স্বপ্নের ভেতর একটা ঘ্রাণ পায় সে। পরিচিত ঘ্রাণ। কত দিন এমন সুন্দর ঘ্রাণটা পায় না। মাঝেমধ্যে বাজারে গেছে।
ইলিশ
মহি মুহাম্মদ

ও তছিরুন, তোমার ব্যাপার কী? তার এই জিজ্ঞাসায় কাঠগড়ায় দাঁড়ানো তছিরুন জবাব দেয় না। আবারও জিজ্ঞেস করে—ও তছিরুন, তোমার কি ইলিশ মাছ দিয়া ভাত খাইতে ইচ্ছা করে?
তছিরুনের ভেতরটা তখন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। তছিরুনের ফ্যাকাসে চোখ জোড়া জ্বল জ্বল করে ওঠে। এক থালা গরম ভাত আর বেশ মোটা করে কাটা এক টুকরা ইলিশ মাছের দৃশ্য চোখে ভাসতে দেখে। খিদায় পেট চোঁ চোঁ করলে বেশি করে স্বপ্নের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে সেই শৈশবের কথা। যখন জ্বাল দেওয়া ইলিশ মাছের পানি দিয়ে ভাত মাখাত। নাকের কাছে নিলে কেমন ঘ্রাণ পেত। সারা দিন সেই ঘ্রাণ শুঁকেই কাটিয়ে দেওয়া যেত। মনের অজান্তেই যেন তার হাত নাকের কাছে চলে আসে। কিন্তু দুপুরের রোদে তিন রাস্তার সড়কে দাঁড়িয়ে তছিরুন কোনো ঘ্রাণ পায় না। তবে তার ছোটবেলার অনেক স্মৃতি মনে পড়ে যায়। যখন দেশে যুদ্ধ হলো, তখন তার বয়স দশ কি বারো। যুদ্ধের আগে ছেলে-মেয়েদের মুখে মুখে একটা ছড়া ফিরত। ছড়ায় ছড়ায় তারা স্বাধীনতার গান গাইত। পাকিদের হেয় করত। টিক্কা খানকে হেয় করার সেই ছড়াটা এখনো তার মনে গেঁথে আছে।
ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা
বোয়াল মাছের দাড়ি
টিক্কা খান ভিক্ষা করে
শেখ মুজিবের বাড়ি।
এখানে দুজন ব্যক্তির নাম আর দুটি মাছের নাম আছে। তছিরুন অনায়াসে এদের সম্পর্কে বলতে পারে। কারণ যুদ্ধের বছর তার বয়স একেবারে কম না। ছেলে-মেয়েদের মুখে মুখে তখন এসব কথা ঘুরে বেড়াত। ইলিশ মাছ, বোয়াল মাছ তারা ভালোভাবেই চিনত। আর মুজিবের কথা তো কওয়ারই নাই। তাঁর বাজখাই কণ্ঠ তো এখন মাইকে মাইকে বাজে। সেই সময়ও মা-বাবার কাছে অনেক অনেক শুনেছে। টিক্কা খান একটা বদ লোক। পাকিস্তানের এই টিক্কা খান যে তাদের দেশটা চায়নি, সে কথাও সে ভালোভাবেই জানে। তছিরুনের শুধু মাথায় ঢোকে না, যে এত করল হেই মজিবররে ক্যান মারল? একখান দ্যাশ দিছে যে, হেরে এমুন কইরা জীবন দিতে হইলো। দূর, এই সব হইলো রাজনীতির কথা। এইগুলান ভাইভা কাম নাই। এখন সব কিছুই পাল্টে গেছে। তছিরুনের ভাগ্যের চাকা উল্টা ঘোরে। এই বয়সেও তাকে ভিক্ষা করতে হয়। বড় ছেলেটা কী যে করল, কিছুই বুঝল না। শুধু একদিন সন্ধ্যারাতে হারিয়ে গেল। কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। মেজো ছেলেটা পাজি একটা মেয়েকে সাঙ্গা করে আলাদা হয়ে গেছে। নিজের মেয়েটাও নিরুদ্দেশ। বিয়ে দিয়েছিল মেয়েটার। হারামজাদা জামাইটা প্রতিরাতে মেয়েটাকে ধরে পিটাত। একদিন মেয়েটা ভেগে গেল। কোথায় গেল, কার কাছে গেল, তার হদিস তছিরুন পেল না।
দুই.
এবার বৃষ্টিটা বেশি। ঝরছে তো ঝরছেই। ভিক্ষা তেমন পাচ্ছে না। এক বেলা খেলে আরেক বেলা উপোস। ভাতের মাড়টারও জোটে না। পরপর কয়েক দিন বৃষ্টি ক্ষান্ত না দিলে পলিথিন মাথায় বেঁধে বেরিয়ে পড়তেই হলো। সেদিন বিকেলেই কাঁপিয়ে জ্বরটা এলো। কিছুই ভালো লাগছে না। বারবার মৃত স্বামীর মুখটা ভেসে উঠছে।
তিন.
দুপুরে রুক্ষ হাওয়া বইছে। কেমন একটা গুমট গরম। মনটা বেশ পেরেশানিতে ভরে ছিল। তছিরুন বুঝতে পারল না। শরীরটা চলতে চাচ্ছে না কেন। কেমন ঝিম মেরে যাচ্ছে। মনে হয়, এক মগ রং চা পেলে শরীরটা চাঙ্গা হতো। দূর, কী চিন্তা করছে সে। এখন তো দুপুর উতরে গেছে। ভাত খাওয়ার সময়। দলে তারা পাঁচজন। হাঁটছিল রেললাইন ধরে। আকাশে আলোর তীব্রতা নেই। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। সবাই আগে আগে যাচ্ছিল। সে শুধু পিছিয়ে পড়ছে। খিদেটা তখন পেটের মধ্যে খামচে ধরেছে। এই সময় কে যেন এই বুড়ি বুড়ি করে ডাকছে। অনেকটা ঘোরের মধ্যে তছিরুন সেদিকে তাকাল। দেখল, একটা আট-দশ বছরের বাচ্চা তাকে পেছন পেছন ডেকে আসছে।
তছিরুন থামল। কারে কও। ছেলেটি বলল, তুমারে কই। তুমারে ডাক পাড়ে।
কেডায়?
উই যে বলে ছেলেটি একটু দূরেই একটি বাড়ির দিকে নির্দেশ করে। জারুলগাছ আর মেহগনিতে ঢাকা বাড়িটির গেটের দিকে এগিয়ে যায় তছিরুন। দেখে, বেশ ছিমছাম এক যুবতী দাঁড়িয়ে আছে।
কী গো মায়, আমারে ডাকছেন।
মেয়েটি বলল, হ, ডাকছি। ভাত খাইবেন?
অ্যাঁ, কিতা কন? তছিরুনের মনে হলো, মেয়েটি তাকে কোনো স্বপ্নের কথা বলেছে। সে ভুল শুনেছে কি না তাই আবার জিজ্ঞেস করল। কী কইলেন?
হ, আপনে দুইটা ভাত খাইবেন?
মায়গো মায়, কী কয়! খামু না কিয়ারে? খামু, খামু। তয় তরকারি কী?
মেয়েটি হাসে। কেমন সুন্দর পরির মতো মনে হয় তছিরুনের কাছে। মনে হয়, মেয়েটির নতুন বিয়ে হয়েছে। নিশ্চয়ই ওর সোয়ামী চাকরিতে এখন। গরিব-দুঃখী মানুষকে দুপুরে চারটা ভাত খাওয়ার জন্য খুঁজছে। মনে হয়, গত রাতে খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। আর তাই মানত করেছে, আজ কোনো অসহায় ভিক্ষুক দেখলে ভাত খাওয়াবে। যা হবে হোক, তার আর তর সইছে না। মেয়েটি কিছু না বলে ঘরের ভেতরে ঢোকে। ফিরে আসে গরম ভাতের থালা হাতে। ঘরের ভেতরে মেঝেতে বসে পড়ে তছিরুন। হাতটা একটু পানি ছিটিয়ে কায়দা করে ধুয়ে নেয়। এবার তরকারির বাটি আসে। ডাল, ঢেঁড়স ভাজি আর এক টুকরো মাছ। মাছটা দেখেই চিনতে পারে তছিরুন। এটা ইলিশ মাছ। কড়া করে ভেজে তারপর পেঁয়াজ-মরিচে জড়িয়েছে। যেমনটা সে মনে মনে কদিন ভাবছে। মাছটা মুছে পেঁয়াজ-মরিচগুলো দিয়ে ভাত মাখায়। গরম ভাতগুলো তার কাছে এখন কিসের মতো মনে হচ্ছে? না, কোনো কিছু ভেবে পেল না। তবে স্বর্গীয় ব্যাপার বুঝি একেই বলে! ভাবল তছিরুন। কিভাবে স্বপ্ন এমন করে সত্যি হয়ে যায়! খাওয়া শুরু করে তছিরুন। মেয়েটি একটা প্লাস্টিকের টুল নিয়ে তছিরুনের খাওয়া দেখে।
খেতে খেতে তছিরুন জিজ্ঞেস করে, মায়গো মা, বাচ্চা-কাইচ্চা হইছে না বুঝি!
মেয়েটি সলাজ হাসিতে মুখ রাঙায়। মাথা দোলায় এদিক-ওদিক।
আবার জিজ্ঞেস করে, নতুন বিয়া হইছে?
মেয়েটি হাসে। হ বলে উত্তর দেয়।
যখন সে ইলিশ মাছ ছাড়া আর কিছুই পাতে তোলে না, তখন মেয়েটি বলে, তরকারি নেন। ডাইল-ভাজি নেন। সব খান।
তছিরুনের পাতে তখন মাছের আস্ত পেটির টুকরাটি। তছিরুন সেটি মুছে মুছেই ভাত সাবাড় করেছে। খেতে খেতে বুড়ি যে চিন্তায় মশগুল, তা মেয়েটিও ধরতে পেরেছে। মেয়েটি দেখতে পেল, বুড়ি এবার মাছের টুকরাটি একটু একটু করে রসিয়ে রসিয়ে খাচ্ছে। মেয়েটি এই ফাঁকে একটু অন্যমনস্ক হয়েছিল। হঠাৎ সে ঘড়ঘড় আওয়াজটা শুনতে পেল। দেখল, বুড়ি চোখমুখ উল্টে একপাশে কাত হয়ে পড়ে গেল। মেয়েটি ভয় পেয়ে চেঁচামেচি শুরু করল। বেশ কয়েকজন মহিলা এসে বুড়িকে দেখতে লাগল। আর বুড়ি জবাই করা গরুর মতো ঘড়ঘড় শব্দ করে পা ছুড়তে লাগল। কেউ কেউ বলল, মনে হয় গলায় ভাত আটকেছে। তাড়াতাড়ি পানি খাওয়াও। একজন মহিলা জোর করে পুরো গ্লাস পানি বুড়ির মুখে ঢেলে দিল। আস্তে আস্তে বুড়ির শরীরটা নেতিয়ে পড়ে। বুড়ির হাঁ করা মুখের ভেতর ইলিশ মাছের পেটির লাঙল মার্কা কাঁটাগুলো থরে থরে দেখতে পায় লোকজন। তারা ভাবে, এতগুলো কাঁটা একসঙ্গে বুড়ির শ্বাসনালি বন্ধ করে দিয়েছে। সবাই নানা রকম মন্তব্য করতে ব্যস্ত। কেউ কেউ বলছে—না, বুড়িকে এখনই একজন ডাক্তার দেখানো দরকার। এই করতে করতেই বুড়ির দেহটা নিথর হয়ে গেল।
ঠিক তখনই এক তরুণ লোকজনকে ঠেলে ভেতরে আসে। এত লোকের ভিড় দেখে সে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। তার স্ত্রী এগিয়ে আসে। স্ত্রীকে দেখে যুবকটির মুখে হাসি ফোটে। মেয়েটি সবিস্তারে ঘটনা খুলে বললে যুবকটি বুড়ির দিকে তাকায়। বুড়ির দিকে তাকিয়ে যুবকটির মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না। আস্তে আস্তে পায়ের কাছে বসে পড়ে। মনে মনে মা মা বলে ডাকে। কিন্তু বুড়ি আর কোনো সাড়া দেয় না। তার মা বউয়ের হাতেই মরেছে! এটা অবিশ্বাস্য।
সম্পর্কিত খবর

পিয়াস মজিদ
খুচরা আষাঢ়

আসকাল আজ
মেঘের মনের গায়ে
কেউ কাক
চুপচাপ।
ভিজে যেতে চেয়ে আমি
বহুকালের শুকনো সরোদ;
বাজনারা ঝরে গিয়ে
পাহাড়ের চুল চুইয়ে।
আকাশ বাজারের ব্যাগ হাতে ফিরবে ঘরে।
কেনাবেচার রিমঝিম শব্দে বধির মাটিতে
থেকে থেকে ঠিক তোমার মতো
প্রয়াত জ্বরেদের স্মৃতি মনে আসে!
।
নাসির আহমেদ
পাঁচটি আঙুল

কিছুই বলোনি, শুধু রুপালি আঙুল, নখ-ছবি
পাঠিয়ে দিয়েছ এই লেখার সম্মানে। মুগ্ধ কবি!
অনামিকা থেকে কনিষ্ঠায় দ্যুতিময় রাঙা হাত
হঠাৎ জানাল যেন প্রথম দিনের সুপ্রভাত!
তীব্র, তীক্ষ এই মুগ্ধ মৌন অনুভব
কতটা প্রকাশযোগ্য! ভাষায় কতটা তাকে ধারণ সম্ভব!
বর্ষার বৃষ্টির মতো রুপালি সৌন্দর্যে রিমঝিম
সবুজ পাতায় জ্বলে পাঁচটি আঙুল। ব্যাখ্যাও সম্ভব নয় কবিতার থিম।
।

দিলারা মেসবাহ
পাথরে ফুটুক ফুল

তুমি সেই প্রত্নপাথর!
মরমি সান্নিধ্যের সাধন ভজন
‘সুপ্রভাত’ বলার সাধুবাদ, শেখোনি কস্মিন।
তুমি এক অচিন পাথর
দেখো আজ অনামিকায় ওপাল ঝলক
খোঁপায় তারার ফুল!
তুমি সেই অন্ধ পাথর।
দেখো আজ জোড়া চোখ বিহ্বল বিজন
অপার মায়ার বশে বেদনাবিধুর।
তুমি সেই নির্বোধ পাথর,
শুনলে না কলকণ্ঠ পাখির গোপন।
তুমি এক পাইথন শীতনিদ্রা স্বভাব
তুমি সেই প্রত্নপাথর।
খোলস খসাও—
দেখাও ফণার সার্কাস!
চেয়ে দেখো হাত দুটো বিজন ব্যাকুল
জেগে ওঠো, পাথরে ফোটাও ফুল।

প্রদর্শনী
গ্যালারি কায়ায় মাস্টার শিল্পীদের কাজ
- মোহাম্মদ আসাদ

গ্যালারি কায়া মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ২১ বছর ধরে। প্রতিনিয়ত উপহার দিচ্ছে বৈচিত্র্যময় শিল্পকলা প্রদর্শনীর। প্রায় আট দশকের দেশের শিল্পকলার সংগ্রহ নিয়ে এবারের প্রদর্শনী। দেশের চারুকলা শিক্ষার শুরুটা হয় ১৯৪৮ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের হাত ধরে।
ঈদমেলা থেকে বাড়ি ফেরা। শিল্পী : মুর্তজা বশীর
আরো আছে সমরজিৎ রায়চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, হামিদুজ্জামান খান, আবদুস শাকুর শাহ, মাহমুদুল হক, আবুল বারক আলভী, মোহাম্মদ ইউনুস, জামাল আহমেদ, চন্দ্র শেখর দে, মোস্তাফিজুল হক, রণজিৎ দাস, রতন মজুমদার, ফরিদা জামান, কনক চাঁপা চাকমা, শেখ আফজাল, আহমেদ শামসুদ্দোহা, শিশির ভট্টাচার্য্য, মোহাম্মদ ইকবাল, গৌতম চক্রবর্তীর মতো গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীদের কাজ। প্রদর্শনীতে রয়েছে প্রতিশ্রতিশীল শিল্পীদের কাজও। গৌতম চক্রবর্তী গ্যালারিটির প্রতিষ্ঠাতা।
প্রদর্শনীতে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ মুর্তজা বশীরের ‘ঈদমেলা থেকে বাড়ি ফেরা’। ১৯৫৬ সালে তিনি এই ছবিটি এঁকেছেন ছাত্রজীবনে। রাজধানীর চকবাজারের ঈদমেলার ঐতিহ্য আছে।
কামরুল হাসানের প্রিন্ট দুটি দেখে ভালো লাগবে। কাইয়ুম চৌধুরীর একটি মিছিলের ছবি। ব্যানারে লেখা ‘নিপাত যাক’। কাজী আবদুল বাসেতের দুই বৃদ্ধার গল্প বলা। এই প্রদর্শনীতে একটি কাজ আছে মাহমুদুল হকের। মাহমুদুল হক গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী। তিনি জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০২২ সালে তিনি নীরবে চলে যান আমাদের ছেড়ে।
২১ বছরের গ্যালারি কায়া দেখাচ্ছে প্রায় আট দশকের শিল্পকলা ইতিহাস। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনীতে শিল্পাচার্যের একটি কাজ থাকলে ষোলো কলা পূর্ণ হতো। আবার যা আছে তা-ও কম কিসের। প্রদর্শনী চলবে ১২ জুলাই পর্যন্ত।