<p>জাতির স্মরণীয় কোনো অধ্যায়কে তুলে ধরতে ভাস্কর্যের বিকল্প নেই। বই বা পেইন্টিংয়ের মাধ্যমে জাতির ইতিহাস জানা গেলেও তা মুক্ত বা খোলা জায়গায় সবার কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়। যদি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নানন্দিক ভাস্কর্য তৈরি করা হয়, তাহলে সহজেই সবার নজর কাড়ে। সারা বিশ্বই ভাস্কর্যের মাধ্যমে তাদের গৌরবময় অধ্যায়কে স্মরণ করছে, বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।</p> <p>মুক্তিযুদ্ধ জাতির সবচেয়ে বড় গৌরবময় অধ্যায়ের নাম। আর এই গৌরবের কথা মনে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু ভাস্কর্য। এই ভাস্কর্যগুলোতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বর্বরতার নানা ঘটনাপ্রবাহ ফুটে উঠেছে। এই ভাস্কর্যগুলো যেন একাত্তরের সেই রক্তিম দিনগুলোর কথা জানান দেয় মাথা উঁচু করে। এসব ভাস্কর্য বহন করে দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংগ্রামী ইতিহাস।</p> <p>ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, ‘আমাদের দেশে কিছু ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। কিন্তু ভালো কাজের সংখ্যা কম। অনেক জায়গায়ই ভাস্কর্য নির্মিত হচ্ছে, কিন্তু তা শিল্পকর্মের জায়গায় পৌঁছছে না। ফলে মানুষকে সেই ভাস্কর্যগুলো নাড়া দিতে পারছে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধকে নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ভালো কাজ হওয়া দরকার। ভাস্কর্যগুলো হতে হবে মানসম্পন্ন, যাতে মানুষ তা দেখেই মুগ্ধ হয়।’</p> <p>ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘আমাদের দেশে কিছু ভাস্কর্য নির্মাণ হয়েছে। কিন্তু তা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পুরোপুরি প্রতিফলন আমরা করতে পারিনি। বিশ্বের অনেক দেশ স্মৃতিময় ঘটনা ধরে রাখার জন্য ঘটনাস্থল সংরক্ষণ বা সেখানেই ভাস্কর্য নির্মাণ করছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে অনেক টর্চার সেল ছিল বা অনেক জায়গায়ই সম্মুখযুদ্ধ হয়েছে, সেগুলো সংরক্ষণ করা যেত। আমাদের নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সংযুক্ত রাখতে হবে। সে জন্যই আরো বেশি মানসম্পন্ন ভাস্কর্য নির্মাণের পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে।’</p> <p>জাগ্রত চৌরঙ্গি : মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদদের অসামান্য আত্মত্যাগের স্মরণে গাজীপুর চৌরাস্তায় নির্মিত হয়েছে ভাস্কর্য ‘জাগ্রত চৌরঙ্গি’। মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় নির্মিত এটিই প্রথম ভাস্কর্য। ভাস্কর আবদুর রাজ্জাক ১৯৭৩ সালে এটি নির্মাণ করেন। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চের আন্দোলন ছিল মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ। আর এই প্রতিরোধযুদ্ধে শহীদ হুরমত উল্যা ও অন্য শহীদদের অবদান এবং আত্মত্যাগকে জাতির চেতনায় সমুন্নত রাখতে জয়দেবপুর চৌরাস্তার সড়কদ্বীপে স্থাপন করা হয় দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকর্ম জাগ্রত চৌরঙ্গি।</p> <p>অপরাজেয় বাংলা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে বন্দুক কাঁধে দাঁড়িয়ে থাকা তিন নারী-পুরুষের ভাস্কর্য যেটি সর্বস্তরের মানুষের স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে সেটি ‘অপরাজেয় বাংলা’। এর তিনটি মূর্তির একটির ডান হাতে দৃঢ় প্রত্যয়ে রাইফেলের বেল্ট ধরা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। </p> <p>স্বোপার্জিত স্বাধীনতা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পশ্চিম পাশে ডাসের পেছনে অবস্থিত এই ভাস্কর্য অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অনুপ্রেরণা জোগায়। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে এই ভাস্কর্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৮৮ সালের ২৫ মার্চ ভাস্কর্যটির উদ্বোধন হয়। এটি গড়েছেন অন্যতম কীর্তিমান ভাস্কর শামীম সিকদার।</p> <p>সংশপ্তক : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯০ সালের ২৬ মার্চ নির্মিত হয়েছে স্মারক ভাস্কর্য সংশপ্তক। ভাস্কর্যটির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যুদ্ধে শত্রুর আঘাতে এক হাত, এক পা হারিয়েও রাইফেল হাতে লড়ে যাচ্ছেন দেশমাতৃকার বীর সন্তান।</p> <p>সাবাস বাংলাদেশ : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে নিতুন কুণ্ডুর তৈরি ‘সাবাস বাংলাদেশ’ নামের ভাস্কর্য দেখা যায়। ১৯৯১ সালে নির্মিত এই ভাস্কর্যটিতে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন মুক্তিযোদ্ধার একজন রাইফেল উঁচু করে দাঁড়িয়ে তার বাঁ বাহুটি মুষ্টিবদ্ধ করে জাগানো। অন্যজন রাইফেল হাতে দৌড়ের ভঙ্গিতে রয়েছে। ডান দিকের দেয়ালে রয়েছে দুজন তরুণ-তরুণী। তরুণের কাঁধে রাইফেল, মুখে দাড়ি, কোমরে গামছা বাঁধা, যেন বাউল। আর তরুণীর হাতে একতারা।</p> <p>এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে ভাস্কর শামীম শিকদারের ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পী শ্যামল চৌধুরী ‘বিজয় ৭১’, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পী রশিদ আহমেদের ‘মুক্ত বাংলা’, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পী স্থপতি নৃপল খানের ‘চেতনা ৭১’, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পী স্থপতি গোপাল চন্দ্র পালের ‘অদম্য বাংলা’, রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজে শিল্পী এহসানুল আহ্সান খানের ‘জয়িতা ৭১’, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর সৈয়দ মোহাম্মদ সোহরাব জাহানের ‘জয় বাংলা’, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর গোপাল চন্দ্র পালের ‘দুর্বার বাংলা’, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পী শ্যামল চৌধুরীর ‘স্বাধীনতা চত্বর’সহ সারা দেশে রয়েছে আরো বেশ কিছু মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য।</p>