<p>‘ওপর থেকে ডাক এলে উড়াল দেবে জীবন পাখি...ঠিকানা শুধু এক সমাধি, সাড়ে তিন হাত মাটি।’ নিজের গানের কথাকে সত্য মেনে মায়ের কবরের বাঁ পাশে সাড়ে তিন হাত মাটিতেই চিরনিদ্রায় ঘুমালেন ব্যান্ডসংগীতের কিংবদন্তি রকস্টার আইয়ুব বাচ্চু। আশির দশকে সংগীতে প্রতিষ্ঠা পেতে মায়ের কোল ছেড়ে ঢাকায় গিয়েছিলেন। মায়ের মৃত্যুর পর বিভিন্ন পারিবারিক আড্ডায় নিজের মৃত্যুর কথা উঠলে কিছু ইচ্ছা ব্যক্ত করতেন। শিল্পীর সেই ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে নগরীর স্টেশন রোডের চৈতন্যগলির বাইশমহল্লা কবরস্থানে শনিবার বিকেল সাড়ে ৫টায় তাঁর চির শয্যা পাতা হলো। কফিনবন্দি হয়ে নিজ শহরে ফিরে লক্ষাধিক মানুষের জানাজায়, ভক্তকুলের ভালোবাসায় আরো একবার সিক্ত হলেন রুপালি গিটারের অভিমানী ছেলেটি।</p> <p>সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটে ইউএস বাংলার একটি ফ্লাইটে আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়। চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন শিল্পীর মরদেহ গ্রহণ করেন। সঙ্গে ঢাকা থেকে এসেছেন স্ত্রী ফেরদৌস আক্তার, ছেলে আহনাফ তাজওয়ার আইয়ুব ও মেয়ে ফাইরুজ সাফরাসহ স্বজনরা।</p> <p>বিমানবন্দর থেকে আইয়ুব বাচ্চুর কফিন নেওয়া হয় নগরীর পূর্ব মাদারবাড়ির নানাবাড়িতে। কফিনবাহী অ্যাম্বুল্যান্সটি ঢাকা ছিল একটি কালো ব্যানারে। তাতে লেখা ছিল ‘কিংবদন্তির মৃত্যু নেই’। ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া আইয়ুব বাচ্চুর শৈশব-কৈশোরের অনেকটা সময় নানাবাড়িতেই কেটেছে। তাঁকে শেষবার দেখতে সেই বাড়িতে ভিড় করেছেন বন্ধু, স্বজন, আত্মীয় আর ভক্তরা। দুপুর ১২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত স্বজন আর হাজার হাজার নারী-পুরুষ ‘গিটারের জাদুকর’কে একনজর দেখার জন্য ভিড় করে। ভক্ত-অনুরাগীর ঢল সামাল দিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হিমশিম খেতে দেখা যায়।</p> <p>প্রিয় ভাগ্নের অকালমৃত্যুতে শোকে মূহ্যমান ছোট মামা মো. আবদুল হালিম লোহানী। ভাগ্নের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সুযোগ পেলেই চট্টগ্রামের মাদারবাড়িতে ছুটে আসত বাচ্চু। আমার বোন (বাচ্চুর মা) মারা যাওয়ার পর বাচ্চুকে আমরা দেখাশোনা করতাম। ছোটবেলা থেকেই তার ইচ্ছা ছিল সে একজন বড় শিল্পী হবে। ইচ্ছা অনুযায়ী জনপ্রিয় ও দেশবরেণ্য শিল্পীও হয়েছে সে। কিন্তু এত বড় শিল্পী হওয়ার পরও সে আমাদের কাছে সেই ছোট্টটিই ছিল। পায়ে ধরে সালাম করত। বলত, আপনি তো আমার মামা। মামা মানে মা মা, দুইটা মা।’</p> <p>বাবার আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ পেয়ে আগের রাতে দীর্ঘ বিমান ভ্রমণ শেষে দেশে ফেরেন বাচ্চুর একমাত্র ছেলে আহনাফ তাজওয়ার আইয়ুব। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ আর সদ্য বাবা হারানোয় বিহ্বল চেহারা। তার পরও বাবার জন্য সবার কাছে দোয়া চাইলেন। বললেন, ‘সবার কাছে আমার একটাই চাওয়া, আপনারা আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন। তাঁর যেন বেহেশত নসিব হয়। আর তাঁকে নিয়ে কারো মনে কোনো ক্ষোভ থাকলে মাফ করে দেবেন।’ আহনাফ তাজওয়ার আরো বলেন, ‘আমার বাবা হয়তো আপনাদের জন্য সর্বোচ্চটা দিতে পারেননি। কিন্তু তিনি আপনাদের অফুরন্ত ভালোবাসা দিয়েছেন। তিনি অনেক করেছেন। আপনাদের কাছে শেষ কথা, আপনারা আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন।’</p> <p>চট্টগ্রাম শহরে এক খণ্ড জমি কিনে একটি বাড়ি করার স্বপ্ন দেখেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। জানালেন চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। মেয়র বলেন, ‘দেখা হলেই আমাকে বলতেন, ‘বদ্দা, আমাকে একটা বাড়ি করার ব্যবস্থা করে দেন। একটা জায়গা ঠিক করে দেন, আমি কিনে নেব। আমি একটা বাড়ি করব। সেখানে আমার বাবাকে রাখব। আমিও এসে থাকব। বাচ্চুকে ছোটবেলা থেকেই আমি চিনি। সে মানুষকে খুব ভালোবাসত। চট্টগ্রামকে ভালোবাসত।’</p> <p>বিকেল পৌনে ৩টায় আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ নগরীর দামপাড়া জমিয়তুল ফালাহ মসজিদে নামাজে জানাজার উদ্দেশ্যে আনা হয়। এ সময় ভক্তের ঢল নামে শিল্পীকে একনজর দেখার জন্য। ভক্তের ঢল জমিয়তুল ফালাহ মসজিদের ময়দান ছাড়িয়ে পাশের সড়কে ছড়িয়ে পড়ে। উপস্থিত মানুষজনের মতে, চট্টলবীর এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরে এত বড় জানাজা চট্টগ্রামে হয়নি। ভক্তদের ভালোবাসার ফুলে সিক্ত হয় আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান, নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি মাহতাব উদ্দীন চৌধুরী, শিল্পী পার্থ বড়ুয়া প্রমুখ। পরে সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে শিল্পীর মরদেহ সমাহিত হয় মায়ের কবরের পাশে।</p> <p>এর আগে পূর্ব মাদারবাড়িতে ভিড় থেকে একটু দূরে নিষ্পলক কফিনের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলতে দেখা যায় এক যুবককে। কাছে গিয়ে পরিচয় জানতে চাইলে ইতস্তত করে নামটি জানালেন—শিহাব। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর করা শিহাব নিজের অনুভূতি জানিয়ে বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনে আসা-যাওয়ার পথে বাচ্চু আর জেমস ছিলেন আমাদের সব সুখ-দুঃখের সাথি।’</p>