ঢাকা, মঙ্গলবার ২২ জুলাই ২০২৫
৬ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৬ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, মঙ্গলবার ২২ জুলাই ২০২৫
৬ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৬ মহররম ১৪৪৭
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন

বিনামূল্যে ২০% অতিদরিদ্রের জন্য স্বাস্থ্যসেবার প্রস্তাব

  • প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, চিকিৎসা ব্যয়ে জোর
  • প্রত্যেক নাগরিকের জন্য ইউনিক স্বাস্থ্য আইডি ও স্মার্ট স্বাস্থ্য কার্ড
নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
বিনামূল্যে ২০% অতিদরিদ্রের জন্য স্বাস্থ্যসেবার প্রস্তাব
ড. মুহাম্মদ ইউনূস

সংবিধান সংশোধন করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ও বিনামূল্যে সেবা প্রদানের প্রস্তাব করেছে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন। এ ছাড়া পুরাতন আইন যুগোপযোগী করা, নতুন আইন প্রণয়ন ও চিকিৎসা ব্যয় কমানোর বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অতিদরিদ্র ২০ শতাংশের জন্য রয়েছে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা।

গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সংস্কার কমিশনের প্রধান জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খানের নেতৃত্বে এ প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়। 

স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। যেসব সুপারিশ এখনই বাস্তবায়নযোগ্য, তা দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ইনফরমেটিকস বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাকির হোসেন, অধ্যাপক লিয়াকত আলী, ডা. সায়েবা আক্তার, সাবেক সচিব এম এম রেজা, ডা. আজহারুল ইসলাম, ডা. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন, ডা. সৈয়দ আতিকুল হক, ডা. আহমেদ এহসানুর রাহমান এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি উমায়ের আফিফ।

পরে বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন সংস্কার কমিশনের সদস্যরা। সংবাদ সম্মেলনে ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, আমার জানা মতে, এ জনপদে স্বাস্থ্য সংস্কারের উদ্যোগ এই প্রথম। এই প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে সারা দেশের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত গ্রহণ, সরেজমিন পরিদর্শন, জনমত জরিপ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা যতই বলি স্বাস্থ্য আমার অধিকার।

কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন নেই। প্রতি তিনজনের মধ্যে দুজন রোগী সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। তবে তিনজনের মধ্যে একজন রোগী প্রয়োজনীয় সেবা না পেয়ে ফিরে যান বা উপেক্ষিত হন।

জনমত জরিপে যা জানা গেল : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে আটটি বিভাগে আট হাজার ২৫৬ জন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের মতামত নেওয়া হয়েছে। এতে ওষুধের মূল্য, রোগ নির্ণায়ক পরীক্ষার ফি নির্দিষ্ট করার পক্ষে মত দিয়েছে ৯৬ শতাংশ।

৯৭ শতাংশ জানিয়েছে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিনামূল্যে দেওয়া প্রয়োজন। ৯২ শতাংশ ওয়ার্ড ও ইউনিয়নে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরির পক্ষে মত দিয়েছে।

৭২ শতাংশ মনে করে, জনস্বাস্থ্য সেবা পৃথক অবকাঠামোর মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া উচিত। স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ের বেশির ভাগ সরকারের ওপর ন্যস্ত হওয়া উচিত বলে মনে করে ৯২ শতাংশ। স্বাস্থ্য হানিকর খাদ্য, পানীয় ও ভোগ্য পণ্যের ওপর উচ্চহারে কর প্রয়োগের বিষয়ে একমত ৭৯ শতাংশ।  স্বাস্থ্য বীমা গ্রহণে আগ্রহী ৭১ শতাংশ। 

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সংস্কার কমিশনের সদস্যরা এ পর্যন্ত ৫১টি বৈঠক করেছেন। কমিশন চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল ও ঢাকায় ৩২টি পরামর্শ সভা করেছে।

কমিশনের প্রতিপ্রাদ্য ঠিক করা হয়েছে স্বাস্থ্য সবার অধিকার। স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের সুপারিশকে সাতটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো স্বাস্থ্য সেবাদান ও ভৌত অবকাঠামো, নেতৃত্ব সুশাসন ও কর্মসংস্কৃতি, স্বাস্থ্য জনবল ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য জনবলের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধপত্র, চিকিৎসা প্রযুক্তি ও সরঞ্জামাদি সরবরাহ, স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ন ও স্বাস্থ্য তথ্যব্যবস্থা।  

সুপারিশ প্রণয়নে বিবেচনায় রাখা হয়েছে সংবিধান ও আইন, নীতি, প্রতিষ্ঠান, কর্মসূচি, সুপারিশ বাস্তবায়নে প্রস্তাবিত মেয়াদ, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে করণীয় এবং জাতীয়  প্রত্যাশা ও অঙ্গীকার।

বিদ্যমান স্বাস্থ্য ক্যাডারসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ক্যাডার এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা সব জনবল নিয়ে নতুন সিভিল সার্ভিস করার সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন। প্রস্তাবিত এই সার্ভিসের নাম হবে বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস (বিএইচএস)। শুধু তা-ই নয়, এই সার্ভিসের জন্য একজন চিকিৎসকের নেতৃত্বে স্বতন্ত্র সচিবালয় করা, নিয়োগের জন্য আলাদা পিএসসি গঠন এবং পৃথক বেতনকাঠামোরও সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।

সুপারিশে আরো যা বলা হয়েছে : দেশের ২০ শতাংশ অতিদরিদ্র হাসপাতালে বিনা মূল্যে সব ধরনের সেবা, প্রাথমিক পর্যায়ে বিনা মূল্যে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। শুরুতে ২৫ শতাংশ ওষুধ জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন করতে হবে। পাঁচ বছরের মধ্যে ১০০ শতাংশ ওষুধ জেনেরিক নামে লিখতে হবে।

ওষুধ কম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা চিকিৎসকের কাছে সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে তাদের পণ্যের প্রচার করতে পারবেন না। শুধু চিকিৎসকদের ই-মেইলে বা ডাকযোগে তাদের পণ্য সম্পর্কিত তথ্য পাঠাতে পারবেন। ক্যান্সার, ডায়বেটিসের ওষুধের ভ্যাট-ট্যাক্স মওকুফ করার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

স্বাস্থ্যসেবা গ্রহীতার  অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য একটি আধুনিক ডিজিটাল অভিযোগ নিষ্পক্তি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে হবে।  হাসপাতাল  ও ক্লিনিকে সহিংসতা রোধে মেডিক্যাল পুলিশ নামে প্রশিক্ষিত একটি বিশেষ ইউনিট গঠন, জরুরি স্বাস্থ্যসেবা  ও পরিষেবা সহায়ক নেটওয়ার্ক, প্রত্যেক নাগরিকের জন্য ইউনিক স্বাস্থ্য আইডি ও স্মার্ট স্বাস্থ্য কার্ড চালু করতে হবে। এ ছাড়া কাগজবিহীন ডিজিটাল স্বাস্থ্যব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য খাতে জাতীয় আয়ের কমপক্ষে ৫ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখার সুপারিশ এসেছে সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে।

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

জুলাই শহীদদের আত্মা আজ কষ্ট পাচ্ছে : ইশরাক

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
জুলাই শহীদদের আত্মা আজ কষ্ট পাচ্ছে : ইশরাক
ইশরাক হোসেন

বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশে এমন কোনো নির্বাচনী এলাকা নেই যে এনসিপির কেউ জয়লাভ করবে। তাই তারা পিআর পদ্ধতির নামে নির্বাচন পেছানোর চক্রান্ত করছে।

তিনি বলেন, জুলাই শহীদদের আত্মা আজ কষ্ট পাচ্ছে। কারণ শহীদরা কেউ জানত না তাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে কারো মধ্যে ক্ষমতার লোভ জাগবে।

গতকাল রবিবার রাজধানীর নয়াবাজারে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কটূক্তি, অন্তর্বর্তী সরকারের নির্লিপ্ততায় সারা দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির প্রতিবাদে এক মশাল মিছিলপূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। নয়াবাজার মোড় থেকে মশাল মিছিলটি তাঁতীবাজার, গুলিস্তান, পল্টন হয়ে নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে এসে শেষ হয়।

ইশরাক হোসেন বলেন, প্রতিটি মানুষের ব্যক্তি-বাক স্বাধীনতা আছে, তার মানে এই নয় যে আরেকজনের স্বাধীনতা হরণ করবেন, সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করবেন। এনসিপি আজকে যেভাবে শিষ্টাচারবহির্ভূত কথা বলছে, সেটিকে গণতন্ত্র বলে না।

কক্সবাজারে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ সম্পর্কে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী যে শিষ্টাচারবহির্ভূত কথা বলেছেন তার জন্য তাঁকে ক্ষমা চাইতেই হবে। নতুবা চকরিয়ার মতো সারা দেশে জনগণ তাঁদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করবে।

তিনি বলেন, আজকে দেশে কিছু হলেই এনসিপি-জামায়াত বিএনপির দিকে আঙুল তোলে। তারা ভালোভাবেই জানেদেশে নির্বাচন হলে বিএনপি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে।

তাই একেক সময় একেক অযৌক্তিক দাবি জানিয়ে নির্বাচন পেছানোর পাঁয়তারা করছে তারা।

বিএনপির এই নেতা বলেন, আজকে জুলাই শহীদদের নিয়ে ফায়দা লোটা হচ্ছে। আমি জানতে চাইজুলাই আন্দোলনে এনসিপি-জামায়াতের কতজন শহীদ হয়েছেন? এনসিপি নেতারাও ভালোভাবে জানেন, পর্দার আড়ালে এই আন্দোলন তারেক রহমান তত্ত্বাবধান করেছেন এবং বিএনপি ও ছাত্রদল-যুবদলের নেতারা মৃত্যুর অগ্রভাগে ছিলেন। আজকে ক্ষমতার লোভে তাঁরা তা বেমালুম ভুলে গেছেন। শুধু তাই নয়, তারুণ্যের অহংকার তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতেও তাঁদের বিবেক একটুও কাঁপে না।

তিনি বলেন, গোপালগঞ্জে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় বিএনপির তিনজন নিহত হলো। তখন কেন এত প্রতিবাদ হলো না, রাষ্ট্রযন্ত্র কেন নিশ্চুপ ছিল? এনসিপির সমাবেশ ঘিরে যে পাঁচটি জীবন গেল তার দায়ভার কে নেবে?

ইশরাক বলেন, মুরাদনগরে উপদেষ্টা আসিফ সজীব ভূঁইয়া কী করছেন তা সবাই অবগত। একের পর খুন হচ্ছে। হত্যা হলেই যাচাই-বাছাই না করেই বিএনপির ওপর দোষ চাপানো হয়। আর যখন দেখে এখানে নতুন একটি দলের সম্পৃক্ততা রয়েছে তখন মিডিয়াও নিশ্চুপ হয়ে যায়। মুরাদনগরে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর এখন যত নির্যাতন চলছে তা আওয়ামী লীগ আমলেও হয়নি।

মন্তব্য
অ্যামচেমের নীতি সংলাপে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

পাল্টা শুল্ক নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
পাল্টা শুল্ক নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেই

ট্রাম্পের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ১ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপিত হবে। পাল্টা শুল্ক আরোপিত হলেও এসব কথা বারবার বলে উদ্বেগ তৈরির দরকার নেই বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, সরকার যা যা করার সেটা করছে।

গতকাল রাজধানীর বনানীর শেরাটন হোটেলে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ (অ্যামচেম) আয়োজিত টেকসই বিনিয়োগ বিষয়ক এক নীতি সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন উপদেষ্টা।

সংলাপের উদ্বোধনী বক্তব্যের পর জ্বালানি, পোশাক ও তামাক খাত নিয়ে আলাদা তিনটি উপস্থাপনা তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে পোশাক খাত নিয়ে উপস্থাপনা দেন বেসরকারি রিকভারি গ্রুপের প্রধান রূপান্তর কর্মকর্তা ফাহমি মুহসিন। তামাক খাতের টেকসই বিনিয়োগ নিয়ে উপস্থাপনা দেন ফিলিপ মরিস গ্রুপের এদেশীয় ব্যবস্থাপক রেজওয়ানুর রহমান মাহমুদ এবং জ্বালানি খাতের টেকসই বিনিয়োগ নিয়ে উপস্থাপনা তুলে ধরেন শেভরন বাংলাদেশের পরিচালক ইমরুল কবির। উপস্থাপনা শেষে শুরু হয় মূল আলোচনা পর্ব।

আলোচনা শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে উপস্থিত অতিথিদের বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর দেন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পরও পোশাক খাত ধ্বংস হয়ে যাবে বলা হয়েছিল; কিন্তু সরকার ও ব্যবসায়ীরা একসঙ্গে কাজ করায় এই খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। একসঙ্গে চললে সব বাধা দূর হবে। টেকসই বিনিয়োগ প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, টেকসই বিনিয়োগের ধারণাটি বিশ্বের সব দেশের জন্য হওয়া উচিত।

কিন্তু আমরা দেখছি, যারা দূষণের জন্য বেশি দায়ী, তারা এ ধরনের বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে না। টেকসই পৃথিবী বিনির্মাণে শুধু টেকসই বিনিয়োগে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না; জীবনধারণের পদ্ধতিও টেকসই হতে হবে। ভোগপ্রবণতাও কমাতে হবে। পানি কম ব্যবহার করতে হবে।

রিজওয়ানা হাসান বলেন, দেশের বস্ত্র খাতে আমরা বেশ কিছু টেকসই বিনিয়োগ দেখতে পাচ্ছি, যেখানে কম পানি ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে।

শিল্পের ক্ষেত্রে বিনামূল্যে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। এ বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরি করছে সরকার। জ্বালানির মিশ্রণ নিয়েও আমরা কাজ করছি, যাতে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান জ্বালানিসংকটে না থাকে। সরকারি সব প্রতিষ্ঠানের ছাদে সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা উৎপাদন খাতে ৩০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করতে চাই।

আলোচনা শেষে ট্যানারিশিল্প নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এখানে যৌথ ব্যর্থতা ছিল। এই ব্যর্থতার জন্য এককভাবে কাউকে দায়ী করা যাবে না। সরকার বিনিয়োগ করেছে। আবার ব্যবসায়ীরা সক্ষমতার চাহিদা দিয়েছিল। এখন এই শিল্প নিয়ে নতুনভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

সভাপতির বক্তব্যে অ্যামচেম সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, পাল্টা শুল্ক নিয়ে ভালোভাবে আলোচনা হলে কিছু না কিছু ছাড় পাওয়া যাবে। এ ধরনের আলোচনা শুধু আমাদের সঙ্গে হচ্ছে না। বিশ্বের অনেক দেশের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমরা আমেরিকা থেকে তুলা আনার কথা বলছি। কাস্টমসের সংস্কার নিয়ে কথা বলেছি।

অ্যামচেম সভাপতি আরো বলেন, দূষণ এখন শুধু পরিবেশগত কোনো বিষয় নয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রায় ৩.৪ শতাংশ দূষণের কারণে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। তবে অনেক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশে এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরিবেশবান্ধব কারখানা রয়েছে।

সংলাপে অ্যামচেমের সদস্য প্রতিষ্ঠান রিকভার, ফিলিপ মরিস বাংলাদেশ লিমিটেড ও শেভরন বাংলাদেশ তাদের টেকসই উদ্যোগ তুলে ধরে।

মন্তব্য

বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও পিআরের নামে প্রতারণার জাল

শরীফুল আলম সুমন
শরীফুল আলম সুমন
শেয়ার
বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও পিআরের নামে প্রতারণার জাল

অনেক শিক্ষার্থীর পছন্দের তালিকায় এখন বিদেশে উচ্চশিক্ষা। আবার অনেকেই উন্নত জীবনযাপনের আশায় বিদেশে পার্লামেন্ট রেসিডেন্সি (পিআর) ও সিটিজেনশিপ পেতে চান। আর এই সুযোগই নিচ্ছে রাজধানীতে গড়ে ওঠা অনেক কনসালটেন্সি ফার্ম। তারা তাদের ওয়েবসাইটে আকর্ষণীয় নানা তথ্য তুলে ধরে।

এরপর ফেসবুকসহ নানা সামাজিক মাধ্যমে চটকদার বিজ্ঞাপন দেয়। এমনকি তাদের অফিস খুবই পরিপাটি করে সাজায়। ফলে আগ্রহী প্রার্থীদের একবার অফিসে নিতে পারলে অনেকটাই পটিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়। আর একবার একটি ধাপ শুরু করলে পরে আর বের হওয়ার সুযোগ থাকে না।
আর এভাবেই হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একাধিক কনসালটেন্সি ফার্ম।

ইউনেসকোর গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল এডুকেশন শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে শুধু ৫০ থেকে ৬০ হাজার শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমান। তাঁদের বেশির ভাগই বিভিন্ন কনসালটেন্সি ফার্মের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপ্রক্রিয়া ও ভিসা প্রসেসিং সম্পন্ন করে। বিনিময়ে ফার্মগুলো ক্ষেত্রভেদে একেকজনের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে।

সূত্র জানায়, সারা দেশে নামে-বেনামে দুই হাজারের মতো কনসালটেন্সি ফার্ম গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই রাজধানীতে। তবে তাদের অনেকেই কিছুদিন পর পর অফিস পরিবর্তন করে। সরকারের মনিটরিং না থাকায় ভয়ংকর প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করেছে কয়েকটি চক্র। আর তাদের ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও তাঁর পরিবার।

ওয়েবসাইটে অনেকটা চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে আগ্রহী প্রার্থীদের আকর্ষিত করছে এডুএইড নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখা যায়, তারা অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডে স্কিলড মাইগ্রেশন প্রোগ্রামে কনসালটেন্সি করে। সিটিজেনশিপ ও পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে দেয় তার্কি, ভানুয়াতু এবং অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডায়। আর রেসিডেন্সির ব্যবস্থা করে হাঙ্গেরি, লাটভিয়া, ইউএই ও সৌদি অ্যারাবিয়ায়। আর বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য তাদের আছে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইউকে, ইউএসএ, আয়ারল্যান্ড ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। এ ছাড়া তারা বিভিন্ন দেশে স্কুলিং ভিসার মাধ্যমে পরিবারকে বিদেশে পিআরের ব্যবস্থা করে দেয়। এ ছাড়া তারা ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিনিয়িত আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। বিভিন্ন সেমিনার ও মেলারও আয়োজন করছে। তাদের গুলশান-১, ধানমণ্ডিসহ দেশের বাইরে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার অফিসের ঠিকানা দেওয়া আছে।

গত মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) বিকেলে পরিচয় গোপন করে এই প্রতিবেদক এডুএইডের গুলশান অফিসে যান। সেখানে প্রথমে রিসেপশনে জানতে চাওয়া হয়, আপনি হায়ার এডুকেশন, স্কিলড মাইগ্রেশন, পিআর, না সিটিজেনশন কোন ব্যাপারে আলোচনা করতে চান। স্কিলড মাইগ্রেশন ও পিআরের কথা বললে একজন কনসালট্যান্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি বিভিন্ন দেশের স্কিলড মাইগ্রেশনের কথা বলেন। একজনের জন্য তাঁরা আট লাখ টাকা ফি নেন। এর সঙ্গে স্ত্রী যুক্ত হলে ১০ লাখ, আবার একজন সন্তান যুক্ত হলে ১১ লাখ টাকা নেন বলে জানান। এই ফি তাঁরা স্টেজ বাই স্টেজ নেন। তৃতীয় স্টেজ পর্যন্ত গেলে আর ফির টাকা ফেরত দেওয়া হয় না বলে জানান।

এরপর পিআর ও সিটিজেনশিপের জন্য এডুএইডের আরেকজন কনসালট্যান্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি জানান, বর্তমানে জাপানে পিআর খুবই ইজি। এ জন্য প্রথমে একবার ওখানে গিয়ে একটি অ্যাকাউন্ট করে ৩৫ হাজার ডলার জমা রাখতে হয়। তাঁরা তৃতীয় কোনো দেশ থেকে ওই অর্থ ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করে দেবেন। আর তাঁদের ফি একজনের জন্য আট থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত দেওয়া লাগতে পারে। আর তুরস্কে পিআরের জন্য পাঁচ কোটি টাকার ইনভেস্টমেন্ট লাগবে। সেটিও তাঁরা তৃতীয় দেশ থেকে ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করে দেন। এরপর তাঁরা তুরস্কের পাসপোর্টেরও ব্যবস্থা করে দেবেন। তবে তাঁদের কত টাকা ফি দিতে হবে, সেটি আলোচনা সাপেক্ষে বলে জানান।

তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিদেশে উচ্চশিক্ষার আবেদনের তৃতীয় স্টেজ খুবই সাধারণ ধাপ। অর্থাৎ অনেকটা প্রাথমিক আবেদনের মতো। সেখানে সহজেই যাওয়া যায়। ফলে যাঁরা ফি দেন, তাঁদের ভিসা না হলেও তা আর ফেরত পান না। আর এডুএইড ইউএই, সৌদি আরব, তার্কি, লাটভিয়া, ক্যারিবিয়ানসহ অন্য বেশ কিছু দেশে যে পিআরের কথা বলছে, তা এখন অনেকটাই বন্ধ। আবার তারা তৃতীয় দেশের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে মানি লন্ডারিংয়ের মতো অপরাধ করছে। 

জানা যায়, চটকদার প্রচারণার মাধ্যমে অসাধু এজেন্সিগুলো প্রধানত তিন ধরনের প্রতারণা করে থাকে। এক. শিক্ষার্থীদের টাকা আত্মসাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপ্রক্রিয়া অসম্পন্ন রাখা ও বিদেশে না পাঠানো। দুই. আগ্রহী প্রার্থীদর ভুয়া কাগজ তৈরি করে টাকা আত্মসাৎ করা। তিন. ভিসা করে বাইরে পাঠিয়ে প্রতিশ্রুত সুযোগ-সুবিধা না দেওয়া। উচ্চশিক্ষা গ্রহণে দেশের বাইরে গমনেচ্ছু শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতারকচক্রগুলো এখন লাগামহীন। এটিকে মানবপাচার ও মানি লন্ডারিংয়ের নতুন ক্ষেত্র বলছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী।

সূত্র জানায়, কনসালটেন্সি ফার্মগুলোর কর্মকাণ্ড তদারকির কোনো ব্যবস্থা সরকারের নেই। কেবল পরামর্শক হিসেবে একটি ট্রেড লাইসেন্স বা কম্পানি করেই প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। ফলে বিপুল অঙ্কের টাকা লোপাট করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন ফার্মসংশ্লিষ্ট প্রতারকরা। মামলা বা অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। তবে আটক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বেশির ভাগ মামলা হয় ৪২০ ধারায়। ফলে আসামিদের বেশির ভাগ জামিনে বের হয়ে যায়।

বিদেশে ভর্তির নামে স্টুডেন্ট কনসালটেন্সি করা এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ফরেন অ্যাডমিশন অ্যান্ড ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ফ্যাডক্যাব)-এর সদস্যসংখ্যা চার শর মতো। অথচ রাজধানীর ফার্মগেট, পল্টন, মতিঝিল, ফকিরাপুল, কাকরাইল, উত্তরা, গুলশান, মহাখালীসহ সারা দেশে এই সংখ্যা দুই হাজারের মতো।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর কালের কণ্ঠকে বলেন, বিভিন্ন কন্সালটেন্সি ফার্মের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার যাঁরা হন, তাঁদের অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা তদন্তসাপেক্ষ অভিযান পরিচালনা করে প্রতারকদের আইনের আওতায় এনে থাকি। এ ছাড়া আমাদের নিজস্ব কিছু নজরদারি থাকে। এতে যদি কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি প্রতারণা করে এমন পাওয়া যায়, তাদের সুনির্দিষ্ট আইনের আওতায় আনা হয়।

সম্প্রতি অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এ রকম তিনজনের প্রতারিত হওয়ার কথা জানিয়েছে। উত্তরার ট্রাভেলার এজ বিডি নামের একটি প্রতিষ্ঠান সাব্বির হোসেন (২১), শামীমুল হক ও আমিনুল ইসলাম নামের তিনজনকে পড়াশোনার জন্য কানাডায় পাঠানোর কথা বলে যথাক্রমে ২০ লাখ, ১৫ লাখ ও ১৭ লাখ টাকা নেয়। এরপর তাঁদের কানাডায় না পাঠিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় পাঠানো হয়। সেখানে শুরু হয় তাঁদের মানবেতর জীবন। ভিসার মেয়াদ শেষ হলে ইন্দোনেশিয়া পুলিশ তাঁদের আটক করে এবং ১৭ দিন তাঁরা জেলহাজতে থাকেন।

বিদেশে উচ্চশিক্ষার নামে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান এম কে খায়রুল বাশারকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি।

সিআইডির প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত খায়রুল বাশার তাঁর স্ত্রী খন্দকার সেলিমা রওশনকে সঙ্গে নিয়ে একটি সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র গড়ে তোলেন। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ, স্কলারশিপ ও ভিসা প্রক্রিয়ার প্রলোভন দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আদায় করে তারা। প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞাপনে চটকদার প্রতিশ্রুতি থাকলেও বহু শিক্ষার্থীর নামে কোনো বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনই করা হয়নি। ভুয়া অফার লেটার তৈরি করে তারা নিজেরাই টাকা আত্মসাৎ করেছে। আবার অনেককে পাঠাতে পারলেও তাঁরা বিদেশে গিয়েও নানাভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৪৪৮ জন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী তাঁদের প্রতারিত হওয়ার অভিযোগ জমা দিয়েছেন।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী রুমন আলী লস্কর বলেন, বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, স্কলারশিপ ও ভিসার নামে আমাদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ আদায় করে। আমার মতো ভুক্তভোগীর সংখ্যা এক হাজারের বেশি। গড়ে প্রত্যেকের ২০ লাখ টাকা করে হিসাব করলে অন্তত ২০০ কোটি টাকার প্রতারণা করা হয়েছে।

মন্তব্য
ফিরে দেখা ২১ জুলাই ২৪

কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল সংঘর্ষে সারা দেশে আরো ১৯ জন নিহত

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল সংঘর্ষে সারা দেশে আরো ১৯ জন নিহত

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় ২০২৪ সালের ১ জুলাই। শুরুতে অহিংস থাকলেও ১৫ জুলাই থেকে এই আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়। ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদসহ ছয়জন নিহত হন। নজিরবিহীন সহিংসতা ও সংঘর্ষে পরের মাত্র চার দিনে (২০ জুলাই পর্যন্ত) নিহতের এই সংখ্যা দাঁড়ায় দেড় শর কাছাকাছি।

দেশজুড়ে কারফিউ জারি করেও থামানো যাচ্ছিল না মৃত্যুর মিছিল।

এমন পরিস্থিতিতে গত বছরের ২১ জুলাই প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৯৩ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে এবং ৭ শতাংশ কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে সরকারকে নির্দেশ দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সাত শতাংশ কোটার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়।

তবে আগের দিনের মতো গত বছর ২১ জুলাইও কারফিউয়ের মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সংঘর্ষ হয়।

সংঘর্ষে ঢাকাসহ সারা দেশে এদিন ১৯ জন নিহত হন। এর মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১০ জন, নরসিংদীতে চার, গাজীপুরে দুই, নারায়ণগঞ্জে এক, সাভারে এক ও চট্টগ্রামে একজনের মৃত্যুর খবর জানায় গণমাধ্যমগুলো। 

 

অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় ঝরেছে অনেক প্রাণ

২০১৮ সালে ৫৬ শতাংশ কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হাইকোর্টের রায় বাতিল করে ২০২৪ সালের ২১ জুলাই রায় দেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। তবে নির্ধারিত কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সংশ্লিষ্ট কোটার শূন্য পদে সাধারণ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করতে হবে।

এই নির্দেশনার আলোকে সরকারের নির্বাহী বিভাগকে অবিলম্বে গেজেট জারির নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে এই নির্দেশনার পরও সরকার প্রয়োজনে আদালত নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে বলে উল্লেখ করা হয় রায়ে।

 

শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া

কোটা ইস্যুতে আপিল বিভাগের রায়কে স্বাগত জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। রায়ের পর এক প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম জানান, আপিল বিভাগের রায়কে শিক্ষার্থীরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত হিসেবে দেখছেন তাঁরা।

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) তথ্য অনুযায়ী, রায়ের পর শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তবে চার দফা দাবি পূরণে আন্দোলনের সমন্বয়করা ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন। চার দফা দাবির মধ্যে ছিলকারফিউ তুলে দেওয়া, ইন্টারনেট চালু করা, বিশ্ববিদ্যালয় ও আবাসিক হল খুলে দেওয়া এবং আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

এ ছাড়া আন্দোলনে সংঘটিত গত্যাকাণ্ডের বিচারসহ আট দফা দাবি দ্রুত বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে সরকারকে আহবান জানানো হয়। সেই সঙ্গে পরদিন ২২ জুলাই গায়েবানা জানাজা কর্মসূচির ঘোষণাও দেন শিক্ষার্থীরা।

তবে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ। তাদের মতে, ভবিষ্যতে কোটার পরিমাণ নিয়ে সরকারের যথেচ্ছ ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। তারা এক সপ্তাহের মধ্যে সংসদের জরুরি অধিবেশন ডেকে স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে এ সংক্রান্ত আইন পাস করার দাবি জানায়।

 

রাজধানীসহ সারা দেশের পরিস্থিতি

এদিন ভোরে রাজধানীর পূর্বাচল এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে পাওয়া যায়। পরে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর আগে ১৯ জুলাই দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে রাজধানীর নন্দীপাড়ার এক বন্ধুর বাসা থেকে নাহিদ ইসলামকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ করে তার পরিবার।

২১ জুলাই ছিল সরকারঘোষিত দুই দিন সাধারণ ছুটির প্রথম দিন। এদিনও সারা দেশ ছিল ইন্টারনেটবিহীন, বলবৎ ছিল কারফিউ। জরুরি পরিষেবা রোগীবাহী অ্যাম্বুল্যান্স, গণমাধ্যমের গাড়ি এবং আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ গন্তব্যের যাত্রীরা টিকিট দেখিয়ে যাতায়াতের সুযোগ পায়।

তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জানান, পরের দিনও দেশে কারফিউ বলবৎ থাকবে। দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকবে। ঢাকা জেলা ও মহানগর, গাজীপুর জেলা ও মহানগর এবং নারায়ণগঞ্জে কারফিউয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অন্য জেলাগুলোতে জেলা প্রশাসকরা পরিস্থিতি বিবেচনা করে কারফিউয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন। দু-এক দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

কারফিউয়ের মধ্যেও এদিন রাজধানীর বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, কুড়িল ও মিরপুর এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। যাত্রাবাড়ী এলাকার বিভিন্ন সড়কে জড়ো হয় বিক্ষোভকারীরা। সংঘর্ষ বাধলে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট ছোড়ে। এতে আহত হয় শতাধিক ব্যক্তি।

দুপুরে রাজধানীর কুড়িল চৌরাস্তা ও নর্দা সড়ক অবরোধ করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে হেলিকপ্টার থেকে সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়।

মিরপুরে বিক্ষোভকারীরা মেট্রো রেলের কাজে ব্যবহৃত তিনটি গাড়ি ভাঙচুর করে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে রামপুরা ও বাড্ডা এলাকায়ও।

রাজধানীর খিলগাঁও, মালিবাগ ও চৌধুরীপাড়া এলাকা ছিল থমথমে। আগের দিনের তুলনায় এসব এলাকার সড়ক ও অলিগলিতে মানুষ ও যানবাহনের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়ভাবে কম।

তবে বিকেল ৩টায় দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে সড়ক ও অলিগলিতে মানুষ ও রিকশার উপস্থিতি ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে।

এদিন রাজধানীর বাইরে বড় ধরনের সংঘর্ষ হয় নরসিংদীতে। দুপুরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ বাধলে চারজন নিহত হন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে কয়েক শ আন্দোলনকারী আহত হন। এদিন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১৯ গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।

বাসস বলছে, রাজধানীর সেতু ভবন ভাঙচুর, রামপুরার বিটিভি ভবনে আগুন দেওয়া ও বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগের ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন মামলায় এদিন বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, নিপুণ রায় ও গণ-অধিকার পরিষদের নেতা নুরুল হক নুরকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।

এদিন এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) পক্ষ থেকে বলা হয়, ৩১ জুলাই পর্যন্ত পিএসসির সব ধরনের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।

 

বিদেশি কূটনীতিকদের সরকারের ব্রিফিং, আন্দোলন ছিনিয়ে নিয়েছে বিএনপি ও জামায়াত-শিবির

এদিন রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বিদেশি কূটনীতিকদের চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিফিংকালে সরকারের পক্ষে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, কোটা বাতিল ও সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিনিয়ে নিয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে পুঁজি করে স্বাধীনতাবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী ও ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী সামপ্রতিক সহিংসতা চালিয়েছে। ব্রিফিংয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে স্বাধীনতাবিরোধী ও উগ্রবাদী গোষ্ঠীর সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞের একটি ভিডিও দেখানো হয়।

 

দেশের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক

২১ জুলাই রাতে দেশের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে সামরিক-বেসামরিক শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার উপস্থিত ছিলেন।

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ