<article> <p style="text-align: justify;">মুখোমুখি ট্রেন সংঘর্ষ। ঘড়িতে তখন সকাল ১০টা ৫০ মিনিট। দুর্ঘটনাস্থল গাজীপুরের জয়দেবপুরের আউটার স্টেশন। এলাকার নাম ছোট দেওড়া। ঢাকার দিকে যাচ্ছিল টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেন। উল্টো পথে আসে একটি তেলবাহী ট্রেন। এতে অন্তত ৯টি বগি লাইনচ্যুত হয়। দুমড়েমুচড়ে যায় বগির একাংশ।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">কমিউটার ট্রেন সাধারণত যাত্রীতে ভরপুর থাকে। কিন্তু গতকাল শুক্রবার ট্রেনটির সাপ্তাহিক বন্ধ থাকায় যাত্রীবিহীন ছিল। পথে যাত্রাবিরতির সময় দু-একজন উঠে থাকতে পারে। ফলে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা এড়ানো গেছে।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">তবে এমন পরিস্থিতি তো সব সময় থাকে না। গত চার বছরে ট্রেন দুর্ঘটনায় এক হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। অথচ জানমালের ক্ষতিপূরণ নিয়ে কথা হচ্ছে না।</p> <p style="text-align: justify;">দেশের পরিবহনব্যবস্থায় বাস, বিমান ও নৌযান—তিন খাতেই যানের জন্য বীমার প্রচলন রয়েছে। এতে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ পান পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">বিমানে যাত্রীর জন্য বীমা এবং বাসে যাত্রীর জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রয়েছে, কিন্তু নৌযানে যাত্রীর জন্য কোনোটিই নেই। সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ক্ষতিপূরণে সরকারের সুনির্দিষ্ট আর্থিক তহবিল রয়েছে। অথচ রেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ গণপরিবহনে কোনো ধরনের বীমার ব্যবস্থা নেই। ফলে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংশ্লিষ্ট পরিবহন প্রতিষ্ঠান হিসেবে রেল কর্তৃপক্ষ কোনো ক্ষতিপূরণ পায় না। এমনকি যাত্রীর ক্ষতিপূরণ বাবদ সরকারের বরাদ্দ করা আর্থিক তহবিল নেই।</p> <p style="text-align: justify;">রেলে দুর্ঘটনা সড়কের তুলনায় কম, এটা ঠিক। হতাহতের সংখ্যাও সড়কের তুলনায় অনেক কম। কিন্তু ট্রেন দুর্ঘটনা বাড়ছে। বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। স্থায়ীভাবে পঙ্গু হচ্ছে অনেকে। অগ্নিসংযোগের মতো নাশকতার ঘটনায় জানমালের ঝুঁকি বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, ট্রেন দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ নেই কেন?</p> <p style="text-align: justify;">২০১৯ সালে বীমা করার পরিকল্পনা করেছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। সেটি আগায়নি। রেলওয়ে এখনো ১৮৯০ সালের আইনে পরিচালিত হচ্ছে। বহু বছর আগের আইন বর্তমানের সঙ্গে কতটা মানানসই, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।  </p> <p style="text-align: justify;">নতুন করে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ প্রণয়ন করে সরকার। সেই আইনের বিধিমালার মধ্য দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আর্থিক তহবিল তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু রেলের আইন অনেক পুরনো হওয়ায় সেই সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে আইনের সংশোধন জরুরি। নতুন আইনের মধ্য দিয়ে রেল দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ তহবিল তৈরি করা যেতে পারে।</p> <p style="text-align: justify;">বীমা বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক আল মাহামুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্বের বহু দেশে গণপরিবহনে বীমার প্রচলন রয়েছে। আমাদের দেশে বীমাব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে এটি সম্ভব হচ্ছে না। আর্থিক খাতে ব্যাপক দুর্নীতির কারণে ব্যক্তিগত বীমার ওপর বিশ্বাস হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। আর জটিলতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বীমা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। বীমাপ্রক্রিয়া আরো সহজ করা প্রয়োজন।’</p> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বীমা করা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি। কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় হবে, তা এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।’</p> <p style="text-align: justify;"><b>সড়কে ক্ষতিপূরণ তহবিল রয়েছে</b></p> <p style="text-align: justify;">সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে তহবিল গঠন করেছে সরকার। মোটরযান মালিকদের নির্দিষ্ট চাঁদায় এই তহবিল গঠন করা হয়। সেই তহবিলের অঙ্কের সঙ্গে সরকারের ভর্তুকিও যুক্ত হচ্ছে।</p> <p style="text-align: justify;">সড়ক পরিবহন বিধিমালায় বলা হয়েছে, দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে বা মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীকে আর্থিক সহায়তা দিতে আর্থিক সহায়তা তহবিলে গাড়ির মালিকদের চাঁদা দিতে হবে। প্রতিটি বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও প্রাইম মুভারের জন্য বছরে এক হাজার ৫০০ টাকা; মিনিবাস, মিনি ট্রাক ও পিকআপের জন্য বছরে ৭৫০ টাকা; কার, জিপ ও মাইক্রোবাসের জন্য বছরে ৫০০ টাকা; তিন চাকার যান ও অন্যান্যের জন্য বছরে ৩০০ টাকা এবং মোটরসাইকেলের জন্য এককালীন এক হাজার টাকা চাঁদা দিতে হবে মালিকদের।</p> <p style="text-align: justify;">বিধিমালার ১৪১ ধারায় আর্থিক সহায়তার পরিমাণ নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দুর্ঘটনায় নিহত বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা গেলে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে এককালীন অন্তত পাঁচ লাখ টাকা।</p> <p style="text-align: justify;">দুর্ঘটনাকবলিত ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গহানি হলে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে অন্তত তিন লাখ টাকা। গুরুতর আহত এবং চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা না থাকলে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে অন্তত তিন লাখ টাকা। এ ছাড়া গুরুতর আহত কারো চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকলে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে অন্তত এক লাখ টাকা।</p> <p style="text-align: justify;">যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, এটা সম্ভব হয়েছে শুধু সড়ক পরিবহনে নতুন আইন করার কারণে। রেলের পুরনো আইনে এটি প্রায় অসম্ভব। রেলের আইন যুগোপযোগী করে নতুন বিধিমালার আওতায় রেলেও এমন তহবিল তৈরি করা সম্ভব।</p> <p style="text-align: justify;"><b>রেলের কল্যাণ ট্রাস্টে যাত্রীর টাকা যায় মৃত্যুতে ক্ষতিপূরণ পায় না পরিবার</b></p> <p style="text-align: justify;">বিশ্বের প্রায় সব উন্নত দেশে দূরপাল্লার গণপরিবহনের যাত্রীর বীমার ব্যবস্থা থাকে। এমনকি ভারত ও শ্রীলঙ্কায়ও এই প্রথা রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশেও বিমানের যাত্রীরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বীমার আওতায় চলে আসে। সে ক্ষেত্রে দুর্ঘটনাকবলিত যাত্রীর পরিবার ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়ে থাকে। কিন্তু দেশের রেলব্যবস্থায় ট্রেন ও যাত্রী কেউ বীমার আওতায় নেই।</p> <p style="text-align: justify;">এক প্রশ্নের জবাবে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটা বিষয় আমাকে খুব অবাক করে, যাত্রীর টাকায় রেলের কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন হতে পারে। অথচ যাত্রীর বীমার তহবিল তৈরি করা যাচ্ছে না।’</p> </article>