<p>বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী নিয়ে কোনো ধরনের বাণিজ্য চলবে না—এই ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর। কিন্তু কে শোনে কার কথা। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষের মনোগ্রাম ব্যবহার করে পটুয়াখালীর অন্তত দুটি উপজেলায় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতারা বাণিজ্যে নেমেছেন। এই বাণিজ্যের উপকরণ হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে ‘লাকি কুপন’ ও ক্যালেন্ডার, যার প্রতিটির মূল্য ধরা হয়েছে ৫০ টাকা। পাশাপাশি ধার্যকৃত চাঁদা তো রয়েছেই। আর এসব বাণিজ্যের কবলে পড়েছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও। তাঁদের উপকরণ বিক্রির হাতিয়ার করা হয়েছে।</p> <p>কুপন বাণিজ্য : অভিযোগে জানা গেছে, পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলায় মুজিববর্ষ পালনের অনুষ্ঠান সামনে রেখে শিল্পকলা একাডেমি ও ক্রীড়া সংস্থার উদ্যোগে লটারির ‘লাকি কুপন’ বিক্রির নামে চাঁদাবাজিতে নেমেছে উপজেলা প্রশাসন। কুপনের মূল্যমান ৫০ টাকা। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের সংখ্যা হিসাব করে তারও অতিরিক্ত কুপন পাঠানো হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোতে। তবে ৫০-এর কম কোথাও পাঠানো হয়নি। সর্বোচ্চ ২০০ পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক দুটি কুপন কিনতে বলা হয়েছে। আর সব কুপন বিক্রি হোক বা না-ই হোক, সেগুলোর মূল্যের সব টাকা পরিশোধ করতে হবে প্রধান শিক্ষককে।</p> <p>লেবুখালী সরকারি হাবিবুল্লাহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে এই বিদ্যালয়ে ১০০ কুপন পাঠানো হয়েছে। সেগুলো শিক্ষক, কর্মচারীসহ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে। কয়েকজন শিক্ষক বলেন, আমরা ওগুলো বিক্রি না করে দিলে পুরো টাকাই আমাদের পরিশোধ করতে হতো।</p> <p>কুপন বাণিজ্য ছাড়াও এই উপজেলার প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নির্ধারিত অঙ্কের চাঁদা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শঙ্কর কুমার বিশ্বাস। প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ৩০০ টাকা এবং মাধ্যমিক, মাদরাসা ও কলেজকে ৫০০ টাকা দিতে বলা হয়েছে। দুমকি উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয় ৫৯টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২২টি, দাখিল মাদরাসা ২২টি এবং সাতটি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। ব্যবসায়ীদেরও চাঁদা ধরা হয়েছে।</p> <p>এ নিয়ে শিক্ষক ও ব্যবসায়ীরা উপজেলা প্রশাসনের ওপর ক্ষুব্ধ। একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘পটুয়াখালী জেলায় আটটি উপজেলার মধ্যে দুমকি ছাড়া মুজিববর্ষ উপলক্ষে আর কোনো উপজেলার ইউএনও চাঁদাবাজির মতো নোংরা কাজ করছেন না। দুমকির ইউএনও এ কথাও বলেন—যারা একটা কুপন কিনবে তারা মুজিবকে ভালোবাসে, মুজিববর্ষকে ভালোবাসে। ৫০ টাকার জন্য এসব বলে তিনি বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানকে অপমান করছেন।’</p> <p>নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা জানান, জাতির পিতার নাম ভাঙিয়ে এমন বাণিজ্য তাঁরা আশা করেন না। যারা এটা করছে তাদের এতে কিছু আসে-যায় না; কিন্তু জাতির পিতাকে ছোট করা হয়।</p> <p>একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘আমাকে ১০০ কুপন দিয়ে পাঁচ হাজার টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। আমি মাত্র ৩৪টি কুপন বিক্রি করেছি। বাকিগুলো বিক্রি হবে কি না সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু আমাকে পাঁচ হাজার টাকাই পরিশোধ করতে হবে। এটি আমার জন্য একটি বোঝা। এ ছাড়া অতিরিক্ত দিতে হবে ৫০০ টাকা।’</p> <p>এসব অভিযোগের জবাবে দুমকির ইউএনও শঙ্কর কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘মুজিববর্ষ উপলক্ষে কুপন ছাড়াটা ঠিক হয়নি। মূলত বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য পুরস্কারসহ খরচ মেটাতে কুপন ছাড়া হয়েছে। কিন্তু কাউকে লটারি কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে না।’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ৩০০ ও ৫০০ করে টাকা উত্তোলনের ব্যাপারে বলেন, ‘আমাদের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সফল করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সহায়তা চাওয়া হয়েছে। আমি নিজেও দুই হাজার টাকা চাঁদা দিয়েছি।’</p> <p>বাউফলে ক্যালেন্ডার বাণিজ্য : পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলায় চলছে ক্যালেন্ডার বাণিজ্য। ১০ টাকা মূল্যের একটি ক্যালেন্ডার ৫০ টাকায় কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। এখানেও বেছে নেওয়া হয়েছে শিক্ষকসমাজকে। ক্যালেন্ডার বিক্রির নির্দেশনা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় সংসদ সদস্য আ স ম ফিরোজের বিরুদ্ধে।</p> <p>জানা গেছে, ১ মার্চ উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ ও মাদরাসা প্রধানদের নিয়ে সভা করেন এমপি ফিরোজ। ওই দিনই ক্যালেন্ডারের মোড়ক উন্মোচন করেন তিনি। কোন শ্রেণির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদরাসা ও কলেজ) কতটি করে ক্যালেন্ডার কিনবে এই নির্দেশনাও দেন তিনি। মোট ৫০ হাজার ক্যালেন্ডার তৈরি করা হয়েছে। ক্যালেন্ডারে ওপরের অংশে বড় করে বঙ্গবন্ধুর ছবিসংবলিত মনোগ্রাম রয়েছে।</p> <p>সালাউদ্দিন আহম্মেদ নামের এক ছাপাখানার মালিক ওই ক্যালেন্ডার দেখে বলেন, এটি ছাপানোর সর্বোচ্চ মূল্য ৮ থেকে ১০ টাকা হতে পারে।</p> <p>ওই উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২৩৯, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬০, কলেজের সংখ্যা ১২ এবং মাদরাসা ৬৯টি। উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা এবং শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্যালেন্ডার বিক্রির জন্য একটি প্রধান কমিটি এবং ২১টি উপকমিটি গঠন করা হয়েছে।</p> <p>উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে উপজেলা পর্যায়ে ৬১ সদস্যের প্রধান কমিটির সভাপতি এমপি ফিরোজ নিজেই এবং সদস্যসচিব হলেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব হাওলাদার। প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভার জন্য ৩১ সদস্যের পৃথক ১৬টি উপকমিটি রয়েছে, যার সদস্যরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থক। এ ছাড়া প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদরাসা ও কলেজের জন্য রয়েছে পৃথক চারটি উপকমিটি।</p> <p>শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপকমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মাদরাসায় বিক্রির জন্য পাঁচ হাজার করে মোট ১৫ হাজার, ১২টি কলেজের শিক্ষকদের কাছে বিক্রির জন্য তিন হাজার, ১৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় বিক্রির জন্য ১৬টি উপকমিটির কাছে ৩২ হাজার ক্যালেন্ডার সরবরাহ করা হয়েছে।</p> <p>এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান বলেন, ‘আমাকে ১০০ ক্যালেন্ডার দিয়ে বলা হয়েছে, পাঁচ হাজার টাকা দিতে হবে। তাই আমি সহকারী শিক্ষক ও কর্মচারীদের মধ্যে দুই থেকে তিনটি করে ক্যালেন্ডার বিক্রি করে দিয়েছি।’ আরেক প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘আমার বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক পাঁচজন। আমাকে ২১টি ক্যালেন্ডার দিয়ে উপকমিটির প্রধানের কাছে দুই হাজার ৫০ টাকা দিতে বলা হয়েছে।’</p> <p>মাধ্যমিক পর্যায়ের উপকমিটির প্রধান মোসা. মরিয়ম বেগম নিসু বলেন, ‘মাধ্যমিক পর্যায়ে চার হাজার ক্যালেন্ডার দেওয়া হয়েছে। কাউকে কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে না। যাঁরা নিতে আগ্রহী তাঁদেরই দেওয়া হচ্ছে।’</p> <p>এ ব্যাপারে এমপি আ স ম ফিরোজ সাংবাদিকদের বলেন, ‘২৫ টাকায় ক্যালেন্ডার ছাপিয়ে ৫০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। এটা আমার ব্যবসা না। এটা আমার নির্দেশে হচ্ছে না। শিক্ষকরা চাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জীবনী সংরক্ষণ করতে। তাই এটা ছাপিয়ে বিতরণ করা হচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে যে টাকা পাওয়া যাবে তা ১৭ মার্চ ব্যয় করা হবে। কাউকে কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে না।’ এরপর তিনি বলেন, ‘এটা কোনো নিউজ না। আমার বদনাম করতে এসব ক্ষুদ্র জিনিস নিয়ে যারা নিউজ করে তাদের বংশপরিচয় নাই।’</p> <p> </p> <p> </p>