<p>২৬ বছর আগে, ১৯৯৫ সালের ১৩ জুলাই তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হক আপিল বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে তাঁর নিজের বক্তব্য পেশ করতেই আদালতকক্ষে ঢলে পড়েন। উপস্থিত এজলাসকক্ষ এমন ঘটনায় তাত্ক্ষণিকভাবে মুলতবি ঘোষণা করে জরুরি ভিত্তিতে তাঁকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে বাংলাদেশের আইন অঙ্গনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলো নিভে গেছে। যে মামলা চলমান অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন, সেটি ছিল ১৯৮৭ সালে তৎকালীন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতাকালে একটি পাঁচতারা হোটেল নির্মাণ প্রসঙ্গে। তবে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা প্রায় সবাই বাংলাদেশের ইতিহাসে বিখ্যাত ও কুখ্যাত। সে সময় হংকংয়ে ট্রেড কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারী মেজর শরিফুল হক ডালিম, যাঁর স্বাক্ষরিত একটি চিঠি শিল্প মন্ত্রণালয়ে আসে বাংলাদেশে হোটেল হোল্ডিংস লিমিটেডের পক্ষে হোটেলের জায়গা বরাদ্দের জন্য। সেনা সরকারের ওপরমহলের চাপে তড়িঘড়ি জায়গা বরাদ্দের চিঠি আমলাতন্ত্রের দীর্ঘসূত্রতা এড়িয়ে সরাসরি চলে যায় এরশাদের হাতে। শর্ত দেওয়া হয়, এক হাজার আসনের একটি কনভেনশন হল রাষ্ট্রপতির জন্য সংরক্ষিত রাখলেই ছাড়পত্র মিলবে। প্রকল্পের স্থান নির্ধারণ করা হয় বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর দিকে নির্মাণাধীন অংশে। পাশাপাশি জমির মূল্য ধরা হয় মূল বাজারদরের অনেক কম, যাতে বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে রাষ্ট্রকে। তাই রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরোর কর্মকর্তা আতাহার আলী বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় একটি ফৌজদারি মামলা করেন। দণ্ডবিধি ৪০৯/১০৯ তৎসহ ৫(২) প্রিভেনশন অব করাপশনের এই মামলায় হাইকোর্টে বিচারপতি নইমউদ্দিন আহমেদ ও মো. রুহুল আমিনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে বিভক্ত রায় আসে। পরে তৃতীয় বিচারপতি এ এম মাহমুদুর রহমানের একক বেঞ্চে মূল মামলায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়ের করা অংশ অক্ষুণ্ন রাখা সাপেক্ষে নিষ্পত্তি হয়। উল্লেখ্য, সেই দায়ী ব্যক্তিদের দলে প্রয়াত ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদও ছিলেন। সময় পরিক্রমায় বাংলাদেশে তখন নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায়। বিএনপি শাসিত এই সরকারের শিল্পমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তিনি হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতাসীন সরকারের শিল্পমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সরকারপক্ষীয় আইনজীবীরা নানা অজুহাতে সময়ক্ষেপণ করে মামলার গতি পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। ১৩ জুলাই দিনটিতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অথচ একজন অকুতোভয় আইনজীবী হিসেবে আমিনুল হক এই মামলায় বিবাদীকে সময় দেওয়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি কখনোই অন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেননি, প্রতিপক্ষ যতই ক্ষমতাধর হোক না কেন। এই মামলায় তাঁর উপস্থাপিত যুক্তিতর্কের নিরিখে পরবর্তী সময়ে ২.১১.১৯৯৫ সালে আপিল বিভাগের বিচারপতি মোস্তফা কামাল শিল্প মন্ত্রণালয়ের আপিলটি খারিজ করে দিয়ে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। সংগত কারণেই আদালত অঙ্গনে এবং প্রবীণ আইনজীবীদের মধ্যে এমন মামলা উদাহরণ হয়ে আছে আজও।</p> <p>১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চলা গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে দেশের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় আইনজীবী আমিনুল হক তিন দলের মনোনীত ব্যক্তি হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেলের পদে নিয়োগ পান এবং বিএনপি সরকার শপথগ্রহণের পর পদত্যাগপত্র জমা দিলে সেটি গৃহীত হয়নি। পরবর্তী পাঁচ বছর তিনি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে এই পদে আসীন ছিলেন এবং জীবনের শেষ দিনটিও তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে অন্যায়ের বিরুদ্ধেই নিজের অবস্থান সমুন্নত রাখেন। মানবাধিকার রক্ষায় ও সাধারণ মানুষের আইনগত অধিকার রক্ষায় তাঁর ব্রত একসময় তাঁকে পিপলস অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে পরিচিত করে।</p> <p>জনাব আমিনুল হক ও তাঁর পরিবারের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তিনি ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের ছোট ভাই এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে জাতির পিতা নিজে তাঁর বাসভবন এলিফ্যান্ট রোডের চিত্রা হাউসে সার্জেন্ট জহুরের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করতে আসেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা সপরিবারে নির্মমভাবে প্রাণ হারালেও তিনি এই দল ও তাঁর পরিবারের জীবিত সদস্য হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নানা আইনি সহায়তা দেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অনেক মুক্তিযোদ্ধা তৎকালীন স্বৈরাচারী মোশতাক সরকারের রোষানলে পড়েন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন টাঙ্গাইলের বিশ্বজিত নন্দী। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত হন; কিন্তু আইনজীবী আমিনুল হক তাঁকে বেকসুর খালাস করেন। ১৯৮৯ সালে বিশ্বজিত নন্দীর মুক্তির দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে তাঁকে অভিবাদনের জন্য উপস্থিত ছিলেন। পরে বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দ্বারা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর নানা ধরনের অন্যায় চলে, যার বিরুদ্ধে আইনি সহায়তা দেন এই আইনজীবী। ১৯৮৮ সালে বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল ফারুক আহমেদের গঠিত রাজনৈতিক দল ফ্রিডম পার্টির একটি ট্রাক মিছিলে বোমা হামলার অভিযোগে অরুণ নামের এক আওয়ামী লীগ কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে পুুুলিশ হেফাজতে তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। উল্লেখ্য, সেই একই স্থানে আওয়ামী লীগেরও পথসভা ছিল এবং এই গ্রেপ্তার তাদের কর্মসূচি ব্যাহত করে। পুলিশের বিরুদ্ধে হওয়া এই মামলায় আপসের জন্য আইনজীবী আমিনুল হককে নানা ধরনের চাপ প্রয়োগ করা হলেও তিনি আপস করেননি। ‘আমাকে গুলি করে হত্যা করা হলেও আমি আপস করব না’ এই ছিল সেদিন তাঁর প্রতিক্রিয়া। অতঃপর আসামিদের ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয় এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে জনাব আমিনুল হকের সম্পর্ক আরো গভীর হয়।</p> <p>মুক্তিযোদ্ধা ও অকুতোভয় এই আইনজীবীর প্রয়াণ দিবসে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাঁর আদর্শ ও চেতনা আমার মতো তাঁর অন্য সহকারীদের বাংলাদেশের আইন অঙ্গনকে সাধারণ মানুষের সেবায় নিয়োজিত করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। বরেণ্য এই আইনজীবী বাংলাদেশের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকুন—এমন প্রত্যাশাই ব্যক্ত করি।</p> <p>লেখক : বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগ</p> <p>বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট</p>