সেনাবাহিনীকে নিয়ে রাজনীতি বা সেনাবাহিনীকে দিয়ে রাজনীতি—কোনোটাই এ দেশে টেকেনি। বুমেরাং হয়েছে নিদারুণভাবে। যাঁরা সেই চেষ্টা করেছেন বরণ করতে হয়েছে করুণ পরিণতি। পতিত বিতাড়িত হয়েছেন, দেশান্তরিও হয়েছেন।
বিশেষ লেখা
রাষ্ট্র ও নিরাপত্তাবিরোধী কাজে না জড়ানোর সাফ কথা সেনাবাহিনীর
- মোস্তফা কামাল

এ প্রত্যয় তিনি রক্ষা করে চলেছেন। রাজনীতিকরাও যেন সেনাবাহিনীতে হস্তক্ষেপ করতে না পারেন, সেই চেষ্টাও করছেন।
নামে সোশ্যাল হলেও এ মাধ্যমটিকে রীতিমতো আনসোশ্যাল করে তুলছে তারা। আজগুবি তথ্য ও মিথ্যাচারে ভরিয়ে দিচ্ছে। ছাড়ছে একের পর এক নানা কনটেন্ট। সেই সঙ্গে গুজবের বিস্তার। অথচ যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থাকার অঙ্গীকার বারবার ব্যক্ত করেই চলছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তাঁকে যেন কাদম্বিনীর মতো ‘মরিয়া প্রমাণ করিতে হইবে’ যে তিনি মরেননি। তিনি যে বেঁচে আছেন সেটাও ঘটনা। ৫ আগস্ট পূর্বাপরে গান পয়েন্টেই ছিলেন জেনারেল ওয়াকার। পুলিশ ও তখনকার ক্ষমতাসীনদের বিভিন্ন দলের লাঠি-গুলির মাঝে সেনাবাহিনীকে ফিরিয়েছেন ‘নো ফায়ার’ নির্দেশে। তা মাত্র ৮-৯ মাস আগের ঘটনা। তখন কী দশা-দুর্গতিতে ছিল বাংলাদেশ। কার অসিলায় কিভাবে এখন মুক্ত বাতাসে দম-নিঃশ্বাস নিচ্ছেন এখন যাঁরা সিনা টান করে ঘুরছেন? আর রটাচ্ছেন-ছড়াচ্ছেন নানা অ-কথা?
মানবসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক বড় রকমের বিপর্যয় ঘটলে সেনা ডাকতে মন চায়। দ্রুত এবং মানসম্পন্ন নির্মাণকাজ চাইলে আবশ্যক মনে করা হয় সেনাবাহিনীকে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য অর্ধেক খরচে সেনাবাহিনী ঘর বানিয়ে দিলে মন্দ লাগে না। ঝিল, লেক, খাল মজে গেলে তা উদ্ধার ও খননে ডাক পড়ে সেনাবাহিনীর। জাতিসংঘ মিশনে গিয়ে সেনাবাহিনী দেশে টাকা পাঠালে তা রেমিট্যান্স নামে অর্থনীতিতে যোগ করতেও চমক বলে মনে হয়। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে আহতদের সেনা ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হাসপাতালে চিকিৎসায়ও যারপরনাই আস্থা জাগে। সেনাবাহিনীর এসব কাজকে রাজনীতি মনে হয় না। সেগুলো কোন নীতিতে পড়ে তাও বলেন না সমালোচকরা। বর্তমান সময়েও সিভিল প্রশাসনের সারথি হয়ে মাঠে কাজ করছে সেনাবাহিনী। তা গোপনে বা আড়ালে নয়, একেবারে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে। সেনা সদর থেকেও মাঝেমধ্যে জানানো হয় তাদের কর্মের হাল-হকিকত। এ দফায় গত সোমবার স্পষ্ট জানানো হয়েছে, জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়—এমন কোনো কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করবে না সেনাবাহিনী। করিডর একটি স্পর্শকাতর বিষয় বলে তারা মনে করে। পরিস্থিতির অনিবার্যতায় সেনা সদরের ব্রিফিংয়ে এটিও উল্লেখ করা হয়েছে, সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে কোনো মতবিরোধ নেই; বরং সেনাবাহিনী কাজ করছে সম্পূরক হিসেবে। সীমান্তের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো কম্প্রোমাইজ করবে না সেনাবাহিনী। মব ভায়োলেন্স কিংবা জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করলে কঠোর হাতে তা দমনের হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে।
খুব দরকার ছিল দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও সমসাময়িক ইস্যুতে ব্রিফিংটি। এতে জানানো হয়েছে গেল ৪০ দিনে ২৪১টি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত দুই হাজার অপরাধীকে গ্রেপ্তারের কথা। পাহাড়ি আত্মস্বীকৃত সন্ত্রাসী দলকে নির্বাচনে যুক্ত করা সমীচীন হবে না—এমন মন্তব্য সেনা সদরের। সেনা সদরের মিলিটারি অপারেশন পরিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা এক প্রশ্নের জবাবে জানান, সীমান্তে আরসা বাহিনীর সশস্ত্র টহল নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে তাঁদের। কুকি চিনের ইউনিফর্ম তৈরির বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ভারত থেকে পুশ ইন ঠেকাতে বিজিবি সক্রিয় রয়েছে। প্রয়োজন হলে সেনাবাহিনী পাশে থাকবে বলেও জানানো হয়েছে। সম্পূরক কাজটি সেনাবাহিনী করছে পূর্ণ ম্যাজিস্ট্রেসি নিয়ে। কিন্তু সেই মাত্রায় হাঁকডাক বা ম্যাজিস্ট্রেসি শো করছে না। সহায়কের মতো কাজ করছে পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে। অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ না করার কৌশলগত সিদ্ধান্ত তাদের আগেরই নেওয়া। সেনা সদস্যদের মাঠ থেকে সরালে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কী দশা হবে, কারো কারো ধারণায় না থাকলেও সাধারণ বুঝ-জ্ঞানের মানুষ তা যথাযথ উপলব্ধি করে। সশস্ত্র বাহিনী শুধু সার্বভৌমত্বের প্রতীকই নয়, একটি দেশের স্থিতিশীলতায়ও কত বলীয়ান তা জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে বাস্তবে দেখিয়েছে সেনাবাহিনী। বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অত্যন্ত পেশাদার, দক্ষ, প্রত্যয়ী। উঁচু মনোবলে শুধু নিজেরা নয়, জনতাকে নিয়েও ঐক্যবদ্ধ। দেশে এখন একটা বিশেষ পরিস্থিতি। নির্বাচন নিয়ে কথা হচ্ছে। কোনো কোনো দল তো নির্বাচনের জন্য অস্থির-উতলা। রাষ্ট্র সংস্কার নিয়েও কথা হচ্ছে। পরীক্ষিত সেনাবাহিনীকে সম্পৃক্ত করে একটি ঐতিহাসিক নির্বাচনের তাগিদ রয়েছে কারো কারো। এগুলোর সবই প্রস্তাব। সমস্যা দেখা দিচ্ছে প্রকাশের ভাষাভঙ্গি নিয়ে। মনোজগতে কারো কারো উদ্দেশ্যই হচ্ছে সমালোচনা-নিন্দা-গিবত করা, তা সেনাপ্রধানের নামাজের ইমামতি নিয়েও। আর রাজনীতির অপবাদ তো ছড়ানো হচ্ছেই।
এবারের পটপরিবর্তনে সেনাবাহিনীর জনসম্পৃক্ততার অনন্যদৃষ্টান্তকে বানচাল করতে মহলবিশেষ নানা ফাঁদ পাতছে। কেউ দেশে, কেউ ভিন দেশে বসে এ টোকায় যুক্ত হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার কথা ভিন্ন। কারণ তাদের কোনো সম্পাদকীয় কর্তৃপক্ষ নেই, দায়বদ্ধতা নেই। হিট বা ভাইরাল হতে গিয়ে নিজের সম্পর্কে অশ্রাব্য শব্দ-বাক্য ব্যবহারও তাদের কাছে বিষয় নয়। কিন্তু দেশে একান্নবর্তী পরিবারের মতো রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতিতে সম্পৃক্তরাও বুঝে, অবুঝে বা অতি বুঝে, ফাঁসে-বেফাঁসে সেনাবাহিনীর ইমেজে আঘাত করে বসে নিজেদের অপরিণামদর্শিতাকেই স্পষ্ট করে তুলছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর স্থল শাখা। এটি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্ববৃহৎ শাখা। সেনাবাহিনীর প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের অখণ্ডতা রক্ষাসহ বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করা এবং সব ধরনের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহায়তায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সঙ্গে প্রয়োজনীয় শক্তি ও জনবল সরবরাহ করা।
প্রাথমিক দায়িত্বের পাশাপাশি যেকোনো জরুরি অবস্থায় বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় এগিয়ে আসতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সাংবিধানিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যুদ্ধবিদ্যায় বিশ্বসেরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘উই রিভোল্ট’ বলে একাত্তরে এই বাহিনীর বীরত্বগাথা। পাকিস্তানিরা এ অঞ্চলের অধিবাসী সেনাদের নিয়ে ব্যঙ্গ করত। ভেতো বাঙালি বলে মশকরা করত। ওই ভেতোদের একজন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনারাও ওই গোত্রভুক্ত। জাতির জরুরি প্রয়োজনে যা করা দরকার, তা-ই করেছেন তাঁরা। পরবর্তী সময়ে তাঁদের সঙ্গে মেলেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস—ইপিআর সদস্যরাও। সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি বেসামরিক জনগণ মিলে গড়ে তোলে মুক্তি বাহিনী। কর্নেল (অব.) মো. আতাউল গনি ওসমানীকে দেওয়া হয় বাংলাদেশ বাহিনীর নেতৃত্ব। ১৯৭১ সালের ১১-১৭ জুলাই সেক্টর কমান্ডারস কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এই কনফারেন্সে লে. কর্নেল আব্দুর রবকে চিফ অব স্টাফ, গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এবং মেজর এ আর চৌধুরীকে অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে বাংলাদেশ বাহিনীর কমান্ড প্রতিষ্ঠা হয়। যুদ্ধ পরিচালনায় সাধারণ মানুষের সার্বিক সহযোগিতা ছিল সাফল্যের অন্যতম অনুঘটক।
মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর অবদানকে একটি দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করা খুবই দুরূহ কাজ। পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে ‘ভেতো বাঙালি’ সেদিন সামরিক ক্ষেত্রে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, তা বিশ্ব সামরিক ইতিহাসেও স্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর বেশ কয়েকটি যুদ্ধ সারা বিশ্বের সামরিক ইতিহাসে পাঠ্য। প্রচলিত যুদ্ধ পদ্ধতির বাইরে গিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেছে, তা সামরিক যুদ্ধ কৌশলের মাপকাঠিতে অনন্য। আধুনিক যুদ্ধবিদ্যার অন্যতম সমর কৌশল এই গেরিলা যুদ্ধ। সেই থেকে সেনাবাহিনী ক্রমেই বিকশিত। রাজনীতির মধ্যে নয়, বাইরেও নয়। অর্থনীতি-কূটনীতির বাইরেও নয়। দুর্যোগ-দুর্বিপাকসহ জরুরি সব কাজেই সম্পৃক্ত থাকছে। আবার জাতিসংঘের শান্তি মিশনে রাখছে অন্যান্য দেশের কাছে ঈর্ষণীয় ভূমিকা। সিয়েরা লিওনসহ আফ্রিকার দেশগুলোতে শিক্ষাবিস্তারেও সহায়তা করছে। সামাজিকতা এমনকি খাদ্যাভ্যাস পর্যন্ত শেখাচ্ছে। শাক-সবজিসহ শস্য ফলিয়ে সবুজ করছে মরুর বুক। এর সুনাম ও বিশ্বস্বীকৃতি যোগ হচ্ছে বাংলাদেশের খাতায়। একাত্তরের ‘উই রিভোল্টের’ ওই সেনাবাহিনী এবারের ছাত্র-জনতার বিপ্লবে যোগ করেছে ‘নো ফায়ার’।
নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে ছিল তখনকার সেনাপ্রধান জেনারেল নূরউদ্দীন খানের ‘এনাফ ইজ এনাফ’, ‘অনেক হয়েছে আর না’ জানিয়ে দেওয়া। জনতার সঙ্গে সেনাদের উপলব্ধির ওই ভূমিকার জেরে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়ার ঘোষণা দিতে হয় এরশাদকে। দেশ, জনতা, সময় ও বাস্তবতার চাহিদায় সেনাবাহিনীর এ ধরনের ঐতিহাসিক ভূমিকার মাঝে রাজনীতি খোঁজা এক ধরনের বিমারির মতো; বরং এ বাহিনীর দেশপ্রেম ও জন-আকাঙ্ক্ষার দৃষ্টান্ত খুঁজলে অনেক উপাদান মিলবে। এখনকার সেনাপ্রধানের ক্ষমতালিপ্সা থাকলে তা কবেই চরিতার্থ করতে পারতেন। তিনি সেই পথ মাড়াননি। মাড়াবেনও না বলে জানিয়েছেন সোজাসিধা বাংলা ভাষায়। এমনকি তাঁর বাহিনীকে নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ দেবেন না বলে দৃঢ় প্রত্যয়ও রয়েছে তাঁর। এর পরও জেনারেল ওয়াকার বা তাঁর বাহিনীর মাঝে রাজনীতি খোঁজার রোগ কিভাবে সারে, সেই পরিণতি কয়েকবার দেখতে হয়েছে। উচ্ছিষ্ট হয়ে পালাতে হয়েছে, বিতাড়িত হতে হয়েছে। কারাভোগও করতে হয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
সম্পর্কিত খবর

ব্যর্থ মেহেদী হাসান মিরাজ


বেশি দামে আরো ১০ মিলিয়ন ডলার কিনল বাংলাদেশ ব্যাংক
নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখী করার ইঙ্গিত দিয়ে নিলামের মাধ্যমে আরো ১০ মিলিয়ন ডলার কিনেছে। ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণার দিনই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানিয়েছিলেন, প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করবে। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব। প্রয়োজন হলে ডলার কিনব, আবার প্রয়োজন হলে বিক্রিও করব।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এর মাধ্যমে একদিকে যেমন বাজারে ‘আপওয়ার্ড সিগন্যাল’ দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে চাহিদা-জোগানের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা চলছে। এতে করে ডলারের রেট একদিকে পুরোপুরি বাজারের ওপর নির্ভরশীল থাকছে, অন্যদিকে প্রয়োজন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত উপস্থিতিও বজায় থাকছে। এই কৌশল মুদ্রাবাজারে অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণ এবং আইএমএফের শর্ত পূরণ উভয় উদ্দেশেই সহায়ক হিসেবে কাজ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখী করার ইঙ্গিত দিয়ে নিলামের মাধ্যমে আরো ১০ মিলিয়ন বা এক কোটি ডলার কিনেছে। গত ২৩ জুলাই এই নিলামে কাট-অফ রেট নির্ধারণ করা হয় ১২১.৯৫ টাকা, যা আগের তুলনায় ০.৪৫ টাকা বেশি। এর মাধ্যমে মাত্র আট দিনের ব্যবধানে নিলামে ডলারের রেট উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘বিভিন্ন ব্যাংকের দর দেখে ১২১ টাকা ৯৫ পয়সায় এক কোটি ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য একজন কর্মকর্তা জানান, এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কৌশলগত পদক্ষেপ। এই নিলামে ডলারের কাট-অফ রেট নির্ধারণ করা হয়েছে ১২১.৯৫ টাকা।
ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণ ও বাজারে প্রতিক্রিয়া : শীর্ষস্থানীয় একটি বেসরকারি ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিলামে অংশ নেওয়ার জন্য আমাদের আমন্ত্রণ জানায়। তবে এবার আগের মতো অনেক ব্যাংক আগ্রহ দেখায়নি। কারণ অনেক ব্যাংক ধারণা করছে, সামনে ডলারের দাম আরো বাড়বে। তাই তারা অপেক্ষা করছে। চড়া দর সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক মাত্র ১০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করতে পেরেছে। এ থেকেই বোঝা যায়, বাজারে প্রত্যাশা কিভাবে গড়ে উঠছে।’
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ মোহাম্মদ মারুফ মনে করেন, এ মুহূর্তে ব্যাংকগুলো চাচ্ছে, যে ডলার রয়েছে সামনে সেটা দিয়েই দায় পরিশোধ করবে। তা ছাড়া চলতি মাসেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো প্রায় ৫০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। যে কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংক ডলার বিক্রি করতে তেমন আগ্রহী ছিল না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
মারুফ বলেন, ‘বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে যা উদ্বৃত্ত ডলার ছিল তা বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়েছে। এটা দিয়ে বোঝায় যে ব্যাংকের কাছে যে পরিমাণ উদ্বৃত্ত ডলার ছিল তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ে গেছে এবং যে পরিমাণ তারল্য রয়েছে, আসলে এত দরকার নেই।’
বাজার পরিস্থিতি ও এলসির চাপ : পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘সম্প্রতি ডলারের বাজার কিছুটা টাইট। কারণ ব্যাংকগুলো আমদানি এলসি খোলার পরিমাণ বাড়াচ্ছে। তবে আগামী সপ্তাহে ডলারের প্রবাহ বাড়লে তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করছি।’ তিনি বলেন, ‘ডলারের বাজার স্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করে। সম্প্রতি মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস। আগের অস্থিরতা অনেকটাই কেটে গেছে, তবে আরো কিছুদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা দরকার।’
স্পট ও আন্ত ব্যাংক বিনিময় হার : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২৩ জুলাই স্পট বিনিময় হার ছিল ১২১.৯৪ টাকা। আন্ত ব্যাংক বাজারে ডলার লেনদেন হয় ১২১.৬০ থেকে ১২২.০২ টাকার মধ্যে। শীর্ষস্থানীয় আরেক ব্যাংকের কর্মকর্তা বলেন, ‘বুধবার আন্ত ব্যাংক বাজারেই ডলারের দাম ১২২ টাকা ছাড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আপওয়ার্ড সিগন্যালের ফলে আগামীকাল এটি আরো বাড়তে পারে।’
আইএমএফের শর্তে বাজারভিত্তিক নীতি : বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী এক কর্মকর্তা জানান, আইএমএফের ঋণচুক্তির আওতায় এখন আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি হস্তক্ষেপ করে নির্দিষ্ট রেটে ডলার কেনে না। মে মাস থেকে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু হওয়ায় এখন নিলামের মাধ্যমে ডলার কেনা হয়। এতে করে ডলারের মূল্য নির্ধারণে বাজার প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে।
তিনি বলেন, ‘আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেরা রেট নির্ধারণ করত। এখন মার্কেট রেটেই লেনদেন হচ্ছে। এই পদ্ধতিই দীর্ঘ মেয়াদে বাজারকে আরো স্বচ্ছ করবে।’

ফিরে দেখা ২৫ জুলাই ’২৪
মানবাধিকার লঙ্ঘন তদন্তে সহযোগিতার প্রস্তাব জাতিসংঘের
নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে মানবাধিকার লঙ্ঘন তদন্তে সহযোগিতার প্রস্তাব দেয় জাতিসংঘ। ২০২৪ সালের ২৫ জুলাই জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক এক বিবৃতিতে এই প্রস্তাব দেন। অন্যদিকে ভারতের নয়াদিল্লিতে এক ব্রিফিংয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় উল্লেখ করে বাংলাদেশে শিগগিরই শান্তি ফিরবে বলে আশা প্রকাশ করেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে হতাহতের ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্ত চেয়েছে বিএনপিও।
এদিকে এদিনই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে প্রবাসী ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে বিক্ষোভ করে তাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য চায় সরকার। বিশ্বের নানা দেশে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাস, হাইকমিশন এবং অনাবাসিক মিশনগুলোর মাধ্যমে হোস্ট গভর্নমেন্টের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এদিন সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত চার ঘণ্টা খোলা ছিল সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অফিস। রাজধানীতে দূরপাল্লার গণপরিবহনে যাত্রীদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায়। কারফিউ বলবৎ থাকায় রাজধানীতে ছিল কঠোর সেনা টহল।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) তথ্য অনুযায়ী, এদিন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আর কেবল কোটা সংস্কারের ইস্যুতে সীমাবদ্ধ নেই।’ তিনি বলেন, ‘প্রজ্ঞাপন জারির সঙ্গেই এই আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটবে না।
অন্যদিকে ২৩ জুলাই (২০২৪) প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে আংশিক বিজয় অর্জিত হয়েছে বলে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে জানায় ‘সাধারণ শিক্ষার্থী মঞ্চ’। বিবৃতিতে ৯১ জন শিক্ষার্থী স্বাক্ষর করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আটটি বার্তা দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে হতাহতদের তালিকা তৈরি, হত্যা ও হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করা, বিশ্ববিদ্যালয় ও হল খুলে দেওয়ার জন্য চাপ তৈরি, হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের সহযোগিতা, রংপুরের আবু সাঈদসহ নিহত সবার কবর জিয়ারত, রুহের মাগফিরাত কামনা এবং পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো।
২৫ জুলাই সারা দেশে ইন্টারনেট চালু, কারফিউ তুলে দেওয়াসহ ‘জরুরি’ চার দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম শেষ হয়। তবে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে না পারায় নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারেনি তারা। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে আরেক অংশের একটি বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। এর সমন্বয়ক হান্নান মাসুদের বরাত দিয়ে ওই বিবৃতিতে বলা হয়, পরদিন ২৬ জুলাই বাদ জুমা সারা দেশে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে প্রার্থনা ও শোক মিছিল করা হবে।
নিহত ১৭০ জনের বেশি, আহত হাজারের বেশি— জাতিসংঘ : জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, হালনাগাদ তথ্য থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে ১৭০ জনেরও বেশি লোক নিহত এবং হাজারের বেশি আহত হয়েছে। তাদের অনেকে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সরকারের নীতির বিরুদ্ধে ছাত্র ও তরুণদের প্রতিবাদ কর্মসূচির পর অনেকে নিখোঁজ রয়েছে। অন্তত দুজন সাংবাদিক নিহত এবং আরো অনেকের আহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের কয়েক শ লোকের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এদিনই এক যৌথ বিবৃতিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পূর্ণ জবাবদিহির আহবান জানান জাতিসংঘের ১৩ জন স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞ। তাঁরা বাংলাদেশে সহিংস দমন-পীড়নের অভিযোগ এনে তা বন্ধ করার আহবান জানান।
ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রো রেল স্টেশন পরিদর্শনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, বিচার চাইলেন জনগণের কাছে : এদিন সকালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে মেট্রো রেল স্টেশন পরিদর্শন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন ঘুরে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। এ সময় তাঁকে চোখের পানি মুছতেও দেখা যায়। পরিদর্শন শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশের জনগণকে তাদের (দেশব্যাপী তাণ্ডবের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের) বিচার করতে হবে। আমি জনগণের কাছে ন্যায়বিচার চাইছি। ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা দেওয়ার মতো আমার আর কোনো ভাষা নেই।’
মামলা ও গ্রেপ্তার : ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সূত্র দিয়ে দেশের গণমাধ্যমগুলো জানায়, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে নাশকতার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে এদিনও অভিযান অব্যাহত ছিল। এদিন বিকেলে রাজধানীর নিউ এলিফ্যান্ট রোড থেকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য আন্দালিব রহমান পার্থকে গ্রেপ্তার করা হয়।

প্রসঙ্গ শুল্ক
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২৯ জুলাই চূড়ান্ত আলোচনা
নিজস্ব প্রতিবেদক

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রধান বাণিজ্য আলোচনাকারী সংস্থা ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) বাংলাদেশকে আগামী ২৯ জুলাই তৃতীয় ও চূড়ান্ত শুল্ক আলোচনায় বসার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সংবাদ সংস্থা বাসসকে এই তথ্য জানিয়েছেন বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান। তিনি জানান, এর আগে বাংলাদেশ ২২ জুলাই ইউএসটিআরের কাছে নিজেদের অবস্থানপত্র পাঠায় এবং ২৬ জুলাই চূড়ান্ত দফার আলোচনা শুরুর প্রস্তাব দেয়।
বাণিজ্যসচিব জানান, ইউএসটিআর ২৯ জুলাই দিন ধার্য করেছে।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের জন্য বিদ্যমান ৩৫ শতাংশ শুল্ক হার হ্রাস করবে। কারণ এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র জাপানের জন্য ১৫ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার জন্য ১৯ শতাংশ, ভিয়েতনামের জন্য ২০ শতাংশ এবং ফিলিপাইনের জন্য ১৯ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করেছে।
বাংলাদেশ এরই মধ্যে মার্কিন পণ্য, যেমন—তুলা, গম, তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), বিমান ও অন্যান্য কৃষিপণ্য শুল্কমুক্ত আমদানির প্রস্তাব দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়াতে বাংলাদেশ ২০ জুলাই মার্কিন গম সরবরাহকারীদের সঙ্গে সাত লাখ টন গম আমদানির চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টার কাছে সাংবাদিকরা শুল্ক আলোচনার সর্বশেষ অগ্রগতি জানতে চান। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ নিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে, এমন কোনো কাজ করা হবে না।
শুল্ক আলোচনায় বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন প্রচারণা নাকচ করে উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে আমরা কেন এমন কাজ করব? তাহলে তো আন্ত মন্ত্রণালয় মিটিংয়ের দরকার হয় না। কিছু জিনিস মেনে নিয়ে কাজটা করে ফেললেই তো হয়ে যায়। সম্পূরক শুল্কের মতো আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিষয়গুলোতে লবিইস্ট নিয়োগ করে ভালো ফল পাওয়া যায় না।’