করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে খাদে পড়া সিলেটের পর্যটন খাতে বছরের শেষ সময়ে এসে সুদিনের ইঙ্গিত মিলছে। প্রায় সাড়ে চার বছর পর চলতি ডিসেম্বরে ভালো ব্যবসা হয়েছে। বিজয় দিবস ও বড়দিনকেন্দ্রিক বড় দুই ছুটিতে ব্যবসা হয়েছে শতকোটি টাকার, যা গত সাড়ে চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
সিলেটের পর্যটন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
তাঁরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি প্রথম বড় ধাক্কা দেয় সিলেটের পর্যটনে। প্রায় দুই বছর পর করোনা গত হলেও পর্যটনে বিপর্যয় থামছিল না। ২০২২ সালের বড় বন্যার পর ২০২৩ সালের বন্যা আর রাজনৈতিক পরিস্থিতি মিলিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারছিল না পর্যটন। চলতি বছরও ভালো যায়নি। সিলেটে পর্যটনের মূল মৌসুম মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত। কিন্তু চলতি বছর টানা তিন দফা বন্যা, এরপর আন্দোলনে বড় সময়জুড়ে খারাপ গেছে এই খাতে। সে হিসেবে ডিসেম্বরে পর্যটকদের উপস্থিত সুদিনে ফেরার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডিসেম্বরের বেশির ভাগ সময়ই পর্যটকদের ঢল ছিল সিলেটে।
ছুটির দিনগুলো ছাড়াও বিজয় দিবস ও বড়দিনকে (ক্রিসমাস) কেন্দ্র করে লম্বা সময় নিয়ে ঘুরতে এসেছেন পর্যটকরা। এই সময়ে বিভাগের হোটল-মোটেল, রেস্টহাউস, রিসোর্টগুলো পুরো বুকড ছিল। স্থানীয়দের (২০ থেকে ২৫ শতাংশ) চেয়ে বিদেশি ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে (৭৫ শতাংশ) আসা পর্যটকের উপস্থিতি ছিল বেশি। পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে নৌকার চাহিদা বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ গুণ। গত শুক্রবার শুধু রাতারগুলে তিন শতাধিক ও সাদাপাথরে ৮০০ পর্যটকবাহী নৌকা ঢুকেছে।
সিলেট নগরের জিন্দাবাজারের গোল্ডেন সিটি হোটেলের মহাব্যবস্থাপক মৃদুল কান্তি দত্ত মিষ্টু বলেন, ‘এবার ডিসেম্বরটা আমাদের ভালো গেছে। প্রায় সাড়ে চার বছর পর এবার ব্যবসা ভালো হয়েছে। যদিও দীর্ঘ লসের তুলনায় এটি খুবই কম। তবু এটি আমাদের আশাবাদী করেছে।’
দেশের একমাত্র জলাবন খ্যাত রাতারগুল পর্যটনকেন্দ্রে ছিল পর্যটকদের ভিড়। সেখানকার রিসোর্ট ‘সোহেল স্কয়ারে’র স্বত্বাধিকারী সোহেল আহমদ বলেন, ‘এবার বছরের শেষ সময়ে এসে ব্যবসা সবচেয়ে ভালো হয়েছে। হোটেলগুলো শতভাগ পূর্ণ ছিল।’ তিনি বলেন, ‘সাধারণত শুক্রবারের মতো ছুটির দিনে যেখানে রাতারগুলে ২০ থেকে ৩০টি নৌকা পর্যটক নিয়ে ঢোকে, সেখানে গত শুক্রবার তিন ঘাট থেকে তিন শতাধিক পর্যটকবাহী নৌকা রাতারগুলে ঢুকেছে।’
সিলেটের সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্র এলাকার ‘সাদাপাথর হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের ব্যবস্থাপক জুয়েল মিয়া বলেন, ‘২০২০ সাল থেকে পর্যটনে মন্দা শুরু। প্রথমে করোনাভাইরাসের ধাক্কা, তারপর প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা। পদে পদে হোঁচট। সর্বশেষ গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর রাতে আমাদের রিসোর্টটি লুটপাট, ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। এতে ক্ষতি হয়েছে কয়েক কোটি টাকা। নতুন করে শুরু করলেও অনিশ্চয়তা কাটছিল না। তবে ডিসেম্বরে সব রুম বুকিং ছিল। মাসটা খুব ভালো গেছে।’
সাদাপাথর নৌকাঘাটের মাঝি মোহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, ‘আমাদের নৌকাঘাটে প্রায় ১২০টি নৌকা রয়েছে। এমনও সময় গেছে, অনেক নৌকার মাঝি সারা দিন কাটিয়ে ৫০০ টাকাও ইনকাম করতে পারেনি। কয়েক সপ্তাহ ধরে পর্যটকদের আসা বাড়ায় প্রতিদিন একেকটি নৌকা আটটি পর্যন্ত ট্রিপ দিয়েছে। প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৭০০ ট্রিপ দিয়েছে।’
সিলেট হোটেল-মোটেল রেস্টহাউস মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমিত নূরী জুয়েল, ‘পর্যটন খাতসংশ্লিষ্ট সবার ব্যবসা এবার ভালো হয়েছে। বিশেষ করে ১০ ডিসেম্বরের পর এ কয়দিন খুব ভালো গেছে। যদিও তিন দফা বন্যা, আন্দোলন মিলিয়ে ছয় মাস পুরো লস।’
সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পর্যটন সাব কমিটির চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির লিটন বলেন, ‘গত সাড়ে চার বছরের মধ্যে চলতি মাস সিলেটের পর্যটনে সুদিনের ইঙ্গিত দিয়েছে। ডিসেম্বরে পর্যটনে শতকোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বন্যা ও আন্দোলনের কারণে বর্ষার সময় থেকে আগস্ট পর্যন্ত কেউ আসতে পারেননি। সে কারণে ডিসেম্বরের ছুটিকে তাঁরা হয়তো বেছে নিয়েছেন।’