছোটাছুটি শুরু করবে। এমনকি কোমল আচরণের সৈনিকও পড়তে অক্ষম হয়ে সব সময় তার বইয়ের একটা লাইনের দিকেই তাকিয়ে আছে। মুখ লাল হয়ে আছে, থেকে থেকে দাঁত বের করছে সে। একজন আরেকজনের দেহরেখা হারিয়ে আমরা আর একে অন্যের মুখোমুখি নই। আগে কখনো যা করিনি তা-ই করি আমরা। একে অন্যকে বিচার করে দেখি, অনুমোদন দিতে পারি না কোনো কিছুতে এবং শেষ পর্যন্ত ঘৃণা করি।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">শরতের প্রথম দিকের এক ঝকঝকে মেঘমুক্ত দিন। দক্ষিণ সাগরের প্রবালপ্রাচীরে এ রকম মৃদু বাতাস কল্পনা করা যেতে পারে। গোটা মালভূমি আমাদের সামনে তার চেহারা মেলে ধরে : আমাদের স্বাভাবিক মানসিক অবস্থায় আমাদের ভ্রমণের প্রতিটা উত্থান-পতন আমাদের সামনে প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারত। আমাদের ভ্রমণের আগে যেমন কখনোই ছিলাম না তেমন অল্পবয়সী হয়ে ওঠার অনুভূতি নিয়ে আমরা নিজেদের মনুষ্যমেঘ ভেবে থাকতে পারতাম, স্টেশন থেকে স্টেশনে এগিয়ে যেতে যেতে, বিশ্রাম নিয়ে, ঘুমিয়ে আমরা ধ্বংসের সামনেও অটুট থাকতে পারতাম। একটা বেদির পাদদেশে কুয়াশার চকচকে আঁকাবাঁকা রেখা দেখে আমরা পুলকিত হতে পারতাম, নাকি এটা কোনো প্লাস্টিকের আচ্ছাদন ছড়ানো মাঠ? না, এটা আসলে সমুদ্র। বাগানের মধ্যে ঝাঁকড়া মোমের আকারের কুশি আবৃত বিশাল সিডারগাছটার গা ঘন কালো। এটা আসলে কবর সমর্থিত গির্জার সামনের ভাগ; আমাদের যদি ওপরের দিকে তাকাতে না হতো এবং এটাকে যদি আমাদের দৃষ্টির সমস্তরে স্থাপন করা হতো তাহলে এটাকেই তুষ্ট মনে আমাদের ভ্রমণের স্বাভাবিক গন্তব্য বলে গ্রহণ করতাম।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কিন্তু আমরা এখন যেখানে পৌঁছেছি তাতে মনে হচ্ছে, আমরা বিপথগামী হয়েছি। আলো আমাদের জন্য বেশিই হয়েছে। আর সৌন্দর্য শুধু অর্থহীনই হয়নি, অশোভনও হয়েছে। আমাদের নিকুঞ্জ থেকে দেখা পিলারের মতো দৃশ্য পরিহাসের মতো মনে হয়েছে। ছায়া থেকে সূর্যালোকের দিকে বয়ে যাওয়া লতা আত্মাকে আহত করেছে। আমরা কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি, একমাত্র কাক ছাড়া স্বর্গের কোনো পাখি আমাদের কাছে বিস্বাদ মনে হতে পারে। সিডারগাছের কুঞ্জ থেকে অনেক জাতের পাখির কাছ থেকে আমরা এখন একই রকম পরিহাসের আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছি। বুনো ঘুঘুদের নিজের জায়গা থেকে পাখা ঝাপটানো দেখে মনে হলো, এরা শূন্যে কোথাও নামবে, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি, এদের সরু গলা ফুলে গরুর গলার মতো হয়ে গেছে।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তারপর তো আছে আমাদের অপরাধবোধ। মানুষজন সবখানে কিছু না কিছু করছে, কেউ কাজ করছে, কেউ পড়াশোনা করছে; যেমন</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এখানে পার্কে বাগানিরা তাদের নবিশদের নিয়ে কাজ করছে; শহরে রাজমিস্ত্রিরা বছরের পর বছর ধরে কাজ করেই যাচ্ছে; খছাটি পাথর দিয়ে বিশ্বস্ততার সঙ্গে তারা গির্জা পুনরায় নির্মাণ করে যাচ্ছে। আজকের দিনে, আজকের যুগে এর চেয়ে আর কী এমন ভালো পেশা থাকতে পারে? কোনো রকমের তাড়াহুড়া ছাড়াই এই মানুষগুলো কি তাদের কাজে অন্য সময়ের চেয়ে বেশি মগ্ন নয়? ভবনের সামনে দাঁড়ানো মেষটা পেছনে শূন্যের দিকে তাকাচ্ছে। একটা ঘুঘুর স্বস্তি বাজপাখির দৃষ্টিতে সকালের সূর্যের মুখোমুখি হচ্ছে। পাথরের তিন রাজা তাদের গর্তের মধ্যে শান্তিময় গভীর ঘুমে থেকে স্বপ্নের মধ্যে আবার তারকাদের অনুসরণ করছে। শুধু গির্জার চূড়ার মাথা অনেক দূরে যেখানে লতাঝোপের মধ্যে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল সেখানেই পড়ে আছে; চারপাশে লতাগুল্ম গজিয়ে উঠেছে। চত্বরের যে লোকগুলো অলস দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল, তাদের দিকে মাথা ঘোরালেই তাদের কাছ থেকে রাজরাজড়াদের মতো সেবা পাওয়া যেত। পেছনে ক্যাশ রেজিস্ট্রারের অবিরাম পি পি আওয়াজ শুনতে অবিকল মহাশূন্যে রাডারহীন স্পেসক্যাপসুলের বিপত্সংকেতের মতো, যেন ওই যানটাই আমাদের পৃথিবী থেকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এ হলো ব্যক্তিগত ও বিশ্বজনীন ইতিহাস থেকে মুক্তি পাওয়া এবং তথাকথিত ভূগোলে পলায়ন।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আমরা ভয়ানক রকমের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। কোনো কিছুই আর আমাদের একত্র করতে পারবে না। যদি বৃদ্ধ আবার এসে হাজির হতো এবং আমাদের একত্র হওয়ার প্রস্তাব দিত তাহলে আমরা হেসেই উড়িয়ে দিতাম, শুধু তার প্রস্তাব নয়, তার উপস্থিতিটাও।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">শেষে এক ঘণ্টা কিংবা এক মাস পর আমাদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে ছোট, একজন শিশুর চেয়ে বড়জোর একটুখানি বড়, মানে সৈনিক কথা বলা শুরু করে। সে কথা বলা শুরু করার আগমুহূর্তে তার কণ্ঠমণি সাংঘাতিক রকমের ঝাঁকুনি খায়, তার গলার আর ললাটের শিরাগুলো ফুলে ওঠে এবং সে নিজের মুখের ওপর মুষ্টি চাপা দেয়। মুষ্টিটা যখন সে সরিয়ে নেয় দেখা যায়, তার মুখের নিচের গোটা অংশই জন্মদাগের মতো কালো হয়ে গেছে। অবশেষে আবার যখন কথা বলা শুরু করে, আমরা তার ঠোঁট নড়া দেখতে পাই না। বিস্ময়ে আমরা এদিক-ওদিক তাকাই, সে কি মায়াকণ্ঠ হয়ে গেল! জোর চেষ্টা করার ফলে তার পেশি শক্ত হয়ে যায়; আক্ষরিক অর্থেই তার পোশাকে ভাঁজ পড়ে যায়। বইয়ের ওপর নুয়ে পড়ে সে কোমলভাবে, তবে স্পষ্টভাবে কথা বলে, যেন বই থেকে পড়ছে সে। তার পড়ায় কোথাও ছেদ টানতে পারছে না, তোতলা ব্যক্তি যেমন চেষ্টা করে কথা বলা শুরু করলে একটানা খানিক বলে যায়, তেমন। তার অন্য সব কাজের মতো কথা বলাও স্বাভাবিকভাবে ঘটে, মাঝখানে অন্য কিছু করতে হয় না; প্রায় সাদামাটাভাবেই একা একা কথা বলার মতো করে বলে, যেন বক্তব্য আর নীরবতার মাঝখানে চলে এ রকম কথা বলা। আমাদের তিনজনের মধ্যে শুধু সে একাই এ রকম শান্ত অব্যক্তিক কণ্ঠ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নাকি? এমনকি অসংখ্য গোলমেলে কণ্ঠের মধ্যেও একজন মানুষ এভাবে উৎসাহিত হতে পারে! তবু দুর্ভোগের মতো কালো কালো কী যেন তার ক্রু-কাট চুলের নিচ থেকে আগ্নেয়গিরির লাভার মতো বের হয়ে আসতে চায়। কথা বলার সময় সে গুহার সেই ছোট পাথর এবং ভ্রমণের সময় বিচ্ছিন্ন করে ফেলা বোতাম আমাদের মধ্যে অবিরত হাতে হাতে বিতরণ করে চলে এবং তার সিট থেকে বারবার লাফিয়ে উঠতে থাকে।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">হতে পারে, আমার বিদায় জগতের কাছে মিথ্যা প্রতিজ্ঞা রেখেছে। সে একটা চুক্তিতে এসেছিল এবং পরে আর সেটা মেনে চলেনি। সে নিজেকে মামলা দায়েরকারী বলেছে, কিন্তু নিজের দাবি প্রতিষ্ঠা করার জন্য কোনো শব্দ খুঁজে পায়নি। গভীর স্থান থেকে সে আমাকে তুলেছিল, কিন্তু আরো গভীরে ফেলে দিয়েছে। সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, মহান কোনো দেশে আমাকে নিয়ে যাবে, কিন্তু আমি এখন এখানে শত্রুদের মাঝে একা। সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, এই ঊষর তেপান্তর ফলদায়ী বাগানে পরিণত হবে, যেহেতু সে এটাকে একটা নির্দিষ্ট আকার দিয়েছে। সে এক নকল রাজকুমার। সে আমাকে লোভ দেখিয়ে বাড়ি থেকে, ব্যারাক থেকে, আমার নিজের লোকজনের কাছ থেকে নিয়ে এসেছে। এমন একটা দেশে এনেছে, যেখানে শুধু তার জন্য ছাড়া এক ফুঁ বাতাসও নেই। বিশ্বসাম্রাজ্যের কোনো রাজকুমার সে নয় যে সবার জন্য কাজ করবে। সে এক মায়াজীবী। সে আমাকে দিয়ে আমার নিজের গ্রামের সঙ্গে প্রতারণা করিয়েছে, সে আমাকে এক মরুচারী বানিয়েছে; আমি সবাইকে ছেড়ে এসেছি। আমার আপাত রাজকুমার আমার মাথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে, আমার স্বাভাবিক আবহ থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করেছে, আমাকে শূন্যতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। আমার স্কাউট হিসেবেও সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। সে সব রকমের জায়গা দেখেছে, কিন্তু কোথাও থাকেনি। সে ভূগোলবিদ নয়, কারণ ইতিহাসবিদ হয়ে সাক্ষ্য-প্রমাণ রাখার মতো অতটা ধৈর্য তার নেই। কোনো দুর্ভিক্ষের কিংবা কোনো মোটর মহাসড়ক তৈরির কিংবা রেলওয়ের কর্মীদের ভারসাম্যহীন বাগান সম্পর্কে কোনো ঘটনা লিখে রাখার পরিবর্তে সে শুধু এখানে-সেখানে চিহ্ন খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছে। ফলে পথপ্রদর্শক হিসেবে সে আমাকে সোজা পথে দূরে কোথাও নিয়ে যায়নি, বরং তার জাদুকরী সংকেতের মাধ্যমে আমাকে একটা বৃত্তের চারপাশে ঘুরিয়ে ক্রমান্বয়ে গোলকধাঁধার গভীরে নিয়ে গেছে। খোলা এলাকায় সে যেমন মিথ্যা রাজকুমার ছিল, গোলকধাঁধার মধ্যে সে তেমনই মিথ্যা স্কাউট হয়েছে। কারণ স্কাউট হিসেবে তার পদক্ষেপে নিশ্চয়তা থাকা উচিত ছিল, যে দেশে সে কখনো আসেনি সেখানকার পথঘাট চিনে রাখা উচিত ছিল, শুধু তার পদক্ষেপের মাধ্যমে তার চিহ্ন অনুসরণকারী হওয়া উচিত ছিল।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তবে গত রাতে আমি এই স্বপ্নগুলো দেখেছি : প্রথমটা ছিল এই বইটা সম্পর্কিত। বাস্তবে এটা তো একটা ফোলিও ভলিউম, স্বপ্নে তার চেয়ে দশ গুণ বড় দেখলাম এটাকে। স্বপ্নে আমার একটা শিশু দেখলাম, তাকে ফোলিওর ফাঁকায় লুকিয়ে রেখে আমার সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু যখন একটা নিরাপদ কোনায় এসে তাকালাম, আমার শিশুকে আর সেখানে পেলাম না। গুহাটাসহ, মানে আমার ইন্ডিয়া-পেপারের ফোলিওটাসহ আমার শিশু বাচ্চাটা চলে গেছে। তারপর শুধু শব্দ দেখলাম এবং একই সময়ে আমি শব্দগুলো বানান করে গেলাম : </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কত তাড়াতাড়ি তোমার শৈশবের সঙ্গে প্রতারণা করলে। ওই বৃদ্ধ লোকটা খারাপ ছিল না। সে ছিল শুধু একজন চিরন্তন শিশু। শৈশবের সারবস্তুর অপব্যবহার করা উচিত নয়।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> আমার শেষের স্বপ্নটা ছিল ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত এবং সেখানকার বাক্যগুলোও ছিল ভবিষ্যৎকালে : যে লোকটা নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে তাকে আমরা খুঁজব। খুঁজতে পুরো এক বছর লাগবে। আমরা তাকে আলাদা আলাদাভাবে খুঁজব। মহিলা, আপনি এখানে অপেক্ষা করবেন। জুয়াড়ি, আপনি আপনার গাড়ি চালিয়ে শহরে খুঁজে বেড়াবেন, একেক দিন একেক শহরে খুঁজবেন। আর আমি সৈনিক এই খোলা দেশে প্রতিনিয়ত বৃহত্তর পরিসরে চক্রাকারে খুঁজে বেড়াব তাকে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় হোটেলে টেলিফোন করে আমরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখব। যেহেতু সন্ধানকর্ম ও অপেক্ষা আমাদের ধীর করে দেবে এবং আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোকে তীক্ষ করবে, সেহেতু আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো সার্বক্ষণিক সমুপস্থিত ফলাফলের গুণ লাভ করবে। বসন্তের শেষ দিকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে আপনারা বৃদ্ধের পায়ের ছাপ আবিষ্কার করবেন পথচারীদের পারাপারের ক্রসিংয়ে। উত্তরায়ণে সারা রাত আপনাদের চত্বর থেকে পাহাড়ি এলাকায় আগুনের চাকার একটাকে আরেকটার ছেদ করে যাওয়া দেখতে পাবেন। শরতের একটা ঝড় থেমে গেলে আমি সৈনিক একটা স্বপ্নে আক্ষরিক অর্থেই একটা পতিত জমিতে তখনো বর্ধনশীল একটা ওকগাছ তুলে আপনাদের কাছে নিয়ে আসব প্রমাণ হিসেবে। শীতের শুরুতে সমুদ্রবন্দরের শহরে রেলপথ যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে আমরা দেখা করব। বালিয়াড়ি আর সমুদ্র পাওয়ার আগে বাফেট হবে পার হয়ে যাওয়ার মতো সর্বশেষ বাধা। স্টেশনের প্ল্যাটফরমের উপরিভাগে থাকবে আলকাতরা; আলকাতরার ভেতরে খুঁটির মতো পোঁতা থাকবে টিকিট, ম্যাচ, খবরের কাগজের ক্লিপিং ইত্যাদি; এগুলোর সারি গিয়ে ঠেকবে বালিয়াড়িতে। সেখানে চেইন-লিংক বেড়ার পাশে বড় বড় ঘাসের মধ্যে বৃদ্ধের খাতাটা খোলা অবস্থায় পড়ে থাকবে, একটু দূর থেকেই চোখে পড়বে, আপাত মনে হবে, নষ্ট হয়নি। তবে অনেক বছর খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকার ফলে ভেতরের লেখাগুলো সাদা সাদা এবং আবছা আবছা দেখাবে। পেনসিলটাও বহু বছরের আবহাওয়ায় ক্ষয় হয়ে থাকবে, তবু পেনসিল দিয়ে লেখা যাবে এবং আমরা কাগজের ওপরকার লেখা লাইনগুলো খুঁজে খুঁজে বের করতে থাকব। এমনকি যদি বিচ্ছিন্ন শব্দগুলো এবং লাইনগুলো বিরাট কোনো তাৎপর্য না-ও আনতে পারে, তবু খাতার ভেতরে দেখার চেষ্টা এবং আমাদের একসঙ্গে খাতার ওপরে ঝুঁকে থাকাটাও বর্তমান যুগে সবচেয়ে উত্তেজনাকর, সবচেয়ে বিশাল অভিযান হয়ে যাবে। আমি কিন্তু আমার স্বপ্নের প্রতিটা শব্দ হুবহু বলছি, আর যখন আমরা মুখ তুলে ওপরের দিকে তাকাব, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বালিয়াড়ি হবে আমাদের ভাইয়ের কবর, কাছে দূরে সবখানে চকচক করবে।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> আমার বৃদ্ধ সম্পর্কে কথা বলতে আমার অনীহা। আমাদের সবার বৃদ্ধ সম্পর্কে সবারই কথা বলায় অনীহা থাকা উচিত। তার পুনরাবিষ্কৃত লেখা আমার স্বপ্নে ফুল হয়ে ফুটেছে।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">শেষে সৈনিক হ্যামার থ্রোয়ারের মতো একটা ছোট বৃত্তে কয়েক পাক ঘোরে। তারপর সে এমনভাবে বসে পড়ে, যেন কিছুই ঘটেনি। হাত দিয়ে চোখ ঢাকে। সামনের দিকে ঝুঁকে মহিলা দুই হাঁটুর মাঝে বেশ জোর করেই দুই হাত ঢোকায়। জুয়ারি জুতার তলা থেকে নুড়িগুলো তুলে আনে। একে অন্যের মুখের দিকে না তাকিয়েও আমরা প্রত্যেকের চোখের নিচের হাড়ের রেখা এবং চোখের রং সম্পর্কে অবগত। আমরা তিনজনে তিন জোড়া মানুষ হয়ে যাই। আমাদের চারপাশের সব ধরনের শব্দকে মরা নীরবতা গিলে খায়, যেন ভূমিকম্পের হৈ-হট্টগোল এক যুগ পরেও সক্রিয় আছে। বিমান দুর্ঘটনার দৃশ্যে যেমন প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন দিকে, ভিন্ন ভিন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, সেভাবে আমরা চত্বরে বসি। লনের মাঝখানে একগুচ্ছ প্রেইরি ঘাস কেঁপে ওঠে, যখন একটা পাখি ঘাস খায়। নিকুঞ্জের প্রান্তে একটা আইভিপাতা হাতছানি দিয়ে ডাকে। আমরা ওখানে বসে থাকার সময় একজন ওয়েটার আমাদের মাথার ওপরে রোদ-ছাউনি খাটিয়ে দেয়। ছাউনির ভাঁজ থেকে বৃষ্টির মতো পাতা গড়িয়ে পড়ে; পাতাগুলো কয়েকটা মাটিতে এখানে-ওখানে পড়ে লাফিয়েও ওঠে। গ্লাসের ওপরের ফোঁটাগুলো একমুহূর্তের জন্য গড়াতে থাকে। আমাদের পাশ দিয়ে হঠাৎ উড়ে যাওয়া গন্ধকের প্রজাপতিটা কি বসন্তের অগ্রদূত নয়? তবে নিঃসঙ্গ আপেলগাছটা শরতের ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে; সময়ের আবর্তে আমাদের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনের প্রভাবে আপেলগাছটা একটা ঝাঁকড়া গাছের বীজাধারের মতো দোল খেতে শুরু করে।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">একটা ঝাঁকড়া গাছ আসলেই দেখা যায়</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কেটে ফেলা, টুকরা করা এবং গুঁড়ি বানিয়ে ছোপ ছোপ দাগের স্তূপ করে রাখা অবস্থায় দেখা যায় গাছটাকে। আমাদের রূপকথার পানি-তোলা গাছটা কি কেটে টুকরা করে ফেলা হয়েছিল? সেটার জোড়ালাগা ডালগুলোও কি করাত দিয়ে কেটে ছোট ছোট গুঁড়ি বানানো যেত? সৈনিক গুহা থেকে নিয়ে আসা নুড়িগুলোর একটাকে পাথরের টেবিলের ওপরে চক্রাকারে ঘোরাতে থাকে। নুড়িটার ভেতরে একটা খাঁজ ছিল, ঘোরানোর ফলে সেটার একটা সর্পিল আকৃতি দেখা যায়, আবার থামানোর পর দেখা যায় একটা ফাটল।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">শেষে আমরা কিছু একটা হয়েছি। অন্তত আমরা তো অসুখী।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আমাদের দুঃখের মধ্যে আমরা সব জাতের মানুষের দৃষ্টি অর্জন করি। তাতে আমরা যেন শক্তি পাই, কাটার সময় একটা ঝাঁকড়া গাছের গোড়া বাগানি ওই মুহূর্তের জন্য আপাতত মাটির ওপরে রেখে দিয়েছিল; সেটা এখন অন্য দিক থেকে উঠে এসেছে। অনাবৃত শিকড়গুলো মনে হয় একটা ফাঁপা স্থান তৈরি করার জন্য একসঙ্গে বড় হয়েছে, যেটা বৃষ্টির পানিতে কিংবা পানি ছিটানো যন্ত্রের পানিতে পূর্ণ, উপরিভাগটা বাতাসে কাঁপার মতো হালকাভাবে কেঁপে ওঠে। ফাঁপাটার আকৃতি মানুষের কানের মতো, শব্দ গিলে খাওয়ার বদলে এটা শব্দকে আরো তীব্র করছে। বিমানের স্কোয়াড্রনের দূরবর্তী গর্জন, ঘেঁষাঘেঁষি রেসিং কারের হুংকার এবং থেকে থেকে হলেও একটা শিশুর অন্তর্ভেদী কণ্ঠ ধীরে ধীরে বলা কথাগুলো শেষ করছে </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আমি আসছি</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> বলে।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ছেলেবেলায় আমরা প্রায়ই লুকিয়ে থাকার সময় চাইতাম, অন্যরা আমাদের খুঁজে বের করুক</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">প্রসঙ্গটা মনে পড়তেই একই মুহূর্তে আমাদের সবার মধ্যে একটা ঝাঁকুনি খেলে যায়। মনে হয়, আমাদের ভেতর থেকে একটা বাতাস ওঠে, সব কিছুর ভেতর দিয়ে বয়ে  যায় : কবিতার বাতাস, অতিকল্পনার বাতাস, ভিন্নতর এক অনুপস্থিতিতে এসে পৌঁছানোর বাতাস। সদ্য কাটা ঘাসের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে পার্কে; সিডারগাছের পাখিগুলো যেন মাঠের কর্ষণের হলরেখা থেকে ডাকছে। গির্জার চূড়ার বেলটাকে মনে হচ্ছে নড়াচড়াহীন একটা ঝুলন্ত কালো ছায়া। পাথরের সোজা সিঁড়ি ওপরের দিকে উঠছে। রোদ-ছাউনিটা ফুলে ফুলে খিলানের আকার ধারণ করছে। শয়নকক্ষের পরিচারিকা হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা বসেছি। বাগানিরা উঠে দাঁড়িয়েছে। দেয়ালগুলো ওপরের দিকে উঠে দাঁড়িয়েছে। সিডারগাছের ডালগুলো আঁকাবাঁকা রেখায় একটা অরেকটাকে ছেদ করেছে। শিকড়গুলো বাইরের দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ভূপৃষ্ঠের নিচের তপ্ত তরল শিলা জ্বলে উঠছে। সমুদ্র ফুলে উঠছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড শোঁ শোঁ শব্দে ঘুরছে। আকাশের পাখিরা পাখায় পাখায় মসৃণ গতিতে ভেসে যাচ্ছে। গাছের পাতারা আরো সবুজ হচ্ছে। গাছের গুঁড়িগুলো গোলাকারে আরো প্রশস্ত হচ্ছে। ধোঁয়া সংকেত দিচ্ছে।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"><span style="font-size:10.5pt"><span style="line-height:10.5pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আমাদের সন্ধানপর্ব নিয়ে পুরো একটা বই লিখতে পারতাম। তবে আমাদের প্রথমে নিবৃত্তির সুযোগ দেওয়া হয়। সৈনিক পা ছড়িয়ে বসে; জুয়াড়ি তার টাকা-পয়সা ভাগ করে। মহিলা মুখে মেকআপ মেখে এক কোনায় অপেক্ষমাণ কার জন্য যেন মুচকি হাসে। শেষে আমরা সবাই একে অন্যের কাঁধে হাত রাখি। কিছুক্ষণের জন্য আমরা তিনজনই ওখানে বসে থেকে নিজেদের এভাবেই প্রদর্শন করি।</span></span></span></span></span></span></p> <p class="body" style="text-align:justify; text-indent:0.15in"> </p> <p style="text-align:justify; margin-bottom:13px"><span style="font-size:11pt"><span style="line-height:115%"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="line-height:115%"><span style="font-family:SolaimanLipi">(রাজত্বের একটা ঘোড়া</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="line-height:115%"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="line-height:115%"><span style="font-family:SolaimanLipi">ঘোড়ার গুণাগুণ সম্পূর্ণ। এই মনে হয় ঘোড়াটা চিন্তিত, এই মনে হয় পথ হারিয়ে ফেলছে, আবার মনে হয় নিজেকেই ভুলে গেছে। এ রকম একটা ঘোড়া বল্গিত চালে চলে, কিংবা যাত্রার স্বাভাবিক গতি চালিয়ে যায়, কিংবা ধুলার ওপরে অবজ্ঞায় পা ফেলে; কারণ এখন জানে, সে কোথায় আছে।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="line-height:115%"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="line-height:115%"><span style="font-family:SolaimanLipi">চুয়াং জু) </span></span></span></span></span></span></p>