<p>কুমিল্লা নগরীর রাজগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা ছিলেন দিলীপ দাস (৬২)। কোতোয়ালি মডেল থানার সামনেই বাসা। লন্ড্রির কাজের আয় আর একটি দোকান থেকে পাওয়া ভাড়া দিয়ে ভালোই চলছিল তাঁর সংসার। এক ছেলে, এক মেয়ে আর স্ত্রী রূপা দাসকে নিয়ে ছিল তাঁর সুখের সংসার। কিন্তু হঠাৎই পরিবারটিতে নেমে এসেছে বিপর্যয়।</p> <p>সাম্প্রদায়িক শক্তির আঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি দিলীপ। ছেলেমেয়েকে নিয়ে এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন দিলীপের স্ত্রী। অথচ কয়েক দিন আগেও তাঁর পরনে ছিল রঙিন শাড়ি, মাথায় সিঁদুর। এখন সব রং মুছে দিয়ে সাদা শাড়িতে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছেন রূপা দাস। শুক্রবার সন্ধ্যায় টিক্কারচর শ্মশানে স্বামীকে চিতার আগুনে পোড়ানোর আগে তাঁর পায়ের বুড়ো আঙুলে মুছে দেওয়া হয়েছে রূপার সিঁথির সিঁদুর।</p> <p>গত ১৩ অক্টোবর নগরীর নানুয়ার দীঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া সহিংসতায় গুরুতর আহত হন দিলীপ দাস। টানা ৯ দিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে অবশেষে বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) রাত ১২টার দিকে না-ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি।</p> <p>দিলীপ দাস নিহতের ঘটনায় রবিবার সকালে কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন স্ত্রী রূপা দাস। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে।</p> <p>কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কমল কৃষ্ণ ধর বলেন, ‘দিলীপ দাস নিহতের ঘটনায় মামলা হয়েছে। তবে এই মামলায় এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে তদন্ত করে এ ঘটনায় জড়িতদের শনাক্তের চেষ্টা করছি। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারব।’ </p> <p>পুলিশ ও পরিবারের সদস্যরা জানান, দুর্গাপূজার মধ্যে ওই সহিংসতার দিন সকালে বাসায় নাশতা সেরে নগরীর মনোহরপুর রাজরাজেশ্বরী কালীমন্দিরে পূজা দিতে গিয়েছিলেন দিলীপ। সেদিন নানুয়ার দীঘির পাড়ের মণ্ডপে কোরআন পাওয়ার ঘটনায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে পুরো নগরীতে। রাজরাজেশ্বরী কালীমন্দিরেও চলে হামলা। সংঘাত দেখে বাসায় ফিরতে চেয়েছিলেন দিলীপ। তবে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মন্দিরের গেটের পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় হামলার শিকার হন তিনি।</p> <p>ওই মন্দিরের পুরোহিত দুলাল চক্রবর্তী জানান, দিলীপ মন্দিরের গেটের ভেতরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এক পর্যায়ে মন্দিরের ভেতরে ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করে হামলাকারীরা। এতে মাথায় আঘাত পেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। এ সময় অন্য পূজারিরা গামছা দিয়ে দিলীপের মাথা বেঁধে বসিয়ে রাখেন। পরে তাঁকে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।</p> <p>দিলীপের স্ত্রী রূপা দাস বলেন, ‘সেই দিনটি ছিল আমার কাছে একটি ভয়ংকর দিন। দুপুরে কুমিল্লা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে ফোন পাই। এ সময় আমাদের বাসার সামনে পুলিশ ও হামলাকারীদের ধাওয়াধাওয়ি চলছিল। পুলিশ আমাদের বাইরে যেতে নিষেধ করে। এর মধ্যেই আমি এক আত্মীয়কে নিয়ে হাসপাতালে যাই। পরে সেখান থেকে কুমিল্লা মেডিক্যাল এবং পরে রাতে ঢাকা মেডিক্যালে পাঠানো হয় দিলীপকে।</p> <p>দিলীপ দাসের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছেন। বড় মেয়ে প্রিয়া রানী দাস কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতকোত্তর করছেন। আর ছেলে রাহুল দাস ঢাকার একটি কলেজে লেখাপড়া করেছেন। মেয়ে প্রিয়া দাস দৃষ্টিপাত নামে একটি নাট্যদলের সদস্য। তাঁর বাবা হামলায় আহত হওয়ার পর ওই নাট্য সংগঠন চিকিৎসার জন্য কিছুটা আর্থিক সহযোগিতা করেছে। এ ছাড়া এখনো কেউ তাঁদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেনি।</p> <p>রূপা দাস বলেন, ‘পরিবারের সদস্যরা তাঁর স্বামীর আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। পাশাপাশি একটি ছোট দোকান ভাড়া দিয়ে মাসে পাঁচ হাজার টাকা পাওয়া যায়। স্বামী মারা যাওয়ার পর আমরা বড় সমস্যায় পড়েছি। দোকানভাড়ার মাত্র পাঁচ হাজার টাকায় কিভাবে সংসার চলবে, দুই ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ কিভাবে চালাব তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি।’</p> <p>দিলীপের মেয়ে প্রিয়া বলেন, ‘চিকিৎসা চলাকালে আমরা দৃষ্টিপাত ছাড়া অন্য কারো আর্থিক সহযোগিতা পাইনি। বাবার মৃত্যুর পর তেমন কেউ খোঁজখবরও নিতে আসেনি। আমি বাবার হত্যাকারীদের কঠোর শাস্তি চাই। প্রশাসনের কাছে আমাদের নিরাপত্তা চাই।’</p>