<p>প্রথমবারের মতো ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের জন্য ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা গুচ্ছ পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়, যা শুরুতে সবার বিবেচনায় ইতিবাচক ছিল। কিন্তু বাস্তবে অনেক অসংগতি লক্ষ করা গেছে। গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা কার্যক্রমের নেতৃত্বে ছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অংশগ্রহণ করবে কি না সন্দেহ রয়েছে। এ ছাড়া বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো না আসায় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা শতভাগ সফল হয়নি। কারণ গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় কোনো শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করলেও বড় চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ফলে ভোগান্তি কমেনি। শিক্ষার্থীদের আর্থিক সাশ্রয়ও হয়নি। কারণ একবার গুচ্ছ ভর্তিতে আবেদনের জন্য এক হাজার ২০০ টাকা দিতে হয়েছে। তারপর প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথকভাবে আবেদনের জন্য আবার ৪০০ বা ৬৫০ টাকা দিতে হয়েছে শুধু একেকটি ইউনিটে। এ ছাড়া মৌখিক পরীক্ষা দিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়েছে, যা এক অন্য ধরনের ভোগান্তি। যেমন—একজন শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফি বাবদ ১১ হাজার বা ১২ হাজার টাকা দিয়ে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন। যাতায়াত এবং অন্যান্য খরচও তাঁকে বহন করতে হয়েছে। পরে ওই শিক্ষার্থী আবার অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো বিষয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। অর্থাৎ আগের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বাতিল করে আবার ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। অর্থাৎ ভোগান্তি, আর্থিক সাশ্রয় এবং কষ্ট কোনোটাই হ্রাস পায়নি।</p> <p>বর্তমানে নতুন জটিলতা তৈরি হয়েছে। কারণ প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমবেশি আসন খালি রয়েছে। অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে বহুবার সাক্ষাৎকার নিয়েও ভর্তি সম্পন্ন করতে পারেনি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। ২০ মার্চ ২০২২ তারিখের তথ্য অনুযায়ী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনসংখ্যা খালি রয়েছে ২৬৭টি, যা ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত আসনসংখ্যার প্রায় ১৩ শতাংশ। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন খালি আছে ২০০টির মতো, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১২টি, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫০টি, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০টি এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন খালি আছে ২০০ বা এরও বেশি। তবে উল্লিখিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম চলমান। কারণ কর্তৃপক্ষ চাচ্ছে আসনসংখ্যা পূরণ করে ভর্তি সম্পন্ন করতে। আমার কর্মস্থল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০টির মতো আসন খালি রয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষ এত আসন খালি রেখে ভর্তি কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করেছে, যদিও এই সিদ্ধান্তের পেছনে অনেক যৌক্তিক কারণ রয়েছে। যেমন—অনেক বিভাগে মিডটার্ম পরীক্ষা নেওয়ার সময় হয়ে আসছে। এখন যদি নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি নেয়, তাহলে একাডেমিক ক্যালেন্ডার বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়বে।</p> <p>তবে এর পরও কিছু কথা থেকেই যায়। কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে জনগণের টাকায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একেকটি আসন একটি স্বপ্নের মতো। কারণ একজন শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলে তার জীবন ও ক্যারিয়ার পর্যন্ত পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে, যা তাঁকে দেশ ও সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সহযোগিতা করে থাকবে। তাই মনে করি, সব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটু বিভাগগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে আসনসংখ্যা খালি না রেখে ভর্তি সম্পন্ন করাই ভালো। একই পরিমাণ সম্পদ ব্যবহার করে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীকে ভর্তির সুযোগ দিয়ে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার অধিকার দেওয়া যুক্তিযুক্ত।</p> <p>তবে অতীতে শিক্ষার্থীরা বড় চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতেন। এগুলোতে সুযোগ না হলে তাঁদের ঘুরতে হতো সারা দেশে। এখন গুচ্ছ পদ্ধতি আশপাশের কোনো কেন্দ্রে বসে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ করে দিয়েছে শিক্ষার্থীদের। এটি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার ইতিবাচক দিক।</p> <p>কিন্তু শিক্ষকরা গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কারণ প্রতিটি কক্ষে প্রধান পরিদর্শক রাখা হয়নি, রাখা হয়েছে ফ্লোর ইনচার্জ। ফলে সমন্বয়হীনতা দেখা গেছে। একই সময় দুটি কক্ষে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তখন ফ্লোর ইনচার্জ বেকায়দায় পড়ে যান। তাই প্রতি কক্ষে প্রধান পরিদর্শক থাকলে এ সমস্যা হবে না এবং ফ্লোর ইনচার্জ রাখার কোনো প্রয়োজন নেই।</p> <p>এ ছাড়া গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার নেতিবাচক দিক হলো, যদি কোনো এক শিক্ষার্থী দুর্ঘটনাবশত পরীক্ষা দিতে না পারেন বা পরীক্ষায় বেশি খারাপ করে ফেলেন, তাহলে তাঁর গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ আর থাকবে না। আগে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা খারাপ করলেও আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ভালো পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি হওয়ার সুযোগ মিলত। পছন্দক্রম অনুযায়ী আসন না পড়ায় ভর্তীচ্ছুদের বড় একটি অংশ আসনবিন্যাসের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। আবার অনেকে মনে করছেন, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়কে আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার ঝুঁকি রয়েছে। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় অনেক অসংগতি রয়েছে। তাই এসব অসংগতি এবং সমন্বয়হীনতা দূর করে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা বাস্তবায়ন করা উচিত।   </p> <p>দেশে অনুমোদিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫১টি বা এর বেশি। ২০টি সাধারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা, তিন প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা। এ ছাড়া কৃষি ও কৃষিপ্রধান সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা গুচ্ছ পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়। অন্যদিকে বুয়েটসহ বড় পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা আলাদা তারিখে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি প্রকৃতপক্ষে ওই রকম হ্রাস পাচ্ছে না। অর্থাৎ গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা সফল হবে তখনই, যখন একটি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হবে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।</p> <p>শিক্ষার্থীদের প্রাপ্ত স্কোর এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবজেক্ট পছন্দক্রমের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয়ভাবে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার মতো প্রত্যেক আবেদনকারীকে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয়ে চান্স পেয়েছেন, তা নির্ধারণ করে দিলেই অনেক সমস্যার সমাধান সহজেই হতো। ফলে শিক্ষার্থীদের হয়রানি কমে যেত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রমে জটিলতা কমে আসত। তাহলে এই ধরনের আসন খালি রেখে ভর্তিপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হতো না এবং বারবার অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে সাক্ষাৎকার নিয়ে ভর্তি কার্যক্রম শেষ করার প্রয়োজন ছিল না। তাই প্রশ্ন থেকেই যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা সফল কি?</p> <p> লেখক : সাবেক সভাপতি, শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম</p> <p>বিশ্ববিদ্যালয় (জাককানইবি), ত্রিশাল, ময়মনসিংহ</p>