<p>১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, আজ তা বিশ্বমানবের গৌরবান্বিত ঐতিহ্য। বাংলাদেশের ভূগোল ছাড়িয়ে ৭ই মার্চের ভাষণ আজ সমগ্র পৃথিবীতে পরিব্যাপ্ত। একটি ভাষণ একটি জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দিয়েছে—বিশ্ব ইতিহাসেই এমন দ্বিতীয় কোনো দৃষ্টান্ত নেই। বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দীতে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ নানা দৃষ্টিকোণে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে—এ কথা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যেমন সত্য, তেমনি সত্য বিশ্ব প্রেক্ষাপটেও।</p> <p>একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়, যুদ্ধকালীন ৯ মাসে, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি ছিল বাঙালির কাছে অনুপ্রাণনার অন্তহীন উৎস—মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনপণ অভিযানের শ্রেষ্ঠতম পাথেয়। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ আর জয় বাংলা ধ্বনি সেদিন রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃসাহসিক সব অভিযানের সময় অন্তহীন শক্তি সঞ্চার করেছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার-নিষ্ঠুরতা-মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বাঙালির কাছে, মুক্তিবাহিনীর কাছে ছিল চরম ও পরম দিকনির্দেশনা। ‘বঙ্গবন্ধু’ আর ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি একাত্তরে ঔপনিবেশিক হানাদার বাহিনীর কাছে সেদিন দেখা দিয়েছিল মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে। হাজার বছরের অপেক্ষার শেষে ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসেই দেখা দিয়েছিল ঐতিহাসিক এক ম্যাগনাকার্টা রূপে, মুক্তি আর স্বাধীনতার চিরায়ত এক চার্টার হয়ে। একটি ভাষণ গোটা জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছে স্বাধীনতার স্বপ্নে, মুক্তির সংগ্রামে। একটি ভাষণ বাঙালির ঘরে ঘরে প্রতিটি বাঙালির অন্তরে পৌঁছে দিল স্বাধীনতার বার্তা। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এ সূত্রেই অনন্য, অতুলনীয় ও ঐতিহাসিক। ভাষণটি ছিল একটি জাতিরাষ্ট্র নির্মাণের মৌন শক্তি ও রাজনৈতিক দর্শন। অন্যদিকে তা জাগ্রত করেছিল গোটা জাতিসত্তাকে—বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সব নৃগোষ্ঠীর মানুষকে। পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষণের সঙ্গেই তাই বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের তুলনা হয় না। প্রসঙ্গত, আমরা আব্রাহম লিংকন, প্যাট্রিক হেনরি কিংবা মার্টিন লুথার কিংয়ের ভাষণের কথা বলতে পারি। এই তিনজনের ভাষণও বিশ্ব ইতিহাসের অসামান্য গৌরবোজ্জ্বল ভাষণ। প্যাট্রিক হেনরির ‘Give me liberty, or give me death’ (১৭৭৫), আব্রাহম লিংকনের ‘Gettysburg address’ (১৮৬৩) কিংবা মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘I have a Dream’ (১৯৬৩) ভাষণত্রয় মানুষকে জাগ্রত করেছে; কিন্তু জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টি করেনি। প্যাট্রিক হেনরি ভাষণ দিয়েছিলেন বিপ্লবী যুদ্ধের জন্য, ভার্জিনীয় সেনা সরবরাহের জন্য; আব্রাহাম লিংকনের ভাষণটি দেওয়া হয়েছিল আমেরিকায় গৃহযুদ্ধের পটভূমিতে, আর লুথার কিংয়ের ভাষণ ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের মানবাধিকার রক্ষার আহ্বান। পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ ছিল স্বাধীনতার আহ্বান, মুক্তির আহ্বান—একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা। মনে রাখতে হবে, হেনরি-লিংকন-লুথার চরম বিপদ ও আতঙ্কের মধ্যে ভাষণ দেননি। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়েছেন রাইফেল-মেশিনগান-কামানের গোলার মুখে। তখন তাঁর মাথার ওপর চক্কর দিচ্ছিল পাকিস্তানি জঙ্গিবিমান। সরদার ফজলুল করিমের কথা স্মরণ করে বলি, সেদিনের সেই মুহূর্ত চোখে না দেখলে বোঝানো সম্ভব নয় বঙ্গবন্ধুর সেই মহাকাব্যিক ভাষণের মহিমা ও তাৎপর্য।</p> <p>ইতিহাসের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে, বিশ্বরাজনীতির সেই গৌরবোজ্জ্বল মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু কি ছিলেন নিজের মধ্যে? টুঙ্গিপাড়ার ভূগোল পেরিয়ে, রেসকোর্সের সীমানা ছাড়িয়ে আকাশছোঁয়া তর্জনী নিয়ে সেদিন সেই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু তো আবির্ভূত হয়েছিলেন মানব ইতিহাসের বিস্ময়-জাগানিয়া এক সত্তা রূপে—দেবদূতের মতো সেদিন তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন রেসকোর্স ময়দানে—কণ্ঠে এলো মেঘমন্দ্র ধ্বনি—অবয়বে দেখা দিল অলৌকিক এক মহিমা, যেন এক গ্রিক ভাস্কর্য।</p> <p>সন্দেহ নেই, প্রচণ্ড চাপ ছিল সেদিন বঙ্গবন্ধুর ওপর—কোটি মানুষের স্বপ্ন, দেশের স্বাধীনতা, ঔপনিবেশিক ষড়যন্ত্র, সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নামে সব উদ্যোগ নিঃশেষ করে দেওয়া—কোন দিকে যাবেন ইতিহাসের মহানায়ক? কিন্তু তাকিয়ে দেখুন পাঠক, সেদিনের সেই দৃশ্য—সিঁড়ি বেয়ে মঞ্চে উঠে চশমা খুলে চারদিক তাকিয়ে কী ধীরস্থির প্রশান্ত অবয়বে সামান্যতম নোট ছাড়াই ১৮ মিনিট তিনি যে ভাষণ দিলেন—তা কি তিনি ভেবে এসেছিলেন? না, ওই ভাষণ ভাবনা থেকে হয় না—ওই ভাষণ আসে দ্বৈববাণীর মতো—তবে তাঁর জন্য চাই মানসিক শক্তি ও অন্তহীন বিশ্বাস। সব চাপকে পাশ কাটিয়ে, সব ভয়কে জয় করে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম কূটনীতিকের মতোই সেদিন তিনি রূপান্তরিত সত্তায় ভাষণ দিয়েছিলেন। সেদিনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণটা নির্মাণে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ভূমিকার কথাটা আজ বিশেষভাবে স্মরণ করছি। বঙ্গবন্ধু যে এতটা নিঃশঙ্ক নির্ভার ছিলেন বেগম মুজিব ছিলেন তার পরম কারিকর।</p> <p>কথাটা একবার শোনা যাক বঙ্গবন্ধু আত্মজা শেখ হাসিনার বয়ানে : ‘ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। ওইদিন কত মানুষ, কত মত, কত কাগজ, কত পরামর্শ। আব্বা সবই ধৈর্যসহকারে শুনেছেন। সব কাগজই গ্রহণ করেছেন। সারাটা দিন এভাবেই কেটেছে। যখন জনসভায় যাওয়ার সময় হলো তার কিছুক্ষণ পূর্বে আব্বা কাপড় পরে তৈরি হবেন। মা আব্বাকে ঘরে নিয়ে এলেন। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আব্বাকে বললেন ১৫ মিনিট চুপচাপ শুয়ে থাকার জন্য। আমি আব্বার মাথার কাছে বসে মাথাটা টিপে দিচ্ছিলাম। মা বেতের মোড়াটা টেনে আব্বার কাছে বসলেন। হাতে পানদান, ধীরে ধীরে পান বানাচ্ছেন আর কথা বলছেন। যে কোনো বড় সভায় বা গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাওয়ার আগে মা আব্বাকে কিছুক্ষণ একদম নিরিবিলি রাখতেন। সেদিন আব্বার একটু সর্দি ছিল। আমি গলায় কপালে ভিক্স মালিশ করে দিলাম। কাঁথাটা গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকলেন।</p> <p>আমার মা আব্বাকে বললেন, সমগ্র দেশের মানুষ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সবার ভাগ্য আজ তোমার ওপর নির্ভর করছে। তুমি আজ একটা কথা মনে রাখবে, সামনে তোমার লাঠি, পেছনে বন্দুক। তোমার মনে যে কথা আছে তুমি তা-ই বলবে। অনেকে অনেকে কথা বলতে বলেছে। তোমার কথার ওপর সামনের অগণিত মানুষের ভাগ্য জড়িত, তাই তুমি নিজে যেভাবে যা বলতে চাও নিজের থেকে বলবে। তুমি যা বলবে সেটাই ঠিক হবে। দেশের মানুষ তোমাকে ভালোবাসে, ভরসা করে।’</p> <p>বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে ইতিহাসচেতনা এবং রাজনীতি-ভাবনার নিপুণ মিলন ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ভাষিক সচেতনতার কথাও বলা প্রয়োজন। সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়েও তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন অভূতপূর্ব এক কৌশলে। সেদিনের সেই উত্তেজনার মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর এই কূটনৈতিক দূরদৃষ্টির কথা ভাবলে আজও বিস্মিত হতে হয়। লোকায়ত শব্দের ব্যবহার, উচ্চারণে বিশেষ বিশেষ সময়ে আঞ্চলিক ঢং, কণ্ঠের ওঠানামা—সব মিলিয়ে এক অসামান্য ভাষিক স্বাতন্ত্র্যের পরিচয়বাহী ৭ই মার্চের ভাষণ।</p> <p><strong>লেখক : </strong>উপাচার্য, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়</p>