’
বিপ্লব আরো বলেন, ‘ভিডিওতে দেখা গেছে, কুলিয়ারা গ্রামের আব্দুল বারিকের ছেলে জামায়াত নেতা আবুল হাশেম মজুমদারের নেতৃত্বে একই গ্রামের অহিদুর রহমান, এমরান হোসেন, পেয়ার, রাসেল, শহীদ, আহমেদ, ফরহান, ইসমাইল, বেলালসহ জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা আমার বাবাকে লাঞ্ছিত করেছে।’
গতকাল সোমবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে অভিযুক্ত কাউকে এলাকায় পাওয়া যায়নি। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা জামায়াতের আমির মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘এ ঘটনার সঙ্গে স্থানীয় জামায়াতের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আবুল হাশেম আমাদের দলের কেউ না। তবে সমর্থক কিংবা অনুসারী হলেও হতে পারে। এ ঘটনা কোনো রাজনৈতিক বিষয় নয়, কানুর কারণে এলাকার মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছিল বিগত সময়ে। সেই ক্ষোভ থেকে এ ঘটনা কেউ করতে পারে। তবে জামায়াতের বিষয়ে যে অপপ্রচার করা হচ্ছে তার নিন্দা জানাচ্ছি। আর যারা এই ঘটনা করেছে আমরাও তাদের শাস্তি চাই।’
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেও বিগত সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই কানু ছিলেন নির্যাতিত। চৌদ্দগ্রামের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের বিপরীতে রাজনীতি করার কারণে গত প্রায় আট বছর এলাকাছাড়া ছিলেন তিনি। তাঁর বাড়িঘরে একাধিকবার হামলা চালিয়েছে মুজিবুলের লোকজন। দেওয়া হয়েছে হত্যাসহ বিভিন্ন মামলা। সম্প্রতি তিনি বাড়িতে গেছেন।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি কামরুল হুদা বলেন, ‘একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে অপমান করে তারা সারা দেশ ও চৌদ্দগ্রামবাসীকে কী মেসেজ দিলেন? ফ্যাসিবাদী আমলের কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় হত্যা, গুম, লুণ্ঠনের বাইরে বাকি ছিল শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের গলায় জুতার মালা পরিয়ে অপমান-অপদস্থ করে গ্রামে গ্রামে হাঁটানো। তাঁর অন্যায় থাকলে তাঁকে পুলিশে সোপর্দ করেন, আদালত তাঁর বিচার করবে। কিন্তু এইভাবে গ্রুপ করে বীভৎসভাবে নিজেদের হাতে আইন তুলে নেওয়া মোটেও ঠিক নয়। আমি ফেসবুকে এ নিয়ে পোস্ট করায় আমাকে জামায়াত পরিচয় দিয়ে হুমকি দিচ্ছে দুর্বৃত্তরা।’
চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি এ টি এম আক্তার উজ জামান বলেন, ‘ভিডিওটি দেখে আমি ওই বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে দুইবার কথা বলেছি। তিনি কোনো অভিযোগ করতে রাজি হচ্ছেন না। তবে এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করতে পুলিশ কাজ করছে। জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
চৌদ্দগ্রামের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রহমত উল্লাহ বলেন, ‘আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মিডিয়ায় ঘটনাটি দেখেছি। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত। আমি চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলেছি। নির্যাতিত বীর মুক্তিযোদ্ধা কানু সাহেব ফেনীতে আছেন। আমি আইনগত সহযোগিতা ও নিরাপত্তা বিষয়েও কথা বলেছি।’
চৌদ্দগ্রাম উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার প্রমথ রঞ্জন চক্রবর্তী জানান, ‘বিজয়ের মাসে বীর মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান করবে, এটা মানা যায় না। আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনকে অনুরোধ করেছি।’
কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) আরাফাতুল ইসলাম বলেন, ‘এ ঘটনায় কুমিল্লা জেলা পুলিশ মর্মাহত। আমরা লিখিত কোনো অভিযোগ পাইনি, তবে আমরা মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তিনি অসুস্থ, ফেনীতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। যারা এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে, আমাদের টিম রাত থেকে এখন পর্যন্ত মাঠে আছে। গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হেনস্তার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। সোমবার এক বিবৃতিতে উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ বাজি রেখে দেশকে স্বাধীন করা একজন যোদ্ধাকে এভাবে প্রকাশ্যে অপমান কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদের বরাত দিয়ে বিবৃতিতে উদীচীর নেতৃবৃন্দ বলেন, রবিবার দুপুরে ৭৮ বছর বয়সী আব্দুল হাই কানুকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা করে বেশ কয়েকজন। সে ঘটনার ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, তাঁকে গ্রামছাড়া করার হুমকিও দেওয়া হয়। স্থানীয়দের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা কানু দীর্ঘদিন ধরেই এলাকায় যেতে পারেননি। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যাসহ ৯টি মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
উদীচী মনে করে, বিজয়ের মাসে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে প্রকাশ্যে হেনস্তা করার ঘটনায় হতবাক সাধারণ মানুষ। কেউ দোষী হলে তাঁর বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। একইভাবে মুক্তিযোদ্ধা কানুর বিরুদ্ধেও মামলা করাসহ আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু তা না করে তাঁকে প্রকাশ্যে হেনস্তা করা অত্যনন্ত নিন্দনীয়। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুত গ্রেপ্তার করা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবিও জানিয়েছেন উদীচীর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।
চৌদ্দগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই কানুকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় দুই সমর্থককে বহিষ্কার করেছে জামায়াতে ইসলামী। একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাকে লাঞ্ছিত করায় নিন্দা জানিয়ে জড়িতদের গ্রেপ্তার দাবি করেছে দলটি।
বহিষ্কার হওয়া কর্মীরা হলেন কুলিয়ারার মৃত আবদুল বারেকের ছেলে মু. আবুল হাশেম ও মৃত শফিকুর রহমানের ছেলে মু. ওহিদুর রহমান। গতকাল সোমবার এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা শাখা।
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা শাখার আমির অ্যাডভোকেট মু. শাহজাহান ও জেলা সেক্রেটারি ড. সরওয়ার উদ্দিন ছিদ্দিকী যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই কানুকে লাঞ্ছনার ঘটনা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। আমরা এই দুঃখজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’
প্রতিবাদে চৌদ্দগ্রাম বিএনপির বিক্ষোভ মিছিল
এদিকে চৌদ্দগ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই কানুকে লাঞ্ছিত ও জুতার মালা পরিয়ে এলাকা ছাড়া করার প্রতিবাদে এবং দোষী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেছে উপজেলা ও পৌর বিএনপি। সোমবার রাতে বিএনপির উপজেলা কার্যালয় থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ স্থান প্রদক্ষিণ করে। এ সময় মিছিলে নেতৃত্ব দেন উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক নুরু নবী পাটোয়ারী নুরু। এ সময় পৌর বিএনপির আহ্বায়ক হারুন অর রশিদ মজুমদারসহ নেতারা বিক্ষোভ মিছিল শেষে বক্তব্যে বলেন, ‘আমাদের প্রতিবাদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে যারা অপমান করেছে তাদের বিরুদ্ধে। এই মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যদি ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন না করতেন তাহলে আমরা পেতাম না লাল-সবুজের পতাকা। প্রশাসনের প্রতি আহবান জানিয়ে বিএনপির এই নেতা বলেন, যারা এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান করে জুতার মালা পরিয়েছে, তাদের অবিলম্বে আইনের আওতায় আনা হোক।’