যখন ঘুম ভাঙল, তখন হাতঘড়িতে ১০টা। মাহমুদ চোখ কচলে আবার ঘড়ির দিকে তাকাল। ঠিক ১০টাই। তড়িঘড়ি বিছানা থেকে নামল।
জন্মদিন
মুহাম্মদ মহিউদ্দিন

টেনশন হলে কোনো কাজই ঠিকমতো হয় না। মাহমুদেরও তাই। পত্রিকা পড়া, বাথরুম সারা কোনোটাই নিয়মমাফিক হচ্ছে না।
এ সময়ে আবার কে এলো? সকালে তো বুয়া আসে না। ময়লা নেওয়ার লোক—কী জানি। মাহমুদ ভাবছে আর...। আবার কলিংবেল বাজল।
অসমাপ্ত রেখেই মুখে পানির ঝাপটা দিল। পত্রিকাটা বিছানায় ফেলে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে দরজার কাছে গেল। ফুটো দিয়ে দেখল একজন লোক বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝবয়সী। মাহমুদ দরজা খুলল। লোকটি সালাম দিল।
—আপনি কি ইকবাল মাহমুদ পাটোয়ারী?
—কেন, বলুন তো?
—বলার জন্যই তো সাতসকালে এসে হাজির হয়েছি। বলতে বলতে লোকটি অনেকটা জোর করেই ড্রইংরুমে ঢুকে পড়লে মাহমুদ বাধা দিতে গিয়েও পারল না।
—স্যরি, পারমিশনের অপেক্ষা না করেই ঢুকে পড়লাম। আসলে আমি বিপদে পড়েছি। লোকটা বলল।
—কী বিপদ?
—আগে বলুন, আপনি ইকবাল মাহমুদ পাটোয়ারী কি না?
—কেন? আপনার পরিচয় কী?
—সবই বলব। তার আগে আপনার পরিচয়টা আমার নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
—যদি বলি ইকবাল মাহমুদ পাটোয়ারী নই?
—সত্যি আপনি ইকবাল মাহমুদ পাটোয়ারী নন?
মাহমুদ চুপ করে থাকে। দেয়ালের ঘড়ির দিকে তাকায়। মোবাইলটা বেডরুমে। মাহমুদের মনে রাগ জমছে। ইচ্ছা করছে লোকটিকে গলাধাক্কা দিয়ে বের দেয়; কিন্তু পারছে না।
—চুপ করে আছেন কেন? লোকটি বলে থামল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে টিপল। বেডরুমে মোবাইলটা বেজে উঠল। মাহমুদ বেডরুমের দিকে যেতে চেয়েও থামল।
—যান কল রিসিভ করুন। চুরি-ডাকাতির ভয় নেই।
মাহমুদ লোকটির দিকে তাকাতে তাকাতে ভেতরে গেল। মোবাইলে রিং বন্ধ হয়েছে। মাহমুদ মোবাইল হাতে নিয়ে ড্রইংরুমে এলো। স্ক্রিনের নম্বরটা অপরিচিত।
লোকটি আবার মোবাইল টিপল। মাহমুদের হাতে মোবাইল বেজে উঠল। মাহমুদ কল রিসিভ করতে যাবে তখনই লোকটি বলল, কলটা আমিই দিয়েছি। তাহলে আপনিই ইকবাল মাহমুদ পাটোয়ারী। কিছু মনে করবেন না। আপনার নামটা একটু বেশি বড়, আমি কী আপনাকে পাটোয়ারী সাহেব বলে ডাকতে পারি?
—হ্যাঁ, বলুন। মাহমুদ রাগত স্বরে বলল।
—আমি হাসান রায়হান। আমাকে হাসান অথবা রায়হান—দুটির যেকোনো একটি ডাকতে পারেন। আমার কোনো আপত্তি নেই।
—কোনোটাই আমার ডাকার ইচ্ছা নেই। আপনি কেন এসেছেন বলুন? আমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
—মাঝেমধ্যে অফিসের দেরি হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ রকম এক-আধটু সবার হয়ে থাকে।
—আপনি কেন আমাকে বিরক্ত করছেন বলুন তো?
—ফ্ল্যাটটা তো বেশ বড় পরিপাটি-সুন্দর, একাই থাকেন বুঝি?
—একা না দোকলা থাকি—তা জেনে আপনার লাভ কী?
—লাভ নিশ্চয়ই আছে। এ ছাড়া প্রতিটি ক্ষেত্রে লাভ-ক্ষতির অঙ্ক কষে জীবন চলে না।
মাহমুদের বিরক্তির মাত্রা থার্মোমিটারের পারদের চেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে। পায়চারি করছে সে। লোকটিও ড্রইংরুমে পায়চারি করছে। দুজনই চুপচাপ। লোকটি পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে।
—দিয়াশলাই হবে?
মাহমুদ খটমট করে লোকটির দিকে তাকায়।
—দিয়াশলাই হবে? গলার ভলিউম বাড়িয়ে লোকটি আবার বলে। মাহমুদ কোনো উত্তর দেয় না। রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। লোকটি সিগারেট বের করে দুই আঙুলের মাঝখানে চেপে ধরেছে। পায়চারি করছে আর ঘরের আসবাব দেখছে।
কিছুক্ষণ পর মাহমুদ দিয়াশলাই নিয়ে ফিরে আসে। বাড়িয়ে দেয় লোকটির দিকে। ফস করে একটি সিগারেট ধরায় লোকটি। তারপর খুক খুক করে কেশে বলে, পাটোয়ারী সাহেব, আপনার দিনটা মাটি করার জন্য আমি দুঃখিত।
—ধন্যবাদ, এবার আসুন। বিরক্তি নিয়ে জবাব দেয় মাহমুদ।
—হ্যাঁ, আসছি। লোকটি কয়েক পা গিয়ে আবার ফিরে আসে। আসল কথাই তো বলা হয়নি।
মাহমুদ চোখ তোলে। কপাল কুঁচকায়। শোনার প্রবল আগ্রহ নিয়ে লোকটির দিকে তাকায়। লোকটি চুপচাপ। বলুন।
—বৃষ্টিকে চেনেন?
মাহমুদ চমকে ওঠে। তারপর ও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে প্রশ্ন করে, কোন বৃষ্টি?
—এমন একটা ভাব করছেন যেন চেনেন না?
মাহমুদ কী বলবে বুঝতে পারে না। এর পরও নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, আপনি কোন বৃষ্টির কথা বলছেন?
—যে বৃষ্টি আপনার একাকী জীবনকে মধুময় করে তোলে। যাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ান, পার্কে-রেস্টুরেন্টে...। থামে লোকটি।
—মাহমুদর ধমকের সুরে বলে, কী বলতে চান?
—বলতে চেয়েছিলাম আপনি বৃষ্টিকে চেনেন কি না?
—না, চিনি না! মাহমুদ রেগে যায়।
—রাগবেন না, আপনার মঙ্গলের জন্যই এখানে এসেছি। বৃষ্টি আত্মহত্যা করেছে।
মাহমুদের মাথায় যেন বজ্রপাত হয়। চোখ কপালে তোলে। ভ্রু কুঁচকে লোকটির দিকে তাকায়। —বৃষ্টি আত্মহত্যা করেছে?
—হ্যাঁ। এবং চিরকুটে লিখে গেছে তার মৃত্যুর জন্য আপনিই দায়ী। পুলিশ লাশ নিয়ে গেছে। আমি চিরকুটটা নিয়ে পালিয়ে এসেছি। বাঘে ছুলে আঠারো ঘা আর পুলিশে ছুলে ছত্রিশ ঘা। পুলিশি জেরায় আমরা কেউ রেহাই পাব না।
—আপনি বৃষ্টির কে হন? মৃদুস্বরে বলল মাহমুদ।
—হাজব্যান্ড। স্বামী দেব।
মাহমুদ রায়হানকে আপাদমস্তক দেখে। আপনি বৃষ্টির হাজব্যান্ড!
—প্রমাণ চান? নাকি পুলিশের হাত থেকে বাঁচার উপায় খুঁজবেন! আমার মনে হয় দ্বিতীয়টাই এখন জরুরি।
—ও হঠাৎ আত্মহত্যা করতে গেল কেন? মাহমুদ বলল।
—প্রশ্নটা তো আমারও। নিশ্চয়ই আপনাদের মধ্যে সে রকম কিছু ঘটেছে? আপনার আর বৃষ্টির সম্পর্কটা কেমন বলুন তো?
—বন্ধুর মতো। আমরা একে অপরের ভালো বন্ধু।
—শুধুই বন্ধু? নাকি...। রায়হান থামে। আপনাদের সম্পর্কের বিষয়টা আমি অনেক আগেই টের পেয়েছিলাম। কিন্তু বৃষ্টির স্বামী হিসেবে ওকে বাধা দিতে পারিনি। কারণ সব সময় ওর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েছি। ওকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছিলাম। ব্যবসায়ী বলে বেশির ভাগ সময় আমাকে ঢাকার বাইরে, দেশে-বিদেশে কাটাতে হয়েছে। হচ্ছে। তাই ওর চলাফেরার স্বাধীনতায় কখনো বাধা দিতাম না। বৃষ্টির প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল। কিন্তু...। একনাগাড়ে অনেকক্ষণ বলে থামে রায়হান।
সুনসান নীরবতা। মাহমুদ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বেলা ১২টা পেরিয়ে গেছে। সকালের নাশতার কথা মনে নেই। দুপুরে খাবারের সময় হয়ে আসছে। হঠাৎ মাহমুদের মোবাইল বেজে ওঠে। মাহমুদ চমকে ওঠে। মাথা থেকে শীতল রক্ত বেয়ে যেন পায়ের দিকে গড়িয়ে যায়। অফিসের ফোন।
হ্যালো। জি বলছি। না, জানি না। ঠিক নেই। এলে জানাব। রাখি। মাহমুদ মোবাইল অফ করল। রায়হান বুঝতে পারল অফিসের ফোন। এতক্ষণ সোফায় পা তুলে বসেছিল রায়হান। উঠে আবার পায়চারি শুরু করে।
—জীবনে এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হব ভাবতেই পারিনি। মানসম্মান, সমাজ সব যে একই সঙ্গে গেল, হাতে আঙুল মোড়াতে মোড়াতে বলল রায়হান।
—হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছি।
—ভেবে কী হবে? এখন কী করবেন তাই বলুন। আচ্ছা আপনার আর বৃষ্টির মধ্যে কী এমন ঘটেছিল যে বৃষ্টি আত্মহত্যা করতে পারে? বলল রায়হান।
—কই তেমন কিছু তো ঘটেনি।
—তাহলে? সত্যি করে বলুন তো, বৃষ্টিকে ভালোবাসতেন কি না? ওর তো এখন পোস্টমর্টেম চলছে। সত্যি কথা বললে আপনার কোনো সমস্যা হবে না।
পোস্টমর্টেমের কথা শুনে চমকাল মাহমুদ। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, —হ্যাঁ, বাসতাম।
—অন্যের সংসারে যে আপনি বিষফোড়া হয়ে ঢুকেছেন, সেটাও বুঝতে পারেননি?
—দেখুন রায়হান সাহেব, এখন ওসব বলে তো কোনো লাভ নেই। বৃষ্টি তো চলে গেছে। মাহমুদ দুই হাতে মাথা চেপে ধরে সোফায় বসে পড়ে। রায়হান টেবিলের কাছে গিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে পান করে। ফিরে মাহমুদের কাছে এসে বসে। মাথার ওপর সিলিং ফ্যানটা ঘুরছে। তার পরও ঘামছে মাহমুদ।
—ডোন্টওয়ারি পাটোয়ারী সাহেব। আমি তো আপনার পাশে আছি। আফটার অল আমার স্ত্রীকে ভালোবাসতেন। থামে রায়হান। আবার বলে, আপনি বিয়ে করেছেন?
—আমার প্রসঙ্গ থাক। বলল মাহমুদ।
—শুধু এটুকু বলুন, বিয়ে করেছেন কি না?
—হ্যাঁ, করেছিলাম। রাগত স্বরে বলল মাহমুদ।
—করেছিলেন? আর কিছু বলতে হবে না। বৃষ্টি যদি আমাকে ছেড়ে আপনার কাছে চলে আসত তাকে কি গ্রহণ করতেন?
—হ্যাঁ করতাম। কারণ তাকে আমি ভালোবাসতাম এবং বৃষ্টিও আমাকে ভালোবাসত।
—কাল রাতে ঘুমানোর আগে বৃষ্টি কী বলেছিল জানেন? আজ নাকি ওর খুব কাছের বান্ধবীর জন্মদিন। বিকেলে পার্টি আছে। সেখানে তাকে যেতেই হবে। তাই আমার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে ও অ্যাটেন্ড করবে না।
রায়হানের কথা শুনে চমকায় মাহমুদ। এতক্ষণে মনে পড়ে আজ তার জন্মদিন। বিকেলে বৃষ্টির আসার কথা। দুজনে লং ড্রাইভে যাবে। সাভারে কোনো নয়নাভিরাম বাংলোতে রাত কাটাবে। অনেক মজা করবে।
—কী ভাবছেন পাটোয়ারী সাহেব? বলল রায়হান।
রায়হানের কথায় সংবিৎ ফিরে পায় মাহমুদ।
—ও না, কিছু না। রায়হান সাহেব আপনি বসুন। আমি বাথরুম থেকে আসছি।
মাহমুদ ওর ঘরের দিকে যায়। রায়হান সোফায় পা তুলে আয়েশ করে বসে। মাহমুদ বাথরুমের দরজায় সিটকিনি লাগিয়ে ফোন করে বৃষ্টিকে। বৃষ্টির মোবাইল বন্ধ। মাহমুদের ভয় বেড়ে যায়। বুঝতে পারে রায়হানকে হাতে না রাখলে তার বিপদ হতে পারে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। মাহমুদ ফ্রিজ থেকে কয়েকটা আপেল এনে রেখেছিল। তাই খেয়েছে দুজন।
—মাহমুদ সাহেব! বৃষ্টিকে আমিও খুব ভালোবেসেছিলাম। সব সময় চাইতাম ও হাসি-খুশি থাকুক। আনন্দে থাকুক। ওর কোনো ইচ্ছাকে আমি বারণ করতাম না। দেশের বাইরে, এমনকি দেশেও ভালো কিছু চোখে পড়লে ওর জন্য কিনে নিতাম। বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রায়হান। দম নেয়। আবার বলতে থাকে—কিন্তু ধরে রাখতে পারলাম না। তাকে এত ভালোবাসতাম! সে ভালোবাসত আপনাকে? যার জন্য আমি ছুটে আসতাম, সে ছুটে যেত অন্যের কাছে। পৃথিবীটা কেমন যেন। আমারও আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না। কিসের অভাব ছিল বৃষ্টির। বাড়ি, গাড়ি, অর্থ—কী ছিল না তার! তার পরও ভালোবাসার খাঁচায় বৃষ্টিকে বেঁধে রাখতে পারলাম না।
হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে রায়হান। মাহমুদ কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। সান্ত্বনা দেয়। সান্ত্বনার বাণী রায়হানের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না।
কলিংবেল বেজে ওঠে। মাহমুদ বেশ চমকে যায়। রায়হান কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে।
—পুলিশ নয়তো? বলল মাহমুদ।
আবার কলিংবেল বেজে ওঠে। মাহমুদ দরজা খুলতে ইতস্তত করে। একবার রায়হানের দিকে তাকায়, আবার দরজার দিকে। কলিংবেল বেজে চলে, মাহমুদ ভয়ে ভয়ে সিটকিনি খুলে চমকে যায়। অপরূপ সাজে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টি।
—কি ঘুমিয়েছিলে? বলতে বলতে ভেতরে ঢোকে বৃষ্টি।
ড্রইংরুমের সোফায় রায়হানকে বসা দেখে রক্ত শীতল হয়ে যায়। বৃষ্টির মুখ দিয়ে কোনো শব্দই বের হয় না। মাহমুদ ও বৃষ্টি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রায়হানের দিকে। রায়হান ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। মাহমুদও বৃষ্টির কাছাকাছি আসে।
হাসতে হাসতে রায়হান বলে—ইকবাল মাহমুদ পাটোয়ারী সাহেব, আপনার বৃষ্টি আপনারই জন্মদিন পালন করতে ছুটে এসেছে। সারাটা দিন আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। তবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি অকপটে সব কিছু স্বীকার করার জন্য। মহা আনন্দে জন্মদিন উদযাপন করুন বাকি জীবনে। মিসেস বৃষ্টি? বৃষ্টির ফ্যাকাসে চেহারাটা আরো মলিন হয়ে যায়।
কাগজপত্র আমি পাঠিয়ে দেব। আর যা কিছু আপনার পছন্দের সব। মাহমুদ সাহেব, আপনারা ভালো থাকুন।
বেরিয়ে যায় রায়হান। মাহমুদ ও বৃষ্টি খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে।
সম্পর্কিত খবর

বই আলোচনা
মাশির হোসেন হিরু স্মারকগ্রন্থ বিস্মৃতি থেকে স্মৃতিতে

সাংবাদিক মাশির হোসেন, যিনি হিরু ডাকনামে অধিক পরিচিত। তাঁর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী ও সুধীজনের কাছে তিনি স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। প্রায় দুই দশক পরেও তাঁরা তাঁকে ভুলে যাননি; মনে রেখেছেন। মুস্তাফা মজিদ সম্পাদিত ‘মাশির হোসেন হিরু স্মারকগ্রন্থ : বিস্মৃতি থেকে স্মৃতিতে’ তারই প্রমাণ।
মায়ানমারের ইয়াঙ্গুনে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর শৈশব কাটে ঢাকার আর্মানিটোলায়, পরবর্তীতে শান্তিনগরে। স্বাধীনচেতা মাশির হোসেন তাই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতা। শুরু করেন স্পোর্টস রিপোর্টার হিসেবে। ভাষা আন্দোলনে ছিল তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ।
স্মারকগ্রন্থের সম্পাদক মুস্তাফা মজিদ বলেছেন, অন্য অনেক স্মারকগ্রন্থের মতো মাশির হোসেন হিরু স্মারকগ্রন্থও সাদামাটা, যা ভালোবাসার মানুষদের স্মৃতিচারণাই। যদিও কোনো কোনো বৃহৎ ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেছেন কেউ কেউ, তা সত্ত্বেও তার ভেতরেই ফুটে উঠেছে এক অনন্য অকৃত্রিম দরদ এবং মাশির হোসেনের চরিত্রের নানা দিক, যা তাঁকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করেছে বর্তমান প্রজন্মের মানুষদের মাঝে; বিশেষত সাংবাদিকতাজগতে যাঁরা এ প্রজন্মের, যাঁদের অনেকেই মাশির হোসেনকে ব্যক্তিগতভাবে দেখেননি এবং চেনেন না। তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন এই গ্রন্থে যাঁরা লিখেছেন তাঁদের সবাইকে।
এই স্মারকগ্রন্থে লিখেছেন আমানউল্লাহ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এরশাদ মজুমদার, আবুল কাসেম ফজলুল হক, মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, মনোয়ার হোসেন, লুত্ফুর রহমান, সৈয়দ দীদার বখত, দীপা দত্ত (সেন), গোলাম তাহাবুর, ড. মাহবুব উদ্দীন চৌধুরী, ইকবাল সোবহান চৌধুরী, রফিকুর রহমান, কাজিম রেজা, আব্দুল আউয়াল ঠাকুর, এ কে এম মহসিন, এলাহী নেওয়াজ খান, আহমদ আখতার, কাজী রওনাক হোসেন, মমতাজ বিলকিস, মারুফ কামাল খান, খায়রুল আনোয়ার, সৈয়দ আবদাল আহমদ, ফজলুল বারী, মোস্তফা কামাল মজুমদার, শওকত মাহমুদ, বুলবুল আহমেদ, মাহমুদ শফিক, শওকত আনোয়ার প্রমুখ।
এ ছাড়া আছে মাশির হোসেন হিরুর লেখা, জীবনবৃত্তান্ত ও কিছু দুর্লভ আলোকচিত্র, যা এই গ্রন্থকে আরো আকর্ষণীয় করেছে। আশা করি, মাশির হোসেন হিরুকে জানতে স্মারকগ্রন্থটি নতুন প্রজন্মকে সাহায্য করবে।
রিহাম হাসান

পাঠকের প্রিয় বই
যেন কারো একান্ত গোপন চিঠির খাম খুলেছি
- তাওহীদাহ্ রহমান নূভ, বাংলা বিভাগ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

চিঠিপত্র তো ব্যক্তিমানসের মুকুর। কেবল এই মুকুরকেই কাজে লাগিয়ে রচিত হতে পারে অনবদ্য কোনো উপন্যাস, এটা হয়তো বুদ্ধদেব গুহর আগে ভাবেননি কোনো কথাকার। শুধু আঙ্গিকেই নয়, বহু দিক থেকে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ‘সবিনয় নিবেদন’ নামের চমৎকার এই উপন্যাস। শিক্ষিত, স্বাবলম্বী ও উদারমনা এক নারী ঋতার সঙ্গে বেতলার জঙ্গলে এক চরম বিপন্ন মুহূর্তে একঝলক দেখা হয়েছিল ঝকঝকে, ব্যক্তিত্ববান অফিসার রাজর্ষি বসুর।
‘সবিনয় নিবেদন’-এর মতো বই পড়া যেন এক ধরনের নীরব সাধনা। যেন কারো একান্ত গোপন চিঠির খাম আমি খুলে বসেছি, যার ভাঁজে ভাঁজে জমে আছে অভিমান, ব্যথা, অরণ্যের ঘ্রাণ আর অপ্রকাশিত ভালোবাসা।
প্রথম থেকেই মনে হয়েছে, উপন্যাস পড়ছি, না একটি রাগপ্রবণ, বেদনাঘন রাগিণী শুনছি। যেন এক পিয়ানো, যার কিছু চাবি বাজে না, কিছু অতিরিক্ত সুর তুলে দেয়। বুদ্ধদেব গুহর ভাষা এতটাই স্বচ্ছ ও জীবন্ত যে চরিত্রের চোখের জলও যেন স্পষ্ট অনুভব করা যায়।
প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন একটি কুয়াশাময় সকাল—অস্পষ্ট, কিন্তু অনুভবে পরিপূর্ণ। সম্পর্ক এখানে নদীর মতো—প্রবহমান, বাঁক নেয়, স্রোতের নিচে পাথর লুকিয়ে থাকে। লেখকের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা অনুভবগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত, যেন পাঠকের আত্মজগতে আয়না ধরে রাখা হয়েছে, যেখানে নিজের ভেতরের চেহারা ধরা পড়ে, যেটা আমরা অনেক সময় এড়িয়ে যাই। ভালোবাসার বর্ণনা এ উপন্যাসে কোনো একপেশে আবেগে সীমাবদ্ধ নয়।
গ্রন্থনা : পিন্টু রঞ্জন অর্ক

বিশ্বসাহিত্য
জার্মান লেখক সেবাস্টিয়ান হাফনারের উপন্যাসের চমক

সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে জার্মান সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ ও লেখক সেবাস্টিয়ান হাফনারের উপন্যাস ‘আবসিড’ বা ‘বিদায়’। হাফনারের জন্ম ১৯০৭ সালে, মারা যান ১৯৯৯ সালে। ‘আবসিড’ বা ‘বিদায়’ নামের উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় প্রয়াত লেখকের ড্রয়ার থেকে। উপন্যাসটি লেখা হয় ১৯৩২ সালের ১৮ অক্টোবর থেকে ২৩ নভেম্বরের মধ্যে।
এ বছর এ উপন্যাস প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয় হওয়ার কারণ হলো, এখানে ইতিহাসের খুব কঠিন সময়ের সাদামাটা জীবনের গল্প বলা হয়েছে।
ফাহমিদা দ্যুতি

এক ঘণ্টা
- জামান আখতার

রাত সাড়ে আটটায় ঢাকা শহরের সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় সরকারি আদেশমতো।
সিটি শপিং মলের আটতলার সব দোকান আটটায় দ্রুত বন্ধ করে দিচ্ছে। ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই লিফট-সিঁড়ি বেয়ে নেমে শপিং মল ত্যাগ করছে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে সিকিউরিটি গেটে সবার চলে যাওয়ায় সহযোগিতা করছে।
রাত সাড়ে আটটা বাজার কিছুক্ষণ আগে ছয়তলা থেকে হন্তদন্ত হয়ে মাস্ক পরা এক স্মার্ট যুবক আশিক লিফটে চড়ে ডোর ক্লোজ বাটন টিপে ঘুরে দাঁড়াল। দেখল, লিফটের কোনায় কিছু শপিং ব্যাগ হাতে একটু ঘুরে দাঁড়ানো সালোয়ার-কামিজ হিজাব-নেকাব পরা এক যুবতি।
লিফট নিচে নামতেই সহসা একটা শব্দ করে থেমে গেল।
: কী হলো?
অস্ফুট স্বরে আশিক বলল—
: কারেন্ট চলে গেল।
: লোডশেডিং!
: ভয় পাবেন না। জেনারেটর ছাড়লেই লিফট চলবে।
সিঁড়ি বেয়ে সবাই নেমে শপিং মল ত্যাগ করল। মার্কেট শূন্য। শুধু অন্ধকার লিফটের ভেতরে আটকা পড়ে আছে আশিক আর একটি রক্ষণশীল নারী।
আশিক তার মাস্ক খুলে মোবাইলের লাইট অন করল। বেশ আলোকিত হলো লিফট।
: হ্যালো। হ্যালো লিফটম্যান। হ্যালো হ্যালো।
আশিক ইন্টারকম বক্সে কারো কোনো সাড়াশব্দ পেল না। সিকিউরটি রমিজ শপিং মলের আন্ডারগ্রাউন্ড কার পার্কিং থেকে একজনের গাড়ি বিদায় করছে। লিফটে বন্দি আশিক চিৎকার করে বলছে—
: কে আছ, লিফটের দরজা খোলো। আমরা আটকা পড়েছি।
সিকিউরিটির কানে তখনো আওয়াজ পৌঁছেনি। আশিক লিফটের দরজায় ডান হাতে অনবরত ঘুষি মারছে আর বলছে—
: আমরা লিফটে আটকা পড়েছি। কে আছ, জেনারেটর চালু করো। নয়তো লিফট ভেঙে ফেলব। ভেঙেই ফেলব।
আশিকের এই আর্তচিৎকারে বিমর্ষ মেয়েটি। সিকিউরিটির কানে আওয়াজ পৌঁছল। দ্রুত সিকিউরিটি লিফট ইন্টারকম বাটন টিপে বলে—
স্যার স্যার, আমি মার্কেট সিকিউরিটি রমিজ।
: তোমাদের লিফটম্যানকে বলো জেনারেটর চালু করতে।
: স্যার, লিফটম্যান করিম ভাই তো সন্ধ্যাবেলা বাইত চইলা গেছে।
: তুমি তাড়াতাড়ি জেনারেটর চালু করো।
: কেমনে চালু করুম স্যার, সারা দিন তিনবার কারেন্ট গেছে। জেনারেটরে তেল নাই।
: লিফটের চাবি নিয়ে, তুমি লিফট ফ্লোর লেভেলে এনে দরজা খুলে আমাদের দুজনকে বের করো।
: স্যার লিফটের চাবি তো লিফটম্যান করিম ভাইয়ের কাছে থাকে। যাইবার সময় কইলো, মার্কেট বন্ধ হইলে লিফটের কারেন্ট পাওয়ার যেন আমি অফ কইরা দেই।
তোমার করিম ভাইকে ফোন করে লিফটের চাবি নিয়ে আসতে বলো।
: আইচ্ছা, ফোন দিতাছি স্যার। চিন্তা কইরেন না।
আশিক লক্ষ করল, মেয়েটি গরমে ঘামছে। আশিক একা মনেই বলল—
: উহ্! এই গরমে টিকব কী করে?
মেয়েটি আঁতকে উঠল—
: অ্যাঁ! তাহলে?
লিফটের ইন্টারকম বেজে উঠল। আশিক দ্রুত ঘুরে তাকল লিফটের সাউন্ড বক্সের দিকে।
: হ্যাঁ, করিম মিয়া আসছে তো?
সিকিউরিটি রমিজ বলল—
: না স্যার। ম্যালা চেষ্টা করলাম, করিম ভাইয়ের মোবাইল বন্ধ।
আশিক উদ্বিগ্ন স্বরে বলল—
: হোয়াট!
শব্দ শুনে মেয়েটি আচমকা বলে উঠল—
: হায় আল্লাহ, এখন উপায়!
রমিজ মিয়া বলল—
আল্লাহ ভরসা। এক ঘণ্টার মধ্যেই কারেন্ট চইলা আসবো। তার পরেও আমি বিদ্যুৎ অফিসে খবর লইতাছি।
আশিকের মোবাইল আলোয় কী অদ্ভুত ঐন্দ্রজালিক অন্ধকার লিফটের চার দেয়ালের ভেতরে চৈত্রদাহে পুড়ছে, দুজন অচেনা-অজানা লিফটযাত্রী।
এক ঘণ্টার লোডশেডিং হলে বিদ্যুৎ আসতে এখনো চল্লিশ মিনিট বাকি। কতক্ষণ আর লিফটে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। মেয়েটি শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে লিফটে বসে পড়ল। আশিকও বসে লম্বা করে পা মেলে দিল। আশিক লক্ষ করল, মেয়েটি শপিং ব্যাগ থেকে একটি পণ্যের প্যাকেট বোর্ড ছিঁড়ে হাতপাখা করে বাতাস তুলে নিচ্ছে তার গায়ে। গরমে হিজাব-নেকাব ভিজে একাকার। আশিক তার কাঁধে ঝোলানো লেদার সাইড ব্যাগ থেকে মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা বের করে মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিল। মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিয়ে, কী যেন ভেবে হাতটা সরিয়ে নিল। আশিক ব্যাপারটা বুঝে বোতলের কক খুলে সামান্য পানি নিজে মুখে ঢেলে নিল। মেয়েটির মনে যেন একটা বিশ্বস্ততা ফুটে উঠল অজানা আশিকের প্রতি। এবার মেয়েটি হাত বাড়িয়ে মিনারেল বোতলটি ধরতেই চমকে উঠল, আশিকের হাতের আঙুল ফেটে তরতর করে রক্ত ঝরে পড়ছে। মেয়েটি পানির বোতলটা নিয়ে লিফটের ফ্লোরে রেখে দ্রুত তার মুখে আবৃত সাদা নেকাবটা টান দিয়ে খুলে আশিকের রক্ত ঝরা আঙুলে পেঁচিয়ে দিতে উদ্যত হলে আশিক হাত সরিয়ে নিয়ে খুব বিনয়ের সুরে বলে—
: য়ু হু। আগে আপনার গলাটা ভিজিয়ে নিন।
মেয়েটি বোতল তুলে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নেকাব দিয়ে আশিকের রক্ত ঝরা আঙুল পেঁচিয়ে বেঁধে দিল। আশিক এক অনন্যা অপ্সরী সুন্দরী নারীর রূপে অভিভূত হলো।। সহসা একটা নিষ্পাপ সুন্দর যেন আশিকের মনকে এই বন্দিত্বের কথা ভুলিয়ে দিল। মেয়েটিকে বলল—
: আমি আশিক। আপনি?
: নাজমা!
: তো, এত প্যাকেট, কী শপিং করলেন?
: গায়েহলুদের কিছু সামগ্রী।
: ও! আপনার গায়েহলুদ?
: জি না। ছোট বোন সূচনার কাল হলুদসন্ধ্যা।
: তো, সাথে কেউ আসেনি?
: বাবা নেই। মা বুড়ো মানুষ!
: সূচনা?
: সামান্য ক’টা আইটেম, ভাবলাম একাই পারব।
: আপনার হাজব্যান্ড?
: জি!
নাজমা আঁতকে উঠল। আশিক বলল—
: চমকে উঠলেন যে!
: এমনি।
: না...বলছিলাম, ছোট বোনের বিয়ে, আপনার হাজব্যান্ডকে নিয়ে...
: নেই।
: নেই, মানে ছোট বোনকে বিয়ে দিয়ে তারপর...
: বিয়ে, ঘর-সংসার—এসব নিয়ে আর ভাবছি না।
: কেন?
: ব্যাপারটা কোথায় যেন একটু কমপ্লিকেটেড মনে হচ্ছে। তাহলে কি আপনার হাজব্যান্ড...
: ছিল।
: তো, এখন উনি...
আশিক লক্ষ করল, নাজমার চোখ ভিজে যাচ্ছে। যেন জীবনের কোনো একটা অতৃপ্ত গল্প লুকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সহসা আশিকের মোবাইল বেজে উঠল। রিসিভ করল—
: হ্যালো, মা। এইতো একটা জায়গায়। কারেন্ট এলেই চলে আসব। জি। জি মা।
আশিক মোবাইল বন্ধ করল—
: বিপদে আছেন, মাকে বুঝতে না দিয়ে ভালোই করেছেন। আমার মা আর সূচনা হয়তো আমাকে ফোন দিয়ে পাচ্ছে না।
: সঙ্গে মোবাইল আনেননি।
: চার্জ নেই।