<p>সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক তার বাণিজ্যিক মুনাফার মডেলটি গড়ে তুলেছে ঘৃণা ও ধাপ্পাবাজির এক বোমা ছোড়া সার্কাসের মধ্য দিয়ে। তাই নিজেকে সংস্কার করতে এটি নিজ থেকে কখনোই উদ্যোগী হবে না। গণতন্ত্রের ওপর তার আধিপত্য বিস্তারের পর থেকে প্রতিটি রাজনৈতিক বিতর্কেই এটি নিজেকে ইতিহাসের ভুল পথে সমর্পণ করেছে। এই সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অ্যালগরিদমের মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে মুনাফা ঘরে তোলা। তাই পরস্পরের প্রতি কুৎসায় মেতে থাকা ব্যবহারকারীদের সহায়তা করা তার কাছ থেকে আশা করা যায় না। এটি সমাজের জন্য মোটেও ভালো নয়; কিন্তু ফেসবুকের জন্য বড় লাভজনক বিষয়। </p> <p>দৃশ্যত কম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের জন্য এই খেলা খুবই চমৎকার। কারণ এরই মধ্যে তিনি ৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মালিক হয়েছেন। কিন্তু এই সার্কাস বোঝার জন্য কম্পানিটির সর্বশেষ কুিসত পর্বটির দিকে নজর দিতে পারেন। সেটি হচ্ছে সম্প্রতি ফেসবুক তার বর্ণবাদী ও সহিংস বিষয়বস্তু নিষিদ্ধ করতে অস্বীকার করায় বিশ্বের কিছু বৃহত্তম ব্যাবসায়িক ব্র্যান্ড প্ল্যাটফর্মটিকে বয়কট করার ঘোষণা দিয়েছিল। এর প্রেক্ষাপটে ফেসবুকও দায়সারা মন্তব্য করেছিল, ‘আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছি।’ কিন্তু ভেতরের গল্পটি একেবারেই ভিন্ন। সেটি হচ্ছে জাকারবার্গের ভাষায়, ‘বয়কটকারীরা তো ফিরেই আসবে এবং আমরাও আমাদের নীতি পরিবর্তন করছি না। ...মুনাফা কমে যাওয়ার আশঙ্কার কারণেই তা করতে পারব না।’</p> <p>আমেরিকায় একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলিত যে পুঁজিবাদই মানুষের বিষয়-আশয় নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু ব্রিটেনে সাধারণত সরকারই সে ভূমিকা পালন করে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রিটেনে সোশ্যাল মিডিয়া ফার্মগুলোকে বিনা বাধায় বাড়তে দেওয়া ঠিক হয়নি—গত সপ্তাহে গণতন্ত্র ও ডিজিটাল টেকনোলজি বিষয়ক লর্ডস সিলেক্ট কমিটির এই বক্তব্য ছিল সঠিক। হাউস অব লর্ডসের ওই সদস্যরা বলেছিলেন, ‘চলমান কভিড-১৯ মহামারিতে এটি তীব্রভাবে স্পষ্ট হয়েছে যে অনলাইনের ভুল তথ্য আমাদের গণতন্ত্রের জন্য শুধুই বাস্তব ও চলমান বিপদই নয়, তা আমাদের জীবনকেও ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে।’ ফলে বাকি সমাজকে আলাদা রেখে শুধু ফেসবুককে বাধাহীনভাবে চলতে দেওয়া ঠিক হয়নি। অবশ্য এরই মধ্যে বার্তাটি আমলে নিয়েছে যুক্তরাজ্যের ‘প্রতিযোগিতা ও বাজার কর্তৃপক্ষ’। তারা প্রস্তাব দিয়েছে গ্রাহকদের তাদের নির্ধারিত বিজ্ঞাপন গ্রহণ করবে, নাকি সরিয়ে দেবে—সেই পছন্দের সুযোগ রাখতে ফেসবুককে বাধ্য করতে হবে।</p> <p>ব্রিটিশ সরকারও এরই মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের সুরক্ষা দেওয়া এবং তাতে ব্যর্থ হলে নিষেধাজ্ঞার সুযোগ রেখে ক্ষতিকর অনলাইন বিষয়ক একটি ‘ফ্রেমওয়ার্ক’ তৈরির কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। এতে অপরাধমূলক আধেয় (কনটেন্ট) সরাতে সময়ক্ষেপণকে ব্যর্থতা হিসেবেও গণ্য করা হচ্ছে। সরকারের এই পদক্ষেপের জন্য সম্প্রতি লর্ডস সিলেক্ট কমিটির প্রশংসাও যথাযথই ছিল। তবে মন্ত্রীরা আইন প্রণয়নে একদিকে যেমন খুবই গড়িমসি করেছেন, তেমনি আরেক দিকে ভুল প্রচারণা থেকে ভোটারদের রক্ষায় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর সতর্কতার কোনো লক্ষণ নেই।</p> <p>ব্রিটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ ফেসবুকের কথিত নিরপেক্ষতা নীতির সঙ্গে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু এটিও তো সত্য, সোশ্যাল মিডিয়া প্রতিষ্ঠানটি হাত গুটিয়ে বসে থাকার দৃষ্টিভঙ্গি মেনে চলছে। এর অর্থ হচ্ছে সে তার বর্ণবাদ, নারীবিদ্বেষ ও ষড়যন্ত্রের জলাশয়কে খুলে দিতে রাজি নয়। যেমন—গত অক্টোবরে এক ভাষণে মার্ক জাকারবার্গ ফেসবুকের স্বার্থকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বার্থের সমান্তরালে চলার একটি বিতর্কিত ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা বলেছিলেন, রাজনৈতিক নেতাদের সেন্সর করার কোনো অধিকার তাঁর কম্পানির নেই। আর ট্রাম্পও অন্যান্য প্ল্যাটফর্মের তুলনায় ফেসবুকে অনেক নমনীয় ছিলেন।</p> <p>এখন দর-কষাকষির বিষয়টি হচ্ছে জট খোলার উপায়। যেমন—ট্রাম্পের বিদ্বেষপূর্ণ ভাষণের ক্রমবর্ধমান প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তার নািস যুগের প্রতীক বহনকারী বিজ্ঞাপন সরিয়ে দিয়েছে। একই কাজ ফেসবুকও করতে যাচ্ছে এবং তারাও মার্কিন ব্যবহারকারীরা রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন দেখবে কি না, তা পছন্দ করার সুযোগ দিতে যাচ্ছে। তবে ব্রিটেনে এখনো মিথ্যা রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন ছড়াতে ফেসবুক ব্যবহৃত হচ্ছে। ফেসবুকও নিজেদের অ্যালগরিদম বিশ্লেষণের ওপর ভর করেই চলতে চায়, যাতে বেশি বিভাজনমূলক আধেয়কে ব্যবহারকারীদের বেশি মনোযোগ কাড়া ও বেশি সময় ব্যয়ের উপায় হিসেবে কাজে লাগাতে চায়। একটি সহজ সমাধান অবশ্য আছে। যুক্তরাজ্য টেলিভিশন ও রেডিওতে সব ধরনের রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন সম্প্রচার বন্ধ করেছে। এখন ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো যদি মৌলিক পরিবর্তন না করে, তাহলে এই নিষেধাজ্ঞাটি সোশ্যাল মিডিয়ায়ও সম্প্রসারণ করার সময় এসেছে।</p> <p>সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান</p> <p>ভাষান্তর : আফছার আহমেদ</p> <p> </p>