<p>রাঙামাটির লংগদুর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। শুক্রবারের তাণ্ডবের পর প্রশাসনের হস্তক্ষেপে গতকাল শনিবার সকাল থেকেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকে। তাণ্ডবের আগে বা ওই সময় ঘরবাড়ি ছেড়ে যাওয়া পাহাড়িরা ফিরে দেখছে তাদের বসতভিটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। চোখের সামনে এমন তাণ্ডবের দগদগে ঘা দেখে কিছুতেই তাদের মনে স্বস্তি ফিরছে না। স্বাভাবিক জীবনে ফেরার ব্যাপারেও অনিশ্চয়তা আছে তাদের মধ্যে।</p> <p>হামলার ঘটনায় এরই মধ্যে সাতজনকে আটক করা হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে ১৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরো ৩০০ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেছে। </p> <p>গতকাল সকালে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মানজারুল মান্নান, পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। দুপুর ২টার দিকে উপজেলা থেকে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দেন জেলা প্রশাসক।</p> <p>এ ছাড়া ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে তিন সদস্যের একটি মূল্যায়ন কমিটি করা হয়েছে। এতে সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবু তৈয়ব ও স্থানীয় পাড়াপ্রধান সুচিত্র কার্বারিকে সদস্য করা হয়েছে।</p> <p>গত বৃহস্পতিবার দুপুরে খাগড়াছড়িতে উদ্ধার করা হয় লংগদু সদর ইউনিয়ন যুবলীগের নেতা নুরুল ইসলাম নয়নের লাশ। ওই দিন সকালে ভাড়ায় মোটরসাইকেলচালক নয়ন দুই যাত্রী নিয়ে খাগড়াছড়ির দিঘিনালায় রওনা হয়েছিলেন। ওই দিন রাতে তাঁর লাশ লংগদুর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। পরদিন শুক্রবার সকালে লংগদুবাসীর ব্যানারে মিছিল নিয়ে নয়নের লাশসহকারে উপজেলা সদরে রওনা হয় লোকজন। ওই মিছিল থেকে পাহাড়িদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটে। তিনটিলাপাড়াসহ কয়েকটি পাড়ায় হামলা চালিয়ে পাহাড়িদের দুই শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনার জন্য পাহাড়ের আঞ্চলিক দুটি দল জনসংহতি সমিতি ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) সেটলার বাঙালিদের দায়ী করেছে।</p> <p>ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরছে পাহাড়িরা : যুবলীগ নেতা নয়নের লাশ পাওয়ার খবর পাওয়ার পর নিজ নিজ বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল কিছু পাহাড়ি। এরপর শুক্রবার সকালে অগ্নিসংযোগ শুরু হলে বাকিরাও পালিয়ে যায়। গতকাল সকাল থেকে ধীরে ধীরে বাড়িতে ফিরে আসতে শুরু করেছে তারা। অনেকে পোড়া ভিটায় এসে কান্নায় ভেঙে পড়ে। কোথায় থাকবে, কী খাবে—এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে তারা।</p> <p>নিজের পোড়া বাড়িতে ফিরে এসেছেন উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের স্বাস্থ্য সহকারী প্রমথ চাকমা। তিনি বলেন, ‘নয়ন খুব ভালো ছেলে, সব সময় পথে দেখা হলে নমস্কার দিত, কুশল বিনিময় করত, কখনো কারো সঙ্গে বিবাদ বা ঝগড়া করতে দেখিনি। এই ভালো ছেলেটিকে যেই হত্যা করুক, আমি তার বিচার চাই। কিন্তু এর জের ধরে আমার বাড়ি কেন পুড়িয়ে দেওয়া হলো আমি জানি না। আমি এখন কোথায় যাব? কী খাব? কিচ্ছু জানি না।’</p> <p>‘ক্ষতিপূরণ নয়, বিচার চাই’ : ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন শেষে উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে বিশেষ আইন-শৃঙ্খলা সভায় মিলিত হন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার। সেখানে লংগদুর স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সভায় ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে বক্তব্য দেন সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কুলিন মিত্র চাকমা আদু, আটারকছড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মঙ্গল কান্তি চাকমা, উপজেলা জনসংহতি সমিতির সম্পাদক মনিশংকর চাকমা।</p> <p>জনসংহতি সমিতির সম্পাদক মনিশংকর চাকমা বলেন, ‘আমরা ক্ষতিপূরণ চাই না, অপরাধীদের বিচার চাই। এই ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত তাদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। আমি চেষ্টা করছি সবাইকে আবার ফিরিয়ে আনতে, কিন্তু তারা তো আমার কথায় আশ্বস্ত হতে পারছে না।’</p> <p>মনিশংকর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার বাসায় যারা আগুন দিয়েছে তারা তো অপরিচিত কেউ না, আমার সঙ্গে সকাল বিকাল দেখা হয়, আমার বাসায় আসে, এমন পরিচিত মুখ। আমার ঘরে তারা কী করে আগুন দিল? এই কষ্ট আমি কোথায় রাখি? সকালে আমাকে প্রশাসন থেকে আশ্বাস দেওয়া হলো কিচ্ছু হবে না, যারা আগের দিন পালিয়ে গেছে তাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। কিন্তু কী হলো? কেন এই ঘটনা হলো? আমাদের সাহায্য দরকার নাই, আমরা প্রয়োজনে না খেয়ে মারা যাব, তবু যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের আইনের আওতায় আনা হোক।’</p> <p>একই দাবি জানিয়ে আটারকছড়া ইউপি চেয়ারম্যান মঙ্গল কান্তি চাকমা বলেন, ‘একটা সভ্য দেশে এমন বর্বর ঘটনা কী করে হতে পারে? কোথায় বাস করছি আমরা?’</p> <p>নিরাপত্তা চৌকি করার প্রস্তাব : সভায় পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জানে আলম বলেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে যে শান্তির বাতাস বইতে শুরু করেছে, তাকে নষ্ট করে সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলা করতে চাইছে কুচক্রী মহল। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে যথাযথভাবে পুনর্বাসন করার দাবি জানান। যে এলাকায় হামলা হয়েছে সেখানে নিরাপত্তা চৌকি স্থাপনের প্রস্তাব করেন শিক্ষক আব্দুর রহিম।</p> <p>‘মিলবে ক্ষতিপূরণ, অপরাধীদের ছাড় নয়’ : সভায় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দেন। এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে তাঁরা বলেছেন, প্রত্যেকের প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি অনুসারে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। বাড়ি নির্মাণের আগ পর্যন্ত লংগদু সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও তিনটিলা বনবিহারে থাকার ব্যবস্থা এবং তাদের খাবার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতিও দেন তাঁরা।</p> <p>চাঁদাবাজিকে দুষলেন জেলা প্রশাসক : জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান সভায় বলেন, নয়ন কেন মারা গেল, কারা মারল? এই ঘটনার জেরে যা ঘটল, এটা মেনে নেওয়া কঠিন। তিনি বলেন, ‘জেএসএস, ইউপিডিএফ ও জেএসএস (সংস্কারপন্থী) এই তিনটি সংগঠনের চাঁদাবাজির কারণে পাহাড়ের সব মানুষ অসহায়। একজন সাধারণ পাহাড়ি যে জুম চাষ করে জীবন নির্বাহ করে তাকেও একটি কলার ছড়ার জন্য চাঁদা দিতে হয়। যদি এসব অন্যায় বন্ধ না করেন, তবে তো এই ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। এই চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে, অস্ত্রবাজি বন্ধ করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আপনার ঘর পুড়েছে, আমরা ঘর করে দিতে পারব। কিন্তু আস্থার জায়গা, বিশ্বাসের জায়গাটা আপনারা পাহাড়ি-বাঙালি মিলেমিশেই তৈরি করতে হবে।’</p> <p>এক মামলায় ৩০০ আসামি : পাহাড়িদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ১৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরো ৩০০ জনের বিরুদ্ধে লংগদু থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। উপপরিদর্শক (এসআই) দুলাল হোসেন বাদী হয়ে এ মামলাটি করেন। এরই মধ্যে সাতজনকে আটক করা হয়েছে। তারা হলো সাইফুল, শাহ আলম, মো. শহীদ, আবুল কালাম, শরিফুল, শরিফ ও মো. মোস্তফা। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে বলে জানিয়েছেন লংগদু থানার ওসি মোমিনুল ইসলাম।</p> <p>নয়ন হত্যার বিচার চাইল পরিবার : জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যুবলীগ নেতা নয়নের খুনিদের বিচারের দাবি জানিয়েছে তাঁর পরিবার। তাঁর সন্তানদের সান্ত্বনা দিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, অবশ্যই নয়নের খুনিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনা হবে। তিনি নয়নের পরিবারকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এ সময় মোটরসাইকেলচালক সমিতির সভাপতি মো. সবুজ বলেন, জেএসএস অথবা ইউপিডিএফ নয়নকে হত্যা করেছে।</p> <p>অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতার প্রতিবাদ : লংগদুতে পাহাড়িদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন সংগঠন। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে বিবৃতিতে ঘটনার জন্য স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের অবহেলাকে দায়ী করা হয়। একই সঙ্গে দলটি নয়নের হত্যাকারীদেরও গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে।</p> <p>পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অন্তত ৩০০ পাহাড়ির ঘরবাড়ি পুড়েছে এবং আগুন দেওয়ার আগে লুটপাট করা হয়েছে দাবি করে সংগঠনটি জড়িতদের গ্রেপ্তারসহ ১০ দফা দাবি জানিয়েছে। ইউপিডিএফ বিচার বিভাগীয় তদন্ত, ক্ষতিপূরণ ও নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছে।</p> <p>সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় দীঘিনালায় সভা : লংগদুর পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ে জরুরি সভা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়রম্যান, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা, আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ এবং লংগদুতে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সম্মিলিতভাবে ত্রাণ সংগ্রহ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।</p> <p>‘অপপ্রচার ও উসকানি’র নিন্দা : পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ, রাঙামাটি জেলা শাখা নয়ন হত্যাকাণ্ডে পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোকে দায়ী করেছে। গতকাল দেওয়া এক বিবৃতিতে পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদের রাঙামাটি জেলা সভাপতি আলমগীর হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম এ দাবি করেন। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘তারা (পাহাড়ি সংগঠন) সাধারণ মানুষের বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগের মতো ভয়াবহ কাজে লিপ্ত হয়ে তার দোষ সাধারণ বাঙালিদের ওপর চাপাচ্ছে। তারই প্রেক্ষাপটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং কিছু কিছু প্রচারমাধ্যম (মিডিয়া) অতি উৎসাহিত হয়ে কিছু ব্যক্তি অন্য কোনো ঘটনার ছবি দিয়ে অপপ্রচারের মাধ্যমে সামপ্রদায়িক উসকানি দিচ্ছে।’</p> <p> </p>