রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। গঠনতন্ত্র, নিবন্ধনসহ অন্য কোনো বিষয়ে দলটির আবেদন বিবেচনাধীন থাকলে তা নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে নিষ্পত্তি করতে বলেছেন সর্বোচ্চ আদালত। দলটির আপিল মঞ্জুর করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ গতকাল রবিবার এই রায় দেন। এ রায়ের মধ্য দিয়ে প্রায় এক যুগ পর নিবন্ধনের পক্ষে রায় পেল দলটি।
হাইকোর্টের রায় বাতিল এক যুগ পর নিবন্ধন ফিরে পাচ্ছে জামায়াত
নিজস্ব প্রতিবেদক

জামায়াতে ইসলামীর প্রতীক ছিল দাঁড়িপাল্লা। সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিদের উপস্থিতিতে ২০১৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ফুল কোর্ট সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে ‘দাঁড়িপাল্লা’ ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে একমাত্র সুপ্রিম কোর্টের মনোগ্রামে ব্যবহৃত হবে। অন্য কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতীক হিসেবে বা কোনো নির্বাচনে প্রার্থীর প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লা বরাদ্দ প্রদান করা যাবে না।
ওই সিদ্ধান্ত অনুসারে কোনো রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীকে প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লা বরাদ্দ না দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠি দেয় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা সংশোধন করে সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের প্রতীকের মধ্য থেকে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বাদ দেওয়া হয়।
সুপ্রিম কোর্টের ফুল কোর্ট সভার ওই সিদ্ধান্ত বাতিল বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী গত ১২ মে আপিল বিভাগে আবেদন দাখিল করে।
এ বিষয়ে গতকাল নির্বাচন কমিশনের (ইসি) আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম জানান, প্রতীক বরাদ্দের বিষয়ে আদালত কোনো পর্যবেক্ষণ দেননি।
গতকাল নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কমিশনের জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত জামায়াতের নিবন্ধন ও প্রতীকের ব্যাপারে আদালতের কোনো অবজারভেশন আমরা পাইনি। পর্যবেক্ষণ পাওয়ার পর এ বিষয়ে আইনগতভাবে যেটা প্রয়োজন সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আদালতে জামায়াতের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক, ইমরান এ সিদ্দিক ও মোহাম্মদ শিশির মনির। ইসির পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম।
রায়ের পর আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়টি বাতিল ঘোষণা করেছেন এবং ইসিকে নির্দেশ দিয়েছেন, জামায়াতের নিবন্ধন এবং অন্য যেসব ইস্যু (বিষয়) ইসির সামনে আছে বা আসবে সেগুলো যেন দ্রুত নিষ্পত্তি করা হয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধন ফিরে পেল। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের করা রিট মামলার মাধ্যমে জামায়াতের নিবন্ধন কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। এই রায়ের মাধ্যমে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক সংসদ প্রাপ্তি নিশ্চিত হলো। আমরা আশা করি, সঠিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাণবন্ত সংসদ গঠিত হবে।’
ইসির আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ে নিবন্ধন বাতিলের পর জামায়াতে ইসলামী ইসিতে রিভিউ (পুনর্বিবেচনার) আবেদন করেছিল, এখন সেখান থেকেই শুরু হবে। পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে রায় অনুযায়ী ইসি সিদ্ধান্ত নেবে।’
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনে নির্বাচন কমিশন। সে সময় ৩৮টি দলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীও ছিল। আইন অনুযায়ী, শুধু নিবন্ধিত দলগুলোকেই দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়। নিবন্ধন দেওয়ার পরের বছরই অর্থাৎ ২০০৯ সালে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন।
এই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি হাইকোর্ট একটি রুল জারি করেন। জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০বি (১) (বি) (২) ও ৯০ (সি) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে। সে সময় নিবন্ধন রক্ষায় দলীয় গঠনতন্ত্রে ব্যাপক সংশোধন আনে জামায়াত। কিন্তু চূড়ান্ত শুনানির পর সেই রুল যথাযথ ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট। সংবিধানের সঙ্গে জামায়াতের গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় দলটির নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হয় ওই রায়ে। পরে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করে জামায়াত। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট সেই আবেদন খারিজ করা হয়। এরপর ওই বছর ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পেলে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করে জামায়াতে ইসলামী, যা পরে আপিল হিসেবে গণ্য করা হয়। হাইকোর্টের রায়ের পর জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে অংশ নিতে পারেননি জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীরা। ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর নিবন্ধন বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন।
গত বছর ৬ নভেম্বর সর্বোচ্চ আদালত এক আদেশে দলটির আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত নেন। এর জন্য ওই বছরের ১২ নভেম্বর তারিখ ধার্য রাখা হয়। এদিন জামায়াতের মনোনীত আইনজীবীর পক্ষে সময় চাইলে আপিল বিভাগ শুনানি পিছিয়ে দেন। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর জামায়াতের আপিলটি শুনানিতে ওঠে। সেদিন জামায়াতের পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। তবে জামায়াতের আইনজীবী প্রয়াত এ জে মোহাম্মদ আলীর পক্ষে অন্য এক আইনজীবী সময় আবেদন নিয়ে দাঁড়ান। আদালত ওই আবেদন না নিয়ে শুনানির সময় কয়েক ঘণ্টা পিছিয়ে দেন। কিন্তু পিছিয়ে দেওয়া সময়েও জামায়াতের পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকায় আপিলটি খারিজ করে দেন সর্বোচ্চ আদালত। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর খারিজ হওয়া আপিল পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেয় দলটি। গত বছর ৩১ আগস্ট আপিল পুনরুজ্জীবিত (রিস্টোরেশন পিটিশন) করতে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করে জামায়াত। গত ২২ অক্টোবর সেই আবেদন মঞ্জুর করেন সর্বোচ্চ আদলত। গত ৩ ডিসেম্বর থেকে শুনানি শুরু হয়।
জামায়াত আমিরের প্রতিক্রিয়া : দলের নিবন্ধন পুনর্বহালের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, এই রায়ের মাধ্যমে জুলুম-নিপীড়নের অবসান হলো। গতকাল রবিবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘সর্বোচ্চ আদালতের সর্বসম্মত রায়ের মাধ্যমে আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পেয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা ২০০৮ অনুসরণ করেই নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন লাভ করে। ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হওয়ার পর ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি একটি বিশেষ মহল জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করে। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্ট বিভক্ত রায়ের মাধ্যমে নিবন্ধন বাতিল করে। জামায়াত এরপর আপিল বিভাগে আপিল করে, যা আজ সর্বসম্মতভাবে মঞ্জুর হয় এবং নিবন্ধন ফিরিয়ে দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়।’
বিবৃতিতে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘এই রায় আমাদের জন্য শুধু একটি আইনি বিজয় নয়, বরং ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা। রায়ের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং আমরা আশাবাদী, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতি একটি নতুন মাত্রা লাভ করবে।’
এ বিবৃতি ছাড়াও ডা. শফিকুর রহমান তাঁর ফেসবুকে পোস্টে বলেন, ‘পরবর্তী প্রক্রিয়া নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মহান রবের সাহায্য চাই আমরা যেন দ্রুত আমাদের পূর্ণ অধিকার ফিরে পাই।’
চট্টগ্রামে শোকরানা মাহফিল : এক যুগ পর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ফিরে পাওয়ায় শোকরানা ও দোয়া মাহফিল করেছে দলটির চট্টগ্রাম মহানগরী শাখা। এতে নগর জামায়াতের আমির সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে বলেই আওয়ামী বাকশালী, ফ্যাসিবাদী, ইসলামবিরোধী শক্তি তা বরদাস্ত করতে পারেনি। তাই তারা আমাদের নিবন্ধন বাতিল করেছিল। আজ সর্বোচ্চ আদালতের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হল। জামায়াত আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করছে।’
গতকাল দুপুর ১টায় চট্টগ্রামের দেওয়ানবাজারের নগর জামায়াতের কার্যালয়ে এই মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে মোনাজাত পরিচালনা করেন নগর আমির শাহজাহান চৌধুরী।
মহানগরী জামায়াতের সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মুহাম্মদ নুরুল আমিনের সঞ্চালনায় শোকরানা মাহফিলে জামায়াতের অন্য নেতারা বক্তব্য দেন।
সম্পর্কিত খবর

ব্যর্থ মেহেদী হাসান মিরাজ


বেশি দামে আরো ১০ মিলিয়ন ডলার কিনল বাংলাদেশ ব্যাংক
নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখী করার ইঙ্গিত দিয়ে নিলামের মাধ্যমে আরো ১০ মিলিয়ন ডলার কিনেছে। ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণার দিনই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানিয়েছিলেন, প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করবে। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব। প্রয়োজন হলে ডলার কিনব, আবার প্রয়োজন হলে বিক্রিও করব।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এর মাধ্যমে একদিকে যেমন বাজারে ‘আপওয়ার্ড সিগন্যাল’ দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে চাহিদা-জোগানের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা চলছে। এতে করে ডলারের রেট একদিকে পুরোপুরি বাজারের ওপর নির্ভরশীল থাকছে, অন্যদিকে প্রয়োজন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত উপস্থিতিও বজায় থাকছে। এই কৌশল মুদ্রাবাজারে অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণ এবং আইএমএফের শর্ত পূরণ উভয় উদ্দেশেই সহায়ক হিসেবে কাজ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখী করার ইঙ্গিত দিয়ে নিলামের মাধ্যমে আরো ১০ মিলিয়ন বা এক কোটি ডলার কিনেছে। গত ২৩ জুলাই এই নিলামে কাট-অফ রেট নির্ধারণ করা হয় ১২১.৯৫ টাকা, যা আগের তুলনায় ০.৪৫ টাকা বেশি। এর মাধ্যমে মাত্র আট দিনের ব্যবধানে নিলামে ডলারের রেট উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘বিভিন্ন ব্যাংকের দর দেখে ১২১ টাকা ৯৫ পয়সায় এক কোটি ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য একজন কর্মকর্তা জানান, এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কৌশলগত পদক্ষেপ। এই নিলামে ডলারের কাট-অফ রেট নির্ধারণ করা হয়েছে ১২১.৯৫ টাকা।
ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণ ও বাজারে প্রতিক্রিয়া : শীর্ষস্থানীয় একটি বেসরকারি ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিলামে অংশ নেওয়ার জন্য আমাদের আমন্ত্রণ জানায়। তবে এবার আগের মতো অনেক ব্যাংক আগ্রহ দেখায়নি। কারণ অনেক ব্যাংক ধারণা করছে, সামনে ডলারের দাম আরো বাড়বে। তাই তারা অপেক্ষা করছে। চড়া দর সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক মাত্র ১০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করতে পেরেছে। এ থেকেই বোঝা যায়, বাজারে প্রত্যাশা কিভাবে গড়ে উঠছে।’
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ মোহাম্মদ মারুফ মনে করেন, এ মুহূর্তে ব্যাংকগুলো চাচ্ছে, যে ডলার রয়েছে সামনে সেটা দিয়েই দায় পরিশোধ করবে। তা ছাড়া চলতি মাসেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো প্রায় ৫০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। যে কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংক ডলার বিক্রি করতে তেমন আগ্রহী ছিল না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
মারুফ বলেন, ‘বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে যা উদ্বৃত্ত ডলার ছিল তা বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়েছে। এটা দিয়ে বোঝায় যে ব্যাংকের কাছে যে পরিমাণ উদ্বৃত্ত ডলার ছিল তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ে গেছে এবং যে পরিমাণ তারল্য রয়েছে, আসলে এত দরকার নেই।’
বাজার পরিস্থিতি ও এলসির চাপ : পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘সম্প্রতি ডলারের বাজার কিছুটা টাইট। কারণ ব্যাংকগুলো আমদানি এলসি খোলার পরিমাণ বাড়াচ্ছে। তবে আগামী সপ্তাহে ডলারের প্রবাহ বাড়লে তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করছি।’ তিনি বলেন, ‘ডলারের বাজার স্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করে। সম্প্রতি মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস। আগের অস্থিরতা অনেকটাই কেটে গেছে, তবে আরো কিছুদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা দরকার।’
স্পট ও আন্ত ব্যাংক বিনিময় হার : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২৩ জুলাই স্পট বিনিময় হার ছিল ১২১.৯৪ টাকা। আন্ত ব্যাংক বাজারে ডলার লেনদেন হয় ১২১.৬০ থেকে ১২২.০২ টাকার মধ্যে। শীর্ষস্থানীয় আরেক ব্যাংকের কর্মকর্তা বলেন, ‘বুধবার আন্ত ব্যাংক বাজারেই ডলারের দাম ১২২ টাকা ছাড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আপওয়ার্ড সিগন্যালের ফলে আগামীকাল এটি আরো বাড়তে পারে।’
আইএমএফের শর্তে বাজারভিত্তিক নীতি : বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী এক কর্মকর্তা জানান, আইএমএফের ঋণচুক্তির আওতায় এখন আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি হস্তক্ষেপ করে নির্দিষ্ট রেটে ডলার কেনে না। মে মাস থেকে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু হওয়ায় এখন নিলামের মাধ্যমে ডলার কেনা হয়। এতে করে ডলারের মূল্য নির্ধারণে বাজার প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে।
তিনি বলেন, ‘আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেরা রেট নির্ধারণ করত। এখন মার্কেট রেটেই লেনদেন হচ্ছে। এই পদ্ধতিই দীর্ঘ মেয়াদে বাজারকে আরো স্বচ্ছ করবে।’

ফিরে দেখা ২৫ জুলাই ’২৪
মানবাধিকার লঙ্ঘন তদন্তে সহযোগিতার প্রস্তাব জাতিসংঘের
নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে মানবাধিকার লঙ্ঘন তদন্তে সহযোগিতার প্রস্তাব দেয় জাতিসংঘ। ২০২৪ সালের ২৫ জুলাই জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক এক বিবৃতিতে এই প্রস্তাব দেন। অন্যদিকে ভারতের নয়াদিল্লিতে এক ব্রিফিংয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় উল্লেখ করে বাংলাদেশে শিগগিরই শান্তি ফিরবে বলে আশা প্রকাশ করেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে হতাহতের ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্ত চেয়েছে বিএনপিও।
এদিকে এদিনই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে প্রবাসী ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে বিক্ষোভ করে তাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য চায় সরকার। বিশ্বের নানা দেশে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাস, হাইকমিশন এবং অনাবাসিক মিশনগুলোর মাধ্যমে হোস্ট গভর্নমেন্টের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এদিন সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত চার ঘণ্টা খোলা ছিল সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অফিস। রাজধানীতে দূরপাল্লার গণপরিবহনে যাত্রীদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায়। কারফিউ বলবৎ থাকায় রাজধানীতে ছিল কঠোর সেনা টহল।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) তথ্য অনুযায়ী, এদিন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আর কেবল কোটা সংস্কারের ইস্যুতে সীমাবদ্ধ নেই।’ তিনি বলেন, ‘প্রজ্ঞাপন জারির সঙ্গেই এই আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটবে না।
অন্যদিকে ২৩ জুলাই (২০২৪) প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে আংশিক বিজয় অর্জিত হয়েছে বলে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে জানায় ‘সাধারণ শিক্ষার্থী মঞ্চ’। বিবৃতিতে ৯১ জন শিক্ষার্থী স্বাক্ষর করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আটটি বার্তা দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে হতাহতদের তালিকা তৈরি, হত্যা ও হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করা, বিশ্ববিদ্যালয় ও হল খুলে দেওয়ার জন্য চাপ তৈরি, হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের সহযোগিতা, রংপুরের আবু সাঈদসহ নিহত সবার কবর জিয়ারত, রুহের মাগফিরাত কামনা এবং পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো।
২৫ জুলাই সারা দেশে ইন্টারনেট চালু, কারফিউ তুলে দেওয়াসহ ‘জরুরি’ চার দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম শেষ হয়। তবে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে না পারায় নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারেনি তারা। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে আরেক অংশের একটি বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। এর সমন্বয়ক হান্নান মাসুদের বরাত দিয়ে ওই বিবৃতিতে বলা হয়, পরদিন ২৬ জুলাই বাদ জুমা সারা দেশে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে প্রার্থনা ও শোক মিছিল করা হবে।
নিহত ১৭০ জনের বেশি, আহত হাজারের বেশি— জাতিসংঘ : জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, হালনাগাদ তথ্য থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে ১৭০ জনেরও বেশি লোক নিহত এবং হাজারের বেশি আহত হয়েছে। তাদের অনেকে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সরকারের নীতির বিরুদ্ধে ছাত্র ও তরুণদের প্রতিবাদ কর্মসূচির পর অনেকে নিখোঁজ রয়েছে। অন্তত দুজন সাংবাদিক নিহত এবং আরো অনেকের আহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের কয়েক শ লোকের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এদিনই এক যৌথ বিবৃতিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পূর্ণ জবাবদিহির আহবান জানান জাতিসংঘের ১৩ জন স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞ। তাঁরা বাংলাদেশে সহিংস দমন-পীড়নের অভিযোগ এনে তা বন্ধ করার আহবান জানান।
ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রো রেল স্টেশন পরিদর্শনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, বিচার চাইলেন জনগণের কাছে : এদিন সকালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে মেট্রো রেল স্টেশন পরিদর্শন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন ঘুরে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। এ সময় তাঁকে চোখের পানি মুছতেও দেখা যায়। পরিদর্শন শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশের জনগণকে তাদের (দেশব্যাপী তাণ্ডবের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের) বিচার করতে হবে। আমি জনগণের কাছে ন্যায়বিচার চাইছি। ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা দেওয়ার মতো আমার আর কোনো ভাষা নেই।’
মামলা ও গ্রেপ্তার : ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সূত্র দিয়ে দেশের গণমাধ্যমগুলো জানায়, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে নাশকতার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে এদিনও অভিযান অব্যাহত ছিল। এদিন বিকেলে রাজধানীর নিউ এলিফ্যান্ট রোড থেকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য আন্দালিব রহমান পার্থকে গ্রেপ্তার করা হয়।

প্রসঙ্গ শুল্ক
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২৯ জুলাই চূড়ান্ত আলোচনা
নিজস্ব প্রতিবেদক

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রধান বাণিজ্য আলোচনাকারী সংস্থা ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) বাংলাদেশকে আগামী ২৯ জুলাই তৃতীয় ও চূড়ান্ত শুল্ক আলোচনায় বসার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সংবাদ সংস্থা বাসসকে এই তথ্য জানিয়েছেন বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান। তিনি জানান, এর আগে বাংলাদেশ ২২ জুলাই ইউএসটিআরের কাছে নিজেদের অবস্থানপত্র পাঠায় এবং ২৬ জুলাই চূড়ান্ত দফার আলোচনা শুরুর প্রস্তাব দেয়।
বাণিজ্যসচিব জানান, ইউএসটিআর ২৯ জুলাই দিন ধার্য করেছে।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের জন্য বিদ্যমান ৩৫ শতাংশ শুল্ক হার হ্রাস করবে। কারণ এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র জাপানের জন্য ১৫ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার জন্য ১৯ শতাংশ, ভিয়েতনামের জন্য ২০ শতাংশ এবং ফিলিপাইনের জন্য ১৯ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করেছে।
বাংলাদেশ এরই মধ্যে মার্কিন পণ্য, যেমন—তুলা, গম, তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), বিমান ও অন্যান্য কৃষিপণ্য শুল্কমুক্ত আমদানির প্রস্তাব দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়াতে বাংলাদেশ ২০ জুলাই মার্কিন গম সরবরাহকারীদের সঙ্গে সাত লাখ টন গম আমদানির চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টার কাছে সাংবাদিকরা শুল্ক আলোচনার সর্বশেষ অগ্রগতি জানতে চান। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ নিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে, এমন কোনো কাজ করা হবে না।
শুল্ক আলোচনায় বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন প্রচারণা নাকচ করে উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে আমরা কেন এমন কাজ করব? তাহলে তো আন্ত মন্ত্রণালয় মিটিংয়ের দরকার হয় না। কিছু জিনিস মেনে নিয়ে কাজটা করে ফেললেই তো হয়ে যায়। সম্পূরক শুল্কের মতো আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিষয়গুলোতে লবিইস্ট নিয়োগ করে ভালো ফল পাওয়া যায় না।’