<p>জাকাত ইসলামী সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান। জাকাত একদিকে দরিদ্র, অভাবী ও অক্ষম জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি, অন্যদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।</p> <p>জাকাত আরবি শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি, আধিক্য ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে জাকাত হলো, ধনীদের ধন-মাল থেকে আল্লাহর নির্ধারিত হারে উপযুক্ত ব্যক্তিকে দান করা। মহান আল্লাহ সম্পদশালীদের সম্পদ থেকে জাকাত সংগ্রহ করে নির্ধারিত আটটি খাতে ব্যয় বণ্টন করার জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন। জাকাত একদিকে জাকাতদাতার মন ও আত্মাকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে, তার ধন-সম্পদকেও পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করে দেয়; অন্যদিকে দরিদ্রদের অভাব পূরণে সহায়তা করে এবং সম্পদে ক্রমবৃদ্ধি বয়ে আনে। লিখেছেন <strong>মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া</strong></p> <p> </p> <p><span style="font-size:18px"><span style="color:#008080"><strong>ইসলামে জাকাতের গুরুত্ব</strong></span></span></p> <p>মহান আল্লাহ বলেন, ‘...সম্পদ যেন শুধু তোমাদের ধনীদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়।’ (সুরা : হাশর,  আয়াত : ৭)</p> <p>অন্য আয়াতে এসেছে, ‘আমার রহমত সব কিছু পরিব্যাপ্ত করে নিয়েছে। শিগগির আমি তা লিখে দেব সেই লোকদের জন্য যারা তাকওয়া অবলম্বন করে ও জাকাত দেয় এবং যারা আমার আয়াতগুলোর প্রতি ঈমান রাখে।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৫৬)</p> <p>হাদিস শরিফে এসেছে, ‘আল্লাহ যাকে ধন দিয়েছেন, সে যদি জাকাত আদায় না করে তাহলে কিয়ামতের দিন তা একটি বিষধর অজগরের রূপ ধারণ করবে, যার দুই চোখের ওপর দুটি কালো চিহ্ন থাকবে। ওই সাপ বলতে থাকবে, আমিই তোমার ধন-মাল, আমিই তোমার সঞ্চয়।’ (বুখারি)</p> <p>জাকাত ইসলামের মৌলিক ফরজ। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয় স্তম্ভ হচ্ছে জাকাত। ঈমানের পর নামাজ এবং তার পরই জাকাতের স্থান। পবিত্র কোরআনের ৩২ জায়গায় জাকাতের কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে ২৮ জায়গায় নামাজ ও জাকাতের উল্লেখ একত্রে করা হয়েছে।</p> <p>ইসলামের প্রথম খলিফা আবুবকর সিদ্দিক (রা.) জাকাত না দেওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।</p> <p> </p> <p><span style="font-size:18px"><strong>জাকাত কারা দেবেন</strong></span></p> <p>ইসলামী আইনবিদরা এ ব্যাপারে একমত যে জাকাত শুধু স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক মুসলিম নর অথবা নারী, যার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ আছে, তার ওপর নিম্ন শর্ত সাপেক্ষে জাকাত ধার্য হবে। শর্তগুলো হলো—১. সম্পদের ওপর পূর্ণাঙ্গ মালিকানা। সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ হওয়ার জন্য সম্পদের মালিকানা সুনির্দিষ্ট হওয়া জরুরি । ২. সম্পদ উৎপাদনক্ষম হওয়া। জাকাতের জন্য সম্পদকে অবশ্যই উৎপাদনক্ষম, বর্ধনশীল বা প্রবৃদ্ধমান হতে হবে।</p> <p>৩. নিসাব। জাকাত ধার্য হওয়ার তৃতীয় শর্ত হচ্ছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা। নিসাব বলা হয় শরিয়ত নির্ধারিত নিম্নতম সীমা বা পরিমাণকে। সাধারণভাবে ৫২.৫০ তোলা রুপা বা ৭.৫০ তোলা সোনা বা এর সমমূল্যের সম্পদকে নিসাব বলা হয়। কারো কাছে ৭.৫০ তোলা সোনা বা ৫২.৫০ তোলা রুপা থাকলে বা উভয়টি মিলে ৫২.৫০ তোলা রুপার মূল্যের সমান অথবা সব সম্পদ মিলে ৫২.৫০ তোলা রুপার সমমূল্যের সম্পদ থাকলে  সে সম্পদের জাকাত দিতে হবে। ৪. মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ থাকা। সারা বছরের মৌল প্রয়োজন মেটানোর পর অতিরিক্ত সম্পদ থাকলেই শুধু জাকাত ফরজ হবে। ৫. ঋণমুক্ত হওয়া। জাকাত ফরজ হওয়ার জন্য ঋণমুক্ত হওয়ার পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা জরুরি। ৬. সম্পদের ওপর এক বছর পূর্ণ হওয়া। কারো কাছে কমপক্ষে নিসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর থাকলেই শুধু সে সম্পদের ওপর জাকাত দিতে হবে।</p> <p> </p> <p><span style="font-size:18px"><strong>জাকাত কাদের জন্য</strong></span></p> <p>পবিত্র কোরআনে আট শ্রেণির লোক জাকাত পাওয়ার যোগ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। (দেখুন—সুরা : তাওবা, আয়াত : ৬০)</p> <p>► ফকির। ফকিরকে বাংলায় গরিব বলা হয়।</p> <p>► মিসকিন। যাদের আর্থিক অবস্থা গরিবদের চেয়েও খারাপ, তারাই মিসকিন।</p> <p>► আমেল। জাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তি।</p> <p>► মন জয় করার জন্য। ইসলামের বিরোধিতা বন্ধ করা বা ইসলামের সহায়তার জন্য কারো মন জয় করার প্রয়োজন হলে এবং নওমুসলিমদের সমস্যা দূর করার জন্য জাকাত তহবিল থেকে অর্থ ব্যয় করা হবে।</p> <p>► গলদেশ মুক্ত করা। গলদেশ মুক্ত করা বলতে দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ লোক এবং বন্দিদের মুক্ত করাকে বোঝানো হয়েছে।</p> <p>► ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধ। ঋণভারে জর্জরিত লোকেরা মানসিকভাবে সর্বদাই ক্লিষ্ট থাকে এবং কখনো কখনো জীবন সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়ে। তাদের জীবনীশক্তির ক্ষয় সাধিত হয়। অনেক সময় তারা অন্যায় ও অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। সুতরাং যথার্থ প্রয়োজনে ঋণগ্রস্ত লোকদের ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত করা ইসলামী সমাজের দায়িত্ব। এ জন্য আল্লাহ জাকাতের অর্থ ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে সমাজকে সুস্থ রাখা যায়।</p> <p>► আল্লাহর পথে ব্যয়। কোরআনের ভাষায় এ খাতের নাম বলা হয়েছে ‘ফি সাবিলিল্লাহ’, যার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর পথে। আল্লাহর পথে কথাটি খুব ব্যাপক। মুসলমানদের সব নেক কাজ আল্লাহর পথেরই কাজ।</p> <p>► পথিক-প্রবাসী। মুসাফির বা প্রবাসী লোকের বাড়িতে যত ধন-সম্পত্তিই থাকুক না কেন, পথে বা প্রবাসে সে যদি অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে তাহলে তাকে জাকাত তহবিল হতে প্রয়োজনীয় সাহায্য অবশ্যই দিতে হবে।</p> <p> </p> <p><span style="font-size:18px"><strong>যেসব সম্পদে জাকাত নেই</strong></span></p> <p>যেসব সম্পদকে জাকাত থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে সেগুলোর একটি তালিকা নিম্নে দেওয়া হলো—</p> <p>বসবাসের জমি, মিল, ফ্যাক্টরি, ওয়্যারহাউস, গুদাম, দোকান, বাড়িঘর, জায়গাজমি, এক বছরের কম বয়সের গবাদি পশু, ব্যবহারের যাবতীয় কাপড়চোপড়, বই-খাতা-কাগজ ও মুদ্রিত সামগ্রী, গৃহের যাবতীয় আসবাব, বাসনকোসন ও সরঞ্জামাদি, তৈলচিত্র, স্ট্যাম্প, অফিসের যাবতীয় আসবাব, যন্ত্রপাতি, ক্যালকুলেটর, কম্পিউটার ইত্যাদি সরঞ্জাম, গৃহপালিত সব ধরনের মুরগি ও পাখি, কলকবজা, যন্ত্রপাতি ও হাতিয়ার ইত্যাদি, চলাচলের জন্তু বা গাড়ি, যুদ্ধাস্ত্র ও সরঞ্জাম, ক্ষণস্থায়ী বা পচনশীল যাবতীয় কৃষিপণ্য, বপন করার জন্য সংরক্ষিত বীজ, জাকাত বছরের মধ্যে পেয়ে সে বছরের মধ্যেই ব্যয় করা হয়েছে এমন যাবতীয় সম্পদ, দাতব্য বা সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের সম্পদ, যা জনগণের উপকার ও কল্যাণে নিয়োজিত, সরকারি মালিকানাভুক্ত নগদ অর্থ, সোনা-রুপা এবং অন্যান্য সম্পদ।</p> <p> </p> <p><span style="font-size:18px"><strong>কোন কোন সম্পদের জাকাত দিতে হবে</strong></span></p> <p>১)   সোনা-রুপা। সোনা-রুপার মধ্যে পিণ্ড আকারে রক্ষিত সোনা-রুপা, সোনা-রুপার বাসন, অলংকার, এসবের বানানোর মূল্য হিসাব করে ৭.৫০ শতাংশ হিসাবে জাকাত দিতে হবে।</p> <p>২)   নগদ অর্থ। হাতে ও ব্যাংকে রক্ষিত নগদ অর্থ ছাড়াও সঞ্চয়পত্র, সিকিউরিটি, শেয়ার সার্টিফিকেট ইত্যাদি নগদ অর্থ বলে গণ্য হবে।</p> <p>৩)   ব্যবসার মালামাল। ব্যবসার মালামালের জাকাত নিরূপণকালে বছর শেষে হিসাব সমাপ্তি দিবসে যে সম্পদ থাকবে তা-ই সারা বছর ছিল ধরে নিয়ে তার ওপর জাকাত দিতে হবে।</p> <p>৪)   কৃষি ফসল। কৃষি ফসলের ক্ষেত্রে প্রতিটি শ্রেণির ফসলের নিসাব পৃথক পৃথকভাবে হিসাব করে নিসাব পরিমাণ ফসল হলে উশর দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ধান যদি ৩০ মণ বা তার বেশি হয়, পাট  যদি ৩০ মণ বা তার বেশি হয়, তাহলে ফসল তোলার সময়ই তার উশর দিতে হবে। তেমনিভাবে কলাই, সরিষা, মধু ইত্যাদি প্রতিটির নিসাব পৃথকভাবে ধরতে হবে।</p> <p>৫)   খনিজ সম্পদ। খনিজ সম্পদের ক্ষেত্রে কোনো নিসাব নেই। খনিজ সম্পদ ব্যক্তিমালিকানায় থাকলে সম্পদ উত্তোলনের পরই হিসাব করে জাকাত দিতে হবে। খনিজ সম্পদের জাকাতের হার হচ্ছে ২০ শতাংশ।</p> <p>৬)   গরু-মহিষ। নিজের কাজে খাটে এবং বিচরণশীল বা ‘সায়েমা’ নয় এমন গরু-মহিষ বাদ দিয়ে ৩০টি হলেই তার ওপর জাকাত দিতে হবে। যাকাতের হার হবে প্রতি ৩০টির জন্য একটি এক বছর বয়সের গরু এবং প্রতি ৪০টি বা তার অংশের জন্য দুই বছর বয়সের একটি গরু।</p> <p>৭)   ছাগল-ভেড়া। ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৪০টি হলে একটি, ১২০টি পর্যন্ত দুটি, ৩০০টি পর্যন্ত তিনটি এবং এর ওপরে প্রতি ১০০টি ও তার অংশের জন্য আরো একটি করে ছাগল জাকাত দিতে হবে।</p> <p> </p> <p><span style="font-size:18px"><strong>জাকাত কখন দেবেন</strong></span></p> <p>জাকাত চান্দ্রবর্ষ অনুসারে দেওয়াই শ্রেয়। এর মধ্যে আবার রমজান মাস হচ্ছে উত্তম। অন্য মাসে কোনো পুণ্যের কাজ করলে যে সওয়াব পাওয়া যায়, রমজান মাসে সেই কাজ করলে আল্লাহ তার অনেক গুণ বেশি সওয়াব দিয়ে থাকেন। সে জন্য রমজান মাসে জাকাত দিলে অন্য মাসের তুলনায় অনেক বেশি সওয়াব পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। আমাদের দেশে এবং অন্যান্য মুসলিম দেশে ও অনেকেই রমজান মাসে জাকাত দিয়ে থাকেন। কিন্তু সারা বছর জাকাত দিলেও কোনো ক্ষতি নেই। মোট কথা, পরিকল্পিতভাবে জাকাত সংগ্রহ ও ব্যয় বণ্টনের ব্যবস্থা করতে পারলে যেকোনো দেশে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও দুস্থ মানবতার কল্যাণে বিরাট ভূমিকা পালন করা সম্ভব।</p> <p><strong>লেখক </strong>: ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও, এক্সিম ব্যাংক</p>