দেশে আলুর উৎপাদনে এবার রেকর্ড হলেও বিপরীত চিত্র বাজারে। উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় হিমাগারে জমে আছে ৩৫ লাখ টনের বেশি আলু, যার বড় অংশই অবিক্রীত। চাহিদার ঘাটতি ও বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে এসব আলুর একটি বড় অংশ—প্রায় ১১ লাখ টন—নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।
এই পরিস্থিতিতে ক্ষতির মুখে পড়েছে কৃষক ও হিমাগার ব্যবসায়ী উভয় পক্ষ।
একদিকে কৃষক তাঁদের উৎপাদন খরচের চেয়েও কম দামে আলু বিক্রি করছেন, অন্যদিকে হিমাগার মালিকরা পড়েছেন বিপুল ঋণ ও সম্ভাব্য খেলাপির ঝুঁকিতে।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএসএ) সূত্র জানায়, এ বছর দেশে আলু উৎপাদিত হয়েছে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ টন, যা চাহিদার তুলনায় ৪০ লাখ টন বেশি। উৎপাদন বেশি হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ গত বছর কৃষক আলুর ভালো দাম পেয়েছিলেন। ফলে এ বছর অনেক বেশি জমিতে আলুর চাষ হয়েছে।
কিন্তু অতিরিক্ত উৎপাদনের পর কোনো পূর্বপ্রস্তুতি বা বাজার ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ না থাকায় বিপাকে পড়েছে পুরো খাতটি। হিমাগারে সংরক্ষিত ৩৫ লাখ টন আলুর মধ্যে ১০ লাখ টন বীজ আলু, বাকি ২৫ লাখ টনের বেশির ভাগই এখনো অবিক্রীত।
বিসিএসএর হিসাব অনুযায়ী, এক কেজি আলুর উৎপাদন খরচ প্রায় ১৭ টাকা। হিমাগারে সংরক্ষণের পর পরিবহন ও অন্যান্য ব্যয় মিলিয়ে প্রতি কেজির চূড়ান্ত খরচ দাঁড়ায় ২৫ টাকার মতো।
অথচ বর্তমানে হিমাগার গেটে আলু বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৩ থেকে ১৫ টাকায়।
অর্থাৎ প্রতি কেজিতে কৃষকের লোকসান ৮ থেকে ১২ টাকা পর্যন্ত। আর হিমাগার ব্যবসায়ীরা প্রত্যাশা করেছিলেন, এই সময়ে গত বছরের মতো অন্তত ৩৯-৪০ টাকা কেজি দাম পাবেন। এখন দাম অর্ধেকেরও কম হওয়ার কারণে বিপুল পরিমাণ আলু হিমাগার থেকে খালাস না হওয়ায় ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
হিমাগার মালিকদের দাবি, ১১ লাখ টন আলু যদি অবিক্রীত থেকে যায় এবং পচে যায়, তাহলে একদিকে অর্থনৈতিক ক্ষতি তো হবেই, অন্যদিকে তা পরিবেশ বিপর্যয়েরও কারণ হতে পারে।
এই আলু ফেলে দেওয়ার বা ধ্বংস করার কোনো ব্যবস্থা নেই। যত্রতত্র ফেলা হলে তা দুর্গন্ধ ও দূষণের সৃষ্টি করতে পারে।
বিসিএসএর পক্ষ থেকে সরকারকে কয়েকটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে—সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় যে ৫৫ লাখ পরিবারকে ভর্তুকি মূল্যে চাল দেওয়া হচ্ছে, এর সঙ্গে প্রতিটি পরিবারকে ১৫ টাকা কেজি দরে ১০ কেজি আলু দেওয়া হোক; দেশের বিভিন্ন স্থানে টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রির ট্রাক সেল কার্যক্রম চালু করা হোক এবং হিমাগার গেটে আলুর ন্যূনতম বিক্রয়মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করা হোক।
এসব ব্যবস্থা নেওয়া গেলে একদিকে কৃষক ও হিমাগার ব্যবসায়ীরা কিছুটা স্বস্তি পাবেন, অন্যদিকে আগামী মৌসুমের জন্য কৃষকের উৎপাদনের আগ্রহও টিকিয়ে রাখা যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এ বিষয়ে বিসিএসএর সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এবার আলু নিয়ে আমরা মহাসংকটে আছি। হিমাগার ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আলু কিনেছেন। ডিসেম্বরের মধ্যে আলু বিক্রি না হলে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়বেন। অনেকে ঋণখেলাপিও হয়ে পড়তে পারেন।’
মোস্তফা আজাদ আরো বলেন, ‘হিমাগারে আলুর ন্যূনতম মূল্য ২৫ টাকা কেজি নির্ধারণ করা না হলে আগামী বছর কৃষকরা আলু চাষে নিরুৎসাহ হবেন। এতে আবার ২০২৪ সালের মতো পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে, যখন প্রতি কেজি আলুর দাম উঠেছিল ৭০-৮০ টাকায়।’
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারের উচিত সমাজসেবামূলক কার্যক্রমে চালের পাশাপাশি আলু যুক্ত করা এবং সারা দেশে টিসিবির মাধ্যমে আলুর ট্রাক সেল কার্যক্রম চালানো। এতে যেমন আলুর চাহিদা বাড়বে, তেমনি কৃষকদের মধ্যে সরকারের প্রতি আস্থাও তৈরি হবে।