<p>মহাবিশ্বে কোটি কোটি ছায়াপথ আছে। আমরা যে ছায়াপথের বাসিন্দা তার নাম হচ্ছে ‘আকাশ গঙ্গা’ (মিল্কি ওয়ে)। এই আকাশ গঙ্গায় আছে কোটি কোটি গ্রহ। কিন্তু তার মধ্যে পৃথিবী নামের গ্রহ আছে মাত্র একটি। এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের (৫ জুন ২০২২) প্রতিপাদ্য করা হয়েছে এটি। অর্থাৎ ‘একটি মাত্র পৃথিবী’ (অনলি ওয়ান আর্থ)। এই প্রতিপাদ্যের মূল কথা হচ্ছে, মহাবিশ্বে পৃথিবী নামের এই গ্রহটি ছাড়া আমাদের বসবাসের জন্য আর অন্য কোনো জায়গা নেই। কাজেই এটিকে আমাদের বসবাসযোগ্য রাখা একান্ত প্রয়োজন।</p> <p>আমাদের এই গ্রহটির বর্তমানে বড় ধরনের সমস্যা তিনটি। জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য হ্রাস ও দূষণ। আর এই ত্রিবিধ সমস্যার মূল কারণ আমরাই। সুখ সুখ খেলায় মত্ত হয়ে আমরা এই গ্রহটির প্রকৃতিকে করেছি ছিন্নভিন্ন। এর শ্যামল নিসর্গকে মুছে ফেলে সেখানে রচনা করেছি ইট, কংক্রিট আর ইস্পাতের ধূসর জঙ্গল। ফলে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। পৃথিবীর নানা জায়গায় মুহুর্মুহু প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, তীব্র জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা, প্রচণ্ড খরা, ঘন ঘন বজ্রপাত, উপর্যুপরি ভয়াবহ দাবানল, হিমবাহের অস্বাভাবিক বিগলন, সমুদ্র পানির অম্লত্ব ও উচ্চতা বৃদ্ধি, বৃষ্টিচক্রে পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া, মহামারি, অকালমৃত্যু ইত্যাদি ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে মানবজাতি এক গভীর অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন।</p> <p><img alt="" src="http://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/ckfinder/innerfiles/images/Print Version Online/print /2022/06.June/05-06-2022/kalerkantho-6-2022-06-05-02a.jpg" style="float:left; height:241px; width:400px" />করোনার অভিঘাত পুরোপুরি সামলে ওঠার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পৃথিবীতে আর এক মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। খাদ্যসংকট ছাড়াও তৈরি হয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা। এই অভিশপ্ত অস্ত্র ব্যবহার করা হলে এক ভয়ংকর পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দেবে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এই যুদ্ধ থামানোর পরিবর্তে তাকে দীর্ঘায়িত এবং আরো বিভীষিকাময় করে তোলার জন্য কিছু দেশ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে কাজ করছে। জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস ও দূষণ সংকটের সঙ্গে যুদ্ধ যোগ হয়ে বৈশ্বিক পরিবেশ এখন চরম এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন।</p> <p>২০১৫ সালে হওয়া প্যারিস চুক্তিতে প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে কিংবা বড়জোর ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে সীমাবদ্ধ রাখার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু কিছু দেশ এটি মানেনি। ফলে এই শতাব্দীতেই তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড অতিক্রম করবে এবং তার অভিঘাতে ওপরে বর্ণিত নানা ধরনের দুর্যোগ আরো কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে ৩০ গিগাটন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বন্ধ করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। যত দিন যাচ্ছে বিষয়টি ততই কঠিন হয়ে পড়ছে।</p> <p>জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বন্ধ করার জন্য ছয়টি ক্ষেত্রে কৌশল অবলম্বনের কথা বলছে। বলা হচ্ছে, এই কৌশলের মাধ্যমে বছরে ৪৫ গিগাটন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বন্ধ করা সম্ভব। এই ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে : শক্তি (১২.৫ গিগাটন নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ও শক্তির অপচয় বন্ধ), শিল্প-কলকারখানা (৭.৩ গিগাটন নিষ্ক্রিয় বা নবায়নযোগ্য শক্তিভিত্তিক গরম ও ঠাণ্ডা পদ্ধতি, শক্তির দক্ষতা বৃদ্ধি, গ্যাস লিকেজ বন্ধ করা), কৃষি ও খাদ্য (৮.৭ গিগাটন পরিবেশবান্ধব কৃষিব্যবস্থা, সুস্থায়ী খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্য অপচয় বন্ধ করা), প্রকৃতিভিত্তিক কৌশল (৫.৯ গিগাটন বনভূমি ধ্বংস বন্ধ করা, বাস্তুতন্ত্র অবনয়ন রুখে দেওয়া ও পুনরুদ্ধার করা), পরিবহন (৪.৭ গিগাটন বিদ্যুত্চালিত গাড়ি, ব্যক্তিগত গাড়ির পরিবর্তে গণপরিবহন, হাঁটা ও সাইকেল ব্যবহার), ভবন ও শহর (৫.৯ গিগাটন সবুজ স্থাপত্য, শক্তি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা, পানি পুনর্ব্যবহার ইত্যাদি)।</p> <p>পৃথিবীতে জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তি হার আশঙ্কাজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। প্রভাবশালী বিজ্ঞান জার্নাল ‘নেচার’ জীববৈচিত্র্যের বর্তমান বিলুপ্তির হার অতীতের তুলনায় বেশি বলে উল্লেখ করেছে (জানুয়ারি ২০২২)। জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ, আবাসস্থল ধ্বংস, অতি আহরণ, পরক (ইনভেসিভ) প্রজাতির আক্রমণ ইত্যাদি কারণে বিভিন্ন ধরনের বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। বিগত কয়েক দশকে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আন্তর্জাতিকভাবে অনেক কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হলেও সেসবের দ্বারা কাঙ্ক্ষিত ফল মেলেনি।</p> <p>প্রতিটি দেশের সরকারকে জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল রক্ষায় সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা এবং তা কঠোরভাবে কার্যকর করা, পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন কার্যক্রম মেনে চলা, জীববৈচিত্র্যের প্রজাতি ও সংখ্যার ওপর মাঠ পর্যায়ে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ তথা গবেষণার জন্য পৃথক জাতীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করাসহ জীববৈচিত্র্যবান্ধব প্রজন্ম সৃষ্টি করা প্রয়োজন। ব্যক্তি পর্যায়ে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, দূষণ ঘটানোর প্রবণতা পরিত্যাগ, জীববৈচিত্র্য অতি আহরণের মানসিকতা এবং তাদের আবাসস্থল ধ্বংসের প্রবণতা বর্জনসহ জীববৈচিত্র্যকে যান্ত্রিক মূল্যে বিচার না করার চেতনা সৃষ্টি করা দরকার।</p> <p>সভ্যতার আরেক অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে দূষণ। জল, স্থল আর বাতাস ক্রমাগত দূষিত হয়ে পড়ছে। এ মাসে (১৭ মে ২০২২) বিখ্যাত বিজ্ঞান জার্নাল ‘ল্যানসেট প্লানেট হেলথ’-এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বিশ্বে দূষণজনিত কারণে বছরে ৯০ লাখ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বলে বলা হয়েছে। বছরে সব থেকে বেশি মৃত্যু (৬৫ থেকে ৭০ লাখ) হচ্ছে বায়ুদূষণের কারণে। দূষণের উৎসগুলো চিহ্নিত করে তা কার্যকরভাবে বন্ধ করা প্রয়োজন।</p> <p>জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি বলছে, প্লাস্টিক দূষণের কারণে আমাদের এই পৃথিবীর দম বন্ধ হয়ে আসছে। একবার ব্যবহারোপযোগী প্লাস্টিক দ্রব্যগুলো ক্ষতিকর প্রমাণিত হওয়ার পরও সেগুলোর ব্যবহারে আমরা নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছি। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির দেওয়া হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে ১০ লাখ প্লাস্টিক বোতল বিক্রি হচ্ছে। প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহৃত হচ্ছে বছরে পাঁচ লাখ কোটি। বছরে প্রায় ৪০ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে বছরে প্রায় ১১০ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হবে। এই মুহূর্তে সমুদ্রে প্রায় ২০ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হয়েছে। মানুষ তথা জীবজগতের জন্য প্লাস্টিক কণা, বিশেষ করে মাইক্রোপ্লাস্টিকস ও ন্যানোপ্লাস্টিকস নানা ধরনের সমস্যা তৈরি করছে। প্লাস্টিকে ব্যবহৃত রাসায়নিক আমাদের শরীরের হরমোনক্রিয়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।</p> <p>প্রধানত জীবাশ্ম জ্বালানি দিয়েই তৈরি হয় প্লাস্টিক। নেচার গ্রুপের জার্নাল ‘নেচার সাসটেইনেবিলিটি’র মতে, প্লাস্টিক শুধু বর্জ্য হিসেবে সমস্যা তৈরি করছে না, তার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ৪.৫ শতাংশ বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাসও তৈরি হচ্ছে। এসব তথ্য প্রকাশের পর পরিবেশবিদদের কপালের ভাঁজ গভীর হচ্ছে। সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির কার্যনির্বাহী পরিচালক ইংগার আন্ডারসন সবাইকে প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য একত্র হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। একবার ব্যবহারোপযোগী প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনা, যত বেশি সম্ভব প্লাস্টিক রিসাইকল করা, শপিংব্যাগ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা এবং পাতলা শপিংব্যাগ উৎপাদন বন্ধ করা, প্লাস্টিক বর্জ্য যত্রতত্র না ফেলা এবং ভাগাড়ে যাওয়ার আগেই তা পৃথক করার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে প্লাস্টিকদূষণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।</p> <p>বাংলাদেশে পরিবেশ সংকট দিন দিন ঘনীভূত হচ্ছে। দেশি-বিদেশি একাধিক প্রতিবেদনে দেশের পরিবেশ সংকটের হালনাগাদ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ দায়ী না হলেও দেশে তার অভিঘাত গুরুতর হয়ে উঠছে। দেশের জলজ ও স্থলজ বাস্তুতন্ত্র হুমকির মুখে। জীববৈচিত্র্য প্রাচুর্য ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। বায়ুদূষণের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ওপরে। দেশের পানি ও মাটিও ভালো নেই। প্লাস্টিকদূষণও বেড়ে যাচ্ছে। প্রবল জনসংখ্যার চাপে দেশের পরিবেশকে ভারসাম্যময় অবস্থায় রাখা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণসহ পরিবেশ সংশ্লিষ্ট নীতিমালা ও আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনাকে নিবিড় গবেষণার আলোকে আরো উন্নত করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রয়োজন পরিবেশ বিষয়ে জনসচেতনতা।</p> <p>আমাদের একটি মাত্র পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখার জন্য বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ, দূষণ হ্রাসকরণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও যুদ্ধ বন্ধ করা প্রয়োজন।</p> <p>লেখক : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়</p>