<p>চিরকালের জন্য দৃষ্টির ওপারে চলে গেলেন বশীর আলহেলাল (১৯৩৬-২০২১)। নিভৃতচারী এই লেখক  ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং বিশেষ করে বাংলা ভাষা ও এর ব্যাকরণ বিষয়ে এত বিচিত্র গবেষণামূলক কাজ করেছেন, যা গুণে-মানেও এতটুকু উপেক্ষণীয় নয়; কিন্তু যে খ্যাতির দ্যুতিতে একজন লেখক পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠেন, সেই আলো পড়েনি তাঁর ওপর। সে পথের সন্ধানও কখনো করেছেন বলে মনে হয় না। দেড় শতাধিক ছোটগল্প পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন প্রায় সাত দশকের সাহিত্যিক জীবনে; কিন্তু গল্পগ্রন্থ করেছেন কয়টি! সে সংখ্যা খুবই নগণ্য।</p> <p>বশীর আলহেলাল ১৯৬৯ সালে যোগ দিয়েছিলেন বাংলা একাডেমিতে, ১৯৯৩ সালে অবসরগ্রহণের পরও লেখালেখি চালিয়ে গেছেন নীরবে। একাডেমিতেই পরিচয় ১৯৭৬ সালে। কিন্তু তাঁর লেখা এবং তাঁকে আরো ভালোভাবে জানার সুযোগ ঘটে দৈনিক বাংলায় কাজ করার সময় (১৯৭৯)। কিংবদন্তি সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবীবের কাছে মাঝে মাঝে আসতেন।</p> <p>হাবীব ভাই এই বিনম্র লেখককে স্নেহ করতেন। তাঁর অনেক লেখা ছেপেছেন। হাবীব ভাইয়ের সহকারী হিসেবে বশীর আলহেলালের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয়। তাঁর সাহিত্যের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ‘আনারসের হাসি’ ছোট গল্পের বই পড়ে। এরপর ‘ক্ষুধার দেশের রাজা’, ‘প্রথম কৃষ্ণচূড়া’, ‘বিপরীত মানুষ’সহ বিভিন্ন গল্পগ্রন্থের সঙ্গে পরিচিত হই। তাঁর যে গল্পটি আমাকে প্রথম মুগ্ধ করেছিল সেটি ‘আত্মহত্যার গাছ’। হাবিল নামের এক সিঁধেল চোরের গল্প। না, একরৈখিক গল্প নয়, দেশভাগ, হিন্দু-মুসলমানের এপার-ওপার চলে যাওয়ার কাহিনিসহ নানা ঘটনায় এই গল্পটি বাঙ্ময়। ইন্ডিয়ায় চলে যাওয়া সদানন্দ বাবুর আমবাগান আর ঘরবাড়ি একাধিক ব্যক্তি কিনেছে। সেই আমবাগানের মালিক এখন রহমত উল্লাহ, বাড়ি ও পুকুরের মালিক নাদের মিয়া, তারই বিবাহিতা মেয়ে আমবাগানের একটি গাছে রাতে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছে। বাগানে আম চুরি করতে গিয়ে গভীর রাতে ঝুলন্ত লাশের হাত থেকে সোনার বালা ছুরি দিয়ে কেটে নিয়েছিল সিঁধেল চোর হাবিল।</p> <p>পরদিন সকালে যখন লাশ দেখে হৈচৈ, তখনই হাবিলের স্ত্রী তাকে ঘুম থেকে ডেকে এই সংবাদ জানায়। শুরুটা এভাবেই। নানা শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত গল্পটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ওই আমগাছে আরো একাধিক মানুষের গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যার কাহিনি এই গল্পের অংশ। এ ঘটনা কিছুটা রহস্যময়ও।</p> <p>উল্লেখ করা দরকার, বশীর আলহেলাল নিজেও দেশভাগের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার অংশীদার। কিশোর বয়সে মুর্শিদাবাদের তালিবপুর গ্রাম থেকে মা-বাবার সঙ্গে চলে আসতে হয়েছিল বাংলাদেশে। ভাষাশহীদ আবুল বরকত, কণ্ঠশিল্পী আব্দুল আলীমসহ বহু বিখ্যাত মানুষ ওই গ্রামের সন্তান। দেশভাগ নিয়ে বশীর আলহেলাল একাধিক গল্প লিখেছেন। তাঁর গল্পে গ্রামজীবনের উপকরণ নানাভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তাঁর আরো একটি গল্প ভালো লেগেছিল, সেটি ‘ঢেঁকিসালের স্বপ্ন’। আমাদের শৈশবে দেখা আবহমান গ্রামীণ ঐতিহ্যের কৃষিজীবী পরিবারের চমৎকার ছবি এই গল্পে উত্কীর্ণ হয়েছিল।</p> <p>না, বশীর আলহেলালের গল্পের আলোচনা বা সাহিত্যের মূল্যায়ন এই স্বল্পপরিসর লেখায় সম্ভব নয়, শুধু প্রয়াত লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তাঁর গবেষণা ও সাহিত্য সাধনার একটি রেখাচিত্র আঁকার চেষ্টা করা যেতে পারে। গল্পকার হিসেবে তাঁর বেশ কিছু লেখা পড়েছি; কিন্তু পূর্ণ পড়া হয়নি তাঁর উপন্যাস ‘কালো ইলিশ ও ঘৃতকুমারী’। সেই অসমাপ্ত পাঠের মধ্য দিয়েও বুঝতে অসুবিধা হয়নি বিষয় নির্বাচনে তিনি সব সময় সিরিয়াস ছিলেন। আরো কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন বশীর আলহেলাল।</p> <p>আমার কাছে সব সময় সৃজনশীল লেখক বশীর আলহেলালের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হয়েছে মননশীল প্রাবন্ধিক গবেষক বশীর আলহেলালকে। বাংলা ভাষার নানা দিক নিয়ে রয়েছে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ, বিশেষ করে ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’, ‘বাংলা একাডেমীর ইতিহাস’, ‘একাত্তরের গণহত্যা : হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট’ (অনুবাদ), ‘বাংলা ভাষার নানান বিবেচনা’, ‘বাংলা গদ্য’, ‘আমাদের কবিতা’, ‘তাঁদের সৃষ্টির পথ’, ‘বাংলা উচ্চারণ’, ‘আদর্শ বাংলা বানান’ (নিয়ম ও শব্দকোষ)—এসব বইয়ের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে। বাংলা একাডেমির ইতিহাস এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তাঁর তথ্যনিষ্ঠ গবেষণা অত্যন্ত উঁচুমানের।</p> <p>তাঁর একটি অনুবাদকর্ম বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। সেটি হচ্ছে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত রিপোর্ট। পাকিস্তানের এককালের প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে ভুট্টো সরকার মুক্তিযুদ্ধের পরপরই মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মাটিতে একাত্তরে পরাজিত জেনারেলদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য করেছিলেন। এখানে সংঘটিত গণহত্যা এবং যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ নিয়ে যেসব তথ্য রেখেঢেকে বলেছিল জেনারেল নিয়াজি ও রাও ফরমান আলীরা, তাতেই আঁতকে উঠেছিল কমিশন। বহু বছর গণহত্যার সেই রিপোর্ট ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। পরবর্তীকালে তা আর চাপা থাকেনি। সেই রিপোর্ট অনুবাদ করে গ্রন্থবদ্ধ করেছেন বশীর আলহেলাল। সন্দেহে নেই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।</p> <p>তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ‘বাংলা ভাষার নানান বিবেচনা’। এ গ্রন্থে নাতিদীর্ঘ সাতাশটি প্রবন্ধ ও পরিশিষ্ট অংশে বাংলা একাডেমির প্রমিত বানান, নিয়মের সমালোচনাসহ বাংলা ভাষাবিষয়ক বহু বিচিত্র দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করেছেন বশীর আলহেলাল। কয়েকটি শিরোনাম উল্লেখ করলে বোঝা যাবে বইটির প্রয়োজনীয়তা এবং ভাষা ও ব্যাকরণ বিষয়ে লেখকের দখলের সীমানা কতটা বিস্তৃত।</p> <p>যেমন—বাংলা প্রচলনের সমস্যা ও পরিভাষা, সরকারি কাজে সাধু ভাষা, না চলিত ভাষা? বাংলা বানান সংস্কার : পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির প্রস্তাব সম্পর্কে অভিমত, ব্যাবহারিক জীবনে ও সংস্কৃতিতে বাংলা ভাষার প্রয়োগের অগ্রগতি, চন্দ্রবিন্দু, বিতর্ক তর্ক নয়, চন্দ্রবিন্দু, টা, টি, আমাদের গণমাধ্যমের বাংলা, বাংলা মুদ্রাক্ষর যন্ত্রের উন্নয়ন ও বৈদ্যুতীকরণ, কবিতার বানান ইত্যাদি।</p> <p>বশীর আলহেলালের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘তাঁদের সৃষ্টির পথ’। প্রায় ৩০ বছর আগে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল বইটি। এই গ্রন্থে মীর মশাররফ হোসেন ও তাঁর বিষাদসিন্ধু, নজরুল কাব্যের দুই ধারা, জীবনানন্দ দাশের জীবনজিজ্ঞাসা, কাজী আবদুল ওদুদের মর্ম পরিচয় ইত্যাদি শিরোনামে বিভিন্ন খ্যাতনামা লেখকের গুরুত্বপূর্ণ রচনার বিশ্লেষণমূলক ১৪টি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’ ও ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাস নিয়ে যে অসামান্য আলোচনা তিনি করেছেন, তাতে তাঁর পঠন-পাঠনের গভীরতাও উন্মোচিত হয়েছে।</p> <p>মৃত্যু জীবনেরই অনিবার্য পরিণাম। চিরসত্য সেই অলঙ্ঘনীয় অনিবার্যতায় ৮৫ বছর বয়সে চলে গেছেন বশীর আলহেলাল। কিন্তু এই যাওয়াই শেষ কথা নয়, তিনি সচেতন পাঠকদের স্মৃতিতে থেকে যাবেন সাহিত্যিক হিসেবে যেমন, বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণের একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক-গবেষক হিসেবেও তেমনি। অথচ এমন নিষ্ঠাবান সাধক-লেখক দীর্ঘদিন বেঁচে থেকেও লেখক কিংবা গবেষক হিসেবে রাষ্ট্রীয় একুশে পদকের মতো সম্মাননা অর্জন করতে পারলেন না! এ কথা ভেবেও এ মুহূর্তে কষ্ট পাচ্ছি। তাঁর আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি।</p>