আমি সুনামগঞ্জ লঞ্চঘাট। সুনামগঞ্জ সদরে সুরমার তীরে আমার বাস। আমাকে চেনে না এমন কেউ এ তল্লাটে নেই। যদিও আগের রং-রূপ এখন আমার নেই।
[আত্মকথা]
সুনামগঞ্জ লঞ্চঘাট
অন্যান্য

পাহাড়ের ধারের দেশ
মেঘালয় পাহাড়ের নিচেই সুনামগঞ্জ। হাওর-বাঁওড়-পাহাড় আর নদীর মালা পরে প্রকৃতির রানি যেন। আমার এখান থেকে মেঘালয়ের পাহাড়গুলো গোনা যায়। ভালো লাগে পাহাড়গুলোয় পেঁজা তুলো মেঘের ওড়াউড়ি। বৃষ্টির পরে পাহাড়ের আবার আরেক রূপ। তখন সেখানে সবুজের নাচন। সুরমার পারে আমি বসত গেড়েছিলাম দেশভাগেরও আগে। আমার পশ্চিম পাশে কয়েক শ গজ দূরেই ছিল স্টিমার ঘাট। মনে আছে পান্না নামের একটি লঞ্চ তখন চলত। যেত ছাতক।
ছাত্রাবাসেও সে রকম ছাত্র নেই
ঐতিহ্যবাহী সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় আমার ধারেই। এর দুটি ছাত্রাবাসের অবস্থাও আমার মতো। ধুঁকছে। একসময় দূর-দূরান্তের শত শত ছাত্র এখানে এসে থাকত। সুরমা পারে বিকেল কাটাত। রাতে তাদের পড়ালেখার আওয়াজ শুনতে পেতাম। এখন ছাত্রাবাসে থাকেই অল্প কয়েকজন ছাত্র।
এখন আছে পনেরোটি দোকান
দেখে মনে হতো সুরমা অভিসারে যাবে। চোখে সুরমা, পায়ে আলতা—মানে নানা রঙের বাতির আলোয় ঝলমল করত সুরমা। তখন অনেক বোর্ডিং (থাকার ঘর) ছিল সুরমা পারে। দূরের যাত্রীরা লঞ্চ মিস করলে এগুলোতে থাকত। এ ছাড়া অনেক খাওয়ার হোটেল ছিল। এখন আছে পনেরোটির মতো দোকান। বেশির ভাগই চা-বিস্কুটের। এই দোকানগুলোতেও বিক্রি-বাট্টা তেমন নেই। সুরমায় ভাঙন চলছে চার বছর ধরে। পুলিশ ফাঁড়িটিও এখন হুমকির মুখে। সরকার কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। আপাতত ঠেকানো গেছে ভাঙন। তবে দুশ্চিন্তা যায়নি।
আহা সেসব দিন
পাকিস্তান আমলেই স্টিমারের চল উঠে যায়। তারপর লঞ্চই হয়ে ওঠে হাওরের মানুষের ভরসা। পাক ওয়াটার কম্পানি ছিল তখন। রাস-গোবিন্দ স্কুলের পাশের খালি মাঠে তাদের অফিস ছিল। যাত্রীদের সুবিধার জন্য তৈরি হয়েছিল কাঠের সুন্দর পন্টুন। আমার তখন খুবই রমরমা। চলত কাঠবডির লঞ্চ। লঞ্চগুলোর নামেরও ছিল বাহার—বুরহান এক্সপ্রেস, আজিজ মঞ্জিল, জালালী, মুন্না, শিবলি, আমিনা, সুরমা, জালালাবাদ, জামালগঞ্জ এক্সপ্রেস, এমভি লাল সাহেব, এমভি জামালগঞ্জ ইত্যাদি। মোহনগঞ্জ, ছাতক, সিলেটও যেত লঞ্চগুলো। জামালগঞ্জের রহমান মিয়া ও লাল মিয়ার অনেক লঞ্চ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয় পাকিস্তান হানাদার বাহিনী। জামালগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ যে দিন শহীদ হন, সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। হানাদাররা সেদিন লঞ্চে চড়েছিল আমার এখান থেকেই। স্বাধীনতার পর পাক ওয়াটার কম্পানির নাম হয় বেঙ্গল ওয়াটার। পল্টু-১, পল্টু-২, শরিফপুর এক্সপ্রেস, রুমি, মুসাফির, ডায়না ইত্যাদি নতুন নতুন লঞ্চ এলো। লঞ্চগুলোর কাউন্টার ছিল আমার এখানে। লঞ্চগুলোতে ছোট টং দোকান ছিল। যাত্রীরা চা-বিস্কুট খেতে খেতে ধানের ফলন নিয়ে কথাবার্তা বলত। আমার এখন লোহার পন্টুন। এখন পাঁচটি লঞ্চ থাকলেও একটিরও অফিসঘর নেই। যাত্রীসেবায় বিভিন্ন সময়ে ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট ও সস্তা মানের বোর্ডিং ছিল।
আমার ঘাটে প্রথম হয় সমাদের দুইতলা হোটেল। চিটাগাং হোটেল ও তছকির উদ্দিনের হোটেলও হয় কাছাকাছি সময়ে। আরো পরে ইদ্রিস আলীর রুটির দোকান হয়। এটি এখনো আছে। ইদ্রিস আলী একজন মুক্তিযোদ্ধা। একসময় কালা ভাইয়ের হোটেলের গরুর মাংসেরও সুনাম ছিল।
একবার হুমায়ূন আহমেদ এসেছিলেন
১৯৯২ সাল ছিল সেটা। সুনামগঞ্জে হাসন রাজা উত্সবের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। অনুষ্ঠান শেষ করে দলবল নিয়ে হেঁটে চলে এসেছিলেন আমার এখানে। সঙ্গে ছিলেন শিল্পী সেলিম চৌধুরী ও অভিনেতা ফজলুল কবির তুহিন এবং তাঁদের বন্ধু রুহুল তুহিন। হুমায়ূন আহমেদ এসে নীরবে সুরমার দিকে তাকিয়ে থেকেছিলেন অনেকক্ষণ। তারপর দাঁড়িয়েই আড্ডা দিয়েছেন। এরপর মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস আলীর দোকানে গিয়ে মাছের ভর্তা দিয়ে রুটি খেয়েছিলেন। পরে আবার ফিরে এসে বসে আড্ডা দেন ভোর পর্যন্ত।
আশির দশক থেকে ভাটা লাগে
আদতে লঞ্চের সংখ্যা কমতে থাকে আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে। অনেক রাস্তাঘাট তৈরি হতে থাকে সে সময়ে। যাত্রীরা স্থলপথকেই বেছে নিতে থাকেন। তবে ১৯৯৫ সালের পর থেকে আবারও লঞ্চের আনাগোনা বাড়ে। বছর কয় চলে ভালোই। এরপর সুরমার হুমকির মুখে পড়ি। এ দুঃখ আর ঘুচবে কি না জানি না।
ছবি : লেখক