দেশ চালাতে সরকার এখন টাকার জন্য মরিয়া। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস টাকা চেয়েছেন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কাছে। টাকার অভাবে যখন বাজেট বাস্তবায়ন হচ্ছে না, তখন জানা গেল পরিবহন মাফিয়া খন্দকার এনায়েত উল্লাহই চাঁদাবাজি করে তুলেছেন প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। এই টাকায় কর্ণফুলী টানেলের মতো আরেকটি টানেল বানানো যেত।
এনায়েতের পেটে ১১ হাজার কোটি
সাইদ শাহীন ও সজিব ঘোষ

চাঁদাবাজির মাত্রা পর্যালোচনা করতে গিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের একটি ‘কেসস্টাডি’ বিশ্লেষণ করা হয়। তাতে দেখা যায়, ওই মহাসড়কেই প্রতিবছর পরিবহন খাতে চাঁদা তোলা হয় ৩৮ কোটি টাকা। চাঁদার ভাগ মাসিক হারে কাকে কত দেওয়া হতো তার একটি তালিকা কালের কণ্ঠ’র প্রতিবেদকদ্বয়ের হাতে এসেছে। পদাধিকার বলে চাঁদার ভাগ পেত সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী, শ্রমিক ও মালিক নেতা, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন এবং সরকারি অন্যান্য দপ্তরের কর্মকর্তাসহ ২১ জনের একটি চক্র।
শুধু একটি মহাসড়কই নয়, সারা দেশে এ রকম চাঁদাবাজির মচ্ছব জারি রেখেছিলেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। অভিযোগ এসেছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের আগস্টের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত খন্দকার এনায়েত উল্লাহ এই দুই সংগঠনের মহাসচিব ছিলেন। এই সময়ে পুরো দেশের পরিবহন খাতের চাঁদাবাজির প্রধান নিয়ন্ত্রকই ছিলেন তিনি।
খন্দকার এনায়েত উল্লাহ কিভাবে চাঁদা আদায় করতেন তার একটি বিবরণ দিয়েছেন দুই পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা।
করোনা মহামারির সময় সরকারি যান চলাচল সীমিত ছিল। ফলে ২০২০ সালের জুনে একটি গাড়ির জন্য সব স্তর মিলিয়ে ৬০ টাকা চাঁদা নির্ধারণ করা হয়। ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত মোট ১৫ হাজার গাড়ি থেকে ৬০ টাকা করে দৈনিক ৯ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। সে হিসাবে মোট এক হাজার ৪২১ দিনে ১২৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা চাঁদা ওঠে।
এ ছাড়া দেশের প্রতিটি জেলা মালিক সমিতির পক্ষ থেকে বাস, মিনিবাস, ট্রাক, ট্যাংকলড়ি, অটোটেম্পো হিউম্যান হলার (লেগুনা), সিএনজিচালিত অটোরিকশার চলাচলের জন্য প্রতি মাসে এনায়েত উল্লাহকে এক লাখ টাকা করে দেওয়া হতো। এই খাত থেকে দিনে ৬৪ লাখ টাকা চাঁদা তুলতেন এনায়েত উল্লাহ। ফলে মোট পাঁচ হাজার ৪৬২ দিনে চাঁদা নিয়েছেন তিন হাজার ৪৯৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে গত ১৬ বছরে ১০ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা চাঁদা তুলেছেন খন্দকার এনায়েত উল্লাহ।
বর্তমান ঢাকা মালিক সমিতির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও ট্রানসিলভা পরিবহনের চেয়ারম্যান সৈয়দ রেজাউল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ঢাকার পরিবহন খাতকে লুটে নিয়েছেন। হাজার হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি করে নিজের পকেট ভরেছেন। তাঁর চাঁদাবাজির অন্যতম দোসর খোকন, তপন, মহারাজ, মাহাবুব ও সেলিম নামের ব্যক্তিরা। তাঁরা পরিবহন কম্পানিগুলোকে জিম্মি করে চাঁদা আদায় করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি নিয়ে সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশও (টিআইবি) একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। সংগঠনটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস ও মিনিবাস থেকে বছরে এক হাজার ৫৯ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। আর এই চাঁদার ভাগ পায় দলীয় পরিচয়ধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারী, পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিক সংগঠন, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা। এ ছাড়া দেশের বৃহৎ বাস কম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশ মালিকই রাজনীতিবিদ। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই যখন যাঁরা ক্ষমতায় থাকে ওই সব দলের সমর্থনপুষ্ট। জানা যায়, চাঁদাবাজি না থাকলে যাত্রীদের ৬০ শতাংশ ভাড়া কমে যেত।
হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। এসব অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘চাঁদাবাজির এসব অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু কখনো এগুলো প্রমাণ করা যাবে না। কারণ আমি কোনো চাঁদাবাজি করিনি। সংগঠন যে চাঁদা নিত সেটা নিয়ম অনুযায়ী নিত। কোনো জেলা সমিতি বলতে পারবে না, আমি চাঁদাবাজি করেছি।’
প্রতি জেলা থেকে এক লাখ করে টাকা চাঁদা আসত—এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাস থেকে মাসে দিত এক হাজার আর ট্রাক থেকে দুই হাজার। তাও সেই টাকা আমাকে নয়, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিকে দেওয়া হতো। কাউন্সিলের সময় দেখা যেত বেশির ভাগই চাঁদার টাকা শোধ করেনি। উল্টো ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির আয় থেকে সারা দেশে সমিতির কার্যক্রম চালানো হতো।’
এ বিষয়ে পরিবহন শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ হানিফ খোকন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পরিবহন শিল্পের সব পক্ষ মিলে চাঁদা নিলেও তা শ্রমিকের কল্যাণে ব্যয় করা হয়নি। চাঁদা যেভাবেই তোলা হোক তার সবটুকুই গেছে মালিক সংগঠনের নেতাদের পকেটে। সেখানে মহাসচিব প্রভাব খাটিয়ে সব দখলে রেখেছিলেন। শ্রমিকদের নিয়োগপত্র দিতে সরকারের আইন থাকলেও তা মানা হয়নি। শ্রমিকদের ঠকিয়ে মালিকরা হাজার কোটি টাকা বানিয়েছেন।’
বর্তমান সরকারের কাছে তিনি দাবি করে বলেন, ‘মালিকদের অবৈধ চাঁদার হাত থেকে শ্রমিক ও যাত্রীদের রক্ষা করতে হবে। যদি শ্রমিকদের কল্যাণে চাঁদা তোলা হয়, সেটি শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করা হোক।’
পরিবহন খাতের প্রভাবশালী এই মালিক নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহর উত্থান হয় ১৯৯১ সালে। তখন রাজধানীর মিরপুরে তিনি বাসের ব্যবসা করতেন। নিজের বাসে নিজেই শ্রমিকও ছিলেন। তারপর ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ পথে এনা পরিবহন নামে বাসের চলাচল শুরু করার পর তাঁর ভাগ্য খুলে যায়। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি শুরু করা এনা পরিবহন ঢাকার মহাখালী থেকে ময়মনসিংহের পথে একমাত্র পরিবহনে পরিণত হয়। অন্য কোনো পরিবহনকে এখানে তিনি দাঁড়াতে দেননি। ২০ থেকে ২৫টি বাস দিয়ে শুরু হওয়া এনায় এখন ৪০০ বাসের বহর। যদিও এখন এই পথে এনা পরিবহন খুব একটা দেখা যায় না। মহাখালী টার্মিনালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০ শতাংশের মতো এনা পরিবহনের বাস সড়কে চলছে। বাকি বাস নাম পরিবর্তন করে অন্য প্রতিষ্ঠানের অধীনে চলার চেষ্টা করছে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তাঁর ব্যবসা বড় হতে শুরু করে। তবে ১/১১-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় দেশ ছেড়ে ভারত চলে যান তিনি। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে আবারও দেশে ফিরে পরিবহন সমিতির নেতৃত্বে বসেন। সেখান থেকে শুধু সামনেই এগিয়ে গেছেন খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্যতা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে তিনি নৌকার টিকিট নিয়ে সংসদে পর্যন্ত যেতে চেয়েছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ঢাকা-৫ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন আশা করে দলীয় আবেদনপত্র সংগ্রহ করেন। কিন্তু তখন তাঁকে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গা। তিনি জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব ছিলেন। তবে পরিবহন খাতে এই চাঁদাবাজিতে সভাপতির দায় কতটুকু এমন প্রশ্নও উঠেছে। কিন্তু তিনি কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
সম্পর্কিত খবর

ঘরে ঘরে জ্বর, আতঙ্ক ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া নিয়ে
নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর পশ্চিম আগারগাঁওয়ের বাসিন্দা ফারুক আহমেদ টানা তিন দিন ধরে জ্বরে ভুগছেন। ফার্মেসির ওষুধে জ্বর না কমায় তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। ফারুক জানান, প্রথমে তিনি জ্বরে আক্রান্ত হন, পরে তাঁর স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তানও জ্বরে ভুগতে শুরু করে।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে হাসপাতালের বহির্বিভাগে কথা হয় ফারুক আহমেদের সঙ্গে।
চিকিৎসকরা বলছেন, আবহাওয়ার পরিবর্তন ও বাতাসে আর্দ্রতার ওঠানামার কারণে ভাইরাসজনিত জ্বর বাড়ছে। শিশুসহ সব বয়সী মানুষ এতে আক্রান্ত হচ্ছে। ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল এবং চিকিৎসকের চেম্বারে জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।
সোমবার ও মঙ্গলবার রাজধানীর ডিএনসিসি হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে দেখা গেছে, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক বেশি শিশু এখন জ্বর নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসছে।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘একসঙ্গে বিভিন্ন ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। সাধারণ ভাইরাল জ্বরের পাশাপাশি ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও রোটা ভাইরাসও বাড়ছে।
রাজধানীর শিশু হাসপাতালে জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি বলে জানান হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. এ বি এম মাহফুজ হাসান আল মামুন। তিনি বলেন, ‘এখন ভাইরাল জ্বরের মৌসুম চলছে। পাশাপাশি চলছে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মৌসুমও। বেশির ভাগ রোগী তীব্র জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, চোখ লাল হওয়া, চোখ দিয়ে পানি পড়া, শরীরে র্যাশ—এসব উপসর্গ নিয়ে আসছে। অনেকের ডেঙ্গুর উপসর্গ থাকলেও পরীক্ষায় ধরা পড়ছে না।’
জ্বর কেন হয়?
চিকিৎসকরা বলছেন, জ্বর নিজে কোনো রোগ নয়, এটি একটি উপসর্গ বা সতর্কবার্তা। সাধারণ ঠাণ্ডা বা সর্দিকাশির পাশাপাশি ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণে জ্বর হতে পারে। করোনাভাইরাস, ডেঙ্গু, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া—এসব রোগের প্রাথমিক লক্ষণ জ্বর। টিকা নেওয়া, টিউমার, ফোড়া, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, প্রস্রাবের সংক্রমণ, পিরিয়ড বা মানসিক চাপ থেকেও জ্বর হতে পারে।
ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘বাইরের প্রচণ্ড গরম থেকে ফিরে অনেকেই এসির নিচে চলে যায় বা ঠাণ্ডা পানি পান করে। এই গরম-ঠাণ্ডার তারতম্য থেকেই জ্বর-সর্দি হতে পারে। প্রতিটি পরিবারেই এখন মৌসুমি জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। এ ছাড়া বন্যাকবলিত এলাকায় টাইফয়েড ও পানিবাহিত রোগও বেড়েছে।’
ডা. লেলিন আরো বলেন, ‘এসব জ্বর সাধারণত প্যারাসিটামল খেলেই সেরে যায়। অ্যান্টিবায়োটিকের দরকার পড়ে না। তবে জ্বর যদি সপ্তাহখানেকের বেশি স্থায়ী হয়, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।’
সাধারণ জ্বর কিভাবে বুঝব?
বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. ফজলে রাব্বি চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগে কভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে জ্বরের সঙ্গে কাশি, গন্ধ না পাওয়া, শ্বাসকষ্ট দেখা যেত। এখন অনেক কভিড রোগীও গায়ে ব্যথা ও মাথাব্যথার উপসর্গ নিয়ে আসছে। তাই পরীক্ষা ছাড়া রোগ নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।’
ডা. ফজলে রাব্বি আরো বলেন, ‘ডেঙ্গুতে সাধারণত মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, পেট ব্যথা ও পাতলা পায়খানা হয়। অন্যদিকে চিকুনগুনিয়ায় গায়ে বেশি ব্যথা, বিশেষ করে জয়েন্টে ব্যথা ও দ্রুত র্যাশ দেখা দেয়। সাধারণ ভাইরাল জ্বরে হালকা গায়ে ব্যথা ও সর্দিকাশি হয় এবং তা চার দিনের মধ্যে সেরে যায়। চার দিনের বেশি জ্বর থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’

জুলাই ফাউন্ডেশনের অফিসে ভাঙচুর
নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর শাহবাগে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের কয়েকজন গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর বারডেম হাসপাতালের পাশের ওই কার্যালয়ের কক্ষে ভাঙচুর চালান।
সূত্র জানায়, হামলার শুরুতে তাঁরা প্রথমে ওই কার্যালয়ে তালা লাগান। পরে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের কর্মচারীদের সঙ্গে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে সেখানে ভাঙচুর করা হয়।
তবে রাতে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামাল আকবর জানান, টাকা না পেয়ে আহতরা ক্ষুব্ধ হয়ে অফিসে তালা লাগিয়ে দেন।
ফাউন্ডেশনের একজন কর্মচারী খারাপ আচরণ করলে সেখানে ভাঙচুর করা হয় বলে আহতদের কয়েকজন জানিয়েছেন।
ভাঙচুরের পর ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, অনেক চেয়ার এলোমেলো পড়ে আছে। পানির ফিল্টার ও তিনটি দরজার গ্লাস ভেঙে ফেলা হয়েছে। মেঝেতে কাচের টুকরা ছড়িয়েছিটিয়ে আছে।
গত বছর আন্দোলনে গিয়ে আহত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত চিকিৎসাধীন জানিয়ে মামুন হোসেন নামের একজন বলেন, ‘আমার মাথার ভেতরে গুলি, ১১ মাস যাবৎ চিকিৎসাধীন। আমাদের জীবনের নিশ্চয়তা কী? তো কিসের জুলাই ফাউন্ডেশন?’
সাভার সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আহত নাজমুল হোসেন বলেন, ‘দ্বিতীয় ধাপের টাকার জন্য সাত মাস ধরে ঘুরছি। টাকা দেওয়া হচ্ছে না। জুলাই ফাউন্ডেশনের সিইও বারবার ডেট দিয়ে আমাদের টাকা দিচ্ছেন না।’
জানতে চাইলে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামাল আকবর বলেন, ‘জুলাই আহতদের অনেকে এখনো মানসিক ট্রমার মধ্যে আছেন।
এই ফাউন্ডেশনে সাত কোটি টাকা আছে জানিয়ে কামাল আকবর বলেন, ‘ধারাবাহিকভাবে আহত ও শহীদ পরিবারগুলোকে অনুদান দেওয়ার চেষ্টা করছি।’ তা ছাড়া আহতদের তালিকা থেকে ৩৯ জন ভুয়া আহতকে বাদ দিতে এবং শহীদদের তালিকা থেকে চারজনের নাম বাদ দিতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার
নির্বাচনের তারিখ আমি নিজেই জানি না
নিজস্ব প্রতিবেদক

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে তা প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন এখনো জানেন না। গতকাল মঙ্গলবার সকালে কানাডার হাইকমিশনার অজিত সিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে এ কথা জানিয়েছেন তিনি। পরে বিকেলে রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ডেমোক্রেসি (আরএফডি) আয়োজিত ফল উৎসব ও সাংবাদিক অ্যাকসেস কার্ড প্রদান অনুষ্ঠানেও তিনি একই কথা বলেন।
এ ছাড়া সিইসি সাংবাদিকদের জানান, আগামী নির্বাচনে ভোটের প্রচারে এআইয়ের অপব্যবহার রোধ করতে চায় নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন ভবনে কানাডার হাইকমিশনারের সঙ্গে প্রায় দেড় ঘণ্টার সাক্ষাৎ শেষে সিইসি সাংবাদিকদের বলেন, ‘মিসইউজ অব এআই আমাদের জন্যও হুমকি। এ বিষয়ে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে কানাডা।
এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘এ পর্যন্ত আমাদের বিভিন্ন সেক্টরে যে প্রস্তুতি নিয়েছি, আগামী নির্বাচনে আমরা ঠিকমতো ডেলিভার করতে পারব কি না সে বিষয়গুলো জানতে চেয়েছেন তাঁরা। আমাদের প্রস্তুতির বিষয়টা বিস্তারিত জানিয়েছি। বিশেষ করে দেশজুড়ে ভোটার সচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু করতে যাওয়ার বিষয়টি জানিয়েছি। ভোটার সচেতনতা ক্যাম্পেইনের পাশাপাশি ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, পর্যবেক্ষকদের প্রশিক্ষণ, এজেন্টদের প্রশিক্ষণসহ সার্বিক কাজে কানাডা পাশে থাকবে বলে জানিয়েছে।
সিইসি বলেন, ‘কানাডা আমাদের সহায়তার জন্য প্রস্তুত এবং আমাদের আলোচনা অব্যাহত থাকবে। তারা চায় যে ফ্রি, ফেয়ার, ক্রেডিবল ইলেকশন যেন হয়। আমাদের ভোটার নিবন্ধনে নারীদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছে, পার্বত্য এলাকায় ভোটার সচেতনতামূলক কাজের বিষয়ে জানতে চেয়েছে। আমাদের প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছি।’
নির্বাচন কবে বা ভোটের সম্ভাব্য সময়সীমা বিষয়ে কানাডার হাইকমিশনার জানতে চেয়েছেন কি না—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে সিইসি বলেন, “উনি জানতে চেয়েছেন ভোটের স্পেসিফিক ডেট হয়েছে কি না। আমি বলেছি ‘নো’। সময়সীমা নিয়ে কোনো আলাপ হয়নি। সময়সীমা সম্পর্কে আপনারা যা জানেন, আমিও তাই জানি। যেদিন ভোট হবে, তার দুই মাস আগে আমি জানিয়ে দেব।”
নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের আসার বিষয়ে জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘এরই মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অবজারভার হিসেবে কাজ করার জন্য জিজ্ঞেস করেছি। নীতিমালাও প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছি। ইইউকে বলা হয়েছে, আগেই যেন জানিয়ে রাখা হয়। তাদের ২৮টি দেশের অবজারভারকে সমন্বয় করে পাঠাতে হবে, এ জন্য আগেভাগে স্বাগত জানিয়েছি।’
পক্ষপাতদুষ্ট বিদেশি পর্যবেক্ষকদের অনুমোদন দেওয়া হবে না বলেও জানান সিইসি। তিনি বলেন, ‘গত তিনটি নির্বাচনকে যাঁরা সার্টিফিকেট দিয়েছেন তাঁদের (অনুমোদন) দেব কেন? যেসব পর্যবেক্ষক গত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন খুব সুন্দর হয়েছে বলে সার্টিফিকেট দিয়েছেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে বলেছেন, তাঁদের কি আমাদের নেওয়া উচিত? আমরা দেখে-শুনেই নেব। যাঁরা অভিজ্ঞ, ডিপেন্ডেবল, রিলায়েবল এবং বিভিন্ন দেশে নির্বাচন অবজার্ভ করেছেন, তাঁদের নেব। তিনটি নির্বাচনকে যাঁরা সার্টিফিকেট দিয়েছেন, তাঁদের কোনোমতেই নেওয়া হবে না।’
বিকেলে আরএফইডির অনুষ্ঠানে সিইসি বলেন, ‘আমরা বারবার প্রমাণ করেছি; ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ সালে সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পেরেছিলাম। এবারও পারব ইনশাআল্লাহ। আমাদের প্রশাসন, পুলিশ ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে বলব, মানুষের শ্রদ্ধা পুনরুদ্ধারের এটিই সময়। ভাবমূর্তি রক্ষা ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ এখন এসেছে।’
সিইসি বলেন, ‘ভোটের নির্দিষ্ট তারিখ এখনো নির্ধারিত হয়নি। তবে কমপক্ষে দুই মাস আগেই সব কিছু জানিয়ে দেওয়া হবে, কোন দিন ভোট, কোন দিন মনোনয়ন—এসবসহ।
গণমাধ্যমের ভূমিকার প্রশংসা করে সিইসি বলেন, ‘আমরা আজকে যা কিছু করছি, তা আপনাদের মাধ্যমেই দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। কানাডার হাইকমিশনারের সঙ্গে আজকে আলাপের সময় দেখি উনি (কানাডার হাইকমিশনার) সব জানেন—ভোটার রেজিস্ট্রেশন, ইউএনডিপির সহযোগিতা, ক্যামেরা, ল্যাপটপ সব কিছু। তার মানে আমাদের সংবাদগুলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে। এ জন্য আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।’
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘সংবাদ পরিবেশনের সময় একটু সচেতন থাকবেন। দেখেছি অনেক সময় ভেতরে পজিটিভ রিপোর্ট থাকলেও হেডলাইন বা স্ক্রলে নেগেটিভ বার্তা থাকে। এতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়, মন খারাপ হয়। দয়া করে শিরোনাম, ক্যাপশন এমন দিন, যাতে মানুষ পজিটিভ বার্তা বুঝতে পারে।’
তিনি বলেন, “সাংবাদিকদের দাবি বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন কমিশন সাংবাদিকদের সরাসরি অংশগ্রহণে বিভিন্ন ‘ওয়্যারনেস রেইজিং ক্যাম্পেইন’ চালু করবে। আমরা সাংবাদিকদের পার্টনার করে কাজ করতে চাই। সচেতনতামূলক প্রচারে আপনাদের যুক্ত করব। ২০১৮ সালের মতো অভিযোগ আর যেন না ওঠে। প্রশাসন, পুলিশ, প্রিজাইডিং অফিসার, সব কর্মকর্তাকে বলব, এটা ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের সময়।” আরএফইডির সভাপতি কাজী এমাদ উদ্দীনের (জেবেল) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী।

মিডিয়াকে হুমকি
ক্র্যাব, অনলাইন এডিটরস অ্যালায়েন্সের উদ্বেগ
নিজস্ব প্রতিবেদক

জুলাই আন্দোলনের এক নেতা কর্তৃক মিডিয়াকে হুমকি দেওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্র্যাব) ও অনলাইন এডিটরস অ্যালায়েন্স।
অনলাইন এডিটরস অ্যালায়েন্সের সভাপতি হাসান শরীফ ও সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সোহেল গতকাল মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। গণমাধ্যমের কোনো প্রতিবেদনে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে তার প্রতিকার পাওয়ার জন্য দেশে প্রেস কাউন্সিল ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার সুযোগ রয়েছে। হুমকি বা ভয়ভীতি প্রদর্শন করে স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিসর সংকুচিত করা যাবে না।
অনলাইন এডিটরস অ্যালায়েন্সের বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মুক্ত মত প্রকাশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হুমকি কিংবা ভয় দেখানোর চেষ্টা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংবিধান প্রদত্ত অধিকার লঙ্ঘনের শামিল, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
এর আগে গত সোমবার ক্র্যাব কার্যনির্বাহী কমিটির পক্ষ থেকে সভাপতি মির্জা মেহেদী তমাল এবং সাধারণ সম্পাদক এম এম বাদশাহ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘মিডিয়াকে হুমকি দেওয়ার ঘটনা জুলাইয়ের চেতনার সঙ্গে মানানসই নয়। যেসব কারণে জুলাইয়ের রক্তক্ষয়ী ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল, তার অন্যতম ছিল মত প্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ।
বিবৃতিতে ক্র্যাব নেতারা বলেন, ‘মিডিয়ার ভূমিকায় কেউ সংক্ষুব্ধ হলে তার প্রতিকারের জন্য প্রেস কাউন্সিল রয়েছে। প্রচলিত আইনের বিধি অনুযায়ী আদালতেও যাওয়া যায়। কিন্তু এই হুমকি দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশের প্রতিবন্ধক বলে আমরা মনে করি।