শৈশব দিয়েই শুরু হোক
উচ্চশিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারে জন্ম। দাদা ১৮৯৩ সালের গ্র্যাজুয়েট। বাবা-ফুফুরা সবাই গ্র্যাজুয়েট। দাদার চার ছেলে-মেয়ে।
শৈশব দিয়েই শুরু হোক
উচ্চশিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারে জন্ম। দাদা ১৮৯৩ সালের গ্র্যাজুয়েট। বাবা-ফুফুরা সবাই গ্র্যাজুয়েট। দাদার চার ছেলে-মেয়ে।
প্রথম স্কুলে যাওয়াটাও মজার। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা বাড়িতেই হয়েছে। শিক্ষক ছিলেন বাবু গিরীন্দ্র পুরকায়স্থ। তিনি প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। আমার প্রথম স্কুল বখতিয়ার বিবি প্রাইমারি স্কুল।
চতুর্থ শ্রেণিতে মোটামুটি পাস করে উঠেছি। আমি খুব খুশি। বড় ভাই খুব ভালো করল। সে নবম হয়েছিল। আমার গড়পড়তা পাস দেখে বাবা রেগে গেলেন। আমি ভাবলাম, এত সুন্দর পাস করলাম, তার পরও এই ব্যবহার? এই রাগের পর আমার মধ্যে একটা কম্পিটিশন স্পিরিট এলো যে স্কুলে ভালো করতে হয়। ক্লাস ফোরে যখন পড়ি, তখন ডিপিআই এলেন স্কুলে। আমার এক শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জানতেন, ইংরেজিতে আমি খুব ভালো। কারণ বাড়িতে ইংরেজি পড়তাম। স্যার বললেন, তুমি রেডি থেকো। আমি ডিপিআইকে বলব তুমি ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতে পারো। আমি ওয়েলকাম অ্যাড্রেস করার পর ডিপিআই খুব খুশি হয়েছিলেন। দিন শেষে স্কুলের সবাই বলাবলি শুরু করল, ক্লাস ফোরের একটি ছেলে ইংরেজিতে বক্তৃতা দিয়েছে। এটা খুব মজার স্মৃতি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কোনো স্মৃতি...
তখন আমি ক্লাস ফাইভে। ওই সময় অনেক কৃষ্ণাঙ্গ এসে স্কুল দখল করল। তাদের ভয় করতাম। মনে করতাম, তারা মানুষ খায়। একদিন এক দল কৃষ্ণাঙ্গ আমাদের বাড়ির সামনে ক্যাম্প করল। ভয়ে দরজা বন্ধ করে রাখলাম। ওরা খুব অবাক। পরের দিন তারা আমাদের লজেন্সের লোভ দেখাল। আমরা লোভে পড়ে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলাম। ওদের সঙ্গে মিশে মনে হলো—যাক, ওরা মানুষ খায় না! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘কলম বন্ধু’ হয়েছিলাম অনেকের। আমার কলম বন্ধু ছিল অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ও জিয়াউল হক টুলু।
বিশ্ববিদ্যালয়জীবন কেমন কেটেছিল?
ক্লাস নাইন পর্যন্ত কখনো ফার্স্ট হইনি। সবচেয়ে দুর্বলতা ছিল গণিতে। পরে অঙ্কে লেটার পাই। ইন্টারমিডিয়েটেও লেটার পেয়েছি।
১৯৫০ সালে অনার্স পড়তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলাম। অনেক সাবজেক্টে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলাম। তার পরও সাবজেক্ট নিয়েছিলাম ইংরেজি। এতে অর্থনীতির শিক্ষক আমিনুল ইসলাম মাহমুদ অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। কারণ ইকোনমিকসেও সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলাম। তিনি (আমিনুল ইসলাম) তাঁর সহকর্মী আখলাক সাহেবকে লাগালেন আমার পেছনে। আখলাক সাহেব এসে বললেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় পণ্ডিত হওয়ার লাইনটা লাগিয়ে দেয়। কিন্তু পণ্ডিত হওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার পর। সুতরাং তুমি যেকোনো বিষয় নিতে পারো, সমস্যা নেই।’
তখন বিভিন্ন সাহিত্য সভা-সমিতিতে প্রবন্ধ পড়তাম। বিখ্যাত ব্যক্তি হয়ে উঠেছি তত দিনে। আমাকে নিয়ে পত্রিকায়ও লেখালেখি হতো। কারণ যুবকদের জন্য ‘যুগভেরি’ পত্রিকার অর্ধেক পাতা আমি লিখতাম। তখনো ছাত্রলীগের জন্ম হয়নি। ছাত্রলীগের জন্ম হয়েছে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর। আমরা তার আগেই সিলেটে ‘এডুকেশন কমিটি’ নামে একটি কমিটি করেছিলাম। আমি এর সেক্রেটারি ছিলাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনটা খুব এনজয় করেছি এবং সব কিছুতে অংশ নিয়েছি। হকি, টেনিস, ভলিবল, বাস্কেটবল—সব খেলেছি। কিন্তু ক্রিকেটে ভালো ছিলাম না। জিমন্যাস্টিকসেও প্রাইজ পেয়েছি। এর মধ্যেই ভাষা আন্দোলন শুরু। আমিও অংশ নিয়েছি। সর্বদলীয় কর্মপরিষদের চেয়ারম্যান ছিলাম। ভাষা আন্দোলনটা ছিল মূলত ছাত্রদের মুভমেন্ট। ১৯৫২ সালে মিছিলে গুলির পর এটা জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়। আমরা তখন ফার্স্ট ইয়ারে ছিলাম। মিছিল নিয়ে মেডিক্যাল কলেজে যেতে চেয়েছিলাম। কারণ ওটার সঙ্গেই হোস্টেল ছিল। দৌড় দিলে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ জন্য গুলিটা হয়েছিল কলেজের সামনে। তাই ওখানেই আমরা আসর গেড়ে ফেললাম। পুলিশকে আমরা ইট মারি, তারা টিয়ার শেল মারে। গুলি যখন মারে, তখন আমাদের আন্দোলন মোটামুটি স্তিমিত হয়ে গেছে।
একদিন বিকেল ৩টা বাজে। ৪টার সময় সেশন হবে। নেতাদের সঙ্গে দেখা হলে বাড়ি চলে যাব, এই ছিল প্ল্যান। কিন্তু গুলি হলো একটা বদমাশ পুলিশ অফিসারের কারণে। মাসুদ মামুন তার নাম। এই পুলিশ অফিসারের পরিণতি শেষ পর্যন্ত ভালো হয়নি। পরে পাকিস্তানেই তার ফাঁসি হয়েছিল। কারণ সে ভুট্টোকে গুলি করেছিল। এই লোকটার কারণেই আমরা আমাদের ভাই শহীদ সালাম, বরকত, রফিকদের হারিয়েছি। দুর্ভাগ্যবশত এই লোকটাই প্রায় ছয় মাস সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টে আমার অধীনে কাজ করেছিল। এই লোকের যখন ফাঁসি হয়, তখন আমি পাকিস্তানেই ছিলাম। সেখানে পাঁচ বছর চাকরি করেছি।
অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ ও হার্ভার্ডেও পড়েছেন। সেখানকার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
১৯৫৭ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পাই। কেমব্রিজে এক বছরের একটা কোর্স করেছিলাম। অক্সফোর্ডে প্রথম দুই টার্মের জন্য আমি ইকোনমিকস ও পলিটিক্যাল সায়েন্স—এই দুটি বিষয় নিয়েছিলাম। আমার অর্থনীতির শিক্ষক ছিলেন পল স্ট্রিটেন, পরে অনেক বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। কলিন লিস নামের একজন মেধাবী পলিটিক্যাল সায়েন্সের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৬৩ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে যাই। ওখানে এক বছরে দুটি ডিগ্রি নিয়েছিলাম। হার্ভার্ডে বেশি সময় দিতে লাগলাম। ফলে বলতে পারেন পণ্ডিত হয়ে গেলাম। এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে হার্ভার্ডের লাইব্রেরি। ওটা পৃথিবীর সেরা লাইব্রেরিগুলোর একটা।
বরেণ্য শিক্ষক হিসেবে কাদের পেয়েছেন?
তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি বিশ্বখ্যাত কিছু শিক্ষক পেয়েছি। ঘনিষ্ঠ ছিল মাইকেল টিট। মাইকেল লিপটন নামের একজন ছিল, সে আমাদের দেশে কনসালট্যান্সি করেছে। ইকোনমিকসে ভালো ছিল। কাছের বন্ধু ছিল সুখময় চক্রবর্তী। সে ভারত ও আমেরিকার খুব বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ছিল। আমরা ক্লাস থ্রি ও ফাইভে একসঙ্গে পড়েছি। ও সারা জীবন আমার বন্ধু ছিল। মজার ব্যাপার হলো, আমি যখন হার্ভার্ডে গেলাম, সে তখন সেখানকার শিক্ষক। ইন্দিরা গান্ধীর উপদেষ্টাও ছিল সে।
নোবেলজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেন আমাদের সমসাময়িক। তিনি আমার চেয়ে তিন-চার মাসের বড়। কিন্তু তিনি অনেক আগেই বিদেশে চলে গিয়েছিলেন। একবার এক অনুষ্ঠানে আমি বলেছিলাম, আমরা সবাই এখানে ৩৪ ব্যাচের। কিন্তু অমর্ত্য সেন উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন—না, না। আমি ৩৩ ব্যাচের। তখন আমি বলেছিলাম, তুমি ৩৩-এর ঠিক আছে, কিন্তু সেটা মাত্র দুই মাসের ব্যবধানের।
এবার চাকরিজীবনে আসা যাক।
হার্ভার্ড থেকে ফিরে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেলাম। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টে ছিলাম। তখন পরিকল্পনা কমিশন ও ক্যাবিনেটের ডেপুটি সেক্রেটারি—এ দুই পদে ছিলাম। ক্যাবিনেটের ডেপুটি সেক্রেটারি ছিল পাকিস্তানের ডেপুটি সেক্রেটারির সবচেয়ে বড় পদ। এটা বড় প্রাপ্তি ছিল। তারপর ওয়াশিংটনে গেলাম। সেখান থেকেই আমি বাংলাদেশ সরকারে জয়েন করি। এটা ছিল ১৯৭১ সালের কথা।
এরপর তো মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল...
আমি ২৭ মার্চ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিই। ওয়াশিংটনে বসেই সিদ্ধান্ত নিই যে আর পাকিস্তানের হয়ে চাকরি করব না।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে স্মৃতি?
বঙ্গবন্ধু তুখোড় ছাত্রনেতা ছিলেন। ১৯৪৭ সালে সিলেটে আড়াই থেকে তিন শ ছাত্র নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন শাহ আজিজও গিয়েছিলেন সিলেটে। বঙ্গবন্ধু থাকলেন বখতিয়ার বিবি প্রাইমারি স্কুলে আর শাহ আজিজ থাকলেন তোতা খান নামের এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে। আমার বাবা রেফারেন্ডাম বোর্ডের সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি আমাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। আমার বয়স তখন ১৩ বছর। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান লম্বা সময় জেলে ছিলেন। তিনি মুক্তি পাওয়ার পর আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। ওটা ছিল আমাদের দ্বিতীয় সাক্ষাত্। তিনি সেন্ট্রাল জেলের কাছে একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। এরপর তাঁর সঙ্গে ওই বাড়িতে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিল। প্রতিবারই আমাকে খোঁচা দিয়ে বলতেন, তুমি আমার দলের ছাত্র না; তুমি প্রগতিশীল গোষ্ঠীর সঙ্গে আছ। তবে আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল। আমার মনে হয়, তিনি আমাকে খুব ভালোবাসতেন। এ জন্যই বোধ হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আমাকে পছন্দ করেন।
যা হোক, চাকরিতে প্রবেশের পর বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকেছিলেন। ১৯৬০ সালে ঢাকায় ট্রান্সফার হই। তখন তিনি বেশির ভাগ সময়ই জেলে থাকতেন। জেলের বাইরে থাকলেই তিনি ফুটবল খেলা দেখতে যেতেন। ১৯৬২ সালে আমি ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের ট্রেজারার নির্বাচিত হলাম। আমিও সুযোগ পেলে ফুটবল দেখতাম এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলতাম।
বঙ্গবন্ধু ‘সিক্রেসি’কে খুব সম্মান করতেন। তিনি কখনো আমাকে কোনো সিক্রেট কাজ দেননি। শুধু একবার বাংলাদেশের সিনিয়র অফিসারদের লিস্ট দিতে বলেছিলেন। আরেকবার বলেছিলেন বৈষম্যের একটা পরিসংখ্যান দিতে। আমি দিয়েছিলাম। এতে অবশ্য অন্যরাও সাহায্য করেছিলেন।
আমি যখন করাচিতে ছিলাম, তখন এক বাঙালি আমাকে টেলিফোন করে বললেন—স্যার, আপনার জন্য একটা বস্তা এসেছে ঢাকা থেকে। আমি বস্তা এনে দেখলাম, এটি অফিসে রাখা যাবে না। বস্তাটা ছিল আওয়ামী লীগের ‘ছয় দফা’। তখনো ছয় দফা গৃহীত হয়নি। বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা দেওয়ার জন্য লাহোরে এসেছেন। বস্তাটি ছয় দফা ঘোষণার কিছু আগে ৪ বা ৫ ফেব্রুয়ারি এসে পৌঁছায়। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার দেখা হলো। আমি তাঁর বাসায়ও গেছি। একদিন তাঁর বাসায় গেছি, কিন্তু একজন পাহারাদারও দেখতে পেলাম না। তিনি এগুলো পাত্তা দিতেন না। আমি বলেছি—স্যার, আপনার এভাবে থাকা উচিত না। একজন পিয়ন ছাড়া আর কেউ নেই। বাসার নিচেও কেউ ছিল না। আমার কথা হেসে উড়িয়ে দিলেন। বললেন, বিদেশে গিয়ে তোমার এমন সব ধারণা হয়েছে। এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। এটা বিদেশ না, এটা বাংলাদেশ। এখানে আমাকে কে মারবে? পাকিস্তান থেকে চলে এলাম। ওখানেই কেউ মারতে পারল না, এখানে আবার কে মারবে? তিনি বিশ্বাসই করতেন না যে বাঙালি কেউ তাঁর ক্ষতি করতে পারে। আর এই মানুষটাকেই আমরা মেরে ফেলেছি!
রাজনীতিতে শুরুটা কিভাবে?
১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে ইআরডি সচিব হিসেবে অবসর নিই। তখন সবাই জানত, আমি আওয়ামী লীগ করি। ১৯৮৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে অফিশিয়ালি আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করার জন্য বলেন। ১৯৮৬ সালে আমি তাঁর উপদেষ্টা হিসেবে কাজ শুরু করি। প্রথম দিনই তিনি আমাকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের মেম্বার নির্বাচিত করলেন। বেশ হাই পজিশনে ছিলাম। নিজের মতো করে কাজ করা শুরু করলাম। তখনো পার্টিতে জয়েন করিনি। ২০০১ সালে যখন নির্বাচন করলাম, তখন আওয়ামী লীগে যোগ দিই। ২০০৪ সালে রিটায়ার করার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন দেখলাম, আমি যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, তার কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। তাই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলাম। এখন নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করছি।
এবার বর্তমান অর্থনীতির প্রসঙ্গে আসি। আপনার সময় অনেকগুলো নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। হলমার্কসহ বেশ কয়েকটি বড় বড় স্ক্যাম হয়েছে।
ব্যাংকের সংখ্যা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন নই। প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারলে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। একটার সঙ্গে আরেকটা একীভূত হবে। আমেরিকায় একসময় পাঁচ হাজারের বেশি ব্যাংক ছিল। এখন হাতে গোনা কয়েকটি। এখানেও তাই হবে। আইন ঠিক করা হচ্ছে। হলমার্ক ঘটনায় দায়ীদের তো ধরা হয়েছে। সেটা বিচারাধীন।
ব্যাংক খাতের জন্য একটি কমিশন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান অর্থমন্ত্রী বলেছেন সেটার প্রয়োজন নেই।
আমি চেয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত করিনি। বর্তমান অর্থমন্ত্রী হয়তো প্রত্যেকটি ব্যাংকের জন্য পৃথক পৃথক কার্যক্রম নিতে চাচ্ছেন। কমিশন যদি হয়ও সেটা দুর্নীতি ধরার জন্য নয়, সেটা হবে কাজ করার জন্য।
ব্যাংকগুলো খারাপ করলে নাম পরিবর্তন করা হচ্ছে। ফারমার্স ব্যাংকের পাশাপাশি আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকও নাম পরিবর্তনের আবেদন করেছে। এটাকে কিভাবে দেখছেন?
তাই নাকি! নাম পরিবর্তন করলেই কোনো ব্যাংক ভালো হয়ে যায় না। মানুষ বদলাতে হবে। মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। আমি চেয়েছিলাম, ফারমার্স ব্যাংককে যেন ভ্যানিশ করে ফেলা হয়। সেটা সম্ভব হয়নি। ফারমার্স ব্যাংককে টাকা জোগান দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। চারটা ব্যাংককে বলেছি, এটাকে উদ্ধার করো। এটি ঠিক হয়নি। তার পরিবর্তে আমি এটাকে রিডিউসড প্রাইসে বিক্রি করে দিতে পারতাম। রিডাকশন যেটা হতো সেটা সরকার একটা শেয়ার নিয়ে ব্যবস্থা করে দিতে পারত।
পারলেন না কেন?
ভয়ের কারণে। ব্যাংকিং সেক্টরে ভয় আছে। ভয়ের কারণও আছে। আমার ভয় ছিল, একটা ব্যাংককে ভ্যানিশ করলে বাকিগুলোও কলাপস করবে। তাই সাহস হয়নি।
ফারমার্স ব্যাংককে ‘ভ্যানিশ’ করার ব্যাপারটি কি প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়েছিল?
জানিয়েছিলাম। তিনি হ্যাঁ-না কিছুই বলেননি। এটা হয়তো আমার ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী আমাকে অনেক বিশ্বাস করতেন। আস্থা রাখতে পারতেন। অবশ্য পদক্ষেপ নেওয়ার পর তাঁকে আবারও জানিয়েছি।
রিজার্ভ চুরির তিন বছর পার হলো। বাংলাদেশ ব্যাংক নিউ ইয়র্কের কোর্টে মামলা করেছে। আরসিবিসিও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছে। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
খোয়া যাওয়া অর্থ মামলার মাধ্যমেই ফিরে আসবে। ফিলিপাইনের আরসিবিসির মামলা ‘বোগাস’। ব্যাংক ইজ আ মেটার অব ট্রাস্ট। তারা বিশ্বাসভঙ্গ করেছে। আদালতের রায়ে রিজাল ব্যাংককে ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে বিদায় করে দেওয়া উচিত। বাংলাদেশের মামলা করতে কিছুটা সময় লেগেছে। কারণ—ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, টাকাটা ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু ফিলিপাইনের যে সিস্টেম তাতে তিনি তা করতে পারেননি। আদালতের রায়ে রিজাল ব্যাংককে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে দূর হতে হবে। বিষয়টি যখন তাদের বোধগম্য হবে, তখন তারা এমনিতেই সমঝোতার প্রস্তাব করবে।
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিলেন। সেটার কত দূর?
এটার খুব দরকার। বেশ ব্যয়বহুল প্রকল্প। হয়তো আগামী বাজেট থেকে সম্ভব হবে না। কন্ট্রিবিউটরি সোশ্যাল সিকিউরিটি ছাড়া এটা সম্ভব নয়। তবে এটা শুরু করতেই হবে।
স্বাধীনতার পর ৪৭ বছর কেটেছে। অর্থনীতি ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে বাংলাদেশ। আপনার মূল্যায়ন কী?
বঙ্গবন্ধু বলতেন আমার মাটি আছে। আমার মানুষ আছে। আর কিছু চাই না। আমরা সেটা প্রমাণ করে দিয়েছি। সময় লেগেছে অনেকটা। কেননা এর মধ্যে কতগুলো সামরিক শাসক এসেছে। তারা আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে। সামরিক শাসন মানেই জংলি শাসন। এতে দেশের উন্নয়ন হয় না। উন্নয়ন হয় সামরিক গোষ্ঠীর। সামরিক শাসকরা ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। এখানে আমরা এরশাদ সাহেবকে একটা ধন্যবাদ দিতে পারি। কারণ তিনি আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছেড়েছেন। নির্বাচন দিয়েছেন। শাসকদলের পরিবর্তন হয়েছে। খালেদা জিয়া কোনো উন্নয়ন করেননি সেটা বলব না। তিনিও দেশের অর্জনে অবদান রেখেছেন। কিন্তু গত ১০ বছরে দেশে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। যার পুরো অবদানই আওয়ামী লীগের। নির্দিষ্ট করে বললে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তিনি কখনই নিজের জন্য কিছু করেন না। যা করেছেন, দেশের জন্য। আমরা উন্নয়নটাকে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে আটকে রাখিনি। এটাকে সামাজিক সূচকগুলোর মধ্যেও ছড়িয়ে দিয়েছি।
বাংলাদেশকে কোথায় দেখতে চান?
একটি উন্নত ও সমৃদ্ধিশালী দেশ হিসেবে দেখতে চাই। সেটা অবশ্য ২০৪১ সালের আগেই হয়ে যাবে। বাংলাদেশের গ্রামগুলো এত স্বয়ংসম্পূর্ণ যে সেগুলোর যদি উন্নতি করা যায় তাহলে সেটাই হবে আসল উন্নয়ন। এ লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করেছি। ৬৪ জেলা নিয়ে কাজ করেছি। শুধু অর্থনৈতিক দিকটাকেই প্রাধান্য দিইনি, সামাজিক দিকটাকেও দিয়েছি।
২০২৪ সালের আগেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্ক ছোঁবে। তিন থেকে চার বছরের মধ্যেই ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে বলে বিশ্বাস করি। এরই মধ্যে ৮ শতাংশ অর্জন করেছি। চীন ও ভারতের প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘর ছুঁয়েছে। আমাদের ওপরে আছে এখন জাপান। ২০২৪ সালের আগেই জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে জাপানকে ধরে ফেলব আমরা।
ধান, সবজি ফলানোর দিক থেকে আমরা বিশ্বে দ্বিতীয়। মাছ উত্পাদনে তৃতীয়। এখন যে অবস্থায় আছে তাতে শিল্প বিপ্লবে যেতে বেশি সময় লাগবে না। আমি খুব তৃপ্তি নিয়েই দুনিয়া থেকে চলে যেতে পারব।
অবসর কাটছে কী করে?
প্রচুর বই পড়ি। আর গত ৪০ বছর ধরে একটা বই লিখছি। বই লেখার জন্যও বই পড়তে হচ্ছে। বইয়ের নাম হবে হিস্ট্রি অব দ্য ওয়ার্ল্ড। ইংরেজিতে লেখা হচ্ছে। তথ্য সংগ্রহ খুব কষ্টসাধ্য। ৪১২ পৃষ্ঠা পর্যন্ত লেখা হয়েছে। ৬০০ পৃষ্ঠার মতো হবে। আগস্টে প্রকাশ করার চেষ্টা করছি। আমার ৫০ হাজার বই আছে। সম্ভবত একক সংগ্রহশালা হিসেবে এটি দেশের সবচেয়ে বড়। সবাই যাতে বইগুলো পড়তে পারে সে জন্য একটা কিছু করে যেতে চাই।
(বনানী, ঢাকা)