কোটি কোটি বছর ধরে ভূতাত্ত্বিক বিবর্তনের ধারায় লবণ বা লবণের উপাদানসমূহ ভূতাত্ত্বিক স্তরসমূহে সঞ্চিত হয়েছে। প্রাকৃতিক (বৃষ্টি, নদী, বাষ্পীভবন, সমুদ্রতলের আগ্নেয় ছিদ্র, ভূগর্ভস্থ গ্যাস ও লাভা ইত্যাদি) এবং মানবসৃষ্ট (ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, খনিজ সম্পদ আহরণ, বনভূমি ধ্বংস ও ভূমির অপরিকল্পিত ব্যবহার ইত্যাদি) কারণে ভূতাত্ত্বিক স্তর থেকে এসব লবণ কিংবা লবণের উপাদান জলাশয় ও মাটির ওপরে এসে পড়ে। কোটি কোটি বছর ধরে পূর্বোল্লিখিত প্রাকৃতিকভাবে সমুদ্রবক্ষে লবণ জমা হওয়ার কারণে সমুদ্রের পানি বেশি পরিমাণে লবণাক্ত হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে সেই লবণাক্ত পানি নানা প্রক্রিয়ায় (জলোচ্ছ্বাস, পানির ঘনত্বে পার্থক্য, শূন্যতা পূরণ ইত্যাদি) সমুদ্রসংলগ্ন ভূমিতে ঢুকে লবণাক্ততা সৃষ্টি করে। সমুদ্র সংযোগহীন দেশগুলোতে ভূস্তরে মিশে থাকা লবণ নানাভাবে বিশেষ করে বৃষ্টি, নদীর স্রোত, সেচ (ভূগর্ভস্থসহ) ইত্যাদির মাধ্যমে জমিতে জমা হয়ে থাকে। রাসায়নিক সার, কীটনাশক, শিল্পবর্জ্যের দ্বারাও জমি লবণাক্ততায় আক্রান্ত হতে পারে।
খাদ্য নিরাপত্তা এবং বৈশ্বিক মাটির স্বাস্থ্যের ওপর বড় ধরনের হুমকির মোকাবেলায় এফএও তাদের ‘গ্লোবাল সয়েল পার্টনারশিপ’-এর মাধ্যমে ২০২১ সালে লবণাক্ত মাটিবিষয়ক এক আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক, ‘ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক অব সল্ট-অ্যাফেক্টেড সয়েলস (ইনসাস)’ গঠন করে। ‘গ্লোবাল সয়েল পার্টনারশিপ’ খাদ্য নিরাপত্তা এবং পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য লবণাক্ত মাটি ব্যবস্থাপনায় জরুরি ও সমন্বিত বৈশ্বিক পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেছে। লবণাক্ত জমিতে লবণসহিষ্ণু ফসল ও হ্যালোফাইট (লবণপ্রিয় উদ্ভিদ) চাষ বৃদ্ধি করা এবং এসব ফসলের বাজার গড়ে তোলাসহ তাতে আর্থিক সহায়তা দানের ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে ২৬ লাখ একরেরও বেশি জমি লবণাক্ততার শিকার (এফএও, ২০২৪)। বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) থেকে বলা হয়েছে যে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৮টি জেলার ৯৩টি উপজেলা বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততায় আক্রান্ত। গত বছর প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মাটিতে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ লবণের পরিমাণ দেখানো হয়েছে যথাক্রমে ০.০৫ মিলিসিমেন্স/সেন্টিমিটার ও ৯.০৯ মিলিসিমেন্স/সেন্টিমিটার (সরকার ও অন্যান্য, ২০২৪)। সাধারণত মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এই অঞ্চলে সব থেকে বেশি লবণাক্ততা বিরাজ করে।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধ ও প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে যে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লবণাক্ততা সেখানকার কৃষি উৎপাদনের পরিমাণ ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করছে। দেশের দক্ষিণ-মধ্য-উপকূলীয় অঞ্চলে উচ্চ লবণাক্ততায় আক্রান্ত জমিতে নিম্ন লবণাক্ততায় আক্রান্ত জমির তুলনায় ৮০ শতাংশের বেশি পরিমাণ বোরো ধান কম উৎপাদন হতে পারে (ভূঁইয়া ও অন্যান্য ২০২৩)। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিরাজমান লবণাক্ততা সেখানকার জনস্বাস্থ্যের জন্যও হুমকি তৈরি হয়েছে। এই অঞ্চলের মানুষ চর্মরোগ, ডায়রিয়া এবং অপুষ্টিতে আক্রান্ত হচ্ছে। মেয়েদের প্রজননগত সমস্যা তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে। কয়েক বছর আগে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলা হয়েছিল যে উচ্চ লবণাক্ততাযুক্ত পানীয়জল উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে রক্তচাপ বৃদ্ধিজনিত সমস্যা সৃষ্টি করছে (নাহিয়ান ও অন্যান্য, ২০১৮)।
বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের সময় জমি ও পুকুরে নোনা পানি ঢুকে পড়া, ভূগর্ভে নোনা পানির অনুপ্রবেশ, চিংড়ি চাষ, লবণ চাষ, নদীতে পলি জমা, নদীর স্রোত কমে যাওয়া ইত্যাদিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের সম্মিলিত অভিঘাত। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রের পানির স্তর বৃদ্ধি এবং উজানে মিঠা পানির প্রবাহ পরিবর্তনের সম্মিলিত প্রভাবের কারণে নদীর পানির লবণাক্ততা বাড়ছে বলে বলা হচ্ছে (বিশ্বব্যাংক, ২০২৫)।
এসআরডিআই থেকে ২০১০ সালে প্রকাশিত লবণাক্ততা রিপোর্টে লবণাক্ততা সমস্যা মোকাবেলায় ‘গবেষণা’ ও ‘উন্নয়ন’—এই দুটি উপ-শিরোনামের অধীনে অনেকগুলো সুপারিশ করা হয়েছিল। রিপোর্টে পানি ও মাটি ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তির উন্নয়ন, লবণসহিষ্ণু ফসলের জাত উন্নয়ন, ভূ-উপরিস্থিত লবণ ধুয়ে ফেলা, মাটি ও পানির লবণাক্ততা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ, অপ্রচলিত লবণসহিষ্ণু ফসলের সম্প্রসারণ, মৃত/মৃতপ্রায় নদী-খাল খননের মাধ্যমে পানি সংরক্ষণ, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন সীমিত রাখা ইত্যাদিসহ মোট সুপারিশ সংখ্যা ছিল ২২টি।
‘লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্র’ নামে খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলায় এসআরডির একটি প্রতিষ্ঠান ২০০১ সাল থেকে পূর্ণাঙ্গভাবে লবণাক্ততা মোকাবেলায় কাজ করছে। এরই মধ্যে এই কেন্দ্র থেকে কলস সেচ প্রযুক্তি, লবণাক্ত এলাকায় ডিবলিং পদ্ধতিতে ভুট্টা চাষ, খামার পুকুর প্রযুক্তি, দুই স্তর মালচিং পদ্ধতি ইত্যাদি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এসব কৌশলের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। জাভা (ইন্দোনেশিয়া)-র ‘সর্জন’ নামক একটি চাষ পদ্ধতি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে জনপ্রিয় হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে উঁচু বেড এবং গভীর খাত পর্যায়ক্রমে তৈরি করা হয় এবং এর মাধ্যমে লবণাক্ততা, বন্যা ও জলাবদ্ধতা মোকাবেলা করা সম্ভব হচ্ছে বলে বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে। পানীয়জলের জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, পুকুর বালু ফিল্টার পদ্ধতি জনপ্রিয়করণ, লবণমুক্তকরণ ইউনিট স্থাপন, ভূ-উপরিস্থিত পানি শোধন প্লান্ট স্থাপন ইত্যাদি কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে।
দেশের লবণাক্ততা মোকাবেলার জন্য এসআরডিআই-এর সুপারিশমালা ও উপরোক্ত কৌশলসমূহ একটি সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার অধীনে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে লবণাক্ততা মোকাবেলায় অভিযোজন কৌশলও পরিবর্তন দরকার। উল্লেখ্য, অস্ট্রেলিয়ার লবণাক্ততা মোকাবেলার সামগ্রিক ও অভিযোজিত কৌশল বহু দশকের অভিজ্ঞতা ও সরকারের উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়