ঢাকা, রবিবার ২৭ জুলাই ২০২৫
১২ শ্রাবণ ১৪৩২, ০১ সফর ১৪৪৭

ঢাকা, রবিবার ২৭ জুলাই ২০২৫
১২ শ্রাবণ ১৪৩২, ০১ সফর ১৪৪৭

বিতর্কিত ইকবালের নিয়ন্ত্রণে এনআরবি ব্যাংক!

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
বিতর্কিত ইকবালের নিয়ন্ত্রণে এনআরবি ব্যাংক!
ইকবাল আহমদ

পণ্য রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচার এবং পাচারকৃত অর্থে যুক্তরাজ্যে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার অভিযোগ রয়েছে ইকবাল আহমেদ ওবিইর বিরুদ্ধে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শেখ হাসিনা-রেহানার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচিত ছিলেন এই বিতর্কিত ব্যবসায়ী। শেখ হাসিনার ছত্রচ্ছায়ায় রাজনৈতিক বিবেচনায় গড়ে তোলেন এনআরবি ব্যাংক। দুর্নীতির দায়ে ২০১৫ সালে ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি থেকে আজীবন বহিষ্কৃত হয়েছিলেন তিনি।

সব কাজের কাজি সেই ইকবাল আহমেদকে পরিচালনা পর্ষদে রেখে পর্ষদ গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংকটির ভবিষ্যত্ নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে।

জানা যায়, চতুর্থ প্রজন্মের এনআরবি ব্যাংকে সুশাসন ফেরাতে আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে পর্ষদ গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পরিচালক করা হয়েছে সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল আহমেদ ওবিইকে।

এ ছাড়া স্বতন্ত্র পরিচালক করা হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য ফেরদৌস আরা বেগম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শেখ মো. সেলিম, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক এমডি কামরুল ইসলাম চৌধুরী, প্রাইম ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি শেখ মতিউর রহমান, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শরীফ নুরুল আহকাম ও হিসাববিদ মিজানুর রহমানকে।

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের মতো জুলাই বিপ্লবে পাওয়া নতুন বাংলাদেশে ফের এই ইকবালদের মাধ্যমে লুটপাট হোক, তা চাইছেন না ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের লুটপাটের সহযোগী, হিমায়িত মাছ ব্যবসার আড়ালে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে যাওয়া ইকবালকে কেন ব্যাংকের শীর্ষ পদে বসানো হলো? তাঁর ক্ষমতার উৎস কী?

তাঁদের দাবি, অতি দ্রুত ইকবাল আহমেদ এবং তাঁর দুই ভাই কামাল আহমেদ ও বিলাল আহমেদের সম্পদের উৎস খুঁজে বের করে তাঁদের আইনের আওতায় আনা জরুরি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ইকবাল আহমেদ, কামাল আহমেদ ও বিলাল আহমেদ তিন ভাই এবং তাঁরা এনআরবি ব্যাংকের উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার।

১৭ মার্চ ২০২৫ শেষে তাঁরা যথাক্রমে ৩.৮০ শতাংশ, ১.৫১ শতাংশ ও ২.১৩ শতাংশ শেয়ারের অংশীদার। এ ছাড়া সিমার্ক (বিডি) লিমিটেড, আইবিসিও লিমিটেড, আইবিসিও এন্টারপ্রাইজ, আইবিসিও ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ম্যানরু ইন্টারন্যাশনাল ও ম্যানরু শপিং সিটিতেও তাঁদের যৌথ বিনিয়োগ রয়েছে। অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, যুক্তরাজ্যে একাধিক কম্পানি রয়েছে তাঁদের। এর মধ্যে রয়েছে সিমার্ক পিএলসি, আইবিসিও হোল্ডিংস, এমএআই ইনভেস্টমেন্ট হোল্ডিংস, ভার্মিলিয়ন গ্রুপ লিমিটেড, ফ্লাইং ইউনিকর্ন, ওপেনশ হোল্ডিংস লিমিটেড, আইবিসিও লিমিটেড, ইউকেবিসিসিআই, ইউকে বাংলাদেশ ক্যাটালিস্টস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং নিউ ইস্ট ম্যানচেস্টার লিমিটেড। এই কম্পানিগুলো মূলত রিয়েল এস্টেট, বিনিয়োগ ও আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত।
শেখ রেহানাসহ শেখ পরিবারের অন্য সদস্যদের নামেও এই কম্পানিগুলোতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করা হয়েছে। এ ছাড়া লন্ডন-ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক সম্পদের মালিকানা গড়ে তুলেছেন। শুধু লন্ডনেই তাঁর প্রায় দুই ডজন বাড়ি ও অত্যাধুনিক প্রপার্টি রয়েছে।

সূত্র জানায়, বিগত এক দশক ধরে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে নিজের অবস্থান গড়ে তোলেন ইকবাল। তাঁর ফেসবুক প্রফাইলজুড়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে অসংখ্য ছবি শেয়ার করা হতো, যা তাঁকে হাসিনা বিশ্বস্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। যদিও ৫ আগস্টে হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ফেসবুক থেকে ছবিগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

সূত্র আরো জানায়, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার শীর্ষ ২০ জন অর্থদাতার মধ্যে ওবিইও একজন। পতিত সরকারের আমলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সিমার্ক গ্রুপের আড়ালে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের অর্থপাচারের ক্যারিয়ার (বাহক) হিসেবেও কাজ করতেন ওবিই। ইকবাল সিমার্ক গ্রুপের প্রধান ব্যবসা হলো মাছ রপ্তানি। মাছের আড়ালে তিনি বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস ও সোনা চোরাচালান করতেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ভাড়া চুক্তির অতিরিক্ত অর্থ ব্যাংক থেকে গ্রহণ করায় গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ইকবাল আহমেদ, কামাল আহমেদ ও বিলাল আহমেদতিন ভাইকে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছে এনআরবি ব্যাংক। লিগ্যাল নোটিশে বলা হয়, নোটিশ পাওয়ার পর অতিদ্রুত অতিরিক্ত ভাড়া বাবদ ব্যাংক থেকে নেওয়া চার কোটি ৫১ লাখ টাকা ফেরত দিতে হবে। না দিলে ফৌজদারি আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে নোটিশদাতা ব্যারিস্টার হেলাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, আইনি নোটিশ দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত বিবাদীপক্ষ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

ইকবাল আহমেদ ক্ষমতার জোরে করেছেন নানা অভাবনীয় কাণ্ডও। ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সে অনিয়ম করে গায়েব করেন দুই লাখ পাউন্ড। এরপর ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের নেতারা ইকবাল আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা করলে তিনি মামলায় হেরে যান। দেশটির আদালত ইকবাল আহমেদকে পাঁচ লাখ পাউন্ড জরিমানা করেন এবং চেম্বার অব কমার্স থেকে আজীবন বহিষ্কার করেন। এর আগে ব্রিটেনের কনজারভেটিভ পার্টির গোপন অর্থদাতা ওবিই দলটিকে ১২ হাজার পাউন্ড ডোনেশন দেওয়ার পর খরচ ফেরতের দাবি করে বিতর্কিত হয়েছেন।

ডেইলি মেইলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই দাতা তাঁর বিলাসবহুল জীবনযাত্রার জন্য পার্টির তহবিল ব্যবহারের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। তাঁর এই আচরণ নিয়ে ব্রিটিশ রাজনীতিতে সমালোচনার ঝড় উঠেছে, যেখানে জনগণের করের টাকা দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তীব্র হয়েছিল।

এই ঘটনা ঘিরে দলটির অভ্যন্তরীণ আর্থিক নীতিমালা ও নৈতিকতা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। স্থানীয় গণমাধ্যম ও সুধীসমাজের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থায়নে কঠোর নিয়মকানুন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছিল।

এদিকে ওবিইর অর্থপাচারের অভিযোগ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ফিন্যানশিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের সাম্প্রতিক রিপোর্টে বাংলাদেশকে ধূসর তালিকা থেকে মুক্ত করতে ওবিইর কেলেঙ্কারি দ্রুত বিচারাধীন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অর্থপাচার ও ব্যাংকের অর্থ লুটে কারো বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে, সে ক্ষেত্রে এমন ব্যক্তিকে পুনারায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান করা হলে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই তদন্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার চলছে। বিতর্কিত ব্যক্তিকে ব্যাংকের শীর্ষ পদে দিয়ে ব্যাংকটির সংস্কার সম্ভব হবে না।

তবে অভিযোগ প্রসঙ্গে ইকবাল আহমদ ওবিইর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ে এনআরবি ব্যাংকের সচিব রেজাউল করিমকে ফোন দেওয়া হলে তিনি জনসংযোগ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। জনসংযোগ বিভাগের প্রধান সালাউদ্দিন মুরাদকে ফোন দেওয়া হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

এনবিআর চেয়ারম্যান

করব্যবস্থায় বড় বাধা দুর্নীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
করব্যবস্থায় বড় বাধা দুর্নীতি
আবদুর রহমান খান

দেশের করব্যবস্থায় বড় বাধা দুর্নীতি বলে মনে করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান। তিনি বলেন, প্রকৃত মূল্যে পণ্য আমদানি-রপ্তানি না হলে কমপ্লায়েন্ট প্রতিষ্ঠান ও প্রকৃত করদাতারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। জবাবদিহি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই করব্যবস্থায় দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব।

গতকাল শনিবার রাজধানীর এফডিসিতে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি আয়োজিত করব্যবস্থাপনায় সংস্কার নিয়ে আয়োজিত ছায়া সংসদে তিনি এসব কথা বলেন।

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, আমদানি-রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং-ওভার ইনভয়েসিং নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা আমাদের সমন্বিত ব্যর্থতা। বর্তমান যুগে পণ্যের দাম পৃথিবীর কোন প্রান্তে কত, তা বোতাম টিপলেই জানা যায়। ঋণপত্র খোলার সময় ব্যাংক ও কাস্টমস পরীক্ষা ও যাচাইয়ের মাধ্যমে দাম নিশ্চিত হতে পারে।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে করব্যবস্থাপনায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা কঠিন।

বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার কারণেই কর প্রশাসনে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত সহজ হচ্ছে। কর আদায়ের চেয়ে বেশি কর অব্যাহতি দেওয়া হয়। এই আইনগুলো সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে সরকার চাইলেই আর অব্যাহতি দিতে পারবে না।
শুধু সংসদ অর্থবিলের মাধ্যমে কর অব্যাহতি দিতে পারবে। এ ছাড়া দেশের সর্বস্তরে কর শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, সবার প্রচেষ্টা থাকলে করনীতি ও করব্যবস্থাপনা দুই ভাগে বিভক্ত করলে সুফল পাওয়া যাবে। তবে এই সংস্কারে প্রশাসন ক্যাডারের আধিপত্য বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন আয়কর ও কাস্টমস কর্মকর্তারা। সংস্কারের ফলে রাজস্ব খাতের কর্মকর্তারা পদোন্নতি ও পদমর্যাদায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে বৈষম্য তৈরি হবে।

রাজস্ব প্রশাসনে অতিরিক্ত শাস্তিমূলক পদক্ষেপ ও প্রশাসনিক ভয় বিভাগীয় কার্যক্রমে হতাশা তৈরি করতে পারে। এতে দায়িত্ব পালনে অনীহা বাড়বে। ফলে কর আদায় ব্যাহত হয়ে রাজস্ব আদায় কমতে পারে।

রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিতে সাতটি সুপারিশ করেছে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি। এর মধ্যে রয়েছে করজাল বাড়িয়ে আদায় সহজ করা ও পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন, প্রস্তাবিত রাজস্ব সংস্কার বিষয়ে সবাইকে স্পষ্ট ধারণা দেওয়া, আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের যাতে উচ্চতর পদে যেতে বাধা তৈরি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা, কেইস টু কেইস ভিত্তিতে কর অব্যাহতির সুযোগ বন্ধ করা, শুল্ক ফাঁকি বন্ধে প্রকৃত মূল্যে আমদানি নিশ্চিত করা, করভীতি দূর করে করবান্ধব পরিবেশ তৈরি ও করের টাকার সঠিক ব্যবহার করা।

ছায়া সংসদে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিক্যাল কলেজের বিতার্কিকদের হারিয়ে গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের বিতার্কিকরা জয়ী হয়। প্রতিযোগিতা শেষে অংশগ্রহণকারী দলকে ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র দেওয়া হয়।

মন্তব্য

নির্বাচনে অস্ত্রের চেয়েও হুমকি এআই : সিইসি

খুলনা অফিস
খুলনা অফিস
শেয়ার
নির্বাচনে অস্ত্রের চেয়েও হুমকি এআই : সিইসি

প্রধান নির্বাচন কমিশনার- সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-এআই অস্ত্রের চেয়েও ভয়াবহ হুমকি হতে পারে।  গতকাল শনিবার সকালে খুলনার আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আয়োজিত মতবিনিময়সভার আগে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এটি একটি আধুনিক হুমকি। যেকোনো কিছু দেখলেই তাই শেয়ার করা ঠিক নয়।

একটু যাচাই-বাছাই করে শেয়ার করা উচিত। অপপ্রচার থেকে নির্বাচনব্যবস্থাকে যথাসম্ভব নিরাপদ রাখার জন্য মিডিয়ার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সোশ্যাল মিডিয়াতে যে ভুল তথ্য দেওয়া হয়, সে ব্যাপারে আপনাদের সহায়তা প্রয়োজন।

সিইসি বলেন, আগামী নির্বাচনে ভোটারদের আস্থা, তাঁদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসা, সামাজিক মাধ্যম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে অপতথ্যের প্রচার বন্ধ করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত অপতথ্য-মিস ইনফরমেশন, ম্যাল ইনফরমেশন ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যা দ্রুত সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে এইআই প্রযুক্তির মাধ্যমে হুবহু ভিউিও-ভয়েস তৈরি করা হচ্ছে। এইআই প্রযুক্তি এখন অস্ত্রের চেয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। মডার্ন যুগে মডার্ন থ্রেট বহুবিধ ও নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে আমরা এগোচ্ছি।
এই ধরনের অপপ্রবাহের কারণে ইউরোপের একটি দেশে ভোট স্থগিত করারও ঘটনা ঘটেছে, যা নির্বাচন কমিশনকে ভাবাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করা হবে।

তিনি বলেন, রাতের আঁধারে কোনো কার্যক্রম নয়, দিনের আলোতেই সবকিছু করতে চাই, যাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়। আমরা জাতিকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে চাই। তা না করতে পারলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন উঠবে।

সবার সহযোগিতায় আমরা জাতিকে একটি ভালো নির্বাচন উপহার দিতে চাই, এটা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

তিনি বলেন, আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করতে পারি, গণ-অভ্যুত্থান করতে পারি, তাহলে একটি স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারব না কেন? জীবন যদি ফজর থেকে মাগরিব হয়, তাহলে আমি আমার জীবনের আসর পর্যন্ত এসে গেছি। তাই এমন কিছু করব না, যা আমাকে কলঙ্কিত করবে। ব্যক্তিগত লক্ষ্য বা স্বার্থ নয়, বরং দেশের জন্য একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করে যেতে চাই। তবে এটি শুধু আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়, এ জন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হলে আপনারা জানতে পারবেন কবে নির্বাচন হবে, তার আগে বলা সম্ভব নয়। এ ছাড়া যখন নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হবে তখন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নির্বাচন কমিশনের অধীনে আসবে। 

তিনি বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের কথা আমরা বলিনি, প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন দপ্তরকে বলেছেন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে।

সিইসি বলেন, আমরা কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নেই, আমরা একটি ইন্টেরিম সরকারের অধীনে আছি, তাই আমাদের দলীয় কোনো চাপ নেই। একটি সুন্দর, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতিকে উপহার দেওয়ার জন্য আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি চলছে। বিদ্যমান আইন না বদলানো পর্যন্ত আগের নিয়মেই নির্বাচন হবে।

সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ফয়সাল কাদের, জেলা সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা বেনজির আহমেদ ফরাজীসহ নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বিকেলে নগরের সার্কিট হাউস মিলনায়তনে খুলনা বিভাগের প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মতবিনিময় করেন।

 

মন্তব্য
ফিরে দেখা ২৭ জুলাই ’২৪

আরো ২ সমন্বয়ক ডিবি হেফাজতে শিক্ষার্থীদের আলটিমেটাম

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
আরো ২ সমন্বয়ক ডিবি হেফাজতে শিক্ষার্থীদের আলটিমেটাম

কোটা সংস্কার আন্দোলনে গত বছর ২৭ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরো দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে হেফাজতে নেয় ডিবি। পরে রাতে ডিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দিতে ও সে সময়ের বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে তথ্য জানতে দুই সমন্বয়ককে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।

এদিকে আদালতের রায়ের ভিত্তিতে কোটা সংস্কার করে সরকারের জারি করা প্রজ্ঞাপনকে প্রত্যাখ্যান করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এদিন রাতে অনলাইনে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন তিন দফা দাবিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন আন্দোলনকারীরা।

কয়েকজন সমন্বয়ক জানান, পুলিশের গ্রেপ্তার, ধরপাকড়সহ নানা কারণে সব সমন্বয়কের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারায় সমন্বিতভাবে কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারছেন না তাঁরা। সংবাদ সম্মেলন থেকে সাম্প্রতিক কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতায় ২৬৬ জন নিহত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়। এ ছাড়া ছাত্রদের নামে করা মামলাগুলো মিথ্যা বলে উল্লেখ করা হয়।

আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মাহিন সরকার বলেন, আন্দোলনের মূল দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে বলে প্রচার করছে সরকার।

কিন্তু আমাদের দাবি ছিল কমিশন গঠন করে এই সংকটের সমাধান করা। সেটি করা হয়নি বলে আমরা এই পরিপত্র প্রত্যাখ্যান করছি।

সংবাদ সম্মেলনে সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, রবিবারের (২৮ জুলাই) মধ্যে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদসহ আটক সব শিক্ষার্থীকে মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার  এবং শিক্ষার্থী গণহত্যার সঙ্গে জড়িত মন্ত্রী পর্যায় থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত সব দোষীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিন দফা দাবি মানা না হলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আরো কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে।

সংবাদ সম্মেলনে পরদিন ২৮ জুলাই সারা দেশের দেয়ালে গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখন কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।

এদিন বিকেলে তিন সমন্বয়কের (নাহিদ, আসিফ ও আবু বাকের) খোঁজ নিতে রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেটওয়ার্কের একটি প্রতিনিধিদল। তারা সেখানে ১৫ থেকে ২০ মিনিট অপেক্ষা করলেও ডিবিপ্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানান।

পরে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে ডিবি কার্যালয়ের ফটকে কথা বলেন শিক্ষকরা। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিন সমন্বয়কের নিরাপত্তা শঙ্কা থাকলে কেন তাঁদের পরিবারের কাছে না দিয়ে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হলোএ প্রশ্ন তোলেন শিক্ষকরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা, নিরাপত্তাসহ সব বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন। ডিবি শিক্ষার্থীদের তো আমাদের জিম্মায়ও দিতে পারত। কিন্তু তিনি (হারুন) তো আমাদের সঙ্গে দেখাই করলেন না।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক মো. সাইমুম রেজা তালুকদার বলেন, একজন মানুষের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হলো পরিবার। যদি তাঁদের নিরাপত্তা দিতেই হবে, তাহলে তাঁদের বাসার আশপাশে নিরাপত্তা দেওয়া হোক, তাঁদের পরিবারের নিরাপত্তা দেওয়া হোক।

এদিন সকালে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় আহতদের দেখতে রাজধানীর শেরেবাংলানগরের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সম্পূর্ণরূপে পঙ্গু করে দেশকে আবার ভিক্ষুকের দেশে পরিণত করতে দেশব্যাপী ধ্বংসাত্মক তাণ্ডবলীলা চালানো হয়েছিল। দেশের মানুষকেই এই সহিংসতার বিচার করতে হবে।

এদিন এক অনুষ্ঠানে তৎকালীন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ঢাকায় সহিংসতার আগে এক লাখ সিম ব্যবহারকারী হঠাৎ নতুন করে রাজধানীতে প্রবেশ করেছিল। তাদের অবস্থানকালেই ১৮ থেকে ২১ জুলাই সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে।

সরকারের পক্ষ থেকে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়নি দাবি করে পলক বলেন, ঢাকা বিভাগের ১৭টি জায়গায় হামলা হয়েছে। মহাখালীতে তিনটি ডাটা সেন্টারে ১৮টি আইআইজি (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে) সিস্টেম রয়েছে। সেখানে থাকা আইএসপির (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডার) ৭০ শতাংশ সার্ভার থাকে। তাই ইন্টারনেট একা একাই বন্ধ হয়েছে। আমরা বন্ধ করিনি।

এদিন কারফিউয়ের অষ্টম দিনে জীবনযাত্রা ছিল অনেকটা স্বাভাবিক। রাজধানীসহ যান চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে দেশের জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোতে। এদিন ট্রেন চলাচল শুরু না হলেও দূরপাল্লার লঞ্চ চলাচল করেছে।

এদিন দেশের কোথাও কোনো ধরনের সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি। তবে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সড়কের মোড়ে মোড়ে ছিল পুলিশের চেকপোস্ট। বিকেল ৫টার পর আবারও কারফিউ শুরু হলে সেনাবাহিনী সড়কের নিয়ন্ত্রণ নেয়।

রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, কারফিউ শিথিলের সময় আরো বাড়ছে। ২৮ জুলাই থেকে ৩০ জুলাই তিন দিন ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জে সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিলের ঘোষণা দেওয়া হয়। অফিসের কর্মঘণ্টাও ২৮ জুলাই থেকে ৩০ জুলাই সকাল ৯টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টা নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

সংঘর্ষে নতুন করে কারো মৃত্যু না হলেও আগে আহতদের মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এদিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে আরো একজনের মৃত্যু হয়।

এদিনও কোটা আন্দোলনের সময় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ভাঙচুর, সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মামলা ও গ্রেপ্তার কার্যক্রম চলমান ছিল। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) বলছে,  ২৭ জুলাই পর্যন্ত সব মিলিয়ে সারা দেশে গ্রেপ্তার সাত হাজার ছাড়িয়েছে।

এদিকে বিরোধীদের দমনে সরকার মধ্যযুগীয় নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের দায় নিয়ে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে।

অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিবের জাতীয় ঐক্যের আহ্বানের সমালোচনা করে বলেন, মির্জা ফখরুলের জাতীয় ঐক্যের আহবান হলো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার মূল্যবোধবিরোধী এবং দেশবিরোধী অপশক্তির ঐক্য!

এদিন সকালে ওবায়দুল কাদের বনানীতে ক্ষতিগ্রস্ত সেতু ভবন পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রো রেলের কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ স্টেশন আগামী এক বছরেও চালু করা সম্ভব হবে না।

এদিন কারফিউ প্রত্যাহার করা, ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের জোর করে তুলে নেওয়া বন্ধ করা, হত্যার দায় স্বীকার করে শেখ হাসিনাকে অবিলম্বে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করাসহ ছয় দফা দাবি জানিয়েছে বিএনপি সমর্থিত রাজনৈতিক দল ও জোট।

 

মন্তব্য

বেলুনের শব্দেও ভয় পেত উমায়ের

শিমুল মাহমুদ
শিমুল মাহমুদ
শেয়ার
বেলুনের শব্দেও ভয় পেত উমায়ের
উমায়ের নূর আসফিক

জন্ম থেকেই হৃদযন্ত্রে ছিদ্র ছিল উমায়েরের (১১)। তাই সাধারণ বেলুন ফাটার শব্দও সইতে পারত না সে। মা-বাবা কারো জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গেলে আগে দেখতেন সেখানে বেলুন আছে কি না। ছেলে ভয় পেতে পারে সে শঙ্কায় ঘরের বাইরে একা যেতে দিতেন না।

অথচ মৃত্যুর আগে শিশুটিকে শুনতে হলো বিমান বিধ্বস্তের বিকট শব্দ। এভাবে আগলে রাখা সন্তানের মৃত্যুতে শোকে বিহ্বল শিশুটির মা-বাবা।

উমায়ের নূর আসফিক ছিল রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। গত সোমবার স্কুল চলাকালে প্রতিষ্ঠানটির পাশে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি শ্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হলে আগুনে দগ্ধ হয়ে উমায়ের নিহত হয়।

উত্তরার দিয়াবাড়ীর তারারটেক মসজিদ এলাকার দ্বিতীয় তলার বাসায় বৃহস্পতিবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, সিঁড়িতে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে উমায়েরের প্রিয় সাইকেলটি। ভেতরে ছেলেকে হারানোর শোকে কাতর হয়ে বসে আছেন মা মাহমুদা খাতুন। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন আত্মীয়-স্বজনরা। কক্ষের এক পাশে রাখা পুড়ে যাওয়া শার্ট, প্যান্ট, জুতা আর স্কুলের আইডি কার্ড দেখিয়ে বিলাপ করছেন তিনি।

ছেলের পড়ার ঘরটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে খাতা, বই, কলম, প্রিয় খেলনার গাড়ি। টেবিলের পাশে ঝুলে থাকা ক্যালেন্ডারে হাতে লেখা রয়েছে—‘রোকেয়া মিস। মূল ঘরে পড়ে আছে ফুটবল আর ইলেকট্রিক স্কুটার।

উমায়েরের মা মাহমুদা খাতুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ওর জন্মের পর ১১ দিন এনআইসিইউতে ছিল। জন্ম থেকেই হার্টের সমস্যা ছিল।

শব্দ সহ্য করতে পারত না। ঘরের বাইরে একা কখনো যেত না। আমি বা ওর দাদি কিংবা ফুফু সব সময় সঙ্গে থাকতাম। আদর করে ওকে ডাকতাম আম্মু, নাম ধরে খুব কমই ডাকতাম।

তিনি বলেন, স্কুলে যাওয়ার আগের দিন দুপুরে ঘরে টেংরা মাছ রান্না হয়েছিল। উমায়ের মাছ পছন্দ করত না। তাই ওর জন্য ডিম ভেজে রেখেছিলাম। কোচিং থেকে ফিরে সেই ডিম-ভাত খেয়েছিল।

কথা বলতে বলতে পুড়ে যাওয়া ছেলের শার্টটি বুকে চেপে ধরে চুমু খান মাহমুদা খাতুন। পাশে থাকা স্বজনদের উদ্দেশে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ঘরে বসে মোবাইল দিয়ে ভিডিও বানাত। ১৯ জুলাই একটি ভিডিও বানিয়ে আমাকে দেখিয়ে বলল, আমি ভাইরাল হব আম্মু। হ্যাঁ, আমার সোনামণি ভাইরাল হয়েছে, কিন্তু মরার পর।

উমায়েরের বাবা ইমরান হোসেন কুতুবউদ্দিন বলেন, সকালবেলা ওর সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়। স্কুলে যাওয়ার আগে খিলখিল করে হাসছিল। জিজ্ঞেস করলাম, এত হাসছো কেন? বলল, বৃষ্টিতে বাপ্পি পিছলে পড়ে গিয়েছিল, সেটা মনে পড়েছে। এটাই ছিল আমার সঙ্গে শেষ কথা।

বিমান বিধ্বস্তের সময়কার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, শুনেই দৌড়ে স্কুলে যাই। গিয়ে দেখি, সেনাবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধারকাজ করছেন। কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছেন না। কিছুক্ষণ পর ছেলেকে বের করে আনেন। তখন দেখলাম, মুখটা পুড়ে গেছে, পেছনের অংশ ছিন্নভিন্ন। দুই কানে হাত দিয়ে বসে ছিল, হাত দুটিও পুড়েছে। সামনের অংশটা ঠিক ছিল। অনেকে বলেছে, শব্দের তীব্রতায় কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, উদ্ধারের পর প্রথমে লুবানা হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখান থেকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়। ইউনাইটেডে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।

উমায়েরের মা বলেন, ও গরম একদম সহ্য করতে পারত না। এ জন্য ওর বাবা বাসার সব কক্ষে এসি লাগিয়েছিল। ও বলত, স্কুলে অনেক গরম। অথচ সেই উমায়ের পুড়ে মরল আগুনে!

শিশুটির জন্মের পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার সময় আয়োজন করেছিল ওর পরিবার। মাহমুদা খাতুন বলেন, আমার মা বলেছিলেন, ১০১ জন মিসকিন খাওয়াতে। আমি বিয়ের অনুষ্ঠানের মতো করে আয়োজন করেছিলাম। বিয়েবাড়িতে যেমন সব রকম খাবার রান্না হয়, সেভাবেই।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি আরো বলেন, আমার সোনামণি বাইরে গেলে বারবার ফোন করত, আম্মু তুমি কি ভালো আছো? আমি ভাইরাল হবএই ছিল ওর স্বপ্ন। আজ ভাইরাল হয়েছে, কিন্তু নিথর শরীর নিয়ে।

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ