<p>পত্র-পল্লবে ছেয়ে আছে চারপাশ। সারি সারি বৃক্ষের জীবন্ত কাণ্ড যেন আশ্রয়ের দেয়াল। সবুজ বৃক্ষের পাতার ছায়ায় মায়া লেগে থাকে। মায়ায় মানুষেরা শীতল হয়। সবুজের সমারোহে মিষ্টি ও ঘি রঙের একতলা মসজিদটি ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকে বলে ‘পারুলিয়া মসজিদ’। যুদ্ধের আগের মানুষেরা বলত ‘নীল মসজিদ’। প্রতিষ্ঠাতা নাম রেখেছিলেন ‘দেওয়ান শরীফ মসজিদ’।</p> <p>নরসিংদীর পলাশ উপজেলার পারুলিয়া গ্রামে অবস্থিত দেওয়ান শরীফ মসজিদ। মানুষ চেনে ‘পারুলিয়া মসজিদ’ নামে। মসজিদের প্রশস্ত তোরণ দিয়ে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে ভারী পাথর বসানো খোলা চত্বর—মসজিদের প্রাঙ্গণ। চারপাশ দেড় ফুট উঁচু দেয়ালে বেষ্টিত। প্রাঙ্গণের উত্তর-পূর্ব কোণে রয়েছে সুউচ্চ দুটি মিনার। মসজিদের বারান্দায় প্রবেশের গেট আছে তিনটি। বারান্দা থেকে মসজিদের ভেতরে প্রবেশের পথও তিনটি। মাঝখানের গেটটি অন্যান্য গেটের চেয়ে বড়। মসজিদের মূল গেটের বাইরের দিকটি উপরিভাগ অর্ধগম্বুজ আকৃতির ছাদের নিচে অবস্থিত।</p> <p>মসজিদের অভ্যন্তরের দৈর্ঘ্য ১৮.২৯ মিটার, প্রস্থ ৫.৫২ মিটার এবং মসজিদের দেয়ালের ঘনত্ব ১.৫২ মিটার।  মসজিদে গম্বুজ আছে তিনটি। মাঝের গম্বুজটি তুলনামূলক বড়। প্রতিটি গম্বুজে নকশা ও খোদাই করা হয়েছে। মসজিদের চার কোনায় অষ্টভুজ টাওয়ার রয়েছে, যেগুলোর উচ্চতা কার্নিশ পর্যন্ত। অলংকার খচিত মেহরাব আছে তিনটি। মসজিদের গম্বুজ, গেট, মেহরাব ও দেয়ালে আঁকা হয়েছিল শ্বেত পাথরের তৈরি গাছের পাতা, ফুল, চাঁদ-তারা। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মসজিদটির ক্ষতি হলে স্থানীয় লোকজন মেরামত করে। নীল রঙের ওপর হলুদ ও গোলাপি রঙের প্রলেপ পড়ে। ইরান, বাগদাদ, ইয়েমেন থেকে কারিগর এনে মসজিদের নির্মাণ ও কারুকাজ করা হয় বলে জানা যায়। রফিক নামের একজন বললেন, ‘মুরব্বিদের মুখে শুনেছি, তিনি শুনেছেন তাঁর মুরব্বি থেকে, এর ধারাবাহিকতায় জানতে পারি, ৩০০ বছরের পুরনো মসজিদ। মসজিদ নির্মাণে ইরান থেকে লোক আনা হয়েছিল। তাঁরা এসব ভালো পারতেন।’</p> <p> </p> <p>মসজিদের শুরুর কথা</p> <p>পারুলিয়ার এই তিন গম্বুজ মসজিদটি নির্মাণ করেন জয়নব বিবি। ১৫৮০ থেকে ১৭২২ সাল পর্যন্ত সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে বর্তমান নরসিংদী ঢাকা জেলার অঞ্চল মহেশ্বরদী নামে পরিচিত ছিল। ১৭১৭ সালে মুর্শিদ কুলি খাঁ বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হন। তাঁর কনিষ্ঠ কন্যার নাম ছিল জয়নব। মুর্শিদ কুলি খাঁ তাঁর কন্যা জয়নবকে ঈশা খাঁর পঞ্চম অধস্তন পুরুষ মনোয়ার খাঁর পঞ্চম ছেলে দেওয়ান শরীফ খাঁর সঙ্গে বিয়ে দেন। জামাতাকে উপহারস্বরূপ মহেশ্বরদী পরগনার দেওয়ানি প্রদান করেন। তখন থেকে তিনি দেওয়ান শরীফ খাঁ হিসেবে সমধিক পরিচিতি লাভ করেন। শরীফ খাঁ মহেশ্বরদীর উন্নয়নকাজে মনোযোগী হন। শীতলক্ষ্যা-ব্রহ্মপুত্র সংযোগ খাল স্থাপন করেন। এটি এলাকার যোগাযোগ, পণ্য পরিবহন ও পানীয় জলের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করার এক মহাপরিকল্পনা। তিনি সফল হয়েছেন। লোকদের মুখে মুখে খালের নাম পড়ে ‘দেওয়ানখালী’।</p> <p>মসজিদের প্রধান গেটে ফারসি ভাষায় লেখা আছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ, কার্দে জয়নব বিনতে নাছের জজায়ে দেওয়ান শরীফ, হিজরি ১০২০।’ </p> <p>৪০০ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক তিন গম্বুজ মসজিদটি মুর্শিদ কুলি খাঁর কন্যা বিবি জয়নব নির্মাণ করেন। স্বামীর নামে নাম রাখেন ‘দেওয়ান শরীফ মসজিদ’। তখন এলাকার নামও প্রতিষ্ঠা পায় ‘শরীফপুর’ নামে। কালের বিবর্তনে নামের পরিবর্তন হয়। মানুষ এখন বলে পারুলিয়া মসজিদ। সে সময় মসজিদ এলাকাটি ছিল কাছারিবাড়ি (খাজনা আদায় কেন্দ্র)। মসজিদের পাশেই রয়েছে দেওয়ান শরীফ খাঁ ও তাঁর স্ত্রী জয়নব বিবির যুগল মাজার। (তথ্যসূত্র : সরকার আবুল কালামের ‘কিংবদন্তির নরসিংদী’, পৃষ্ঠা ৪৫-৪৬)</p> <p>দেশের নানা অঞ্চল থেকে প্রায়ই মসজিদটি দেখতে আসে মানুষ। ভৈরব থেকে পাঁচজনের এক বন্ধুর দল এসেছে মসজিদ দেখতে। আবু হাসনাত নামের একজন বললেন, ‘ঐতিহাসিক সব কিছুর প্রতি আমার আগ্রহ বেশ। মসজিদটি দেখতেই মূলত আসা। ৪০০ বছরের আগের মসজিদে নামাজ পড়ে খুব ভালো লাগছে। আমি চাই, সেই পুরনো আবহ রেখে প্রয়োজনে মসজিদের সংস্কার হোক।’</p> <p>পারুলিয়ার আবদুল হাকিমের বয়স ৫২ বছর। মসজিদের নিয়মিত মুসল্লি। তিনি বলেন, ‘এই মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে পারি। মনে শান্তি লাগে। মানুষের লগে গর্ব করি। দূরের মানুষেরা এলে কথা বলি। তাদের জানা কাহিনি শোনাই।’</p>