ঢাকা, শুক্রবার ২৫ জুলাই ২০২৫
১০ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৯ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, শুক্রবার ২৫ জুলাই ২০২৫
১০ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৯ মহররম ১৪৪৭
কবিতার অন্বেষণ, কবিতার কৌশল ৯

মাত্রাবৃত্তে কবিতা লিখতে দরকার ছন্দে মুনশিয়ানা

  • কামাল চৌধুরী
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
মাত্রাবৃত্তে কবিতা লিখতে দরকার ছন্দে মুনশিয়ানা

১৮ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত

এটম বোমার থেকে (৮)/দু’বছর(৪)/বড় এই আমি (৬)

ধ্বংস ও শান্তির মধ্যে (৮)/মেরু-দূর (৪)/প্রভেদ মানি না (৬)

ক্ষীয়মাণ মূল্যবোধে, (৮)/সভ্যতার (৪)সমূহ সংকটে (৬)

আমি কি উদ্বিগ্ন খুব? (৮)/—উদ্বিগ্নতা (৪)/আমাকে সাজে কি? (৬)

[অন্তরঙ্গে সবুজ সংসার/রফিক আজাদ]

 

২২ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত

এতকাল ধ’রে শুধু (৮)/বাতাস মেঘলা হয় (৮)/নামে না বাদল (৬)

নাড়ি-ছেঁড়া ব্যথা ওঠে, (৮)/কাতরায় খালি ঘরে (৮) চূড়ান্ত পোঁয়াতি (৬)

পশ্চিমের মেঘ দেখে (৮)/হাটবারে দোকানিরা (৮)/গুটায় বেসাতি, (৬)

বরষা আসে না (৬)/—শুধু মেঘ জ’মে ওঠে, (৮)/বাজে মেঘের মাদল। (৮)

(মানুষের মানচিত্র-১৫/রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ)

এখন কেউ যদি জোড়-বিজোড় পর পর গেঁথে অক্ষরবৃত্তে কবিতা লিখতে চান তখন কী হবে? যেমন—৩+২+৩ এভাবে আট মাত্রার চাল কিংবা ৩+৫ এভাবে আট মাত্রার চাল তৈরি করা যাবে কি না? কেউ কেউ এই চেষ্টা যে করেননি, তা নয়। কিন্তু এতে ধ্বনি বদলে যেতে পারে। এতে স্বরবৃত্ত বা মাত্রাবৃত্তের ভঙ্গি এসে যেতে পারে।

অক্ষরবৃত্ত ছন্দে মাত্রা গণনা ও ধ্বনিসাম্য রক্ষায় মতভেদ আছে। তা ছাড়া ২+৩+৩ এ ধরনের মাত্রা ব্যবহার, যদিও কেউ কেউ করেছে—তবে ঝুঁকিপূর্ণ। কবে অনেকেই স্বাধীনতা নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

সনেট ও চতুর্দশপদী কবিতাকে শুরুতে আলাদা ভাবা হলেও এখন পার্থক্য টানা হয় না।

বাংলা কবিতায় সনেট বা চতুর্দশপদীও মূলত অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কবিতা। এর কাঠামো অক্ষরবৃত্তের ৮+৬-এর অনুরূপ। এতে পঙক্তি বা লাইনের সংখ্যা ১৪ বিধায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত এর নাম দিয়েছেন চতুর্দশপদী। তাঁর ‘বঙ্গভাষা’, ‘কপোতাক্ষ’—এসব কবিতা চতুর্দশপদী কবিতা।
তবে চতুর্দশপদী ১৪ মাত্রার চেয়ে বেশি যেমন—১৮ বা অধিক মাত্রারও হতে পারে। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে কিংবা মুক্তক অক্ষরবৃত্তেও সনেট রচনার চেষ্টা আছে। তবে এগুলো চতুর্দশপদীর পর্যায়ভুক্ত কি না, এ নিয়ে ছান্দসিকের মধ্যে সংশয় আছে।

 

মাত্রাবৃত্ত ছন্দ

মাত্রাবৃত্ত ছন্দের আবিষ্কর্তা রবীন্দ্রনাথ। যুক্তবর্ণকে দুই মাত্রা মূল্য দিলে যে এই ছন্দের আসল রূপটি ফোটে সেটি রবীন্দ্রনাথের কাছে ধরা পড়েছিল।

অক্ষরবৃত্তের সঙ্গে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের মাত্রার হিসেবে যেমন পার্থক্য আছে, তেমনি ধ্বনিগত দিক থেকেও পার্থক্য আছে। ছন্দে মুনশিয়ানা না থাকলে মাত্রাবৃত্তে কবিতা লেখা যায় না। অনেক লব্ধপ্রতিষ্ঠিত কবিও মাত্রাবৃত্তে লিখতে ভয় পান। মাত্রাবৃত্তে লিখতে পারা ছন্দ স্বাচ্ছন্দ্যের বড় উদাহরণ। অক্ষরবৃত্তে আমরা দেখেছি জোড়ের পর জোড় আর বিজোড়ের পর বিজোড়ের চাল নিরাপদ; কিন্তু মাত্রাবৃত্তে জোড়-বিজোড় সবই ব্যবহার করা যায়। যেমন—মাত্রাবৃত্ত যেহেতু ধ্বনিপ্রধান ছন্দ, সে জন্য ধ্বনির সাযুজ্য রক্ষা করতে হয়। আলাদা রকম চাল দিতে হয়। একটা উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে। যেমন—অক্ষরবৃত্তে ৩+৩+২+৩+৩ যদি হয় মাত্রাবৃত্তে মাঝের দুই মাত্রা দুই উঠে যাবে। এখানে সাজাতে হবে ৩+৩+৩+৩ পদ্ধতিতে। যেমন—‘জ্ঞান দাসের একটি কবিতার মাত্রাবৃত্তের প্রথম পদ নিম্নরূপ :

সুখের লাগিয়া/এ ঘর বাঁধিনু

৩+৩+৩+৩

একে যদি অক্ষরবৃত্ত লিখতে হয়, তবে

সুখের লাগিয়া আজ এ ঘর বাঁধিনু

 

৩+৩+২+ ৩+৩ এভাবে লিখতে হবে। অর্থাৎ ৩+৩-এর পরে দুই মাত্রা যোগ করতে হবে। ‘আজ’ বসানোর ফলে এটি অক্ষরবৃত্ত হয়ে গেছে—ধ্বনিও হয়ে গেছে কিছুটা প্রলম্বিত। তাই পার্থক্য বোঝা কঠিন নয়।

মাত্রাবৃত্তে অপূর্ণ পর্ব থাকতে পারে এবং সাধারণত থাকে। শব্দ, যতি বা লাইনে কবি অবশ্যই স্বাধীনতা নিতে পারেন, কিন্তু ছন্দ গণনার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। মাত্রাবৃত্ত মুক্তাক্ষর একমাত্রা, কিন্তু যুক্তাক্ষর দুই মাত্রার মর্যাদা পায়। যুক্তাক্ষরকে এখানে বিযুক্ত করে পড়তে হয়—তাই যুক্তাক্ষরকে কখনো কখনো ভাঙতে হয়। যুক্তাক্ষরকে ভাঙার এই রীতির প্রবর্তক রবীন্দ্রনাথ। মূলত ‘মানসী’তেই মাত্রাবৃত্ত ছন্দের সূচনা। ‘সিন্ধুপারে’ কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি :

পউষ প্রখর (৬)/শীতে জর্জর, (৬)/ঝিল্লিমুখর (৬)/রাতি (২);

নিদ্রিত পুরী, (৬)/নির্জন ঘর, (৬)/নির্বাণদীপ (৬)/বাতি (২)

অকাতর দেহে (৬)/আছিনু মগন (৬)/সুখনিদ্রার (৬)/ঘোরে(২)—

তপ্ত শয্যা (৬)/প্রিয়ার মতন (৬)/সোহাগে ঘিরেছে (৬)/মোরে (২)।

রবীন্দ্রনাথ তবে ‘সিন্ধুপারে’ কবিতায় ‘পৌষ’ শব্দটার চলতি বানান ছেড়ে ‘পউষ প্রখর শীতে জর্জর...’ লিখেছিলেন। তবে এ ভাঙার পদ্ধতি নিয়ে নানা মত আছে। যেমন—ছন্দকে কিভাবে পড়া হবে। শঙ্খ ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার ক্লাস-এ যুক্তাক্ষরের মাত্রা বিশ্লেষণসংক্রান্ত এক চিঠিতে জানতে চেয়েছিলেন ‘ছন্দ’ শব্দের মাত্রা হিসাব কেমন হবে। ১+২ (ছ+ন্দ) না ২+১ (ছন+দ)। চোখ বলবে প্রথমটি আর কান বলবে দ্বিতীয়টি। তেমনটাই চৈত্র, সৈন্য, দৈন্য—এসব শব্দকে বিশ্লিষ্ট করাতে দেখা যায়। এই ছন্দে লেখার সময় এসব সূক্ষ্ম দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে চার মাত্রা, পাঁচ মাত্রা, ছয় মাত্রা, সাত মাত্রা এভাবে লেখা হচ্ছে। তবে জনপ্রিয় পদ্ধতি ছয় মাত্রা। এ ছাড়া স্বরমাত্রিক চালও আছে, যা মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত—উভয় ছন্দে পড়া যায়। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা কবিতার উদাহরণ :

 

চার মাত্রার মাত্রাবৃত্ত

প্রিয়, ফুল (৪)/খেলবার (৪)/দিন নয় (৪)/অদ্য (৩)

ধ্বংসের (৪)/মুখোমুখি (৪)/আমরা (৩)

চোখে আর (৪)/স্বপ্নের (৪)/নেই নীল (৪)/মদ্য (৩)

কাঠফাটা (৪)/রোদ সেঁকে (৪)/চামড়া (৩)

[মে দিবসের কবিতা/সুভাষ মুখোপাধ্যায়]

 

পাঁচ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত

সকাল বেলা (৫)/কাটিয়া গেল, (৫)/বিকাল নাহি (৫)/যায় (২)।

দিনের শেষে (৫)/শ্রান্ত ছবি (৫)/কিছুতে যেতে (৫)/চায় না রবি, (৫)

চাহিয়া থাকে (৫)/ধরণী পানে-(৫)/বিদায় নাহি (৫)/চায় (২)

[অপেক্ষা/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর] [►►চলবে]

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

জুলাই বিপ্লব : সাহসের বলিষ্ঠ গ্রাফিতি

    শান্তা মারিয়া
শেয়ার
জুলাই বিপ্লব : সাহসের বলিষ্ঠ গ্রাফিতি

বুকের ভিতর মৃত্যুর গভীর ধ্বনি বাজে

লাল সবুজ পতাকা দৃঢ় হাতে ধরে

রিকশায় শুয়ে আছে মুমূর্ষু নাফিস

ঝরে পড়া রক্তচিহ্ন রাজপথে এঁকে চলে গণতন্ত্রের অমর পোর্ট্রেট।

যাত্রাবাড়ী, চানখাঁরপুল, মোহাম্মদপুর, রামপুরা, বাংলামোটর, উত্তরা

তারুণ্যের প্রবল জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে

স্বৈরাচারী অশুভ শক্তির ক্রূর আস্ফাালন।

আবু সাঈদ, মুগ্ধ, শান্ত, ফারহান শত শত নাম

শহীদের শবদেহ, মায়ের মাতম

রক্তাক্ত জুলাই বাংলার জমিনে সাহসের বলিষ্ঠ গ্রাফিতি।

পৃথিবী বিস্ময়ে দেখে

পরাজয় জানে না জনতা

পরাজিত হয়নি বাংলাদেশ।

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সময় এখন

    মাহমুদ কামাল
শেয়ার
সময় এখন

সময়ের মাঝে প্রবেশ করেছি বলে

সময় এখন সাথে নিয়ে পথ চলে

জীবনানন্দ একা চলেছেন পথে

নির্জনতায় ফুটেছে কথার ঢেউ

তেজোদীপ্ত কথার স্ফুরণে ছবি

হেসে ওঠে যেন মোনালিসা মোনালিসা

সময়ের সাথে বোঝাপড়া শেষ করে

নতুন পথের পথচারী হয়ে একা

নিজেকে চিনেছি হুল্লোড় পিছে রেখে

মানুষের ভিড়ে অযথাই মিশে গিয়ে

সময়ের কাছে পরাজিত হই বলে

এবার আমি প্রবেশ করেছি দেখে

সময় আমাকে সাথে নিয়ে পথ চলে

অভিষেক ঘটে প্রথা ভেঙে নতুনের

মন্তব্য

জুলাই বিপ্লব

    জাহাঙ্গীর ফিরোজ
শেয়ার
জুলাই বিপ্লব

জুলাই বিপ্লবের আলো ঘরে ঘরে জ্বালো

মায়াজাল ছিঁড়ে বদ্বীপ জেগেছে আবার;

নৃমুণ্ডমালিনী পালিয়েছে অহীশ্বর গৃহে

ডাকিনী বর্ণিনী চেলাচামুণ্ডারা দিশেহারা

ওদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস চারিদিকে;

 

দেখ, বিষধর কাকোদর ছোবলে উদ্যত!

গোপালিরা বর্গির বেশে ফিরছে আবার।

 

ভয় নেই বন্ধুরা ভয় নেই

আবু সাঈদের অমিয় সাহস

তুষার অনল হয়ে সহযোদ্ধার বুকে এখনো রয়েছে

অষ্টনাগের পাশ ওরা ছিন্নভিন্ন করে দিবে

প্রয়োজনে পুনরায় তরবারি কোষমুক্ত হবে।

 

জ্বালো জ্বালো জুলাই বিপ্লবের আলো ঘরে ঘরে।

মন্তব্য

যারা গেয়েছিল দ্রোহের গান

    আহমেদ মাওলা
শেয়ার
যারা গেয়েছিল দ্রোহের গান
অঙ্কন : তানভীর মালেক

জসিম বাসায় নেই?

জবাবের অপেক্ষা না করেই ঘরে ঢুকে পড়ে মাসুদ।

তাকে পেছন থেকে পুলিশ তাড়া করছে। জসিমের মা হাতাওয়ালা চেয়ারে দরজার পাশে বসা। ঘরে ছায়া অন্ধকার।

সন্ধ্যা হয় হয়। ঘরের লাইট জ্বালানো হয়নি। মাসুদের মা উঠে সুইচ দিলে আলোতে ঘর ঝলমল করতে লাগল।

জসিম আজ তিন দিন বাসায় ফেরেনি।

তোমার সঙ্গে কি দেখা হইছে? জসিমের মা দেলোয়ারা বেগম জিজ্ঞেস করেন।

আমার সঙ্গে দেখা হয়নি খালাম্মা, তবে মোবাইলে কথা হয়েছে।

তোমরা কী যে আন্দোলন শুরু করেছ, সব ছেলেমেয়েরা ঘরছাড়া। টিভিতে দেখলাম, পুলিশ, বিজিবি যেভাবে ছাত্রদের পেটাচ্ছে! কথা শেষ করতে পারেন না দেলোয়ারা বেগম।

মাসুদ দ্রুত দেলোয়ারা বেগমের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, পুলিশ আমাকে তাড়া করছে। এ বাসায় খুঁজতে আসতে পারে। আমি পেছনের দরজার পাশে লুকিয়ে থাকব। পুলিশ জিজ্ঞেস করলে বলবেন, না, এদিকে কেউ আসেনি। প্লিজ খালাম্মা, আমাকে বাঁচানোর জন্য এই মিথ্যাটা আপনাকে বলতেই হবে।

বলতে বলতে পুলিশ এসে পড়ে। দরজায় কড়া নাড়ছে বিকট শব্দে। দেলোয়ারা বেগম ভয় লাগা কণ্ঠে ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করে, কে?

আমরা পুলিশ!

ঝটপট দরজা খুলে দেন দেলোয়ারা বেগম।

এদিকে কেউ এসেছে? ইয়াং ছেলেদের কেউ?

দেলোয়ারা বেগম বিরস মুখে জবাব দেয়, কই, না তো! কাউকে দেখিনি।

পুলিশের তবু সন্দেহ হয়। ড্রয়িংরুমে ঢুকে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে।

নাহ, কোনো আলামত শনাক্ত করতে পারে না। দেলোয়ারা বেগমের বুকটা দুরুদুরু করতে থাকে।

পুলিশ চলে যাওয়ার পর মাসুদ বেরিয়ে আসে। নিচু স্বরে কথা বলে

চিন্তা করবেন না, খালাম্মা। সারা দেশের স্কুল, কলেজ, সরকারি-বেসরকারি ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা পথে নেমে গেছে। তাদের সঙ্গে শিক্ষকরা, পেশাজীবী, শ্রমজীবীসবাই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।

সাইলেন্ট করা মোবাইলে জসিমের কল আসে, মাসুদ কল রিসিভ করে গলার স্বর নিচু করে কথা বলে

: দোস্ত, তুই এখন কোথায়?

: তোদের বাসায়। পুলিশ কিছুক্ষণ আগে তোদের বাসায় এসেছে। ভেতরে লুকিয়ে ছিলাম, ধরতে পারেনি।

: তুই কোথায়?

: কামারপাড়ায়। কারফিউ কেউ মানছে না। রাস্তায় মানুষের ঢল।

খালাম্মা, আমি আসি বলে মাসুদ এই রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে যায়। পেছন থেকে দেলোয়ারা বেগম ডাকেন, মাসুদ, চারটা ভাত খেয়ে যা। সেই ডাকে সাড়া দেওয়ার সময় এখন নেই মাসুদের।

চে গুয়েভারার কথা মনে পড়ে মাসুদের। বিপ্লব যেন ঘুমিয়ে না পড়ে

দ্বিতীয় বিপ্লবের শক্তি অন্তরে ধারণ করে বুক পেতে দাঁড়িয়ে ছিল আবু সাঈদ। পেছনে ফেরার আর সুযোগ নেই। কে যেন ডেকে বলছে

আমাকে তোমরা দাঁড় করিয়ে দিয়েছ বিপ্লবের মুখে।

ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসের খিজির যেমন ডাকে

এট্টু জলদি করেন ওসমান সাব! পাও দুইখান মনে লয় ইস্ক্রু মাইরা রাস্তার লগে ফিট কইরা দিছেন!

বাড়িতে ঢোকার আগেই মকবুল হোসেন স্ত্রীর বিলাপের শব্দ শুনতে পায়। আবু সাঈদের মৃত্যুর পর থেকেই মনোয়ারা বেগম কারণে-অকারণে কাঁদে। তার কান্না কোনোভাবেই থামছে না।

মকবুল হোসেন হাঁটার গতি আরো বাড়িয়ে দেয়। বাড়িতে ঢুকতেই উঠানে আলাউদ্দিন মিয়াকে দেখতে পায়। এতক্ষণে মকবুল হোসেন বুঝতে পারে, তার স্ত্রী মনোয়ারা বেগমের কান্নার উত্স কী।

মদনখালী ইউনিয়নের আলাউদ্দিন তার মেয়ে আয়েশা আক্তার সুইটিকে নিয়ে এসেছে।

মকবুল হোসেন ও আলাউদ্দিনের বন্ধুত্ব ছোটবেলা থেকেই। সেই সূত্রে আলাউদ্দিনের মেয়ে সুইটির সঙ্গে আবু সাঈদের বিয়ের কথাবার্তা প্রায় পাকা ছিল। ভার্সিটির পড়া শেষ হলেই সুইটির সঙ্গে আবু সাঈদের বিয়ে হবে। কিন্তু অল্প কয়েক দিনের মধ্যে কী যে ঘটে গেল!

দেশের জন্য বিপ্লব করতে গিয়ে সাঈদ খুন হলো।

গ্রামের আকাশে-বাতাসে, গাছের পাতায় যেন আবু সাঈদের মৃত্যুশোক ঝরে পড়ছে। সাঈদের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা ঠিক হওয়ার পর ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে কত না স্বপ্নসাগরে ভেসেছে সুইটি! সেই স্বপ্ন আজ ভেঙে চুরমার। পড়ালেখার ফাঁকে রুমের ভেতর যখন একা থাকে, বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে কেন?

পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পর আবু সাঈদের লাশ যখন ছাত্র-জনতা অ্যাম্বুল্যান্সে করে বাবনপুর গ্রামে দাফন করার জন্য নিয়ে আসে, তখন সুইটি আসতে পারেনি। পুরো গ্রাম যেন ভেঙে পড়েছে। সাংবাদিক, টিভি ক্যামেরা, পুলিশের গাড়িতে বাবনপুর সাঈদের বাড়ির সরু রাস্তায় তখন তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। সুইটি তখন নীরবে একাই কেঁদেছে।

আধো ঘুমে কিংবা তন্দ্রার ভেতরে আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন ছোট মেয়ে কুলসুমের ডাক শুনতে পায়

বাপজান, এলা ওঠো। ভাত হছে। খাবার ডাকলুং মা।

মকবুল হোসেনের চোখের পাতা ঘুমে ভারী হয়ে আছে। কিছুতেই চোখ মেলতে পারে না। ঘুমের মধ্যেই হয়তো আবার তলিয়ে যায়। ঘুমের ভেতর শৈশবে ফিরে যায়। দেশভাগের সেই স্লোগান শুনতে পায়।

ঘুমের মধ্যে বোবায় ধরার মতো গোঙাতে থাকে। গা ধরে কয়েকবার ঝাঁকুনি দেয় মনোয়ারা বেগম, এলা ওঠাং বাজারত যাবার কলাং, বেলা তো যায় গিয়া।

মকবুল হোসেন জেগে ওঠে। প্রথমে কিছু বুঝতে পারে না, তারপর মনে হলো, করতোয়ার পানি সব এসে গেল যমুনায়। বাজারে জগদীশ সাহার চা দোকানে সন্ধ্যাবেলায় জমজমাট আড্ডা হয়। চাষার ছেলে, জোলার নাতি, মাঝির ভাইস্তাসব চ্যাংড়া পোলাপানের দল এসে ভিড় করে। চা-সিগারেট খায়, দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে কে হারবে, আমেরিকার নির্বাচনে এবার কে প্রেসিডেন্ট হবেএসব নিয়ে তর্কবিতর্ক হয়। এ যুগের চ্যাংড়ারা যে দেশ-দুনিয়া নিয়ে এত ভাবে, চিন্তা করে, এটা ওদের পাশে না বসলে কেউ বুঝতে পারে না। হারাধন কবিরাজের দোকানে মানুষের ভিড় দেখে মকবুল হোসেন জগদীশের চা দোকানে এসে বসে।

নীলু মেম্বার একবার নজর দিয়ে চায়।

মকবুল ভাই চা খাবাং?

জগদীশ সাহা ক্যাশ থেকে উঠে এসে নীলু মেম্বারকে দুহাত জোড় করে নমস্কার জানায়।

কর্তা, আউজকার মিষ্টি, একখান দিবাং?

ও বিষ্ণু! কর্তার এখানত দুইখান মিষ্টি দেং

গ্রামের ছেলেমেয়রা স্কুল পাস দিয়ে এখন দেশের বিভিন্ন কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, কেউ পুলিশের হাতে মার খাওয়া, কাউকে ধরে নিয়ে গেছে, কেউ নিখোঁজএসব নিয়ে চায়ের টেবিলে তুমুল আলোচনার ঝড়। মকবুল হোসেন চ্যাংড়াদের আলোচনা কান পেতে শোনে

: লীগ যে ফ্যাসিবাদী দল, এটা প্রথম চিহ্নিত করেন বদরুদ্দীন উমর। লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদ খণ্ডন করে আসছেন তিনি অনেক আগে থেকে। মাঝির পোলা সজীব বলে।

: যা-ই বলো, মুজিব যে বাঙালির জাতীয় নেতা, এটা অস্বীকার করতে পারবে না। জোলার নাতি সামসু বলে।

: আমি বলি কী শোন, ভাষা আন্দোলনের নেতা হিসেবে যে শেখ মুজিবকে দাঁড় করানো যায়নি, সেটা বদরুদ্দীন উমরের অকাট্য দলিল ভাষা আন্দোলন ও পূর্ববাংলার রাজনীতি বইতে আছে।

: দেখ, আমার বাবা শফিক মিয়া, চাষাভুষা মানুষ, সেও মুক্তিযুদ্ধে গেছে। কোনো সার্টিফিকেট নেয়নি। সার্টিফিকেট থাকলে আজ ভাতা পাইত। আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় একটা চাকরি পাইতাম। তার জন্য আমার বাবার তো কোনো আপসোস নেই।

: দেশের উন্নয়ন তো করেছে মুজিবকন্যা, নাকি?

: তোর কথার সঙ্গে আমি একমত হতে পারলাম না দোস্ত। লীগের নেতারা সারা দেশে যে আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে, সাধারণ জনগণ তাদের নিপীড়নে অতিষ্ঠ। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজন, দলের একটু সমালোচনা করলে তাকে রাজাকারের বাচ্চা ট্যাগ লাগানো, দাড়ি-টুপি দেখলে জঙ্গি বলাএসব কারণে সমাজ ও রাষ্ট্রে বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে। একটা ঐক্যবদ্ধ জাতিকে বৈষম্যের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

: তোর যুক্তি  না হয় মেনে নিলাম, কিন্তু তবু কথা থাকে...

: কথা তো কাউকে বলতে দিচ্ছে না লীগ সরকার। না হলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আজ এ পর্যায়ে যায়? আমাদের রংপুর ভার্সিটির ছাত্র আবু সাঈদ, তার কী দোষ ছিল?

তাকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করল কেন?

মকবুল হোসেন অশ্রুসজল চোখে বলে, এখন হামি তো সন্তান হারা হলুং। এখন সকলে আসতেছে, আসি বলতেছে, হামরাই তোমরার ছ্যেইলা। মনোয়ারা বেগমের কি সেই বিদ্যা আছে, সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাব দেয়?

পরনে আধময়লা শাড়ির আঁচলে ঘোমটা দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলে

পুলিশ গুলি কর্যা হত্যা করিচ্ছে পাখির মতন। পাখি যেন্গা করে মারে, সেন্ক্যা কর্যে, ছেলে হামার কোনঠায় লাপঝাঁপ কর্যে নাই, লাঠি নিয়া আছিলো হাতে, ওটে খালি পার হওয়ার চাইছে...

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ