<p>পশুর গোশত খাওয়ার প্রচলন মানবসমাজে নতুন নয়। ইসলাম আগমনের বহুকাল আগে থেকেই পৃথিবীতে পশু-পাখির গোশত খাওয়ার প্রচলন শুরু হয়েছে। পৃথিবীর সব আসমানি ধর্ম, বরং কয়েকটি মাত্র ধর্মীয় মতবাদ ব্যতীত প্রায় সব ধর্মে গোশত খাওয়ার জন্য প্রাণী হত্যা করা বৈধ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভিমত হলো, পশু-পাখির গোশত ছাড়া মানবদেহের আমিষের অভাব পূরণ করা সম্ভব নয়। ইসলামপূর্ব পৃথিবীতে পশু জবাইয়ের বিজ্ঞানসম্মত, মানবিক ও উপকারী কোনো পদ্ধতি ছিল না। গোশত খাওয়া, না খাওয়ার ক্ষেত্রে পশুর শ্রেণিবিন্যাসও দেখা যেত না। তবে আসমানি ধর্মের অনুসারীদের কথা কিছুটা ব্যতিক্রম। সে সময়ের বিভিন্ন সমাজে পশুর গোশত আহরণের বিচিত্র পদ্ধতি দেখা যায়। যেমন—মৃত প্রাণীর গোশত খাওয়া, জীবিত প্রাণীর শরীর থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী মাংস কেটে নেওয়া, শ্বাস রোধ করে হত্যা করা, পিটিয়ে হত্যা করা, জীবন্ত পশু পুড়িয়ে হত্যা করা, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে হত্যা করা ইত্যাদি।</p> <p>ইসলাম গোশত আহরণের জন্য তার অনুসারীদের স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়নি, বরং পশু নির্বাচন ও তা থেকে গোশত সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। ইসলামী শরিয়ত প্রথমেই জীবিত ও মৃত প্রাণীর গোশতের পার্থক্য ঘোষণা করে। ইসলাম মৃত প্রাণীর গোশত এই মর্মে নিষিদ্ধ করে যে তা দৈহিক ও আত্মিকভাবে মানবদেহের ক্ষতি করে। এরপর ইসলাম প্রাণীর ভেতর শ্রেণিবিন্যাস করে। যেসব প্রাণীর গোশত খেলে মানুষের শারীরিক ক্ষতি ও তার ভেতর মন্দ স্বভাব সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে, ইসলাম সেসব প্রাণীর গোশত খাওয়া হারাম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। যেমন—শূকর, কুকুর, বিড়াল, হিংস্র প্রাণী ও পাখি।</p> <p>অন্যদিকে ইসলাম যেসব পশু-পাখির গোশত খাওয়া বৈধ করেছে, তার বিশুদ্ধতায় যেন কোনো অভাব না থাকে সে জন্য জবাইয়ের বিশেষ পদ্ধতি নির্ধারণ করেছে। ইসলাম বর্ণিত পদ্ধতিতেই পশু-পাখির শরীর থেকে দ্রুত ক্ষতিকর ও নাপাক গোশত বের হয়ে যায়। একই সঙ্গে তা পশু-পাখির জন্য সবচেয়ে আরামপ্রদ। মানবদেহের শারীরিক সুস্থতা ও গোশতের পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ন রাখতে এই পদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও তার স্বীকৃতি দিয়েছে।</p> <p>ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, মানুষ উদ্ভিদ ও প্রাণী থেকে যে খাদ্য ও আমিষ গ্রহণ করছে, তার সবই আল্লাহর একান্ত দান ও অনুগ্রহ। এই হিসেবে মানুষ খাদ্য গ্রহণের আগে এবং পরে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আল্লাহর নাম উচ্চারণ করবে, তাঁকে স্মরণ করবে। এ আমল রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর জীবনে এত বেশি করেছেন যে তা ইসলামের নিদর্শন ও প্রতীকে পরিণত হয়েছে। তবে পশু জবাইয়ের আগে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করার যে বিধান রয়েছে, তার রহস্য আরো গভীর। অন্য কোনো খাবার গ্রহণের আগে আল্লাহর নাম স্মরণ না করলে তা বরকতশূন্য হয়ে যায়। ব্যক্তিকে সুন্নত পরিহারকারী গণ্য করা হবে। কিন্তু পশু জবাইয়ের সময় আল্লাহর নাম স্মরণ না করলে তা অবৈধ বলে গণ্য হয়। উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইসলামী দার্শনিক শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি (রহ.) ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘পশু বা প্রাণীর বিষয়টি অন্যান্য উদ্ভিদের মতো নয়। কেননা পশুর ভেতর মানুষের অনুরূপ রুহ বা আত্মা রয়েছে। তাদের মানুষের মতো দেখার, শোনার, ঘ্রাণ নেওয়ার ও চলাচল করার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে। মানুষের মতো ইচ্ছা ও অনুভূতি রয়েছে। একটি সীমা পর্যন্ত তাদের ভেতরও বিচার-বুদ্ধি রয়েছে। সে হিসেবে মানুষের জন্য পশু-পাখির গোশত খাওয়া বৈধ হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিজগেক নিয়োজিত করেছেন। মানুষের প্রয়োজনে পশুর গোশত খাওয়া ও দুধ পান করা বৈধ ঘোষণা করেছেন। তবে এই বৈধতার জন্য কিছু বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বিধান আবশ্যক করেছেন, যা পালন না করলে পশুর গোশত বৈধ হয় না। (সূত্র : জাওয়াহিরুল ফিকহ : ২/৩৬৩-৬৫)</p> <p> </p> <p>অনুবাদ : <strong>শেখ আহমদ বিন মাসউদ</strong></p>