যদি ৩৫ শতাংশ শুল্ক বহাল থাকে, তাহলে সত্যিই টিকে থাকা কঠিন হবে।’
ক্রেতাদের থেকে কার্যাদেশ বাতিল বা বিলম্বিত ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওয়ালমার্ট তাদের একটি সরবরাহকারীকে কার্যাদেশ বিলম্বিত করার কথা বললেও বাতিল করার কোনো ঘটনা জানা যায়নি।’
বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশের রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক শিল্প বর্তমানে এক নজিরবিহীন অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্কের কারণে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হুমকির মুখে পড়েছে। এ পরিস্থিতি সামাল না দিলে শুধু রপ্তানি নয়, দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি, কর্মসংস্থান ও সামাজিক স্থিতিশীলতাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
আড়াই বিলিয়ন ডলার বাড়তি শুল্ক দিতে হবে বাংলাদেশকে : অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (ওটেক্সা) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বাংলাদেশ থেকে ৭.৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক আমদানি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সর্বনিম্ন শুল্ক ১৫.৫০ শতাংশ বিবেচনা করলে এই আমদানির মোট শুল্কের পরিমাণ হবে ১.১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে আরোপ করা ৩৫ শতাংশ শুল্ক যদি গত বছরের শুল্কের সঙ্গে যোগ করা হয় তবে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩.৭১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ শুল্ক আলোচনায় সমঝোতা না হলে গত বছরের চেয়ে ২.৫৭ বিলিয়ন ডলার শুল্ক অতিরিক্ত দিতে হবে বাংলাদেশকে।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তাঁদের জন্য অন্য দেশে গিয়ে উৎপাদন করা কঠিন। এর প্রধান কারণ হলো—আমাদের অবকাঠামো, দক্ষ শ্রমিক ও তৈরি পোশাক খাত পরিচালনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। নতুন শুল্ক কমিয়ে আনতে বাংলাদেশকে ত্বড়িত উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য আনতে হবে, যাতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। অভ্যন্তরীণ ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে, পণ্যের উদ্ভাবন করা অব্যাহত রেখে এবং নতুন বাজারে বৈচিত্র্য আনার মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এবং তৈরি পোশাক খাতে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারে বাংলাদেশ।’
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ফের আলোচনা : প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়েছে, দুই দেশের প্রতিনিধিরা আবারও আলোচনায় বসবেন, সেটি ভার্চুয়ালি কিংবা সামনাসামনি উভয়ভাবেই হতে পারে। খুব শিগগিরই এসংক্রান্ত সময় ও তারিখ নির্ধারণ করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এতে আরো বলা হয়, বাণিজ্য উপদেষ্টা, বাণিজ্যসচিব এবং অতিরিক্ত সচিব ১২ জুলাই দেশে ফিরেছেন। প্রয়োজনে তাঁরা আবারও যুক্তরাষ্ট্র সফর করবেন। তিন দিনের আলোচনার ভিত্তিতে বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ইতিবাচক সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। এর অন্যতম কারণ এ দেশে তৈরি বেশির ভাগ পণ্যে চীনা কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়। তাই তিন দিনের আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র-চীনের শুল্কযুদ্ধের অংশ হিসেবে মার্কিন কর্মকর্তারা বাংলাদেশকে শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য চীনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশ এখনো স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) সদস্য হওয়ায় পাল্টা শুল্ক ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্থানীয় শিল্প খাতে চীনা মালিকানার বৃদ্ধি এবং নীতিনির্ধারণ, মেধাস্বত্ব আইন ও শ্রম অধিকারের দুর্বলতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র কঠোর ‘রুলস অব অরিজিনের (আরওও)’ প্রস্তাব করেছে। এতে মার্কিন বাজারে প্রবেশের জন্য বাংলাদেশি পণ্যে ৪০ শতাংশ স্থানীয় মূল্য সংযোজন প্রয়োজন হবে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত হচ্ছে, দেশটি অন্য কোনো দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা বা বাড়তি শুল্ক আরোপ করলে বাংলাদেশকেও তা অনুসরণ করতে হবে। অন্যান্য কঠিন শর্তের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এমন সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনায় মতপার্থক্য দেখা দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের কাছে যেসব দাবি এসেছে, তার মধ্যে আরো রয়েছে—মার্কিন পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা নিশ্চিত করা, মেধাস্বত্ব সুরক্ষায় অগ্রাধিকার দেওয়া এবং শুল্ক ও অশুল্ক প্রতিবন্ধকতা কমানো। এ ছাড়া কৃষিপণ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, গম, তুলা, এলএনজি, ভোজ্যতেল, যানবাহন, বোয়িং উড়োজাহাজ ও সামরিক সরঞ্জাম আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ বাড়ানোর প্রস্তাবেও বাংলাদেশ সম্মতি দিয়েছে।
তবে আলোচনায় কিছু স্পর্শকাতর শর্তে বাংলাদেশ আপত্তি তুলেছে। যেমন-যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো দেশকে নিষেধাজ্ঞা দেয়, তবে বাংলাদেশকেও তা মেনে চলতে হবে কিংবা যেসব মার্কিন পণ্যকে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে, সেগুলো অন্য কোনো দেশকে না দেওয়ার শর্ত। এসব বিষয় বাংলাদেশের জন্য গ্রহণযোগ্য নয় বলেই জানানো হয়েছে।
বাড়তি শুল্কের খরচ ভাগ করে নিতে মার্কিন ক্রেতাদের চাপ : বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর মার্কিন ক্রেতারা নতুন অর্ডার নিয়ে আলোচনা প্রায় স্থগিত করে দিয়েছেন। একই সঙ্গে এরই মধ্যে যেসব পণ্যের চালান পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে, সেগুলোর ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ হলে বাড়তি খরচের একাংশ বাংলাদেশি সরবরাহকারীদের ভাগ করে নিতে বলছেন তাঁরা।
বিশেষ করে যেসব পণ্যের অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে কিন্তু এখনো পাঠানো হয়নি, সেগুলোর খরচ ভাগাভাগি নিয়ে ক্রেতারা নতুন করে আলোচনা শুরু করায় এই উদ্বেগ আরো বেড়েছে।
অনন্ত গার্মেন্টস লিমিটেডের মোট রপ্তানির ২০ শতাংশের বেশি যায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইনামুল হক খান বাবলু গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের সভা হয়েছে। তারা পাইপলাইনে থাকা অর্ডারে ট্যারিফের কারণে বাড়তি টাকার একটি অংশ বহন করার জন্য আমাদের বলছে।’ তিনি বলেন, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের জন্য পাইপলাইনে থাকা মোট ক্রয়াদেশের পরিমাণ দুই বিলিয়ন ডলারের মতো হতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের অপেক্ষায় রপ্তানিকারকরা : ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্ক ঘোষণার পর সম্ভাব্য করণীয় নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে মঙ্গলবার পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পক্ষ থেকে সময় চাওয়া হয়।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করছি, কিন্তু এখনো শিডিউল পাইনি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নেগোসিয়েশনের জন্য যাতে লবিস্ট নিয়োগ দেওয়া হয়, সে প্রস্তাব আমরা সরকারকে দেব। এ ছাড়া আমাদের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি তুলে ধরে সমাধানের উপায় নিয়েও আলোচনা করতে চাই।’
ভিয়েতনামের পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক : চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ থাকলেও তারা আলোচনা করে ঐকমত্যে পৌঁছেছে, ভারতও সমঝোতায় গেছে। ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তিতে উপনীত হয়েছে। তাদের ওপর যে শুল্ক ছিল, সেটা অর্ধেক থেকেও কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। বাংলাদেশের জন্য ২০ শতাংশ বা যদি তার কাছাকাছি শুল্ক না হয় সে ক্ষেত্রে একটা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে থাকবে না দেশ।
আশাবাদী সরকারের নীতিনির্ধারকরা : তিন দিনের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান আশাবাদী যে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে একটি ইতিবাচক অবস্থানে পৌঁছানো যাবে। তবে চুক্তিতে পৌঁছানোর আগে সুনির্দিষ্ট করে কোনো কিছু বলা যাবে না।