আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরকে একত্রিত করেছে পানামা খাল। এটি ৭৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কৃত্রিম এক খাল। বিশ্বের অন্যতম বাণিজ্যিক নৌ-রুট। বয়স ১০১ বছর।
পানামা খাল ১০১ বছরে
কল্লোল কর্মকার

স্প্যানিশ অভিযাত্রী ভাস্কো নুয়েঞ্জ ডি বালবোয়াই প্রথম ইউরোপীয়, যিনি আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের এই সম্মিলনের কথা বলেছিলেন। তৎকালীন স্প্যানিশ রাজা বালবোয়াইয়ের এই ধারণাকে উড়িয়ে দিলেও, ১৫৩৪ সালে অপর রাজা চার্লস পঞ্চম প্রস্তাবটি যাচাইয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটি তদন্ত করে জানিয়েছিল, একটি জাহাজ প্রবেশ করতে পারে এমন খাল ওই স্থানে খনন করা অসম্ভব।
খনন কিন্তু চাট্টিখানি কথা ছিল না। শুরুর দিকে বেশ কয়েকটি পরীক্ষা ব্যর্থ হয়। ভারি বর্ষণ, আর্দ্রতা ও স্থানীয় বিভিন্ন রোগ ছিল খাল খননের অন্যতম প্রতিবন্ধক। এর আগেও স্পেন খাল খনন শুরু করলে নানা কারণে ২০ হাজার শ্রমিক মারা গিয়েছিল। এই ধাক্কা নিতে পারছিল না স্পেন, তাই খনন বন্ধ রাখা হয়েছিল। তবু যুক্তরাষ্ট্র তার কারিগরি সক্ষমতা দিয়ে শ্রমিক মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনে। তারপরও পাঁচ হাজার ৬০০ শ্রমিক মারা গিয়েছিল। আর এই অধিকাংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল হলুদ জ্বর। সে সময়ে এই রোগের জন্য জাদুটোনা ও খারাপ আবহাওয়াকে দোষারোপ করা হতো। কিন্তু বিশ শতকে এসে ধরা পড়ে, ওই জ্বরের কারণ ছিল মশা।
সংকীর্ণ আর অগভীর হওয়ার কারণে যেকোনো জাহাজকেই এই খাল অতিক্রম করতে অনেকটা সময় ব্যয় করতে হয়। ৭৭.১ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে লেগে যায় ১৫ ঘণ্টা। তাই ২০০৭ সালে সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে পাঁচ দশমিক দুই বিলিয়ন ডলারের এক প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০১৪ সালের মধ্যে সম্প্রসারণের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। ফলে এখন একটির বদলে পাশাপাশি দুটি জাহাজ চলতে পারবে।
খালটি বেশি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র। এর পরেই চীন, চিলি, জাপান, কলম্বিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া। প্রতিটি বড় জাহাজকে এই পথ পাড়ি দিতে ব্যয় করতে হয় চার লাখ ৫০ হাজার ডলার। বর্তমানে বছরে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার টোল আদায় হয় এ খাল থেকে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে খালটির উচ্চতা ৮৫ ফুট। যেকোনো জাহাজ চাইলেই পাড়ি দিতে পারে না। প্রথমে পাড়ি দিতে ইচ্ছুক জাহাজকে তার আনুষঙ্গিক কাগজপত্র ও ছাড়পত্র নিয়ে যেতে হয় কর্তৃপক্ষের কাছে। একটি সিরিয়াল নম্বর দেওয়া হয়। ওই নম্বর অনুসারে জাহাজটিকে একটি নির্দিষ্ট গতিতে খাল পাড়ি দিতে হয়।
পানামা আদতে দুই অংশে বিভক্ত। খালের একটি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্র। এলাকাটি পানামার অংশ হওয়া সত্ত্বেও মার্কিন প্রশাসনের হুকুম ছাড়া সেখানে কিছুই হয় না। চুক্তি অনুসারে কথা ছিল, খালটি থেকে যে রাজস্ব আসবে তা পানামার রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হবে এবং দেশের কল্যাণে ব্যয় হবে। কিন্তু বাস্তবে খালের রাজস্বের খুব অল্প পরিমাণই পানামা পেত। আর এই অসন্তোষ থেকে ১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী একটি দাঙ্গা হয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র ও পানামার মধ্যে একটি চুক্তি হয়, যেখানে বলা হয়, ১৯৭৯ সালে খালের ৬০ শতাংশ পানামার কাছে হস্তান্তর করা হবে। যদিও বাস্তবে পুরো এলাকাটিই ১৯৯৯ সালে পানামার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
১৯৭৯ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত খালটির দায়িত্বে ছিল পানামা খাল কমিশন। প্রথম দশকে এই কমিশনের প্রধান ছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং পরবর্তী দশকে পানামা। এখন যুক্তরাষ্ট্র ও পানামা যৌথভাবে খালটি রক্ষায় দায়িত্ব পালন করছে। ১৯৭৭ সালে পানামা খালকে আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কোনো প্রকার মন্দ পরিস্থিতিতেও যাতে এই খালের গতিপথ অবরুদ্ধ করা না যায় সেদিকে বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে। এমনকি যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও যেন যুদ্ধজাহাজ নির্বিঘ্নে খাল অতিক্রম করতে পারে, সে বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়েছে।
খালটি পানামার মানুষদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তনই আনতে পারেনি। উল্টো দেশটি পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। বহির্দেশীয় কুখ্যাত কয়েকটি কারাগার ও মাদক বাণিজ্যে গোটা দেশের অর্থনীতির চাকা অচল হয়ে গেছে।
এই খালে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব তীর থেকে পশ্চিম তীরে যেতে আগে দক্ষিণ আমেরিকার বিশাল অঞ্চল ঘুরে যেতে হতো, আনুমানিক পনেরো হাজার কিলোমিটার। খাল খননের পর সেই সময় রাতারাতি কমে আসে। উত্তর আমেরিকার এক দিকের উপকূল থেকে দক্ষিণ আমেরিকার অন্য দিকের উপকূলে যাওয়ার ক্ষেত্রেও ছয় হাজার পাঁচ শ কিলোমিটার কম পাড়ি দিতে হয়।
ইউরোপ, পূর্ব এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে যাতায়াতকারী জাহাজেরও প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার পথ বেঁচে যায়। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয় যুক্তরাষ্ট্র, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত দেশগুলোর নৌসীমায় সামরিক মহড়া দিতেও সুবিধা হয়।