<p>আন্দালুসিয়ায় (বর্তমান স্পেন ও পর্তুগাল) মুসলমানরা যে বিশাল সভ্যতা স্থাপন করেছিলেন, তার পরিব্যাপ্তি ছিল প্রায় আট শতাব্দী (৯১-৮৯৭ হি./৭১১-১৪৯২ খ্রি.) পর্যন্ত। সেই সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল শিক্ষার মূল্যায়ন এবং সমাজের সর্বত্র তার সম্প্রচার। ফলে তখনকার মুসলিম সাম্রাজ্যের কোনায় কোনায় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। শুধু রাজদরবার ও ধনী মহলের মধ্যেই নয়; বরং সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা ও পরিচর্যার প্রতি এক ধরনের প্রতিযোগিতা লক্ষ করা গিয়েছিল। সে হিসেবে তখনকার গ্রন্থাগারগুলোকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়। একটি ছিল পাবলিক লাইব্রেরি বা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত গ্রন্থাগার। যেমন—সরকারি গ্রন্থালয়, মসজিদ ও মাদরাসার সঙ্গে যুক্ত পাঠাগার, ওয়াক্ফকৃত বইঘর, এমনকি গার্ডেন বা পার্কের সঙ্গে যুক্ত ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি ইত্যাদি। আরেকটি ছিল ব্যক্তিগত ও পারিবারিক গ্রন্থাগার, যা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল না; বরং ব্যক্তি নিজেই তা গড়ে তুলেছেন এবং নিজের গবেষণাকাজে তা থেকে উপকৃত হয়েছেন। যেমন—খলিফা ও আমিরদের ব্যক্তিগত পাঠশালা, বিজ্ঞ আলিমদের গ্রন্থালয়, ধনী ব্যক্তিদের পারিবারিক বইঘর, শিক্ষানুরাগী সাধারণ মানুষের নিজস্ব গ্রন্থাগার ইত্যাদি। মুসলিম সমাজে শিক্ষার এত গুরুত্ব, চর্চা ও মূল্যায়ন ছিল যে সে সময় এমন কোনো ঘর খুঁজে পাওয়া মুশকিল ছিল, যেখানে কোনো গ্রন্থ নেই। বই সংগ্রহে সবাই মনোযোগী ও প্রতিযোগী ছিল। বিশেষত দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থগুলো নিজের সংগ্রহে আনতে মানুষ চড়া মূল্য পরিশোধ করতেও কুণ্ঠাবোধ করত না। এ জন্য সেই সমাজ ছিল নিত্যনতুন সুশিক্ষায় সমৃদ্ধ। উপরন্তু ঘরে গ্রন্থ না থাকা সামাজিকভাবে ছিল এক ধরনের লজ্জার বিষয়।</p> <p>আন্দালুসিয়ায় ইসলামী শাসনামলের ওই সোনালি যুগে মোট কতটি গ্রন্থালয় গড়ে উঠেছিল, তার নির্ধারিত পরিসংখ্যান বের করা দুষ্কর। তা ছাড়া সেসব গ্রন্থাগারের তথ্য-উপাত্ত ইতিহাসবিজ্ঞানে পুরোপুরিভাবে সংরক্ষিত না হওয়ায় বিষয়টি আরো জটিল আকার ধারণ করেছে। এর পরও বিক্ষিপ্তভাবে একাধিক ইতিহাসগ্রন্থ থেকে সেকালের গ্রন্থাগারগুলোর কিছু তথ্য পাওয়া যায়। সেগুলোর আলোকেই বলা যায়, গ্রন্থালয়গুলোর সংখ্যা ছিল গণনার বাইরে। এখানে সংক্ষিপ্তভাবে মাত্র কয়েকটি ব্যক্তিগত বা পারিবারিক গ্রন্থাগারের কথা পেশ করা হলো।</p> <p> </p> <p><strong>মুহাম্মাদ ইবনে হাজমের গ্রন্থালয়</strong></p> <p>যেমনটা আগেই ব্যক্ত করা হয়েছে যে গ্রন্থাগার গড়ে তোলা মুসলিম সমাজের শুধু ধনী শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং লোকজন খাবারদাবারের মতো গ্রন্থ সংগ্রহকে অন্য সব কিছুর ওপর প্রাধান্য দিত। তাই সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ঘরে ঘরে একেকটি সমৃদ্ধ পাঠশালা গড়ে উঠেছিল। তেমনি এক পাঠশালা ছিল মুহাম্মাদ ইবনে হাজমের (মৃ. ২৮২ হি./৮৯৫ খ্রি.)। ওই পাঠশালায় সংগৃহীত বই পাঠের সুবিধা ছাড়া শিশুদের শিক্ষাগ্রহণেরও সুযোগ অবারিত ছিল। মুহাম্মাদের পুত্র ছেলেদের এবং তাঁর কন্যা মেয়েদের পড়াতেন। ছাত্রদের বেতন বাবদ যে অর্থ আসত, তা দিয়ে বই কেনা হতো। মুহাম্মাদ ইবনে হাজমের সেই ব্যক্তিগত গ্রন্থালয়টি এত সমৃদ্ধ ছিল যে তখনকার কর্ডোভার বোদ্ধামহলও তাকে নিয়ে ঈর্ষা করতেন। সময় সময় এখানে এসে তাঁরা জ্ঞানরাজ্যে বিচরণ করতে পছন্দ করতেন। অবশেষে মুহাম্মাদ ইবনে হাজম হজের উদ্দেশ্যে বের হন। সমুদ্রপথে একটি জলযানে আরোহণ করেন এবং পথিমধ্যেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জাহাজে তাঁর জানাজার নামাজ আদায় করা হয় এবং সমুদ্রেই তাঁকে দাফন করা হয়।</p> <p> </p> <p><strong>ইবনে মায়মুনের গ্রন্থশালা</strong></p> <p>আন্দালুসিয়ার তালায়তালা নগরীর অন্যতম প্রসিদ্ধ গ্রন্থাগারের মালিক ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে উবায়দা আল উমাওয়ির। ইবনে মায়মুন (মৃ. ৪০০ হি./১০০৯ খ্রি.) নামে তিনি ছিলেন সমধিক পরিচিত। তাঁর গ্রন্থশালায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি শাখার গ্রন্থ সংরক্ষিত ছিল। তিনি নিজ হাতে বিভিন্ন দুর্লভ বইয়ের কপি প্রস্তুত করতেন। তাঁর হস্তলিপি ছিল নিখুঁত ও ঝকঝকে। কপিকৃত বইগুলোতে লেখার ভুল বের করা ছিল মুশকিল। আর কোনো ভুল চোখে পড়লে তিনি সেটি তত্ক্ষণাৎই শুধরে নিতেন। সে জন্য বিশুদ্ধ হস্তলিপিকার হিসেবে বিদ্বান সমাজে ইবনে মায়মুনের আলাদা এক পরিচিতি ছিল। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, একবার তালায়তালা বাজারে আগুন লেগে যায়। আশপাশের সব ঘর জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তবে ইবনে মায়মুনের গ্রন্থশালা অক্ষত থাকে। তা দেখে সবাই অবাক! এ সময় ইবনে মায়মুন ছিলেন মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমানা পাহারাদারির দায়িত্বে বাড়ির বাইরে। সংবাদটি প্রচারিত হলে লোকজন তাঁর গ্রন্থশালাটি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে আসতে শুরু করে।</p> <p> </p> <p><strong>কর্ডোভার মহীয়সী নারী আয়েশার গ্রন্থাগার</strong></p> <p>গ্রন্থ সংগ্রহ এবং গ্রন্থাগার গড়ে তোলার আবেগ ও আগ্রহ আন্দালুসিয়ার পুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এমন নয়। বরং সেখানে প্রচুর মহীয়সী নারীও ছিলেন, যাঁরা জ্ঞান ও সাহিত্যের উপাদানগ্রন্থ সংগ্রহে পূর্ণ যত্নবান ছিলেন। তেমন একজন শিক্ষানুরাগী মহীয়সী নারী হলেন আয়েশা বিনতে আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে কাদিম (মৃত ৪০০ হিজরি/১০১০ খ্রিস্টাব্দ)। তাঁর হস্তলিপি ছিল প্রবাদতুল্য চমৎকার। চিঠিপত্র, অফিশিয়াল কাগজপত্র এবং বিভিন্ন লেখা তিনি অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন হস্তে লিখতেন ও কপি করতেন। শিক্ষার প্রচারে তাঁর ছিল নিরলস কর্মতৎপরতা। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিচিত্র শাখার অগণিত বইয়ে সমৃদ্ধ ছিল তাঁর পারিবারিক সেই গ্রন্থাগার।</p> <p> </p> <p><strong>ইমাম ইবনে হাজমের গ্রন্থাগার</strong></p> <p>আন্দালুসিয়ায় যেসব গ্রন্থাগার খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে ছিল, সেসবের একটি হচ্ছে ইবনে হাজম আলী ইবনে আহমাদ ইবনে সাঈদ ইবনে গালিব (রহ.)-এর (৩৮৩-৪৫৭ হিজরি/৯৯৩-১০৬৪ খ্রিস্টাব্দ) ব্যক্তিগত পাঠাগার। ইবনে হাজম কর্ডোভায় বেড়ে ওঠেন। হাদিস ও ফিকহশাস্ত্রে তাঁর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। যুক্তিবিদ্যার প্রতি তাঁর এক রকম ঝোঁক ছিল। এ বিষয়ে অনেক গ্রন্থও তিনি রচনা করেছেন। এই শাস্ত্রের উদ্ভাবক অ্যারিস্টটলের অনেক মতেরও তিনি খণ্ডন করেছেন। ইবনে হাজমের ব্যক্তিগত পাঠাগারটি ছিল রকমারি বিষয়ের প্রচুর গ্রন্থে ঠাসা। এক পরিসংখ্যান মতে, তাঁর পাঠাগারে ছিল চার লাখ ভলিউমের বই। প্রতিটি ভলিউমে ছিল ৮০ পাতা।</p> <p> </p> <p><strong>ইবনে খায়র আল ইশবিলির পাঠাগার</strong></p> <p>ইবনে খায়র আল ইশবিলির (মৃত ৫৭৫ হিজরি/১১৭৯ খ্রিস্টাব্দ) নিজস্ব পাঠাগার ছিল অত্যন্ত সুপরিচিত ও সমৃদ্ধ। তখনকার আন্দালুসিয়ার জ্ঞানী ব্যক্তিরা দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের সন্ধানে ছুটে আসতেন তাঁর ঘরে। গ্রন্থ বিন্যস্তকরণ ও বিশুদ্ধ হস্তলিপির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন প্রবাদপ্রতিম এক মনীষী। এক তথ্য মতে, তাঁর পাঠাগারে সংগৃহীত বইয়ের সংখ্যা ছিল ১১২৬। তার মধ্যে কিরাত-বিষয়ক বই ছিল ১০৮টি, হাদিস-বিষয়ক ১১২টি, নাহু-বিষয়ক ৫০টি, আরবি ভাষা ও সাহিত্য-বিষয়ক ১৩৩টি, গদ্য-বিষয়ক ৮৭টি, পদ্য-বিষয়ক ১৬২টি এবং বাকি বইগুলো অন্যান্য বিষয়ের।</p> <p>আসলে আন্দালুসিয়ার তখনকার মুসলিম সমাজে পারিবারিক গ্রন্থাগারের পুরো উপাখ্যান লিখতে গেলে প্রাসঙ্গিক অনেক ইতিহাস চলে আসে। এখানে খুব সংক্ষেপে কয়েকটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হলো। (তথ্যসূত্র : ড. আশরাফ সালিহ রচিত ‘মাকতাবাতুল মানাজিল ফিল আন্দালুস’)</p> <p><strong>লেখক :</strong> আলোচক, ইকরা টিভি, লন্ডন</p>