<p>বরগুনার বহুল আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতে সাজাপ্রাপ্ত ১৭ আসামির মধ্যে ১১ জনেরই বয়স ১৬ বছরের নিচে। আইনের চোখে এরা শিশু হওয়ায় এদের নিম্ন আদালতে সাজা হয়েছে কম। আর কয়েকজন হাইকোর্ট থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছে।</p> <p>রাজধানীর পল্লবীতে ছয় বছরের শিশুসন্তানের সামনে সাহিনুদ্দিন নামের এক তরুণকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত দুই আসামি মানিক ও মনির বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। বয়স কম বিবেচনায় এই দুজন এর আগে অন্য মামলায় জামিনে মুক্তি পেয়েছিল।</p> <p>রাজধানীর মিরপুরে রাজিব নামের এক যুবককে হত্যার দায়ে গ্রেপ্তার এক কিশোরকে গত ৬ মে এবং সাভারে স্কুলছাত্র সবুজ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার আরেক স্কুলছাত্রকে সম্প্রতি জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট।</p> <p>শুধু এই কয়েকটি ঘটনাই নয়, আসামি শিশু বিবেচনায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাচ্ছে শিশু-কিশোররা। নিম্ন আদালত থেকেও জামিনে মুক্ত হচ্ছে তারা। করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রেক্ষাপটে নিম্ন আদালতে শিশুদের জামিন দেওয়ার ঘটনা আরো বেশি। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, শিশু-কিশোরদের জন্য আইনি এই অধিকার নিশ্চিত করতে গিয়ে তাদের অপরাধ থেকে ফেরানোর ক্ষেত্রে সুফল আসলে কতটা মিলছে।</p> <p>প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানার ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি আরফিন শাকিল ওরফে ডান্সার শাকিলকে গত ৯ মে আব্দুল্লাহপুরে হত্যা করা হয়। এই শাকিল গ্রুপের হাতেই উত্তরখান এলাকায় গত বছরের ২৮ আগস্ট সোহাগ নামের এক কলেজছাত্র খুন হয়। এই গ্যাং গ্রুপের সদস্য দুধ শামীমকে কিছুদিন আগে গ্রেপ্তার করা হলেও সে জামিনে মুক্তি পেয়ে শাকিলকে হত্যার পরিকল্পনা করে বলে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে।</p> <p>এ রকম ঘটনা আরো আছে। অর্থাৎ জামিনে মুক্তি পেয়ে শিশু ও কিশোররা আবার একই ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে সংশোধনের ব্যবস্থা করতে হবে।</p> <p>সুপ্রিম কোর্টের হিসাব বলছে, চলতি বছরের ১২ এপ্রিল থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত সারা দেশে নিম্ন আদালত থেকে এক হাজার ১৬০ শিশুকে জামিন দেওয়া হয়েছে। এদের সবারই বয়স ১৬ বছরের নিচে। আর সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বিভিন্ন অভিযোগে করা মামলায় ৫৩টি মেয়েশিশুসহ ৫৮৯টি শিশুকে গত বছরের ১২ মে থেকে গত বছরের ২ জুলাই পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন শিশু আদালত জামিন দিয়েছেন। এর বাইরে উচ্চ আদালত থেকে কতজন শিশু জামিন পেয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে নেই। তবে নিম্ন আদালত থেকে যেসব শিশুকে জামিন দেওয়া হচ্ছে না তারা উচ্চ আদালতে জামিনের আবেদন করছে। আর উচ্চ আদালত থেকে কেউ কেউ জামিনে মুক্তি পাচ্ছে।</p> <p>মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, কিশোর অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার মাধ্যমে সংশোধন করতে হবে। জামিনে ছাড়া পেলে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার কারণে সে আবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এ কারণেই তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রয়োজন।</p> <p>সুপ্রিম কোর্টে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ড. মো. বশির উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, আইন অনুযায়ী শিশুদের কারাগারে রাখার সুযোগ নেই। তাদের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে সংশোধনাগার নির্মাণ করা হয়েছে। এখন সময় এসেছে, যারা একাধিকবার অপরাধে জড়াচ্ছে তাদের জামিন না দিয়ে সংশোধনাগারে রেখেই সংশোধনের জন্য ব্যাপকভাবে মোটিভেশনাল কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।</p> <p>শিশুদের নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংগঠন চিলড্রেন চ্যারিটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল হালিম কালের কণ্ঠকে বলেন, শিশু-কিশোররা কেন অপরাধে জড়াচ্ছে তা আগে খতিয়ে দেখতে হবে। তারা যাতে অপরাধে না জড়ায় সে জন্য মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের দেশে অপরাধের সংস্পর্শে আসা শিশু-কিশোরদের গ্রেপ্তারের পর আইন অনুযায়ী বড়দের সঙ্গে কারাগারে না রেখে সংশোধনাগারে রাখার ব্যবস্থা আছে। সারা দেশে মাত্র চারটি সংশোধনাগার। এগুলো নামে সংশোধনাগার হলেও বাস্তবে কারাগার। যশোরে সংশোধনাগারে কয়েকজন কিশোরকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় তদন্ত কমিটির রিপোর্ট তো সবার জানা।’</p> <p>ব্যারিস্টার হালিম বলেন, শিশু বা কিশোরদের যদি জামিন না দেওয়া হয় তবে তাদের জন্য প্রতিটি জেলায় একটি করে সংশোধনাগার গড়ে তুলতে হবে। ওই সংশোধনাগারে একটি করে স্কুল থাকতে হবে, সেখানে তাদের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ শিক্ষা কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।</p> <p>একবার গ্রেপ্তারের পর জামিনে বেরিয়ে এসে নতুন করে অপরাধে জড়ানো শিশু-কিশোরদের জামিন দেওয়া প্রসঙ্গে এই আইনজীবী বলেন, ‘তাদের জামিনের জন্য আদালত বা আইন দায়ী নয়। এর জন্য দায়ী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। দেখুন, প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে কেউ কোনো বাজে মন্তব্য করলে দু-এক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে গ্রেপ্তার করছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। কিন্তু মহল্লায় মহল্লায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে, তাদের তৎপরতা মনিটর করা হচ্ছে না।’</p> <p>ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুব আলম বলেন, কিশোরদের অপরাধ বা এ ধরনের প্রবণতা বন্ধ করতে হলে বা কমিয়ে আনতে হলে অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে হবে। এলাকার সচেতন নাগরিকদের খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, আশার কথা হলো, কিশোর গ্যাং তৎপরতা এরই মধ্যে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। বিট পুলিশিং কার্যক্রমও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।</p>