<p>ভারি বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে হু হু করে বাড়ছে নদ-নদীর পানি। উত্তর জনপদের তিস্তা, যমুনা, ধরলা, ঘাঘট ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা নদীর পানি গোয়ালন্দ পয়েন্টে বিপত্সীমা অতিক্রম করতে পারে। বন্যার পানি ঢুকে পড়ছে একের পর এক গ্রামে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে ধুঁকছে। ডুবছে ক্ষেতের ফসল। ভেসে যাচ্ছে মাছ। বানভাসি মানুষ ভোগান্তির মধ্যে পড়লেও ত্রাণ তৎপরতা তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না।</p> <p>বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, সিলেট, নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, তাদের পর্যবেক্ষণে থাকা ১০১ স্টেশনের মধ্যে ৮৬টির পানি বাড়ছে। ১৩টি স্টেশনের পানি কমছে। আর দুটির পানি অপরিবর্তিত রয়েছে।</p> <p>এদিকে সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে গতকাল রবিবার দেশের বিভিন্ন জেলায় ভারি বর্ষণ হয়েছে। মৌসুমি বায়ু পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় আজও দেশের বিভিন্ন স্থানে ভারি বর্ষণ হতে পারে। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা ও বরিশাল এলাকায় বেশি বৃষ্টি হবে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলেও ভারি বর্ষণের আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। এ ব্যাপারে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—</p> <p>ধুনট (বগুড়া) : যমুনা নদীর পানি বাড়তে থাকায় বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনটে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত তিন উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের ৯০ গ্রামের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবর রহমান জানিয়েছেন, গতকাল বিকেলে সারিয়াকান্দির মথুরাপাড়া পয়েন্টে যমুনার পানি বিপত্সীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। পানি বাড়তে থাকায় বন্যা পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি ঘটছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের অবস্থা ভালো আছে। পুরো বাঁধ এলাকা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।</p> <p>গাইবান্ধা : ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও ঘাঘট নদের পানি বেড়েই চলছে। ফলে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত  হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়ছে মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, গতকাল বিকেল পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপত্সীমার ৬৬ সেন্টিমিটার এবং ঘাঘট নদের পানি বিপত্সীমার ৪২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সুন্দরগঞ্জের সাতটি, গাইবান্ধা সদরের তিনটি, ফুলছড়ির ছয়টি ও সাঘাটার তিনটি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এসব এলাকার  ঘরবাড়িতে পানি উঠায় এ পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার পরিবার এখন পানিবন্দি। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। কোথাও কোথাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি উঠেছে।</p> <p>লালমনিরহাট : লালমনিরহাটে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে গতকাল বিকেলে নদীর পানি বিপত্সীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। অন্যদিকে সদর উপজেলার শিমুলবাড়ী পয়েন্টে ধরলা নদীর পানি বিপত্সীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। নদীতে পানি বেড়ে যাওয়া তিনটি উপজেলার বেশ কিছু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি চলছে নদীভাঙন। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আলী হায়দার জানান, সরকারিভাবে গতকাল পর্যন্ত আট হাজার পরিবারের তালিকা করা হয়েছে। তাদের জন্য প্রায় ৬৯ মেট্রিক টন চাল ও ছয় লাখ ২৬ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এদিকে সদর উপজেলার চর গোকুন্ডা এলাকায় অব্যাহত রয়েছে নদীভাঙন।</p> <p>সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বেড়ে গতকাল বিকেলে বিপত্সীমার ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। যমুনায় পানি বাড়ার পাশাপাশি টানা বর্ষণে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে চরাঞ্চলের ফসলি জমি। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, সিরাজগঞ্জ যমুনা হার্ড পয়েন্টে গতকাল বিকেলে যমুনার পানি রেকর্ড করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৫২ মিটার। এতে গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি ৩২ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপত্সীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।</p> <p>জানা যায়, যমুনার পানি বাড়ার ফলে নিম্নাঞ্চলের শত শত একর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। যমুনা নদী সংলগ্ন জেলার পাঁচটি উপজেলার অন্তত ৫০টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।</p> <p>কুড়িগ্রাম : ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়ায় এ দুটি নদ-নদীর অববাহিকার তিন শতাধিক চর ও নদীসংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। গতকাল সকালে ধরলার পানি বিপত্সীমার ৬২ সেন্টিমিটার এবং ব্রহ্মপুত্রের পানি ৬৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বন্যাকবলিত এলাকায় প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে।</p> <p>কুড়িগ্রাম-যাত্রাপুর সড়কসহ জেলা সদরের সঙ্গে বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। চরাঞ্চলের অনেকেই উঁচু ভিটা, নৌকা ও চৌকির ওপর আশ্রয় নিয়েছে। কেউ কেউ নিকটবর্তী বাঁধ, রাস্তা, আশ্রয়কেন্দ্র ও স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে। এদিকে পানির তোড়ে রাজারহাটের কালুয়ারচর, সদর উপজেলার সারডোবসহ বেশ কয়েকটি স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বালুর বস্তা ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করছে। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ রক্ষার জন্য রাত-দিন তদারকির কাজ চলছে।</p> <p>নীলফামারী : নীলফামারীতে তিস্তার পানি বাড়ছেই। গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপত্সীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি বাড়ার ফলে ডিমলার পূর্ব ছাতনাই, খগাখড়িবাড়ী, টেপাখড়িবাড়ী, খালিশা চাঁপানী, ঝুনাগাছ চাঁপানী ও গয়াবাড়ী ইউনিয়নের প্রায় ১৫ চরাঞ্চল গ্রামের পাঁচ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।</p> <p>ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রবিউল ইসলাম বলেন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যারাজের ৪৪ গেটের সব কটি খুলে দেওয়া হয়েছে।</p> <p>উলিপুর (কুড়িগ্রাম) : উলিপুরে ধরলা, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ফলে উপজেলার আটটি ইউনিয়নের প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদে ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙনকবলিত মানুষজন ভিটামাটি হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছে।</p> <p>এদিকে পানি বাড়ার কারণে প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে তিস্তা নদীর বাঁ তীর রক্ষায় নির্মিত টি-বাঁধটি ভাঙনের কবলে পড়েছে। এরই মধ্যে বাঁধটির টি-পার্টের উজানের বেল মাউথের ৫০ মিটার নদীগর্ভে চলে গেছে। বাঁধটি রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড বালুভর্তি জিও টেক্সটাইল ব্যাগ ডাম্পিং করছে।</p> <p>সিলেট : টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায় বন্যা দেখা দেওয়ার পর এবার সিলেট নগরের বিভিন্ন এলাকায়ও সুরমা নদীর পানি ঢুকে পড়েছে। সুরমা নদীর পানি বেড়ে নগরের অভিজাত শাহজালাল উপশহর এলাকাসহ বেশ কয়েকটি এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তবে দুপুর থেকে বৃষ্টি বন্ধ থাকায় জেলার গোয়াইনঘাট, কানাইঘাটসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে।</p> <p>সুনামগঞ্জ : পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে সুনামগঞ্জ শহরের প্রায় সব সড়ক ডুবে গেছে। প্রায় তিন হাজার বাসাবাড়ি, দোকানপাট, সরকারি-বেসরকারি অফিসে পানি ঢুকে পড়েছে। শহরের রাস্তায় এখন নৌকায় চলাচল করছে সাধারণ মানুষ। বাসাবাড়িতে পানি উঠায় দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে।</p> <p> </p>