<p>জলাভূমিকে পৃথিবীর কিডনি বলে অভিহিত করা হয়। মানুষের দেহে বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় তৈরি বর্জ্য যেমন কিডনির মাধ্যমে পরিষ্কার হয়, তেমনি পৃথিবীর অনেক বর্জ্য পরিষ্কার হয় জলাভূমির মাধ্যমেই। অসংখ্য স্থলজ ও জলজ প্রজাতির খাদ্য জলাভূমিতে বেশি পরিমাণ থাকার কারণে এখানকার জীববৈচিত্র্য জলাভূমিসংলগ্ন অন্যান্য বাস্তুতন্ত্রের চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ হয়। জলাভূমি নানা ধরনের অজৈব পুষ্টি পদার্থ ও বায়ুমণ্ডলীয় কার্বনের আধার হিসেবে কাজ করে। অনেক বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির বাসস্থান এই জলাভূমি। বন্যার পানি ধারণ, উপকূলরেখাকে রক্ষা ও ভূগর্ভস্থ জলাধার পুনর্ভরাট করে জলাভূমি। খাদ্য উৎপাদন, সেচ, পর্যটন, বিনোদন, কর্মসংস্থান ও সুস্থায়ী জীবিকা তথা পানি নিরাপত্তার জন্য জলাভূমি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে জলাভূমি মানুষ তথা জীবজগৎ ও প্রকৃতির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এক বাস্তুতন্ত্র।</p> <p>জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অষ্টাদশ শতক থেকে বর্তমান পর্যন্ত পৃথিবীর প্রায় ৮৫ শতাংশ জলাভূমি হারিয়ে গেছে। মূলত কৃষি, বসবাসের জন্য বাড়িঘর তৈরি, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও শিল্প-কারখানা তৈরির প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর নানা জায়গায় জলাভূমিকে ধ্বংস করা হয়েছে। প্রভাবশালী বিজ্ঞান জার্নাল নেচার গ্রুপের অন্যতম জার্নাল নেচার জিওসায়েন্সের সম্পাদকীয়তে বিগত ৫০ বছরে পৃথিবীর বুক থেকে প্রায় ৩৫ শতাংশ জলাভূমি হারিয়ে যাওয়ার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে (৮ মার্চ ২০২১)।</p> <p>বিশ্বের নানা স্থানে জলাভূমি রক্ষায় ১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক স্তরে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইরানের রামসার শহরে এই চুক্তি সম্পাদিত হওয়ায় এটি ‘রামসার কনভেনশন’ নামে পরিচিত। সেই সময় রামসার শহরে ১৮টি দেশ উপস্থিত হয়ে এই চুক্তি সম্পন্ন করে। এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বব্যাপী জলাভূমি ও তার জীববৈচিত্র্য রক্ষা। বাংলাদেশসহ বর্তমানে এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশের সংখ্যা ১৭১।</p> <p>জলাভূমির মূল্য ও উপকার বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি এবং এর সংরক্ষণ ও যৌক্তিক ব্যবহার সম্পর্কে প্রচারের জন্য ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতিবছর ২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব জলাভূমি দিবস পালন করা হচ্ছে। এ বছর এই দিবসের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে, ‘মানুষ ও প্রকৃতির জন্য জলাভূমি কার্যক্রম।’ এই প্রতিপাদ্যের সঙ্গে জলাভূমি হারিয়ে যাওয়া বন্ধ করতে এবং অবনমিত জলাভূমি পুনরুদ্ধারে আর্থিক, মানবসম্পদ ও রাজনৈতিক মূলধন বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয়েছে।</p> <p>একসময় জলাভূমিকে নিয়ে মানুষের মধ্যে নানা রকম কুসংস্কার ছিল। জলাভূমিকে অমঙ্গলের প্রতীক হিসেবে ভাবা হতো। মানুষ জলাভূমিকে ভয় করত। জলাভূমির ঝোপঝাড়, পানি কিংবা গভীর কাদার মধ্য থেকে মানুষ কোনো কোনো সময় নিরুদ্দেশ হয়ে যেত। অনেক সময় এখান থেকে নানা ধরনের প্রাণীর আক্রমণের শিকার হতো মানুষ। অনেকে ভাবত, জলাভূমি মানেই ভূতের আড্ডাভরা স্থান। বন্যার ভয় তো ছিলই। জলাভূমিকে ‘খারাপ বাতাস’-এর উৎস হিসেবেও বিবেচনা করা হতো। বিশেষ করে ম্যালেরিয়ার জন্য নিকটস্থ জলাভূমিকে দায়ী করা হতো। এসব কারণে একসময় মানুষের মধ্যে জলাভূমিবিরোধী মনোভাব শিকড় গেড়েছিল। জুলিয়াস সিজার থেকে মুসোলিনি—অতীতে অনেক রাষ্ট্রনেতা জলাভূমি ধ্বংসের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। জলাভূমি থাকা বা না থাকাকে কেন্দ্র করে কোথাও কোথাও ভোটের রাজনীতিও করা হয়েছে।</p> <p>সাম্প্রতিক সময়ে রামসার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত পৃথিবীর অন্যতম বড় জলাভূমি ব্রাজিলের প্যানসেনাল ম্যাটুগ্রোয়োসো ন্যাশনাল পার্কে আগুন লাগিয়ে বড় ধরনের ক্ষতি করা হয়েছে। নামিবিয়া ও বতসোয়ানায় তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য অনুমোদন দেওয়ায় সেখানকার বিখ্যাত আইকনসদৃশ জলাভূমি ওকাভাঙ্গ ডেল্টা হুমকিগ্রস্ত হতে চলেছে। বিগত দুই দশকে চীনে অনেক জলাভূমি ধ্বংস করা হয়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীতে বর্তমানে মোট জলাভূমির পরিমাণ ১৫০ থেকে ১৬০ কোটি হেক্টর। কিন্তু বেশির ভাগ জলাভূমির গুণগত মান এখন ভালো নেই। বিশেষ করে নানা ধরনের বিপুল পরিমাণ দূষিত পদার্থ মিশে এসব জলাভূমি অনেক জায়গায় মানুষের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করেছে। জলাভূমির জন্য প্লাস্টিক বর্জ্যও বড় ধরনের হুমকি তৈরি করে চলেছে। মানুষের কিডনির ওপর তার ক্ষমতার অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগে যেমন তা বিকল হয়, তেমনি জলাভূমি পৃথিবীর কিডনি হিসেবে কাজ করলেও মানবসৃষ্ট নানা ধরনের বিপুল পরিমাণ বর্জ্যে তার ক্ষতি হচ্ছে।</p> <p>পৃথিবীর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জলাভূমিতে ফসলে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও নর্দমার বর্জ্য নানাভাবে গিয়ে মেশে। বিগত কয়েক দশকে এর পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। এসব থেকে অনেক সময় ফসফেট, নাইট্রোজেন বা অন্য ধরনের রাসায়নিক বিপুল পরিমাণে জলাভূমিতে যাওয়ার ফলে সেখানে হঠাৎ করে পুষ্টির আধিক্য ঘটে। তখন শৈবাল ও ক্ষুদ্র জীবের ঘনত্ব অতি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং পানির অক্সিজেন মারাত্মকভাবে কমে যায়। এই প্রক্রিয়াকে ‘ইউট্রোফিকেশন’ বলা হয়। এ অবস্থায় মাছসহ জলচর প্রাণীর মৃত্যু ঘটে এবং গোটা জলাভূমিকে ‘মৃত অঞ্চল’ (ডেড জোন) বলে চিহ্নিত করা হয়। রামসার সচিবলায় থেকে ২০২১ সালে প্রকাশিত একটি পুস্তিকায় পৃথিবীর প্রায় ৭০০ উপকূলীয় এলাকায় উপরোক্ত মৃত অঞ্চলের অভিঘাত প্রকট হতে চলেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্র পানির অম্লতা বৃদ্ধিজনিত সমস্যা। কাজেই রামসার কনভেনশনে স্বাক্ষর করা প্রতিটি দেশের জলাভূমি রক্ষায় আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন।</p> <p>বাংলাদেশের রয়েছে বিশাল জলাভূমি। নদী, মোহনা, ম্যানগ্রোভ, হাওর, বাঁওড়, বিল, জলাধার, দিঘি, পুকুর ইত্যাদি মিলিয়ে কয়েকটি প্রকাশনায় বাংলাদেশে জলাভূমির আয়তন ৭০ থেকে ৮০ হাজার বর্গকিলোমিটার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ দেশের মোট আয়তনের অর্ধেকের মতো হচ্ছে জলাভূমি। তবে একসময় বাংলাদেশে জলাভূমির আয়তন ছিল আরো অনেক বেশি। বাংলাদেশের জলাভূমিকে প্রাথমিকভাবে নোনা পানির জলাভূমি, স্বাদু পানির জলাভূমি ও মানবসৃষ্ট জলাভূমি–এই তিনভাগে ভাগ করা হয়। দেশের অর্থনীতি, শিল্প, বাস্তুতাত্ত্বিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বিশাল এই জলাভূমির গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের বাস্তুতান্ত্রিক সেবার পরিমাপে জলাভূমির অবস্থান সর্বাগ্রে। কাজেই একে সংরক্ষণ করার জন্য আর্থিক, মানবসম্পদ ও রাজনৈতিক মূলধন বিনিয়োগ প্রয়োজন।</p> <p>২০১৬ সালে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর’ গঠিত হয় এবং এই সাল থেকেই অধিদপ্তরটি তার কার্যক্রম শুরু করে। এই অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে ‘জলাভূমি সুরক্ষা, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন’ সম্পর্কিত একটি আইনের খসড়া প্রণয়ন বিষয়ক সভার বিজ্ঞপ্তি থেকে ধারণা করা যায় যে দেশে জলাভূমিসংক্রান্ত একটি আইন হতে যাচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। সময়োপযোগীও বটে। আইনটি তৈরির কোনো এক ধাপে সাধারণ মানুষের পরামর্শ সংগ্রহ ও সেগুলো পর্যালোচনা করা যেতে পারে।</p> <p>দেশের অনেক জলাভূমিতে সরকারি সম্পত্তি। নানা কারণে সেগুলো বেদখল হয়ে আছে। দখলকারীরা সেসব থেকে নির্দয়ভাবে সম্পদ আহরণ করার ফলে সেখানকার মৎস্যসহ অন্যান্য জীববৈচিত্র্যের সুস্থায়ী সংরক্ষণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে শুকনা মৌসুমের শুরুতে দখলকারীদের মৎস্য আহরণের সর্বগ্রাসী মনোভাব জলাভূমির জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। এসব জলাভূমিতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় মৎস্যসহ অন্যান্য প্রাণী সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। পাশের দেশ ভারতে এটি করা হয়েছে। জলাভূমির মধ্যে রাস্তাঘাট, শিল্প-কারখানা, বাড়িঘর ও স্থাপনা নির্মাণে নিরুৎসাহ করা দরকার। আশা করা যায়, এগুলো বিবেচনায় নিয়ে ‘জলাভূমি সুরক্ষা, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন’ পাস ও তা কার্যকরভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের জলাভূমি সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। বর্তমানে রামসার সাইটে তালিকাভুক্ত সুন্দরবন ও টাঙ্গুয়ার হাওর ছাড়াও সেখানে আরো দু-একটি জলাভূমি অন্তর্ভুক্তির বিষয় পর্যালোচনা করা যেতে পারে।</p> <p>জলাভূমিকে শুধু যান্ত্রিক মূল্যে (ইনস্ট্রুমেন্টাল ভ্যালু) বিচার করলে হবে না, তার অন্তর্নিহিত মূল্যকেও (ইনট্রিনসিক ভ্যালু) বিবেচনায় নিতে হবে। ৩৫ থেকে ৪০ কোটি বছর আগে ডিভোনিয়ান সময়ে সৃষ্টি হয়ে বিবর্তনের ধারায় রূপ নেওয়া বর্তমান জলাভূমি শুধু মানুষের জন্য নয়, অন্যান্য জীব তথা প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যও প্রয়োজন।</p> <p>লেখক : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়</p> <p> </p>