পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলায় সুপারিগাছের পরিত্যক্ত খোল দিয়ে পরিবেশবান্ধব তৈজস তৈরি হচ্ছে, যা প্লাস্টিকের একবার ব্যবহারযোগ্য থালা-বাটির বিকল্প হিসেবে ঢাকার বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় সরবরাহ করা হচ্ছে।
এক বছরের বেশি সময় আগে নারী উদ্যোক্তা নিলুফার ইয়াসমিন এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেন। কাউখালী সদর ইউনিয়নের নাঙ্গুলী গ্রামে তিনি গড়ে তুলেছেন ন্যাচারাল বিউটি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। অর্ধশত শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে এখানে।
তাঁর এই উদ্যোগ স্বল্প দিনের হলেও এরই মধ্যে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আভাস মিলেছে।
নিলুফার জানান, খোলের ভরা মৌসুম অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এসব তৈজস বিক্রি করে তাঁর মাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকা আসে। অন্য সময় মাসে গড়ে ৮০ হাজার টাকা করে পান। বৃষ্টির সময় গাছ ভেজা থাকায় খোল সংগ্রহ করা ও শুকানো কঠিন হয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, তাঁর বাজার মূলত ঢাকায়। বনানী ও ধানমণ্ডির ১০টির বেশি নামকরা চেইন শপ ও রেস্তোরাঁয় তাঁদের পণ্য নিয়মিত ব্যবহার করা হচ্ছে। তাঁরা সুপারির খোল দিয়ে প্লেট, খাবারের বক্স, নাশতার প্লেট, চায়ের কাপ, চামচসহ ১৩ ধরনের পণ্য তৈরি করছেন।
উপকূলীয় এলাকার সুপারিগাছ ঝড় থেকে ঘরবাড়ি রক্ষা করে।
তাই পিরোজপুরে প্রচুর সুপারিগাছ। বিশেষ করে কাউখালী, নাজিরপুর ও স্বরূপকাঠি উপজেলায়।
যেভাবে শুরু : নিলুফার ইয়াসমিনের জন্ম ১৯৮৮ সালে, নাঙ্গুলী গ্রামের পাশের গ্রাম কেউন্দিয়ায়। ২০০৭ সালে তিনি বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। একই বছর হাফিজুর রহমান জুয়েলকে বিয়ে করেন।
স্বামীর চাকরি সূত্রে তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েক বছর ঢাকায় থাকেন নিলুফার। পরে শ্বশুরবাড়ি বরিশাল চলে আসেন। এর মধ্যে তিনি তিন সন্তানের মা হয়েছেন।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিলুফার খোল থেকে তৈজস তৈরির উদ্যোগ নেন। কাউখালীর নাঙ্গুলীতে কারখানা স্থাপন করেন। স্বামীর সহযোগিতায় চারটি মেশিন কিনে আনেন। এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে তাঁর প্রায় ২৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। গত বছর জুনে তিনি নারী উদ্যোক্তা হিসেবে স্বল্প সুদে সোনালী ব্যাংক কাউখালী শাখা থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ পেয়েছেন।
নিলুফার থাকেন বরিশালে, চাকরি সূত্রে তাঁর স্বামী থাকেন ঢাকায়। কারখানা পরিচালনা করেন নিলুফারের মামা ফরিদুল ইসলাম। প্রতি শুক্রবার নিলুফার স্বামীকে নিয়ে কারখানায় আসেন। নিলুফারের এক ভাই ঢাকায় বিভিন্ন দোকানে পণ্যের ফরমায়েশ নেন। সে অনুযায়ী ফরিদুল প্রতি সপ্তাহে সড়কপথে ঢাকায় পণ্য পাঠান। বর্তমানে প্রতি মাসে অন্তত ২৫ হাজার পিস পণ্য তাঁরা ঢাকায় সরবরাহ করেন। তবে আয়-ব্যয় মিলিয়ে এখনো সমান সমান বলে জানান নিলুফার। বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক থাকলে, মেশিন ঠিকমতো চালাতে পারলে এবং পণ্যের চাহিদা বাড়লে তাঁরা লাভের মুখ দেখবেন বলে আশা করছেন।
ফেলনা থেকে আয় : কাউখালীর সাহাপুরার বাগান মালিক ইমাম হোসেন বলেন, ‘সুপারিগাছের খোলগুলো ভিটেবাড়ির আশপাশে পড়ে থাকত। এগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার হতো বাড়ির আঙিনার বেড়া হিসেবে। এ ছাড়া রান্নাবান্নার কাজেও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হতো। এখন বিভিন্ন পণ্য তৈরির জন্য এসব কিনে নিয়ে যাচ্ছেন শ্রমিকরা। আমরাও আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছি।’
লাঙ্গুলী গ্রামের গৃহবধু কল্পনা মজুমদার বলেন, ‘সুপারির খোল বিক্রি করে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ জোগাতে পারছি।’
কারখানার শ্রমিক মিতা বড়াল বলেন, ‘ঘর সামলানোর পর এখন কারখানায় এসে কাজ করি। এতে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ টাকা আয় হয়। যেদিন কাজ থাকে না, সেদিন বাড়ি বাড়ি সুপারিবাগানে গিয়ে খোল সংগ্রহ করি। কারখানায় গিয়ে তা বিক্রি করি।’
পরিবেশকর্মী আরিফুর রহমান বলেন, সাগরসৈকত কুয়াকাটায় শীত মৌসুমে পর্যটকের বেশ আনাগোনা থাকে। তারা অনেকে ওয়ান টাইম প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করে সৈকতে ফেলে দেয়। এতে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে।
তিনি বলেন, সুপারির খোলে তৈরি তৈজসের বিদেশেও চাহিদা রয়েছে। এসব পণ্য রপ্তানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।
উদ্যোক্তার স্বপ্ন ও প্রত্যাশা : নিলুফার ইয়াসমিন বলেন, একটা সুপারি খোল বাগান থেকে সংগ্রহ করতে খরচ পড়ে এক টাকা। পরিবহনভাড়া, পরিষ্কার করা, শুকানো এবং কারখানা পর্যন্ত পৌঁছাতে খরচ পড়ে ছয় টাকা করে। একটি খোল দিয়ে তিনটি পণ্য তৈরি সম্ভব। একটি খোল থেকে আয় ১২ টাকা। কিন্তু প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম পণ্যের দাম অনেক কম। তাই পরিবেশবান্ধব এই পণ্য কিছুটা কোণঠাসা।
সুপারিগাছের পণ্যের ক্রোকারিজ তৈরিকে একটি খাত হিসেবে গড়ে তুলতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সহযোগিতা কামনা করেছেন এই উদ্যোক্তা।
নিলুফার বলেন, এই খাতে উদ্যোক্তা তৈরি এবং বিনিয়োগ বাড়াতে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ব্যবস্থাসহ বিল কমিয়ে দিতে হবে। সোলারের ব্যবস্থা করা গেলে উৎপাদনে ঘাটতি হতো না। তা ছাড়া পণ্য রপ্তানিতে বিশেষ প্রণোদনা প্রয়োজন। তা না হলে প্লাস্টিকের কাছে টিকতে পারবে না এই শিল্প।
পরিবেশবান্ধব এসব পণ্যের প্রচার-প্রসারে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের পিরোজপুর জেলা কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপব্যবস্থাপক এইচ এম ফাইজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা অবশ্যই উনার সঙ্গে যোগাযোগ করে বিসিক ও সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করার চেষ্টা করব।’