’
বলতে বলতে পুলিশ এসে পড়ে। দরজায় কড়া নাড়ছে বিকট শব্দে। দেলোয়ারা বেগম ভয় লাগা কণ্ঠে ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করে, ‘কে?’
‘আমরা পুলিশ!’
ঝটপট দরজা খুলে দেন দেলোয়ারা বেগম।
‘এদিকে কেউ এসেছে? ইয়াং ছেলেদের কেউ?’
দেলোয়ারা বেগম বিরস মুখে জবাব দেয়, ‘কই, না তো! কাউকে দেখিনি।’
পুলিশের তবু সন্দেহ হয়। ড্রয়িংরুমে ঢুকে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে।
নাহ, কোনো আলামত শনাক্ত করতে পারে না। দেলোয়ারা বেগমের বুকটা দুরুদুরু করতে থাকে।
পুলিশ চলে যাওয়ার পর মাসুদ বেরিয়ে আসে। নিচু স্বরে কথা বলে—
‘চিন্তা করবেন না, খালাম্মা। সারা দেশের স্কুল, কলেজ, সরকারি-বেসরকারি ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা পথে নেমে গেছে। তাদের সঙ্গে শিক্ষকরা, পেশাজীবী, শ্রমজীবী—সবাই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।’
সাইলেন্ট করা মোবাইলে জসিমের কল আসে, মাসুদ কল রিসিভ করে গলার স্বর নিচু করে কথা বলে—
: দোস্ত, তুই এখন কোথায়?
: তোদের বাসায়। পুলিশ কিছুক্ষণ আগে তোদের বাসায় এসেছে। ভেতরে লুকিয়ে ছিলাম, ধরতে পারেনি।
: তুই কোথায়?
: কামারপাড়ায়। কারফিউ কেউ মানছে না। রাস্তায় মানুষের ঢল।
‘খালাম্মা, আমি আসি’ বলে মাসুদ এই রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে যায়। পেছন থেকে দেলোয়ারা বেগম ডাকেন, ‘মাসুদ, চারটা ভাত খেয়ে যা।’ সেই ডাকে সাড়া দেওয়ার সময় এখন নেই মাসুদের।
চে গুয়েভারার কথা মনে পড়ে মাসুদের। ‘বিপ্লব যেন ঘুমিয়ে না পড়ে’।
দ্বিতীয় বিপ্লবের শক্তি অন্তরে ধারণ করে বুক পেতে দাঁড়িয়ে ছিল আবু সাঈদ। পেছনে ফেরার আর সুযোগ নেই। কে যেন ডেকে বলছে—
‘আমাকে তোমরা দাঁড় করিয়ে দিয়েছ বিপ্লবের মুখে।’
ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসের খিজির যেমন ডাকে—
‘এট্টু জলদি করেন ওসমান সাব! পাও দুইখান মনে লয় ইস্ক্রু মাইরা রাস্তার লগে ফিট কইরা দিছেন!’
বাড়িতে ঢোকার আগেই মকবুল হোসেন স্ত্রীর বিলাপের শব্দ শুনতে পায়। আবু সাঈদের মৃত্যুর পর থেকেই মনোয়ারা বেগম কারণে-অকারণে কাঁদে। তার কান্না কোনোভাবেই থামছে না।
মকবুল হোসেন হাঁটার গতি আরো বাড়িয়ে দেয়। বাড়িতে ঢুকতেই উঠানে আলাউদ্দিন মিয়াকে দেখতে পায়। এতক্ষণে মকবুল হোসেন বুঝতে পারে, তার স্ত্রী মনোয়ারা বেগমের কান্নার উত্স কী।
মদনখালী ইউনিয়নের আলাউদ্দিন তার মেয়ে আয়েশা আক্তার সুইটিকে নিয়ে এসেছে।
মকবুল হোসেন ও আলাউদ্দিনের বন্ধুত্ব ছোটবেলা থেকেই। সেই সূত্রে আলাউদ্দিনের মেয়ে সুইটির সঙ্গে আবু সাঈদের বিয়ের কথাবার্তা প্রায় পাকা ছিল। ভার্সিটির পড়া শেষ হলেই সুইটির সঙ্গে আবু সাঈদের বিয়ে হবে। কিন্তু অল্প কয়েক দিনের মধ্যে কী যে ঘটে গেল!
দেশের জন্য বিপ্লব করতে গিয়ে সাঈদ খুন হলো।
গ্রামের আকাশে-বাতাসে, গাছের পাতায় যেন আবু সাঈদের মৃত্যুশোক ঝরে পড়ছে। সাঈদের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা ঠিক হওয়ার পর ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে কত না স্বপ্নসাগরে ভেসেছে সুইটি! সেই স্বপ্ন আজ ভেঙে চুরমার। পড়ালেখার ফাঁকে রুমের ভেতর যখন একা থাকে, বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে কেন?
পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পর আবু সাঈদের লাশ যখন ছাত্র-জনতা অ্যাম্বুল্যান্সে করে বাবনপুর গ্রামে দাফন করার জন্য নিয়ে আসে, তখন সুইটি আসতে পারেনি। পুরো গ্রাম যেন ভেঙে পড়েছে। সাংবাদিক, টিভি ক্যামেরা, পুলিশের গাড়িতে বাবনপুর সাঈদের বাড়ির সরু রাস্তায় তখন তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। সুইটি তখন নীরবে একাই কেঁদেছে।
আধো ঘুমে কিংবা তন্দ্রার ভেতরে আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন ছোট মেয়ে কুলসুমের ডাক শুনতে পায়—
‘বাপজান, এলা ওঠো। ভাত হছে। খাবার ডাকলুং মা।’
মকবুল হোসেনের চোখের পাতা ঘুমে ভারী হয়ে আছে। কিছুতেই চোখ মেলতে পারে না। ঘুমের মধ্যেই হয়তো আবার তলিয়ে যায়। ঘুমের ভেতর শৈশবে ফিরে যায়। দেশভাগের সেই স্লোগান শুনতে পায়।
ঘুমের মধ্যে বোবায় ধরার মতো গোঙাতে থাকে। গা ধরে কয়েকবার ঝাঁকুনি দেয় মনোয়ারা বেগম, ‘এলা ওঠাং বাজারত যাবার কলাং, বেলা তো যায় গিয়া।’
মকবুল হোসেন জেগে ওঠে। প্রথমে কিছু বুঝতে পারে না, তারপর মনে হলো, করতোয়ার পানি সব এসে গেল যমুনায়। বাজারে জগদীশ সাহার চা দোকানে সন্ধ্যাবেলায় জমজমাট আড্ডা হয়। চাষার ছেলে, জোলার নাতি, মাঝির ভাইস্তা—সব চ্যাংড়া পোলাপানের দল এসে ভিড় করে। চা-সিগারেট খায়, দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে কে হারবে, আমেরিকার নির্বাচনে এবার কে প্রেসিডেন্ট হবে—এসব নিয়ে তর্কবিতর্ক হয়। এ যুগের চ্যাংড়ারা যে দেশ-দুনিয়া নিয়ে এত ভাবে, চিন্তা করে, এটা ওদের পাশে না বসলে কেউ বুঝতে পারে না। হারাধন কবিরাজের দোকানে মানুষের ভিড় দেখে মকবুল হোসেন জগদীশের চা দোকানে এসে বসে।
নীলু মেম্বার একবার নজর দিয়ে চায়।
‘মকবুল ভাই চা খাবাং?’
জগদীশ সাহা ক্যাশ থেকে উঠে এসে নীলু মেম্বারকে দুহাত জোড় করে নমস্কার জানায়।
‘কর্তা, আউজকার মিষ্টি, একখান দিবাং?’
‘ও বিষ্ণু! কর্তার এখানত দুইখান মিষ্টি দেং’
গ্রামের ছেলেমেয়রা স্কুল পাস দিয়ে এখন দেশের বিভিন্ন কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, কেউ পুলিশের হাতে মার খাওয়া, কাউকে ধরে নিয়ে গেছে, কেউ নিখোঁজ—এসব নিয়ে চায়ের টেবিলে তুমুল আলোচনার ঝড়। মকবুল হোসেন চ্যাংড়াদের আলোচনা কান পেতে শোনে—
: লীগ যে ফ্যাসিবাদী দল, এটা প্রথম চিহ্নিত করেন বদরুদ্দীন উমর। লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদ খণ্ডন করে আসছেন তিনি অনেক আগে থেকে।’ মাঝির পোলা সজীব বলে।
: যা-ই বলো, মুজিব যে বাঙালির জাতীয় নেতা, এটা অস্বীকার করতে পারবে না। জোলার নাতি সামসু বলে।
: আমি বলি কী শোন, ভাষা আন্দোলনের নেতা হিসেবে যে শেখ মুজিবকে দাঁড় করানো যায়নি, সেটা বদরুদ্দীন উমরের অকাট্য দলিল ‘ভাষা আন্দোলন ও পূর্ববাংলার রাজনীতি’ বইতে আছে।
: দেখ, আমার বাবা শফিক মিয়া, চাষাভুষা মানুষ, সেও মুক্তিযুদ্ধে গেছে। কোনো সার্টিফিকেট নেয়নি। সার্টিফিকেট থাকলে আজ ভাতা পাইত। আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় একটা চাকরি পাইতাম। তার জন্য আমার বাবার তো কোনো আপসোস নেই।
: দেশের উন্নয়ন তো করেছে মুজিবকন্যা, নাকি?
: তোর কথার সঙ্গে আমি একমত হতে পারলাম না দোস্ত। লীগের নেতারা সারা দেশে যে আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে, সাধারণ জনগণ তাদের নিপীড়নে অতিষ্ঠ। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজন, দলের একটু সমালোচনা করলে তাকে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ট্যাগ লাগানো, দাড়ি-টুপি দেখলে জঙ্গি বলা—এসব কারণে সমাজ ও রাষ্ট্রে বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে। একটা ঐক্যবদ্ধ জাতিকে বৈষম্যের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
: তোর যুক্তি না হয় মেনে নিলাম, কিন্তু তবু কথা থাকে...
: কথা তো কাউকে বলতে দিচ্ছে না লীগ সরকার। না হলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আজ এ পর্যায়ে যায়? আমাদের রংপুর ভার্সিটির ছাত্র আবু সাঈদ, তার কী দোষ ছিল?
তাকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করল কেন?
মকবুল হোসেন অশ্রুসজল চোখে বলে, ‘এখন হামি তো সন্তান হারা হলুং। এখন সকলে আসতেছে, আসি বলতেছে, হামরাই তোমরার ছ্যেইলা। মনোয়ারা বেগমের কি সেই বিদ্যা আছে, সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাব দেয়?’
পরনে আধময়লা শাড়ির আঁচলে ঘোমটা দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলে—
‘পুলিশ গুলি কর্যা হত্যা করিচ্ছে পাখির মতন। পাখি যেন্গা করে মারে, সেন্ক্যা কর্যে, ছেলে হামার কোনঠায় লাপঝাঁপ কর্যে নাই, লাঠি নিয়া আছিলো হাতে, ওটে খালি পার হওয়ার চাইছে...