আমাদের দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে—‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।’ আজ শ্রীলঙ্কায় যে সংকট দেখা দিয়েছে তার মূলে কাজ করেছে দেশটির নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা ও ক্ষমতাকে কুক্ষিগত রাখার লালসা। এই জটিল সংকট দেশটিকে কোথায় নিয়ে যায় কে জানে! দেশটি যে শুধু অর্থনৈতিক সংকটেই পড়েছে তা নয়, রাজনৈতিক পরিস্থিতি ওই সংকটকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছে। এমন দ্বিমুখী সংকটে এই দ্বীপরাষ্ট্রটি আগে কখনো পড়েছে বলে মনে হয় না।
বিক্রমাসিংহে কি সংকট উত্তরণে সক্ষম হবেন
- এ কে এম আতিকুর রহমান
অন্যান্য

রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি, রাষ্ট্র চালনায় দক্ষতা, জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় আন্তরিকতা ও সততা, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে যথাযথ ধারণা এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুসম্পর্ক রক্ষার সক্ষমতা না থাকলে সেই নেতৃত্ব দিয়ে দেশের উন্নয়ন ঘটে না। শুধু শ্রীলঙ্কাই নয়, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের মানুষের মনমানসিকতায় সাধারণত ব্যক্তিস্বার্থের প্রাধান্য অধিক হারে লক্ষ করা যায়। তা অতি সাধারণ একজন মানুষই হোক বা ধনী ক্ষমতাশালী মানুষই হোক।
বিদেশি ঋণ গ্রহণের আগেই চিন্তা করতে হবে। উন্নয়নের নামে অযথা কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত নয়। যে প্রকল্প দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখবে না, অন্যের টাকার কথা বাদই দিলাম, নিজের টাকা দিয়েও সেই প্রকল্প গ্রহণ করা ভুল হবে। ক্ষমতায় থাকার জন্য বা অন্তর্নিহিত অন্য কারণে বিদেশি ঋণের টাকা দিয়ে চোখ-ধাঁধানো উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিতে গিয়ে শ্রীলঙ্কার নেতারা দেশটার এই অবস্থা করেছেন।
শ্রীলঙ্কা হঠাৎ করেই এ পরিস্থিতিতে পড়েনি। বর্তমান সংকটে পৌঁছানোর বীজ বপন করা হয়েছে অনেক দিন আগেই, পূর্ববর্তী কয়েক সরকারের শাসনামলে। ভূ-রাজনীতির বিষয়টিও শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাপ্রেমী নেতৃত্বকে বিপথগামী করে এই সংকট ত্বরান্বিত করেছে। চীনা ঋণের ফাঁদে পড়ে দেশটির নেতৃত্ব আজ শ্রীলঙ্কাকে যে অবস্থায় দাঁড় করিয়েছে সেখান থেকে বের হওয়া সহজ নয়। ক্ষমতা ধরে রাখার আকাঙ্ক্ষা, সরকারে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, নানা অনৈতিক স্বার্থ প্রাপ্তির লোভ এবং দেশ পরিচালনায় ভুল সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা গ্রহণের ফলে রাজাপক্ষে পরিবার দেশটিকে যে অবস্থায় নিয়ে গেছে তার ক্ষতিপূরণ এখন জনগণকে গুনতে হচ্ছে। শ্রীলঙ্কা সরকারের একা এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন।
গত এপ্রিল অবধি শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা পরিশোধ করার ক্ষমতা দেশটির নেই। গত বছরই তাদের ঋণের পরিমাণ ছিল জাতীয় আয়ের চার গুণ। ওই অবস্থায় শ্রীলঙ্কা সরকার নিজেদের প্রথমে দেউলিয়া এবং গত ১২ এপ্রিল ঋণখেলাপি হিসেবে ঘোষণা দেয়। তবে বিদেশি ঋণ ছাড়াও সংকট এতটা ভয়াবহ করার পেছনে সরকারের কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ড দায়ী। যেমন—জাতীয় আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় করা, উল্লেখযোগ্য পরিমাণে করের হার কমানো, মুদ্রার বিনিময়হারের দুরবস্থা বা মূল্যস্ফীতি, রাসায়নিক সারের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ, প্রবাসী শ্রীলঙ্কানদের পাঠানো রেমিট্যান্সে ধস নামা ইত্যাদি। করোনা মহামারির কারণে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন খাত থেকে কোনো আয় আসেনি। তাই এখন জনগণকে খাদ্য সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে, ওষুধের অভাবে চিকিৎসাবিহীন মরতে হচ্ছে, জ্বালানি নেই, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বাতি জ্বলছে না। তারা মাঠে নেমেছে, বিক্ষোভ করছে।
গণ-আন্দোলনের মুখে মাহিন্দা রাজাপক্ষে পদত্যাগ করলে ১২ মে রনিল বিক্রমাসিংহেকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৬ মে জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে বলেন, দেশে জ্বালানি ও ওষুধের অভাব রয়েছে। মজুদ জ্বালানি দিয়ে হয়তো এক দিন চলা যাবে। কয়েক দিনের মধ্যে কমপক্ষে ৭৫ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থান করতে হবে এসব কেনার জন্য। তিনি বলেন, ‘আমি দেশকে বাঁচাতে এসেছি; ব্যক্তি, পরিবার বা গোষ্ঠীকে নয়।’ তবে এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক থেকে ১৬০ মিলিয়ন ডলার পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ভারত তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। তারা ৬৫ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার সরবরাহ করার ঘোষণাও দিয়েছে।
বিরোধী কয়েকটি দল প্রথম থেকেই রনিল বিক্রমাসিংহেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগে বিরোধিতা করে আসছে। তারা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রিসভায় যোগদানে অস্বীকৃতি প্রকাশ করে দাবি করে, রনিল বিক্রমাসিংহের নিয়োগে ভারতের হাত রয়েছে। অবশ্য ভারত এ দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। যা হোক গত কয়েক দিনে বিরোধী দলগুলোর অনেক নেতার মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। তাঁদের কেউ কেউ বর্তমান সরকারকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছেন। সময় ও উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রয়োজনে শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যদি কোনো পরিবর্তন ঘটে তাতে আশ্চর্য হওয়ারও কিছু থাকবে না।
এদিকে ১৭ মে অনুষ্ঠিত সংসদ অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার ক্ষমতায় থাকা না থাকার ব্যাপারে ‘নো কনফিডেন্স মোশন’-এর ওপর ভোটাভুটিতে তিনি পার (পক্ষে ১১৯ এবং বিপক্ষে ৬৮ ভোট) পেয়ে গেলেও তাঁর পদত্যাগের দাবিতে জনতার বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। তবে তিনি যদি ক্ষমতায় থাকার জন্য অন্য কোনো উপায়ের অর্থাৎ সামরিক শাসন জারির কথা চিন্তা করেন, সেটি বড়ই ভুল হবে। বিশ্বের বা দেশের মানুষের কাছে তা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হবে না, বিদ্যমান সংকট আরো অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে।
ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির নেতা রনিল বিক্রমাসিংহে এর আগে পাঁচবার শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৭ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৯ সালে সংসদ নেতা মনোনীত হওয়ার আগে তিনি বিভিন্ন সময়ে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। তামিল টাইগারদের হাতে প্রধানমন্ত্রী প্রেমাদাসা নিহত হলে ১৯৯৩ সালের ৭ মে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই সময় তিনি শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ২০০১-০৪ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে শ্রীলঙ্কার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেন। সেই সময় শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটে তাঁদের থেকে সহযোগিতাও পাওয়া যায়। ২০০২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এলটিটিইর সঙ্গে বিদ্যমান সংঘাত বন্ধে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ওই চুক্তির বিরুদ্ধে বিরোধী দল ও জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো মাঠে নামে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে প্রেসিডেন্ট কুমারাতুঙ্গা ২০০৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সংসদ ভেঙে দেন।
রনিল বিক্রমাসিংহে ২০১৫ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন। ২০১৬ সালে বৈদেশিক ঋণে ভারাক্রান্ত শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক সংকটে পড়লে তাঁর সরকার আইএমএফ থেকে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের সংস্থান করা ছাড়াও করহার বৃদ্ধি করে। চীনা ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এ অবস্থায় ২০১৭ সালে নবনির্মিত হাম্বানটোটা বন্দরটিকে ৯৯ বছরের জন্য চীনের একটি কম্পানিকে লিজ দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে ঋণের বকেয়া কিস্তি পরিশোধের জন্য চীনের কাছ থেকে আরো এক বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়া হয়।
২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট তাঁকে বাদ দিয়ে মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করলে তিনি আদালতের শরণাপন্ন হন এবং প্রধানমন্ত্রিত্ব রক্ষা করেন। প্রধানমন্ত্রী রনিল ওই সময় শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আয়বৈষম্য কমানো, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ২০২০ সালের নির্বাচনে রনিল বিক্রমাসিংহের দলের ভরাডুবি হয়, একটি আসনেও তারা বিজয়ী হতে ব্যর্থ হয়। তবে বিশেষ বিবেচনায় (ন্যাশনালিস্ট নিয়ম অনুযায়ী) ২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি তিনি সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ পান।
প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের দেশ পরিচালনা করার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। শ্রীলঙ্কার অনেক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটও তিনি মোকাবেলা করেছেন। সেই অভিজ্ঞতার সঞ্চয় নিয়ে তাঁকে এগোতে হবে। মন্ত্রিপরিষদে যাঁরাই অন্তর্ভুক্ত হন না কেন তাঁদেরও শপথ নিতে হবে একই লক্ষ্য অর্জনের জন্য, অর্থাৎ বর্তমান সংকট থেকে শ্রীলঙ্কাকে বের করে আনা। এ ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব একাধিক দলের অভিজ্ঞ নেতাদের সমন্বয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করা গেলে বিদ্যমান রাজনৈতিক সহিংসতা সামাল দেওয়াসহ অন্য চ্যালেঞ্জগুলো থেকে উত্তরণ সহজ হবে। জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে যেন এটি করা যায় সেদিকে জোর দিতে হবে। বর্তমানে দলীয় স্বার্থের কথা ভুলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
দেশে বিদ্যমান খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোসহ অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে জোরদার করতে হবে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যায়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলমান রাখা অত্যন্ত জরুরি। চীন সরকারের সঙ্গে ঋণ পরিশোধের একটা গ্রহণযোগ্য ও সুবিধাজনক সিদ্ধান্তে আসতে হবে। ভারতকে এড়িয়ে চলা শ্রীলঙ্কার জন্য মন্দ বই ভালো হবে না। নিজেদের স্বার্থেই দুই দেশের শক্তিশালী সম্পর্ক বজায় রাখা অপরিহার্য।
সার্বিক বিবেচনায় এ সংকট উত্তরণে বিক্ষোভের চেয়ে ঐক্যের প্রয়োজন অনেক বেশি। দল-মত-নির্বিশেষে জনগণ ও সরকারকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে। মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্নয়নের মধ্যেই নিহিত রয়েছে দেশের অর্থনৈতিক সংকটের উত্তরণ। তাই শ্রীলঙ্কার বর্তমান সরকারকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা স্থাপনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের প্রতি জোর দিতে হবে। সরকার প্রত্যাশিত আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সহযোগিতা লাভে সফল হলে শ্রীলঙ্কার আকাশে ঘনীভূত মেঘ অবশ্যই ধীরে ধীরে কেটে যাবে।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব
সম্পর্কিত খবর

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান
- তুহিন খান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?
গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।
গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।
জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থান—এই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কার—সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘মব’ শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবে—এসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন
- ড. নিয়াজ আহম্মেদ

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ছাড়া গত বছরের গণ-আন্দোলনে তিন-চার মাস আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের এইচএসসি নামক পাবলিক পরীক্ষা। কোনো কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে আমাদের ভর্তি কার্যক্রমও পিছিয়ে যায়।
আমরা যদি জানুয়ারি মাসে এসএসসি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জুলাই মাসে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
উচ্চশিক্ষা যেহেতু বহু রকমের, সেহেতু এখানেও অনেক বিষয় রয়েছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই তারা বেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরীক্ষায় ভর্তি নিতে পারত, তাহলেও সময় বাঁচত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমাদের মানে শিক্ষকদের এখানে করণীয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রতিবছর একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর কার্যক্রম সম্পন্ন করি। ফলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে সমস্যা নেই। ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এক মাসের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পুরো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব।
আমাদের কাছে মনে হয়, সরকারের আন্তরিকতা এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা এখানে মুখ্য বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কতটা সহজে এবং দ্রুত আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারি। আমাদের টার্গেট যদি থাকে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করা, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী কাজটি করতে হবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দেবে, অন্যদিকে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করব। সরকার যদি পাবলিক পরীক্ষা আগে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে আমরাও দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারব। ধরুন, এখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, সেপ্টেম্বরে ফলাফল প্রকাশিত হবে। আমরা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারি। তিন মাসে কি ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যথেষ্ট নয়? আমাদের দরকার সরকারের ইচ্ছা এবং সবচেয়ে বড় দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা। আমরা আশা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন জানুয়ারি মাসেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
nahmed1973@gmail.com

কজন জানে জুলাই সনদ কী
- গাজীউল হাসান খান

সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।
এ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ
- ড. মো. ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।
রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।
জুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।
এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।
‘যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।
বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।
এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।
তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।
এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।
সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd